প্র্যাকটিস দেখছিল দেবদীপ। ক্লাবের মালি উৎপল ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, “বাইরে গাড়িতে বসে আছেন আপনার বাবা। বললেন আপনাকে খবর দিতে।” দেবদীপ পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখল বন্ধ। কাল রাতে ফোন চার্জড হয়নি নাকি? ফোন চার্জে বসিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়াতেই অলোকেশ বললেন, “আধ ঘণ্টা সময় আছে তোমার কাছে? কথা ছিল।”
দেবদীপ বলল, “ভেতরে এস।” রাজি হলেন না অলোকেশ, বললেন, “চলো বাইরে কোথাও গিয়ে বসি।” বসা হল লেকের ধারের একটা বেঞ্চে। নটা বেজে গেছে, প্রাতর্ভ্রমণে উৎসাহীদের ভিড় প্রায় শেষ, লেক অনেকটাই চুপচাপ। অলোকেশ জিজ্ঞেস করলেন, “কুর্চির কোনও খবর রাখো?”
– না। ফোন করলে ধরছে না। শুনেছি শান্তিনিকেতনের বাড়িতেও থাকে না আজকাল।
– কার কাছে শুনলে?
– ভাবছিলাম শান্তিনিকেতনে যাব। রাসুকে ফোন করেছিলাম, ওর কাছেই শুনলাম।
– ভাবছিলে তো গেলে না কেন?
দেবদীপ বুঝল কথা বলতে নয়, অলোকেশ জেরা করতে এসেছেন। একটু হাসিই পেল তার। বলল, “যাব তো। আগে অরিত্রকে হাসপাতাল থেকে বার করে আনি। মনে হচ্ছে, আজ-কালের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।”
– সেরে গেছে একদম? জিজ্ঞেস করলেন অলোকেশ।
– মাথার ক্ষতটা পুরোপুরি সেরেছে এখন, হাঁটা-চলা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। হাসপাতালে থাকতে চাইছে না আর, ছটফট করছে। এদিকে ডাক্তার কর বলছেন, মাঠে ফেরার মতো সুস্থ হতে এখনও সময় লাগবে। আপাতত বাড়ি ফিরে একটু দৌড়-ঝাঁপ শুরু করুক, জিম করুক, স্প্রিন্ট করুক। হাল্কা প্র্যাকটিসও শুরু করতে পারে। কিন্তু ম্যাচ ফিট হতে সময় লাগবে।
– অরিত্রকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করেছিলে, সেদিন কুর্চি ছিল তোমার সঙ্গে?
– অ্যাডমিশনের সময় কুর্চিকে দেখতে পাইনি। দেখার ফুরসৎও ছিল না। পরে নিচে নেমে দেখি, কুর্চি অপেক্ষা করছে।
– কুর্চির সঙ্গে সেদিন তোমার কথা হয়েছিল?
– হ্যাঁ, কুর্চি ছিল, অরিত্রর মা ছিলেন, ক্লাবের দু-চার জন ছিল। সবাইকেই জানাতে হয়েছিল কেমন আছে অরিত্র, ডাক্তাররা কী বলছে।
– কুর্চির সঙ্গে আলাদা করে সুজাতকে নিয়ে কি কোনও কথা হয়েছিল তোমার?
দেবদীপ স্পষ্ট আন্দাজ পেয়ে গেল কেন তাকে জেরা করতে এসেছেন অলোকেশ। শুরু করল নিজের খেলা। বলল, “মাথায় ইনজুরি। সুজাতদার কেস তো নয়…”
তাকে থামিয়ে দিয়ে অলোকেশ বলে উঠলেন, “তার পরে কি কুর্চি আর এসেছিল হাসপাতালে?”
– আমি বা অরিত্রর মা, ভিজিটিং আওয়ারে কেউ না কেউ তো রোজই থেকেছি। কুর্চিকে তো কেউই দেখিনি কোনও দিন।
– হাসপাতালে না এলেও কুর্চির সঙ্গে কোনও দিন কথা হয়েছে তোমার সুজাতকে নিয়ে?
– কুর্চিকে পেলাম কোথায়? নির্বিকার মুখে নির্ভেজাল মিথ্যেটাই বাবাকে বলল দেবদীপ। এবং জুড়ে দিল, “কিন্তু এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?”
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন অলোকেশ। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “তোমার কী মনে হয়? কেন কুর্চি বাড়ি ছেড়েছে? কেন সে সুজাতর ফোন ধরছে না? কেন কোনও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তার সঙ্গে?”
– বাবার ফোনও ধরছে না! জলের দিকে তাকিয়ে খুব নিচু স্বরে বলল দেবদীপ। তারপর অলোকেশের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, “কুর্চি নিজে ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর কি আর কেউ দিতে পারবে?”
চুপ করে গেলেন অলোকেশ। চৈত্রদিনের তাপ বাড়ছে। অনেকক্ষণ ধরে অক্লান্ত ডেকেই চলেছে একটা কোকিল। লেকের জলের ধারে বুড়ো অশ্বত্থের নিচে বসে ছেলের মুখের দিকে বাবা তাকিয়ে থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “সুজাত যদি সরেই যায়, সেটা কত বড় ধাক্কা হবে দক্ষিণীর কাছে?”
– বলা মুশকিল। ভেবেচিন্তে উত্তর দিল দেবদীপ, বোঝার চেষ্টা করল কৌতূহলটা আন্তরিক, নাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গেছে। বলল, “ক্লাবের নামের আগে যদি কোম্পানির নাম বসাতেই হয়, তাহলে দক্ষিণীর পক্ষে স্পনসর পাওয়া এখন হয়ত অসম্ভব নয়। তবে দেখতে হবে তারা কী চাইছে। তদের পছন্দের প্লেয়ার, তাদের মনের মত কোচ নিতে হবে, নাকি এসব স্বাধীনতা আমাদেরই থাকছে। আমাদের আগামী তিন বছরের প্ল্যান, আই লিগের সেকেন্ড ডিভিশনে খেলার স্বপ্ন তারা কীভাবে সাপোর্ট করবে, কতটা করবে সেটা বুঝতে হবে। জার্সিতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় লোগো তারা মানতে রাজি কিনা সেটাও জানা দরকার। আসলে, ঘরপোড়া গরু তো আমরা, তাই ক্লাব ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে নিজেদের স্বার্থ বাঁচানোর কথাই আগে ভাবছি। এদিকে দেশে ইন্ডাস্ট্রির যা হাল, আগে যারা আগ্রহ দেখিয়েছিল তারা যে এখনও রাজি আছে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।”
– তাহলে দু’দিক খোলা রেখেই চল। তোমাদের এখনকার স্পনসর থাকলে ভালো। কিন্তু সুজাত যদি সরে যেতেই চায়, দক্ষিণীর জন্যে একটা প্ল্যান বি-ও তৈরি রেখো। আর, জানাতে থেকো আমাকে। দেখাই তো পাওয়া যায় না আজকাল তোমার। অলোকেশ উঠতে উঠতে বললেন। থমকে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেন, সবে সবে কচি পাতা আসতে শুরু করেছে বুড়ো অশ্বত্থের ডালে।
বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অরিত্রর মাকে এবেলা স্কুলে যেতেই হবে। অলোকেশের জন্যে বেলভেডিয়ারে পৌঁছতে দেবদীপেরও একটু দেরি হয়ে গেল। অরিত্রর কেবিনের দরজা খুলেই হকচকিয়ে গেল দেবদীপ। শুয়ে আছে অরিত্র, ডাক্তার কর তার মাথার ক্ষত পরীক্ষা করছেন, তাঁকে ঘিরে জনা পাঁচেক সহযোগী। দাঁড়িয়ে পড়ল দেবদীপ, উদ্বেগের ছায়া ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে তার মুখে। মিনিট খানেকের মধ্যেই অরিত্রকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ডাক্তার কর। দেবদীপকে দেখতে পেয়ে বললেন, “মুখ শুকনো কেন? কালই ছেড়ে দিচ্ছি আপনার ফুটবলারশ্রীকে। কই, ওর মা আসেননি আজ?”
ডাক্তার কর বেরিয়ে যেতেই ছুটে গিয়ে অরিত্রকে জড়িয়ে ধরল দেবদীপ। বলল, “তোর মা তো এখন পরীক্ষার হলে। খবর দেওয়ার উপায় নেই। কুর্চিকে জানাবি না?”
– কী করে জানাব? আমার ফোন তো বাড়িতে, মার কাছে।
– তাহলে আর উপায় নেই। কুর্চি আজকাল আমার ফোন ধরে না।
অরিত্র অবাক হল, কিন্তু হল না। দেবুদার ফোনও ধরছে না? অবশ্য খাঁচা থেকে পালিয়ে কুর্চিকে অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা পুরনো হিসেব দিয়ে মেলানো যাবে না। প্রশ্নটা মনের মধ্যে মাথা চাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর পেয়ে গেল অরিত্র। কিন্তু শান্তিনিকেতনে রিহ্যাবের প্ল্যানটা তো দেবুদাকে বলতেই হবে।
অরিত্রর শান্তিনিকেতন প্ল্যান শুনতে শুনতে একরাশ বিরক্তি এসে ভিড় করল দেবদীপের মুখে। বলল, “কুর্চি এসে বলে গেল শান্তিনিকেতন চলো, আর তুইও নেচে উঠলি? কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছিস একবার, তবু তোর শিক্ষা হল না? আবার সেধে ঢুকতে চাইছিস বাঘের খাঁচায়? কী করবি, এবার যদি ভাড়াটে খুনি লাগায়? শান্তিনিকেতনে রিহ্যাব – যত্তসব! একটা কাজের ফিজিওথেরাপিস্ট পর্যন্ত পাওয়া যায় না, সেখানে রিহ্যাব।”
– তুমি তাহলে কুর্চির সঙ্গে কথা বলো।
– শুনলি না একটু আগেই বললাম, কুর্চি আজকাল আমার ফোন ধরে না? আমি কি টেলিপ্যাথিতে কথা বলব কুর্চির সঙ্গে?
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, দেবদীপের মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বার করে একবার অরিত্রর মুখের দিকে, একবার ফোনের দিকে তাকাল দেবদীপ। চোখে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে বলে উঠল, “কুর্চির ফোন!”
অরিত্র এক চোখ টিপে বলল, “ফোন, না টেলিপ্যাথি?”
ডাক্তার করকে ফোন করে এক্ষুনি খবরটা পেয়েছে, জানাল কুর্চি, তাই ফোন করছে দেবদীপকে। তারপর শুরু করল তার এতদিনের জমানো কথা। ইতিমধ্যে ফিজিওথেরাপিস্ট এসে অরিত্রকে ব্যায়াম করানো শুরু করে দিয়েছেন। ঘরের কোণের সোফায় বসে ফোন চালিয়ে গেল দেবদীপ। আধ ঘণ্টা কাটিয়ে ফোন যখন শেষ হল, ফিজিও ততক্ষণে তাঁর জিনিসপত্র গুটিয়ে ফিরে গিয়েছেন। দেবদীপ তার নিজস্ব ভুরু-তোলা ভঙ্গিতে অরিত্রর কাছে গিয়ে বলল, “বাব্বা, তোর জন্যে তো জান লড়িয়ে দিয়েছে কুর্চি। আমি অবশ্য এখনই শান্তিনিকেতনের রিহ্যাব প্ল্যানে হ্যাঁ বলতে পারিনি। দেখা যাক, কাল আবার কথা হবে কুর্চির সঙ্গে। ও অনেক খোঁজ নিয়েছে, আমিও কিছু খবরাখবর নিই। কিন্তু ভাবছি, এত কিছু হয়ে গেল, আর আমি টেরও পেলাম না, অ্যাঁ! সুমিত্রাদি জানেন?”
আঙুলে আঙুল জড়িয়ে দুটো হাত মাথার পেছনে নিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল অরিত্র। হাসতে হাসতে বলল, “কী করে জানবে? জানাবে তো তুমি।”