তবলা সারেঙ্গি মৃদঙ্গ। সুরের ধারার সঙ্গে দ্রুত সঞ্চরণ। ছন্দ তাল ভাব। মুদ্রা। আঙ্গিক, বাচিক, মানসিক। বিমূর্ত, দ্রুত এবং ছন্দময়। গতি, রূপ, পরিসর এবং প্যাটার্নের সৌন্দর্য। হিপ-হপ, স্ট্রিট জ্যাজ়, সালসা নয়। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী। মোহিনী আট্টম। পশ্চিমী নাচের অনুকরণ করতে করতে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ভারতের নিজস্ব নাচের দুরন্ত ঐতিহ্য! সন্তানকে নাচ শেখাতে আগ্রহী বাবা-মা আর শাস্ত্রীয় নৃত্য নয়, বরং চটকদার নৃত্য-কৌশলের দিকেই ঝুঁকছেন। বড় একটা ভূমিকা পালন করছে টেলিভিশনের নাচের রিয়ালিটি শো।
রুমঝুম পাদম্বরম। ছন্দে ছন্দে দুই পায়ে মেঝেতে অদৃশ্য আল্পনা এঁকে চলেছে রুমনি। তালমের বোল আর পায়ের ছন্দে নিটোল একটি হারমোনি। মঞ্চের ওপর ভোরের প্রথম আলোর মতো সাদা আলো। শ্বেতবসনা রুমনি, ঠিক যেন একটি শ্বেতকরবী। চুড়ো করে চুল মাথার বাঁদিকে, রূপোর নেটিচুটি খোঁপার চারপাশে। তার নীচে সাদা মল্লিকা জড়ানো লম্বা বেণী। কানে বড় রূপোলি ঝুমকো। নাকে হিরের নাকছাবি, আলো পড়ে চিকচিক করে উঠছে। গলায় মুক্তোর মালা। পরনে সাদা পুভাবা। সোনালি জরির পাড়। নূপুর, হাতে পায়ে আলতা, সারা শরীরে থেকে সোনালী আভা।
আহা! স্বর্গের অপ্সরী বুঝি!
মঞ্চের পেছনে কণ্ঠশিল্পী যন্ত্রশিল্পীরা অর্ধবৃত্তাকারে বসে আছে। বীণা, বাঁশি, টাপ্পু মাদ্দলম, মৃদঙ্গ, এডাক্কি। শুরু হয়েছে স্বরযতি। সরগম সাধছে বাসুদেব। গানের সুরে আকাশ থেকে জ্যোত্স্না নেমে এল মঞ্চ জুড়ে। অর্ধমণ্ডলম মুদ্রায়, অর্ধ উপবেশনের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়ল রুমনি।
আনমনেই একবার চোখ পড়ল গানের দলের দিকে। স্থির চেয়ে আছে বাসুদেব। রোজকার মতো। আর রোজকার মতোই সারা শরীর জুড়ে শিরশিরে একটা অনুভুতি উঠে এলো। কেন যে হয় এমন! কেন যে মনে হয় এই চোখ, এই দৃষ্টি বড্ড চেনা। ঠিক এমনভাবেই যেন নাচের ছন্দে ছন্দে ভেসে বেড়ানো হয়েছে আগেও। ঠিক এমনভাবেই যেন তখনও চেয়ে থাকত বাসুদেব।
কিন্তু তা কী করে হবে? কেরালা এই প্রথম আসা। ধ্রুপদী নৃত্যের এই প্রেস্টিজিয়াস সর্বভারতীয় বিশেষ অনুষ্ঠানে নৃত্য-পরিবেশনা এই প্রথম। নৃত্যগুরু রজনী আম্মা বৈশালীদির গুরু। মানে রুমনির গুরুর গুরু। মহাগুরু যাকে বলে। গানের দল তাঁরই। আজ বৈশালীদিও বসেছে ওই গানের দলেই। রুমনির আজকের নাচ বৈশালীদিরও পরীক্ষা। এর আগে তিনটে ছোট ছোট অনুষ্ঠান হয়েছে, একক নৃত্য আজ প্রথম। আজকের নাচ স্থির করে দেবে মোহিনী আট্টমে এক নতুন নক্ষত্রের জন্ম হল কিনা। বৈশালীদির অনেক আশা রুমনির ওপর। অথচ কেন যে বারবার আনমনা হয়ে পড়ছে রুমনি!
আসার পর রজনী আম্মা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে। সেদিন ছেলেটাকে দেখে আলাদা করে কিছু মনে হয়নি। প্রথম অনুষ্ঠানের দিন চোখে পড়েছিল। প্রথমদিন শুধু “গণপতি স্তুতি”, আর “মুখাচলম”। কেরালার রাগসঙ্গীতের সঙ্গে মোহিনী আট্টমের নান্দনিক নৃত্যশৈলীর পরিবেশন। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে মঞ্চে উপস্থিতি। সেদিনই এই ব্যাপারটা ঘটল। সেদিনও গাইছিল বাসুদেব, চোখ একভাবে রুমনির দিকে। কী একটা অস্বস্তি।
এমনটা আগেও হয়েছে। রাস্তা দিয়ে আপনমনে হাঁটার সময় হঠাত্ একটা বাড়ি, মানুষজন দেখে মনে হল আগেও দেখেছে। অথচ সত্যিই আগে এ রাস্তায় আসা হয়নি। বাবা বলেছিল, এমন অনেকের সঙ্গেই হয়। এই প্রতিক্রিয়ার একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে। ‘দেজা ভ্যু’। শব্দটা মূলত ফরাসি। বাংলায় যার অর্থ– ইতিপূর্বে দেখা। এর অন্য নাম হল পারামনেশিয়া, গ্রিক শব্দ ‘প্রমনেসিয়’, যার বাংলা অর্থ – স্মৃতি। এ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা। অনেকরকম গবেষণা চলছে। কে জানে কী। তবে মাঝে মাঝে রুমনির মনে হয়, এ কোনও মানসিক সমস্যা নয় তো! কিন্তু এমনিতে তো আর কোনও বৈকল্য নেই। শুধু এই মাঝে মাঝে হঠাত্ স্মৃতি ভেসে আসা। বন্ধুরা বলে, সবার নাকি এমন হয়। কে জানে ব্যাপারটা আদতে কী।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন ছিল “পদ্ম”। মহাগুরু রজনী আম্মার কোরিওগ্রাফি। মঞ্চে একসঙ্গে সাতটি মেয়ে। রজনী আম্মার নাচের এই দলে জায়গা পাওয়া এক অমূল্য প্রাপ্তি। এই ‘পদ্ম’ নৃত্যে মোহিনী আট্টমের অভিনয়ের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এক রাজকন্যা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে, কিন্তু সেটি সখিদের কাছে ব্যাখ্যা করতে লজ্জা পাচ্ছে। রাজকন্যা তার স্বপ্নে দেখা সুপুরুষকে নিয়ে নানা কল্পনা করছে। সখিদের কাছে স্বপ্নের নানা খুঁটিনাটি বর্ণনা করছে। কোথায় গেলে পাব সেই স্বপ্নের পুরুষকে! হঠাত্ একসময় রাজকন্যা বুঝতে পারে যে, স্বপ্নে দেখা সেই সুপুরুষ আর কেউ নয়, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। প্রেম থেকে সমর্পণ, অভিনয়ের অনেক দিক এ নৃত্যে। নাচতে নাচতে লয় বাড়ছে, আবার কমছে। মন দিয়ে নাচছিল রুমনি। হঠাত্ তাল কাটতে কাটতে সামলে নিতে হল। সেই দৃষ্টি। একভাবে চেয়ে আছে রুমনির দিকে। পরিচিত, অথচ বহুযুগের ওপারের স্মৃতি যেন। একবার ভেবেছে বৈশালীদিকে বলার কথা। কিন্তু কী বলবে? গান গাইবার সময় যন্ত্রশিল্পীদের গোটা দলটা নাচিয়ের দিকে চেয়ে থাকে। সেটাই নিয়ম।
তারপর আজ। প্রথম নৃত্য ছিল “মায়িলকুটু”। বৃষ্টির জন্য অধীর অপেক্ষা ময়ূরের, বৃষ্টি, এবং আনন্দিত ময়ুরের উল্লসিত ময়ূর নাচ। ময়ূর-নৃত্যটি রূপক। এ আসলে মুক্তির জন্যে প্রাণের আকুতির নাচ। তারপর “অষ্টাপদী”। বৈশালীদির নিজস্ব কোরিওগ্রাফি। দ্বাদশ শতাব্দীর লেখক জয়দেবের গীত-গোবিন্দ থেকে উদ্ধৃত কিছু অংশ নাচের মাধ্যমে পরিবেশন। কৃষ্ণ, গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলাখেলা, রাধার তা দেখে রাগ। অভিমান। একইসঙ্গে বসন্ত এবং বসন্তের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। সব মিলিয়ে ভারী সুন্দর।
কেরালা এই প্রথম আসা। ধ্রুপদী নৃত্যের এই প্রেস্টিজিয়াস সর্বভারতীয় বিশেষ অনুষ্ঠানে নৃত্য-পরিবেশনা এই প্রথম। নৃত্যগুরু রজনী আম্মা বৈশালীদির গুরু। মানে রুমনির গুরুর গুরু। মহাগুরু যাকে বলে। গানের দল তাঁরই। আজ বৈশালীদিও বসেছে ওই গানের দলেই। রুমনির আজকের নাচ বৈশালীদিরও পরীক্ষা। এর আগে তিনটে ছোট ছোট অনুষ্ঠান হয়েছে, একক নৃত্য আজ প্রথম।
বর্ণম শুরু হয়েছে। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় শ্রীরাধা। চোখেমুখে প্রিয় মিলনের উত্কন্ঠা।
‘আলেই পাযুদে কন্না
এন মনম আলেই পাযুদে
উন আনন্দ মোহন বেদধু মদ্দিল…’
বাসুদেব গাইছে। রাগ নীলাম্বরী। করুণ মচ্ছন। সমস্ত দেহের কম্পনে, শরীরী বিভঙ্গে ফুটিয়ে তোলা। হে বেণুধর, আমার মনে ঢেউ উঠেছে। সেই তরঙ্গে আমি ভেসে চলেছি। বাসুদেবের দিকে চোখ না পড়ে, সমস্ত মনপ্রাণ এক করে নাচছে রুমনি।
নাচ শেষ হল। মঞ্চ ঢেকে আস্তে আস্তে নেমে আসছে পর্দা। হল জুড়ে প্রবল করতালি। বহু দর্শক চঞ্চল পায়ে গ্রিনরুমের দিকে ছুটে আসছেন। নবীন নক্ষত্রকে বরণ করে নিয়েছেন তাঁরা। বৈশালীদি উঠে দাঁড়িয়েছেন। চোখে জল, মুখে হাসি। বুকের মধ্যে হঠাত্ কাঁপন। ঠিক এইরকম দৃশ্য যেন আগেও একবার…. কবে? কোথায়? কেন কিছু মনে পড়ে না? পায়ে পায়ে উইংসের দিকে। দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গুরু। মাথা নিচু করে প্রণাম করল রুমনি। উঠে দাঁড়াতেই সারা শরীরে শিহরণ। বৈশালীদির ঠিক পেছনে কে ও? বাসুদেব? ওর হাতে কি ওটা? সেই আসিড ছোঁড়ার বাল্বটা না? ‘ও মা গো! বাঁচাও!’ দু’হাতে মুখ ঢেকে চিত্কার করে উঠেছে রুমনি। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
আরও পড়ুন: ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: কিস্তি
‘কী হয়েছিল রুমনি?’ বৈশালীদির দু’চোখে ভয়, ‘একঘণ্টার বেশি অজ্ঞান হয়েছিলে তুমি।’
কথা বলতে পারছে না রুমনি।
‘আয়না, একটা আয়না।’ অনেক কষ্টে বলল।
‘আয়না? আয়না কী হবে?’
গ্রিনরুম থেকে আয়না নিয়ে এল একজন। আকুল হয়ে মুখ দেখছে রুমনি। এই তো, সব ঠিক আছে। আসিড লাগেনি মুখে। পুড়ে যায়নি মুখ, গলা, শরীর।
‘কী হয়েছে শতরূপা? আয়না নিয়ে অমন করছ কেন?’
রজনী আম্মার গলায়, চোখে উত্কণ্ঠা।
‘ডক্টর বলছেন ইউ আর অলরাইট । হঠাত্ অজ্ঞান হয়ে গেলে কেন? অমন করে মুখে কী দেখছ?’
‘আমাকে দেখে অত ভয় পেয়েছিলে কেন শতরূপা?’
বাসুদেব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা শঙ্খ।
‘তোমাকে দেব বলে নিয়ে এসেছিলাম। পদ্মনাভ মন্দিরের প্রসাদ আর পবিত্র শঙ্খ। তুমি আজ এই শঙ্খের অধিকারী হয়েছ। এ আমাদের গুরুজির নিয়ম।’
আশীর্বাদ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেদিন ঠিক উল্টোটা হয়েছিল। নাচের শেষে গ্রিনরুমের দিকে এগিয়েছিল মেয়েটা। আর ছেলেটা উইংসের ধারে দাঁড়িয়েছিল হাতে সাদা বাল্ব নিয়ে। দিনের পর দিন পিছু নিত, রিহার্সাল-রুমে এসে বসে থাকত। নাচের অনুষ্ঠান হলেই গ্রিনরুমে ঢুকে আসত। পরিষ্কার করে বলেছিল মেয়েটা, আগ্রহ নেই। ছেলেটা বলেছিল, রূপের অহঙ্কার। তাই কুরূপা করে দিতে চেয়েছিল। কবে হয়েছিল এমন? কোন জন্মে? সত্যি সত্যি হয়েছিল এমন? বৈশালীদি বললেন, একঘণ্টা অজ্ঞান ছিল রুমনি। কোথায় ঘুরে এল এই এক ঘণ্টায়? স্পষ্ট দেখল একটা মর্মান্তিক দৃশ্য। নাচ, উইংস, আর হাতে সাদা বাল্ব নিয়ে একটা ছেলে। দৃষ্টিটা খুব চেনা।
একঘণ্টায় এতখানি ভ্রমণ সম্ভব? কোথায় কোথায় ঘুরে এল এই একঘণ্টায়? এ কি স্বপ্ন? নাকি জন্মান্তরের স্মৃতি? নাকি একেই বলে দেজা ভ্যু?
আইভি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৩ সালে ইস্পাতনগরী জামশেদপুরে। সে শহরের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। ব্যাংকে চাকরি করেছেন। নেশা বই পড়া। সর্বভূক পাঠক। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখির জগতে রয়েছেন। বিভিন্ন নামী পত্রপত্রিকা ও ওয়েবজিনে তাঁর গদ্য প্রকাশিত হয়। বইয়ের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত বারো।