কাউন্টারের সামনে ভাল ভিড়। পাড়ার মুদির দোকান। রাত সাড়ে আটটা। খদ্দেররা সবাই পুরুষ।
ভিড়ের পেছনে রাস্তা। সেখান থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল,
–আঙ্কেল, দুটো গোল্ড ফ্লেক দাও না।

পুরুষদের ভেতর যারা দ্বিতীয় সারিতে তাদের কারও কারও ঘাড় একশ পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি ঘুরে গেল। তারা দেখতে পেলেন হাফ প্যান্টের বাইরে নব্বুই শতাংশ মখমলি উরুদেশ। ক্ষীণ কটি আর স্কিন টাইট গেঞ্জির মাঝখানে সোয়া ইঞ্চি জায়গা বেলিবাটন সমেত উন্মুক্ত। মাথার ওপর তোলা চশমা। হাতে চওড়া স্ক্রিনের বাহারি মোবাইল এবং কানে, যথারীতি, হেডফোন, যার শেষ প্রান্তটি অদৃশ্য হয়ে গেছে মৃদু দৃশ্যমান গভীর ক্লিভেজের ভেতর।

অঙ্কটা যেটুকু মিলতে বাকি ছিল মিলিয়ে দিল ওই গোল্ডফ্লেক। তার মানে এটি একটি উচ্ছন্নে যাওয়া ডেঁপো মেয়ে। যে কিনা নিশ্চয়ই যাদবপুরে পড়ে। বাঘাযতীনে পিজি নেয় এবং একাধিক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে।শুধু তাই নয় এরা ডাইনি গোত্রের।এরা একাধিক ছেলেকে চুষে চুষে খায় এবং খাওয়া শেষ হলে ছিবড়েটুকু ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটের মতই, দু–আঙুলের টুসকিতে রাস্তার পাশের ম্যানহোলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ইতিমধ্যে দোকান মালিক আপদ বিদায়ের ভঙ্গিতে বাকিদের দাঁড় করিয়ে রেখে প্যাকেট নামিয়ে দুটি সিগারেট বাড়িয়ে ধরেছেন। কিন্তু মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে, রাস্তার ওপর, সেই অবধি দোকানদারের হাত পৌঁছন অসম্ভব। দুসারি পুরুষালী ব্যারিকেড রয়েছে মাঝখানে। প্রথম সারিতে যারা দাঁড়িয়ে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তারা প্রকট ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, আমরা আগে এসে দাঁড়িয়েছি। এবং আমরা ঘরোয়া মানুষজন। চাল ডাল তেলের খদ্দের। সিগারেট নয়, কনডম নয়, জাপানি তেলও নয়। এসেছি কিনতে পাতি সংসার।
আর এই মেয়ে এসেছে পরে। পোশাকের তো ওই ছিরি। তার ওপর চাইছে সিগারেট!
আমরা, ছেলেরা, আজও ফার্মেসি থেকে ন্যাপকিনটুকুও খোলা হাতে নিই না। প্রথমে দু ফেরতা খবরের কাগজ, তারপর মিশকালো পলিথিনে মুড়িয়ে নিয়েই ব্যাগে পুরে ফেলি। আর এই গা–খোলা ঢলানিকে কি না আগে ছেড়ে দিতে হবে? নেভার।
সামনের সারির একজন হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
–বাসুদা, আমাকে আগে ছেড়ে দাও। তারপর ওইসব ফালতু কাস্টমার সামলিও।
মেয়েটি ইতিমধ্যে কান থেকে ঠুসো জোড়ার একটি নামিয়ে ঘাড় কাত করে বলে উঠেছে,
–এক্সকিউজ মি।
শুধু তাই নয়,লাস্ট রো–য়ের সদ্য রিটায়ার্ড মদনবাবুর পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলে উঠেছে,
–আঙ্কেল একটু হাতটা বাড়িয়ে দাও না প্লিজ।
মদনবাবুর মদনজল শেষ কবে নির্গত হয়েছে ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। পায়ের নোংরা নখের কোণা থেকে মাথার রঙ করা টাক অবধি ঝনঝনিয়ে উঠেছে এইটুকু নারীস্পর্শেই। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
–এই বাসু, দাও দাও আমার হাতে দাও। আমি দিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটি খুচরো রেডি করেই এনেছিল। দেওয়া নেওয়ার ফাঁকে নেলপালিশ লাগান ধারাল নখ ছুঁয়ে গেছে মদনবাবুর হাতের তেলো।
থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল, বলে সরে যেতেই বুক ধড়ফড়ের হাত রেহাই পেলেন তিনি।
কিন্তু নিস্তার কি এত সহজে মেলে! ওই মেয়ে তন্মধ্যে একটি সিগারেট দু’ আঙুলে ঝুলিয়ে গলায় আবদারের সুর তুলে বলে ফেলেছে,
–একটু আগুন হবে বাসুদা?
কাউন্টারের ওপর ফাঁসি হয়ে যাওয়া আসামীর মত একটা দড়িবাঁধা লাইটার সব সময় ঝোলে। কিন্তু সেখানে পৌছতে হলে ভিড়টাকে দুভাগ হতেই হয়। নইলে চামড়ায় আগুন ঘষা খায়।
মদনবাবু এবং আরও দুজন একটু ডাইনে বাঁয়ে হেলে গেলেও বাকিরা হেললেন না। একেই তো লাইন টপকান কেস তায় আবার এখন আগুন চাইছে এই সর্ব অঙ্গে আগুনবাহী মেয়েটা !
বাসু উপায়ান্তর না দেখে দেশলাইটা একটু আলতো করে ভিড়ের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিতেই শেষ চমকটি উন্মোচিত হল। ম্যাচবক্স লুফে নিয়ে মেয়েটি রাস্তা পার হল এবং উলটো দিকে পেছন উঁচু বাইকে, এতক্ষণ ফোকাসের বেমালুম বাইরে থাকা, ইয়াং দেড়েল মাচো ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল। তার পরনেও স্যান্ডো এবং লোমশ পা বার করা বারমুডা।
সবিস্ময়ে স্টার্ভড জনতা দেখল, কী আরামে , হাতের তালুর আড়াল তুলে এক আগুন ভাগাভাগি করে ধরিয়ে নিচ্ছে দুজন দুটো সিগারেট।
দেশলাই ফেরতটুকু দিয়েই মেয়েটি কী মসৃণ দ্রুততায় উত্তুংগ বক্ষ ছেলেটির পিঠে লেপটে ধোঁয়া ছেড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দুজনে, রাস্তার পরবর্তী বাঁকটায়।
এই সমগ্র দৃশ্যে লাইনে দাঁড়ান প্রবীণতম মানুষটির দীর্ঘশ্বাস পতনের সঙ্গে নির্গত শেষ সংলাপটুকু ছিল এই রকম,
–এদের ঘরভাড়া দিসে কেডা? ক্যান দিসে? কলোনি কমিটির মিটিং ডাকোন লাগে। এইজন্যই কি ইংরজের সঙ্গে লড়াই দিসিলাম? দ্যাশ ছাইড়া আইসিলাম?
# # #
খুব একটা ভূল বলেননি ঐ বৃদ্ধ। ইংরেজ আসার আগে আমাদের দেশে চলন ছিল হুঁকো এবং গড়গড়ার। প্রধানত পুরুষেরা প্রকাশ্যে, অন্দরের সম্ভ্রান্ত গিন্নিরা দ্বিপ্রাহরিক পিএনপিসির আসরে ধূমপান করতেন।
সে ছিল তাম্বাকু সেবনের স্বর্ণযুগ।
বিশ্বযুদ্ধ আমাদের উপহার দিল ফ্রন্টে ও সিভিলিয়ান জীবনে বিষাক্ত গ্যাসবাহী সিগারেট।
মেয়েরাও যে ধূমপান করে সেটি আমাদের প্রথম প্রত্যক্ষ করাল হিন্দি সিনেমা।
আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম, কালো লম্বা হোল্ডারের মাথায় লাগান জ্বলন্ত সিগারেট । মৃদু মৃদু টান দিচ্ছেন নাদিরা, হেলেন, বিন্দু। কাঁধ খোলা, দস্তানা ঢাকা পেলব হাতটি রাখা অজিত, প্রাণ কিম্বা প্রেম চোপড়ার কাঁধে, জুয়ার টেবিলে। পরনের পোশাকটিও যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত।
আমাদের জীবনে সিনেমার ভয়ংকর প্রভাব সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই গেঁথে দিল একটি চিরস্থায়ী ডেটা, সিগারেট খায় “খারাপ” মেয়েরা।
ছেলেরা নয়। কারণ সিগারেট হ‘ল দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চনের স্টাইল– সিগনেচার। সিগারেট এদের পৌরুষের জয়ধ্বজা। এদের রোমান্টিসিজমের ফ্লেভার।
‘নায়ক’ ছবিতে রিসিভার কানে, সানগ্লাস চোখে, ঠোঁটে সিগারেট উত্তম তো সর্বকালের সেরা পুরুষালী আইকন।
কিন্তু ‘দিওয়ার’ অবধি আসার পরেও পরভীন ববি যখন দুটি সিগারেট একসঙ্গে জ্বালিয়ে বচ্চনের বুকে মাথা রেখে একটি এগিয়ে ধরে, তখনও আমরা এই মারাত্মক অ্যাংরি ইয়াং ম্যানটির ভয়ে হলে সিটি না দিলেও মনের ভেতর কোথাও সামান্য খেদ রাখি এই ভেবে যে গুরু কি না শেষে একটা কলগার্লের প্রেমে পড়ল!
সিনেমা থেকে বাস্তবের মাটিতে প্রথম আমাদের সামনে সিগারেট মুখে নারীকে দেখলাম ফার্স্ট ইয়ারে। সে তখন থার্ড ইয়ারে। নাম বেগম দি(নামটি কাল্পনিক)।
কলেজের প্রথম দিনই সেই মফঃস্বল তোলপাড় করা ‘জোয়ান অব আর্ক‘কে দেখলাম এয়ার হোস্টেস ব্লাউজ পড়ে ছেলেদের ক্যান্টিনে ব‘সে। হাতের খুরিতে চা। অন্য হাতের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট। আলোচনায় নকশাল আন্দোলনের ভবিষ্যৎ।
সামনে কিছু সিনিয়র ও জুনিয়র । তারা বুঁদ হয়ে বেগমদির কথা শুনছে।
আফশোষ, বেগমদিকে আমরা বেশিদিন পাইনি। পরের বছর এম এ করতে কলকাতা, তার কিছু পরে আমেরিকার কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে নীল আকাশে ধোঁয়া ছেড়ে উড়ে গেল বেগমদি। পেছনে রেখে গেল অজস্র প্রাক্তন ভগ্ন নকশাল হৃদয়।
বেগমদিই, প্রথম প্রতক্ষ্য ‘ধোঁয়াবনবিহারিণী‘ যাকে খারাপ মেয়ে বলবার হিম্মত কেউ সামনে দেখায়নি। আড়ালে যা বলেছে, তা উচ্চারণের অযোগ্য।
সোশাল মিডিয়ায় ক’দিন আগেই একটা ছবি ভাইরাল হ‘ল। এক সুসজ্জিত কনে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে। হাতে সিগারেট। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে বার হয়ে আসছে ধোঁয়া।
কনের বদলে এখানে কিন্তু বর থাকলে ছবিটি ভাইরাল হয় না। কারণ, কনেটি দুষ্টু।
বোঝাই গেল “দুষ্টু” নারীর প্রতি আকর্ষণ, মুখে না স্বীকার করলেও, আজও অপ্রতিরোধ্য। আর সিগারেট আজও মেয়েদের দুষ্টুতর ইমেজ দেয়।
কিছুদিন আগে পল্লীশ্রীর মোড়ে ঘটে গেল নীতিপুলিশের প্রতিবাদ। এক বয়স্ক মানুষ ধমকালেন সিগারেট ঠোঁটে যুবতীকে। আমার সামনে রাসবিহারীর মোড়ে এক নার্সিং হোমের সামনে দাঁড়িয়ে আরেক ধূমপায়িনীকে ধমকাল এক যুবক।হাত তুলে দেখাল সাইনবোর্ড। মেয়েটি এতটুকু বিচলিত না হয়ে ক্রসিং পার হয়ে ওপারে গিয়ে টানতে লাগল অবশেষ।
খাস কলকাতার “প্রগতিশীল” একটি স্বনামধন্য ইউনিভারসিটির অবস্থা বলি।
মেয়েকে এ্যাডমিশন টেস্টে এনেছিলাম। গেট পেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই বাধা দিল এক শীর্ণা। হাতে জ্বলন্ত সাদাকাঠি। নির্গত গন্ধটি কিন্তু গঞ্জিকার। মেয়েকে আমাদের হাত থেকে একরকম ছিনতাই করে গলা জড়িয়ে নিয়ে গেল বিল্ডিং–এর ভেতর। আমি এগোতেই বাধা দিয়ে বলল, তোমার আর আসার দরকার নেই আংকেল। আমরাই ম্যানেজ করে নেব।
এইসব দেখে সুদূর বর্ধমান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসা বাবা মা হতাশ সুরে বললেন,
– চান্স পেলেও এখানে পড়তে দেব না মেয়েকে।
মেয়ের মুখে শাওনের মেঘ নেমে এল যেন।
এডমিশন টেস্ট শেষ। গলগল করে পরীক্ষার্থীরা বার হচ্ছে। গেটের বাইরে বর্ধমান থেকে আসা সেই গার্জেনদ্বয়।
তারা জানতেও পারলেন না যে আমি এইমাত্র দেখে এলাম মেয়েটি আরেক পরিচিতার সংগে ভেতরের ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছে।
আঙুলের দু’ফাঁকে জ্বলজ্বল করছে একটি জ্বলন্ত সিগারেট।
অসাধারণ। যেমন গদ্য তেমন কন্টেন্ট, তেমনই শ্লেষ আর ব্যঙ্গ আমাদের এই সো কল্ড প্রগতিশীল ‘বং’ সমাজের মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে অসামান্য পর্যবেক্ষণ! যা আমরা সাধারণত খেয়াল করে দেখিনা আর করলেও সেটা অতি আলগোছে, ফলে সমাজের ভেতরে চাড়িয়ে যাওয়া কূপমণ্ডূকতার শিকড় গভির থেকে গভীরতর মনন জমিতে প্রেথিত হয়ে যায় খুব দ্রুত। এরকম একটি বিষয় নিয়ে কলম ধরার জন্য ধন্যবাদ প্রতিবেদককে।