banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ভ্রমণ: অর্ধসূর্যের দেশে: প্রথম পর্ব

মে ২৭, ২০২২

Federal Republic of Nigeria
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আর যেখানেই যাই না কেন সপ্তসাগর পার, নাইজেরিয়া যাব এটা কোনওদিন ভাবিনি। দীর্ঘদিন শিশুশিক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আচমকা একটা সুযোগ এসে গেল। কয়েক বছর আগের এক অগস্ট মাসে কয়েকজন স্কুল শিক্ষিকাকে মন্টেসরি ট্রেনিং দেবার জন্য নাইজেরিয়া রওনা দিলাম। থাকার মেয়াদ তিন সপ্তাহ। আফ্রিকার পশ্চিম উপকুলে সিন্ধুর বিন্দু ‘লাগোস’ শহর আমার গন্তব্য।

কলকাতা থেকে দুবাই হয়ে নাইজেরিয়া। দুবাইয়ের পর থেকে আফ্রিকার লোকজনেই প্লেন ভর্তি দেখলাম। দুবাইয়ের কেঠো ব্যবহারের পর প্লেনের ভেতর সম্পূর্ণ অন্য এক জগত। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে আড় ভাঙার জন্য মাঝরাতে প্লেনের ভেতর হাঁটছিলাম। সরু সরু বিনুনি বাঁধা বিমানবালা গায়ে পড়ে আলাপ করে পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি তুলে তক্ষুণি কাগজের ফ্রেমে আটকে ওপরে নিচে পান আকৃতি হৃদয়ের ছবি এঁকে একটি চুমু-সহ আমাকে উপহার দিল। মাঝরাতের ঝিমন্ত প্লেনে এত দুরন্ত ব্যবহারে যা অবাক হলাম বলার নয়। বিমানসেবিকাদের থেকে সব সময় আমরা এক ধরনের সদয় যান্ত্রিক ব্যবহার পেয়ে থাকি। সেটা ধনী-গরিব সব দেশেই এক– প্রবলভাবে আন্তর্জাতিক। এই জাতীয় পাগলামিও যে কোথাও সম্ভব সেই জ্ঞানও লাভ হল।  

লাগোস এয়ারপোর্টটা খুবই ছোট। কনভেয়ার বেল্টটা আরও ছোট। মালের জন্য দাঁড়াতে হল প্রায় দু’ঘণ্টা। সেনা বিদ্রোহে নিহত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্তালার নামে এয়ারপোর্ট। ১৯৬০ সালে নাইজেরিয়া ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর নাইজেরিয়ার কুখ্যাত বায়ফ্রার গৃহযুদ্ধ। সেই থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়টাই সেনাশাসন। শেষ সেনাপ্রধান স্বৈরাচারী আবাচার পর থেকে এখন পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসন চলছে। এখানে আমেরিকার মতো প্রতিটা প্রদেশের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। সর্বোচ্চ পদে আছেন প্রেসিডেন্ট। তারপরে প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সেনেটরের দল।

Lagos city
লাগোস শহর

নাইজেরিয়া আসছি শুনে শুভাকাঙ্ক্ষীর দল একটা কথাই বলেছিল– সাধু সাবধান! এটা সত্যি, পাশ্চাত্য দুনিয়া অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য মনে করি বলে বলে ওই দেশগুলো আমাদের কাছে যত পরিচিত, আফ্রিকা তত নয়। তার মধ্যে নাইজেরিয়া তো নয়ই। কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ নাইজেরিয়া আসেও না। অজস্র রোজগার করেও খরচের কোনও উপায় নেই সেখানে। পর্যটকদের জন্যও কোন লোভনীয় হাতছানি নেই। সবমিলিয়ে একটু উদ্বেগ নিয়েই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু প্লেন থেকে নীচে রাঙামাটি আর ঘনসবুজ দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেল।

লাগোস ভারতবর্ষের যে কোনও মাঝারি মাপের শহরের মতো। সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের গায়ে নাইজেরিয়ার প্রতীক ‘অর্ধসূর্য’ আঁকা। নাইজেরিয়ার একটি প্রধান সম্পদ পেট্রোলিয়াম। তাই সেটি সস্তা বলে গরিবী সত্ত্বেও গায়ে গায়ে লাগা গাড়ি। অথচ রাস্তা নেই, ফলে অনন্ত ট্র্যাফিক জ্যাম। আর সব গরিব দেশের মতো গাড়ি এখানেও সামাজিক সম্মানের চিহ্ন। ব্যবহার হোক বা না হোক, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকের বাড়ির সামনে দারোয়ানের মতো। ইউরোপের যত সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি চলে আসে নাইজেরিয়ায়। সেইজন্য রাস্তায় কত রকম যে গাড়ি আর বিশেষ করে মার্সিডিসের ছড়াছড়ি। 

Okada Nigeria
ওকাডায় সওয়ার স্কুলের শিশুরা। হেলমেটহীন অবস্থায় চালকের কানে ফোন

এই ট্রাফিক জ্যাম মোকাবিলা করতে এক অভূতপূর্ব পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্ম হয়েছে। তার নাম ‘ওকাডা’, যেটা এখন আমাদের অ্যাপ ক্যাব কোম্পানিগুলোও অনুসরণ করেছে। মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাতে বাড়তি হেলমেট নিয়ে মোটরবাইকে অপেক্ষা করে ছেলের দল। যাত্রী পেলেই পেছনে বসিয়ে ছুট। একটি বাহন, একজন চালক, এক যাত্রী। গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সময় মতো পৌছনোর জন্য আবালবৃদ্ধবনিতার নির্ভরযোগ্য বাহন ‘ওকাডা’। মাইলের পর মাইল নিশ্চল গাড়ির মিছিলের মধ্যে বসে এঁকেবেঁকে পথ করে চলে যাওয়া ওকাডার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি কতবার।

এখানে পা দিয়েই নাইজেরিয়ার মেয়েদের মাথায় চোখ আটকে গিয়েছিল। চুলের কথা না বললে এখানকার মেয়েদের কথা প্রায় কিছুই বলা হয় না। মাথা নিয়েই তাদের যত মাথাব্যথা। পোশাকে পুরোপুরি পাশ্চাত্যের অনুকরণ করলেও চুলের সাজসজ্জায় তারা সনাতনপন্থী। অজস্র সরু সরু বিনুনি সবার মাথায়। পরে শুনলাম, এগুলো আলাদা কিনতে পাওয়া যায়। প্রায় নব্বইভাগ মেয়েই এইগুলো ব্যবহার করে। নিজের চুলের সঙ্গে মিশিয়ে বিনুনির বোঝা এরা মাথায় আটকে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় বিনুনি বাঁধার সেলুন। মাসের-পর-মাস এই কেশসজ্জার ফলে এদের গায়ে ঘাম-আঠা মেশানো বিচিত্র এক গন্ধ লেগে থাকে সবসময়। এছাড়া আছে পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং কাপড় দিয়ে মাথায় বাঁধা বান্দানা। সেটা সাধারণ হেয়ারব্যান্ডের মতো সরুও হয় আবার বিরাট পাখির বাসার মতো পাগড়িও হতে পারে। প্রায় নব্বইভাগ মেয়েই মাথা মুড়িয়ে নকল বিনুনি লাগায় নয়তো বিভিন্ন ফ্যাশনের পরচুল পড়ে।

Nigerian Women
নাইজেরীয় মেয়েরা পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং কাপড় দিয়ে মাথায় বাঁধে বান্দানা

নাইজেরিয়ায় আউসা, ইবো, ইরোবা এই তিন প্রধান উপজাতির মধ্যে আবার প্রায় দুশো রকমের নানা গোষ্ঠী আছে। এদের নিজেদের মধ্যে বর্ণভেদ প্রবল। মেলামেশা আর একটু গভীর হতে দেখলাম আধুনিকতা শুধু পোশাকে ও ইংরেজি বুলিতে। সমাজের মধ্যে মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রের ঘাঁটি বেশ শক্ত। ট্রেনিংয়ের ফাঁকফোকরে ছাত্রীদের ঘর-সংসারের কথা জিজ্ঞেস করতাম। বিবাহিতদের অনেকগুলো ছেলে মেয়ে। উর্বরা স্ত্রী, পুরুষের সম্পদ। অনেকে বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে তা প্রমাণ করে। পুরুষের বহুগামিতা মেয়েরা দেখলাম মেনেই নিয়েছে, যেন এটাই স্বাভাবিক। তার প্রতিক্রিয়াতেই বোধহয় সমাজের মধ্যেও যৌনতা নিয়ে শুচিবাই কম। ভাইবোনের পরিচয় দিতে গিয়ে সেম ফাদার সেম মাদার বলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

নাইজেরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আর তেলের জন্য আফ্রিকার মধ্যে অন্যতম ধনী দেশ। কিন্তু দুর্নীতি এত প্রবল যে সম্পদ একাংশের মধ্যেই সীমিত। ধনীরা তাদের বিত্তের সঙ্গে বউ এবং সন্তান বৃদ্ধি করে চলে বেশ গর্বভরে। আমাদের একটি মাঝারি মাপের আবাসনে একটি সংসারের সহাবস্থান সাধারণ ঘটনা। বিবিসির সাংবাদিক এইরকমই এক পরিবারের মহিলাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমাদের এত জনের একটি স্বামী, এটা খারাপ লাগে না?’ মেয়েরা বলেছিল– একটা মিষ্টি পেঁপে একা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা যদি পচা হয়, তাহলে যতজনের মধ্যে ভাগ হয় ততই ভাল।

নাইজেরিয়ায় আউসা, ইবো, ইরোবা এই তিন প্রধান উপজাতির মধ্যে আবার প্রায় দুশো রকমের নানা গোষ্ঠী আছে। এদের নিজেদের মধ্যে বর্ণভেদ প্রবল। মেলামেশা আর একটু গভীর হতে দেখলাম আধুনিকতা শুধু পোশাকে ও ইংরেজি বুলিতে। সমাজের মধ্যে মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রের ঘাঁটি বেশ শক্ত। ট্রেনিংয়ের ফাঁকফোকরে ছাত্রীদের ঘর-সংসারের কথা জিজ্ঞেস করতাম। বিবাহিতদের অনেকগুলো ছেলে মেয়ে। উর্বরা স্ত্রী, পুরুষের সম্পদ। অনেকে বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে তা প্রমাণ করে। পুরুষের বহুগামিতা মেয়েরা দেখলাম মেনেই নিয়েছে, যেন এটাই স্বাভাবিক। তার প্রতিক্রিয়াতেই বোধহয় সমাজের মধ্যেও যৌনতা নিয়ে শুচিবাই কম। ভাইবোনের পরিচয় দিতে গিয়ে সেম ফাদার সেম মাদার বলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

নাইজেরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আর তেলের জন্য আফ্রিকার মধ্যে অন্যতম ধনী দেশ। কিন্তু দুর্নীতি এত প্রবল যে সম্পদ একাংশের মধ্যেই সীমিত। ধনীরা তাদের বিত্তের সঙ্গে বউ এবং সন্তান বৃদ্ধি করে চলে বেশ গর্বভরে। আমাদের একটি মাঝারি মাপের আবাসনে একটি সংসারের সহাবস্থান সাধারণ ঘটনা। বিবিসির সাংবাদিক এইরকমই এক পরিবারের মহিলাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমাদের এত জনের একটি স্বামী, এটা খারাপ লাগে না?’ মেয়েরা বলেছিল– একটা মিষ্টি পেঁপে একা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা যদি পচা হয়, তাহলে যতজনের মধ্যে ভাগ হয় ততই ভাল।

উচ্চপদস্থ অবস্থাপন্ন এক নাইজেরিয়ান ভদ্রলোক খুবই গর্বের সঙ্গে জানালেন, তিনি তাঁর বাবার পাঁচ নম্বর স্ত্রীর আট নম্বর সন্তান। মুসলমান, খ্রিস্টান ও সনাতনপন্থী, এই তিন ধর্মমত বজায় থাকলেও আমার সঙ্গে শুধু গরিব থেকে বড়লোক খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদেরই মোলাকাত হয়েছে। তবে তাদের রীতিনীতি স্থানীয় উপাদান নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক চেহারা নিয়েছে। এখানে খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহ অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। ধর্ম এক হলেও এক গোষ্ঠীর সঙ্গে আর এক গোষ্ঠীর প্রেম হলে পরিণতির পথে বিস্তর বাধা। যদি বিয়ে হয়ও, স্বামীর অকালমৃত্যু হলে স্ত্রীর দুরবস্থার সীমা থাকে না। সন্তান মেয়ে হলে অবস্থা আরও গুরুতর। সকন্যা মাকে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও স্বামীরা ইচ্ছে করলে স্ত্রী পরিত্যাগ করতে পারে। আরও বিয়ে করতে পারে। রক্ষিতা  রাখতে পারে বুক ফুলিয়ে।

পুরুষতন্ত্রের শক্ত ঘাঁটি নাইজেরিয়ার সমাজ ‘উইমেন্স বিল’-এর জন্য লড়াই করছে বহুবছর। এতদিনে তারা সফল হয়েছে কিনা জানি না। মেয়েদের বলছিলাম,
– স্বামীরা অন্যায় করলে তোমরা অন্তত অভিযোগ তো জানাতে পার!
সবথেকে উজ্জ্বল ছাত্রীটি বলল,
– মার খেয়ে নালিশ করলে পর ফিরে এসে আবার তো মার খেতে হবে।
অথচ চটি, জামা, জুতো, চলাফেরার স্বাধীনতায় এরা প্রথম বিশ্বের মেয়েদেরই মতো। আশ্চর্য হচ্ছিলাম এই বৈপরীত্যে। জিজ্ঞেস করলাম,
– স্বামী ত্যাগ করলে তোমাদের খরচপত্র পাবার জন্য কী কর?
– যদি কোর্ট ম্যারেজ হয় তাহলে ডিভোর্স হলে খানিকটা খরচ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ট্রাডিশনাল বিয়েতে লবডঙ্কা।
– অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা– জীবনযাত্রার প্রাথমিক ব্যাপারগুলো সবই খুব দামী। তাহলে বিচ্ছিন্ন অসহায় অবস্থার জন্য কোর্ট ম্যারেজই তো ভালো।
সেটা বলায় তারা প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল,
– তা হয় না। তাহলে মনে হবে দুই পরিবারেই এই বিয়েতে মত নেই। সবার ব্লেসিং চাই।

Many wives of one man in Nigeria
এখানে খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহ অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা

– আসলে আফ্রিকা হল উৎসবের দেশ। কত অনুষ্ঠান থাকে ট্র্যাডিশনাল বিয়েতে। যার যত পয়সা তত লম্বা ফাংশন। কখনও কখনও ছ’মাস একবছর ধরে চলে।
– সেটা কেমন?
– বিয়ের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে মেয়েকে রেডি করা হয় বিয়ের জন্য। শ্বশুরবাড়িতে কেমন করে চলবে, স্বামীকে কীভাবে খুশি করবে, সেটাই বিষয়। অভিজ্ঞরা সেক্স এডুকেশন দেয়। খাইয়ে খাইয়ে আর নানারকম মাসাজ করে হবু বধূকে মোটা করা হয়। মোটা বউ স্বামীর সম্পদের প্রতীক। মোটা বউ শ্বশুর বাড়িতে বেশি আদর পায়।
এটা শুনে মনে হল, আহা! এই নিয়মটা যদি সব দেশে থাকত। জিরো ফিগারের করিনা কাপুর কিন্তু এদেশের বিচারে কুৎসিত। সেজন্য সব মেয়েরই লক্ষ্য বক্ষ ও নিতম্বে ওজনদার হয়ে ওঠা।

Nigerian Bride
এদেশে মোটা বউ স্বামীর সম্পদের প্রতীক

উৎসবের দেশ বলে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ এই উৎসবের ঠেলায় মানুষ কপর্দকশূন্য হয়ে যায়। নাইজেরিয়ায় বিয়ে শুনলাম ওপেন টু অল। আমাদের বিয়ের চিঠিতে ‘সবান্ধবে নিমন্ত্রণ’ শুধু কথা কথা। এখানে সেটা যথার্থই কাজে পরিণত হয়। তিনশো জন নিমন্ত্রিত হলে ছশো জনের আয়োজন করতে হয়। দেশে থাকতেই ডেবরার বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম। এদের অনেকেরই একবার চার্চের পর আবার গ্রামে গিয়ে ট্র্যাডিশনাল বিয়ে হয়। আজকাল কেউ কেউ রেজিস্ট্রিও করছে। 

খুব ইচ্ছে থাকা সত্বেও গ্রামের বিয়ে তো আর দেখা হবে না, তাই চার্চের বিয়েতেই গেলাম। ওয়েডিং বুকে লম্বা অনুষ্ঠানসূচি। শুরু ও শেষের দীর্ঘ প্রার্থনা ও গান ছাড়াও রয়েছে হরেক অনুষ্ঠান। সবথেকে মজা লাগলো দেখে বিয়ের শেষে বর-কনে কার সঙ্গে কার আগে বা পরে ছবি তুলবে তার লম্বা তালিকা আগেই ওয়েডিংবুকে ছাপানো। ছবি তোলা একটা পর্ব। সেটা শেষ হলে পর নাচতে নাচতে সবাই ঢুকলে আবার বারো দফা অনুষ্ঠান– ইনভিটেশন টু দ্য হাই টেবল্‌, গ্র্যান্ড এন্ট্রি, কেক কাটিং, ফিডিং আওয়ার, ফার্স্ট স্টেপস্‌, গিফট গ্যালর, এমনি কত কী। শেষে লম্বা প্রেয়ার। নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা দেখে চোখ ক্রমশ বিস্ফারিত।

ফিলিপ্পা মাত্র ছ’মাস আগে বিয়ে করে তিন মাসের গর্ভবতী। নানা দিক দিয়েই সে বিদ্রোহিনী। আড়ম্বরহীনভাবে অন্য গোষ্ঠীর ছেলেকে বিয়ে করেছে। সে বলল,
– আমি শুধু একদম কাছের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের বলেছিলাম।
– কতজন সবসুদ্ধ?
– খুব কম। আসলে আমরা গাড়ি কিনব বলে পয়সা জমাচ্ছি তাই চারশো জনের বেশি নেমন্তন্ন করিনি। নামকরণ ও ব্যাপ্টিজিমও আমরা খুব সাধারণ করে করব ওই জাস্ট আত্মীয় আর বন্ধুরা।

Traditional wedding in Many wives of one man in Nigeria
চার্চের পর আবার গ্রামে গিয়ে ট্র্যাডিশনাল বিয়ে হয়

ওই ‘জাস্ট আত্মীয় আর বন্ধুর’ সংখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আফ্রিকানদের উষ্ণ হৃদয়। মৃত্যু যদি একেবারে অকালে না হয় তাহলে উৎসবের আয়োজনের জন্য মৃতদেহ দু-তিন মাস ধরেও ঠান্ডাঘরে থাকতে পারে। রোজ়মেরির ঠাকুরদাকেই নাকি এভাবে রাখা হয়েছিল। তারপর সবার সুবিধামতো দিন দেখে টাকাপয়সার যথেষ্ট ব্যবস্থা করে মৃতদেহ সমাধিস্থ করে বিশাল ভোজ। আমাদের শ্রাদ্ধও কখনও কখনও বেশ জমকালো ব্যাপার হয় বটে কিন্তু সেটার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট। উৎসবের আয়তন বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করা হয় না। আমার নাইজেরীয় ক্লাসের ছাত্রীরা সেটা মানতে চায় না। বলে ‘ওল্ড পিপল ক্যান নট গো আননোটিসড।’

এখানকার অন্যতম প্রধান খাদ্য ‘ইয়াম’ মেটে আলুর মতো দেখতে। আয়তনে এত বিশাল, যে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম গাছের গুঁড়ি। সেই ‘ইয়াম’ পরিণত হলে পর হয় ‘নিউ ইয়ামস ডে।’ মনে পড়ল আমাদের নবান্নর কথা। তাছাড়া মেনস্‌ ডে, রিটার্ন অফ নিউ ইয়াম, বেকিং অফ ফয়েল উড আরও কত কি। অজস্র গোষ্ঠী আর তাদের অন্তহীন উৎসব। কথা বলে যা বুঝলাম, নাম আলাদা হলেও সবই ঐতিহ্যকে স্মরণ করে অশুভকে তাড়িয়ে শুভকে বরণ করার উৎসব। এইরকম যে কোনও ছুতোয় ছোট-বড় নানা উৎসব। আর উৎসব মানেই নাচ-গান আর ভোজ। নাচ এদের রক্তে। আধুনিক মলের সেলস বয় এক পাক নেচে তাক থেকে জিনিস পাড়ে। আবার ট্রাফিক পুলিশ দেখি মাঝে মধ্যে নাচের ভঙ্গিতে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে একঘেয়েমি কাটায়। 

একদিন গেলাম বাডাগ্রি। ওইদিনই প্রথম নিজেকে একটু ‘ট্যুরিস্ট’ বলে মনে হল। এখানে একা কেউ বেড়াতে যায় না। আমাদের সঙ্গে আর একটি পরিবারও যাবে। পথে যা খাওয়া হবে তার বিরাট আয়োজন দেখে একটু নিরাশ হলাম, কারণ স্থানীয় খাবার চেখে দেখার এমন সুযোগ মাঠে মারা গেল। ভাগ্যিস অভিজ্ঞরা আমার কথায় কান দেননি। মাইলের পর মাইল ধূ ধূ রাস্তার দু’ধারে নিরাপত্তার অভাবে এবং পর্যটন শিল্পের অনুপস্থিতির জন্য একটি দোকানও নেই। এমনকী ছোটখাটো কোল্ডড্রিঙ্কের দোকান পর্যন্ত নেই। 

Badagry
বাডাগ্রিতেই আছে আফ্রিকার প্রথম দোতলা বাড়ি

তবে উপচে পড়া প্রকৃতি দেখে মন ভরে যায়। লাগোসের গাছপালা প্রকৃতি সবই আমার চেনা। বিশেষ করে আমগাছ দেখেছি যেখানে সেখানে। আর অগস্ট মাসেও প্রচুর আম ফলে আছে। গাছের একদিকে মঞ্জরী অন্যদিকে ফল দেখে জিজ্ঞেস করে জানলাম এগুলো সবই বারোমেসে গাছ। তবে দুষ্টু ছেলেরা গাছ তছনছ করে আম পাড়ে না কেন, তার জবাব অবশ্য পাইনি। 

আটলান্টিকের একেবারে পাড় ঘেঁসে বাডাগ্রি। দাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে ঘানা বা সেনেগালের মতো বিখ্যাত না হলেও আফ্রিকার সবথেকে প্রথম দাস ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে বাডাগ্রির গুরুত্ব রয়েছে। সাড়ে পাঁচলাখ মানুষ এই বন্দরের মাধ্যমে পাচার হয়ে গিয়েছে। একেবারে আটলান্টিকের খাঁড়ির গায়ে বাডাগ্রি ভৌগোলিক কারণেই দাসব্যবসার প্রধান কেন্দ্র ছিল ১৭৫১ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত। আমরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেই ঐতিহাসিক জলরাশির সামনে।      

Museum Badagry
মিউজিয়মে দ্রষ্টব্য বলতে ক্রীতদাস প্রথা সংক্রান্ত যা কিছু

বাডাগ্রির মিউজিয়মে দ্রষ্টব্য বলতে ক্রীতদাস প্রথা সংক্রান্ত যা কিছু। দাসব্যবসার কথা না জানলে তো আফ্রিকার প্রায় কিছুই জানা হয় না। দেখলাম দাসেদের ব্যবহৃত লোহার শেকল, হাতকড়া, পায়ের বেড়ি। মানবশৃঙ্খল তৈরি করার জন্য হাড় ফুটো করার লোহার ঘুর্ণি শিক দেখে শিউরে উঠেছিলাম। এইখানেই আছে আফ্রিকার প্রথম দোতলা বাড়ি। খোলা উঠোনে দু’ধাপ সিঁড়ি দেওয়া দাসদের নিলাম মঞ্চ। নিলাম শেষে ক্রীতদাসের বুকে জ্বলন্ত লোহার শলাকা দিয়ে বিশেষ চিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্বপরিচয় মুছে যেত। বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে মানুষদের জন্তুর মতো তাড়িয়ে এনে নিলামের আগে যে গুদামের মতো বাড়িটায় রাখা হত সেটাও দেখলাম। লোহার একটা বিশাল কড়াই সাক্ষী দিচ্ছে, দাসেরা একসঙ্গে মুখ ডুবিয়ে কীভাবে জন্তুর মতো জল খেতে বাধ্য হত। দাসেদের প্রতি অত্যাচারের সচিত্র বিবরণী, অত্যাচার করার নানারকম যন্ত্রপাতি, দাসব্যবসার খোলাখুলি বিজ্ঞাপন, খবরের কাগজের কাটিং, সবই আছে। আর কী অবাক কাণ্ড! আফ্রিকান গাইড আলমারির মধ্যে রাখা কতকগুলো কড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এগুলো কওরি। সেইসময় টাকার কাজ করত।’     (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৯ মে ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, en.celebrity.tn, Autojosh, stock.adobe

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com