মুক্তা ভার্মা ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। বেঁচে থাকার লড়াই তো বটেই, পাশাপাশি সাধ রয়েছে বিশ্ব ভ্রমণের। এত তাড়াতাড়ি হার মানলে কি চলে? আর পাশে পেয়েছেন তাঁর স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা আর ভালোবাসা। ‘বিয়ের মণ্ডপেই স্বামীকে প্রথম দেখেছিলাম’, তাঁর স্বপ্নের মানুষটিকে জীবনে পাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন অবসারপ্রাপ্ত সরকারি রেজিস্ট্রার মুক্তা ভার্মা। বিহারের ছোট্ট শহরে জন্ম মুক্তার। আট ভাই বোনের সঙ্গে বড় হয়েছেন, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না বাবার সংসারে। কিন্তু ওই যুগে ওই অভাবের মধ্যেও ছেলে মেয়ে সকলের পড়াশোনাকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন মুক্তার আইনজীবী বাবা আর স্কুল শিক্ষিকা মা। ক্লাস ফাইভ অবধি ঘরেই লেখাপড়া করেছেন মুক্তা ভার্মা, তারপর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ‘আমাদের জীবন ছিল খুব ছাপোষা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন হয় আর কী। আমরা লেখাপড়া করতাম, লোকজনের সঙ্গে মিশতাম, পরিবারের সঙ্গে সবাই মিলে সময় কাটাতাম আর রেডিও শুনতাম। বেড়াতে যাওয়ার শখ থাকলেও সাধ্য ছিল না। অত টাকা ছিল না বাবার’।
১৯৮৫ সালে বিয়ে হয় সঞ্জীব আর মুক্তার। সঞ্জীবের বাবা ছিলেন সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক। মা গৃহবধূ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় সঞ্জীব। বিয়ের সময় সঞ্জীব ছিলেন পাটনার একটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির জুনিয়র ম্যানেজার। অল্প বয়স থেকে চাকরি করতেন সঞ্জীব আর তার জন্য প্রচুর ট্র্যাভেল করতে হত। অবসর নিয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হয়ে। ‘আমাদের সময়ে বিয়ের আগে পাত্র পাত্রীর নিজেদের মধ্যে দেখাশোনার চল ছিল না। কাজের সূত্রে আমায় প্রচুর ট্র্যাভেল করতে হত, একদিন একটা ট্যুর থেকে সবে ফিরেছি, আমার বাবা আর কাকা জানালেন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘কোথায় ?!’ তাঁরা বললেন ‘তোমার তা না জানলেও চলবে’ | সঞ্জীবের এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা।
বিয়ের পর মুক্তাকে সঞ্জীব প্রথম যে প্রশ্নটা করেন, তা হল ‘তুমি কোথায় কোথায় বেড়াতে গিয়েছে?’ মুক্তা গয়া আর বারাণসী ছাড়া আর তো কোথাও যাননি। তাই-ই বললেন নতুন বরকে। তার যে কোনও পাসপোর্ট নেই ,তাও জানালেন। সঞ্জীব উত্তর দিয়েছিলেন ‘তবে তো খুব তাড়াতাড়ি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হবে, কারণ আমরা অনেক বেড়াব, গোটা পৃথিবীতে’। দু’জনে মিলে সারা পৃথিবী ঘুরবেন, নব বিবাহিতা নতুন স্বামীর মুখে এ কথা শুনে বড় খুশি হয়েছিলেন। এরপর ৩৪ বছর কেটে গেছে দু’জনে একসঙ্গে। পরস্পরের প্রতি প্রেম বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বেড়েছে তেমন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘোরার নেশাও। খুব কর্মব্যস্ত জীবন দু’জনেরই তবু সময় বের করে দু’জনেই বেরিয়ে পড়তেন। বছরে দু’বার তো বটেই। প্রথম দিকে দু’জন মিলে তারপর ছেলেমেয়েরা আর গোটা পরিবার মিলেই ভারতের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। জম্মু, কাশ্মীর, বৈষ্ণদেবী, সিমলা, ভুটান কত কত সুন্দর জায়গার কতই না মধুর স্মৃতি আছে তাঁদের ! দার্জিলিং-এ মধুচন্দ্রিমা দিয়ে সেই যে শুরু হল ঘোরা, তা আর থামেনি সংসারের বা পেশাগত কাজের চাপেও। যা হোক করে সময় বের করেছেন এই দম্পতি। ৩৪ বছরের বেশি দাম্পত্য জীবনে ভারতের বেশির ভাগ জায়গাই বেড়িয়ে ফেলেছেন তাঁরা। পরবর্তী স্বপ্ন ইউরোপ ভ্রমণ ! কিন্তু সে পরিকল্পনা শুরু হতে না হতেই দুর্যোগ নেমে এল পরিবারে। মুক্তার ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ল।
‘ ২০০৫ সালের অক্টোবর মাস। আমি চেক আপে গেছি, ডাক্তার বললেন আমার টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট। দ্রুত বাদ দিতে হবে স্তন, পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। আমরা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম, কী করব বুঝে উঠতে পারছি না’ মুক্তার মনে পড়ে সেই চরম আতঙ্কগ্রস্ত দিনগুলোর কথা। ‘গোটা পরিবারের কাছে এ দারুণ একটা অভিঘাত। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, মুম্বইতে গিয়ে চিকিৎসা করাব’, জানান সঞ্জীব বাবু। ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছিলেন মুক্তা। কিন্তু ২০১৬ সালে যখন ভাবা হচ্ছিল তিনি প্রায় ক্যানসার মুক্ত তখনই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এই মারণ রোগ। এবার আরও কয়েক গুণ ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে বাসা বেঁধেছে কর্কট, মুক্তার শরীরে। ছড়িয়ে পড়েছে মস্তিস্কে, ফুসফুসে, হাড়ে। ধারাবাহিক ভাবে কঠিন রেডিয়েশন আর কেমোথেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হয় মুক্তা দেবীকে। ‘চিকিৎসার এই সময়টাতেই বিদেশ ঘোরার শখ আরও বেশি করে জেগে উঠল। রেডিওলজিস্ট-এর সঙ্গে কথা বললেন সঞ্জীব বাবু, তিনিও উৎসাহ দিলেন। এই রকম ভাবনার প্রশংসাও করলেন’। তাই ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালীনই তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপ ঘুরতে। ফিরে তাকাননি রোগের দিকে। শরীরে দুরারোগ্য কর্কট রোগ নিয়েই চষে ফেললেন গোটা ইউরোপ মহাদেশ। বেড়িয়ে এসেছেন লন্ডন, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি এবং অতি সম্প্রতি রাশিয়াও ঘুরে এসেছেন মুক্তা-সঞ্জীব।
‘আমরা ঘরে বসে শুধুই বেড়াবার পরিকল্পনা করি। একটা ট্রিপ শেষ করে এসেই আবার পরেরটা ভাবতে বসে যাই। প্রথম বিদেশ ভ্রমণই অনেক সাহস দিয়েছে মুক্তাকে। আমার মনে হয় না আমাদের এই বেড়াবার প্ল্যান খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে’ বিশ্বাসী সঞ্জীব বাবু। মুক্তার সবচেয়ে প্রিয় দেশগুলির কথা বলতে বলতে তিনি জানান, ‘ফ্রান্স, ইটালি, সুইজারল্যান্ডের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কী যে আনন্দ হচ্ছিল ! স্থাপত্য, ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ সব কিছুই বড় চমৎকার। দেশগুলির সমৃদ্ধ ইতিহাস আর সংস্কৃতির পরিচায়ক এগুলি। যেন অতীতকে প্রত্যক্ষ করছি’। মাইকেল এঞ্জেলো, দ্য ভিঞ্চির সৃষ্টি, প্যারিসের নোতর দামের মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রাল সব কিছুই মুগ্ধ করেছে মুক্তাকে।
জীবনের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার অনেক রসদ নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি। বিদেশের মাটি, তার মুক্ত নীল আকাশ, দূষণ মুক্ত পরিবেশ সব কিছুই বড় উপভোগ করেছেন মুক্তা। মুক্তা আর সঞ্জীবের ভালোবাসা, পাশে থাকা, পারস্পরিক বোঝাপড়া দৃষ্টান্ত তৈরি করার মত। যখন তাঁদের এত দীর্ঘ সুন্দর মধুর দাম্পত্য সম্পর্কের গোপন রহস্যের বিষয়ে জানতে চাওয়া হল, মুক্তাই বললেন ‘ব্যক্তি জীবন আর পেশাগত জীবনকে আলাদা রেখেছি চিরকাল। কাজের চাপকে কখনই বাড়িতে ঢোকাইনি। আমার স্বামী যখন অফিসে থাকতেন তখন সেখানে নিজের ১০০ ভাগ দিয়ে কাজটা করে তারপর বাড়িতে ফিরতেন। কিন্তু যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন, অফিসের কাজের কথা ভুলে একজন দায়িত্ববান স্বামী আর পিতার ভূমিকা পালন করতেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বলি, যারা নতুন সংসার করছ, যত স্বল্পই আয় থাক, ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ো। দু’জন একসঙ্গে বেড়াও। বিদেশে যেতে হবেই, এমন কোনও কথা নেই, আমাদের দেশেই অপূর্ব সব জায়গা রয়েছে বেড়াবার’।