প্রেসিডেন্সির এমএ ক্লাসের আমরা একসময় হুজুগে মাতলাম একটা নাটক দাঁড় করাব বলে। কী নাটক? কী নাটক? হঠাৎ মাথায় খেলে গেল আলব্যের কামু-র অসাধারণ একাঙ্ক নাটক ‘ল্য মালাতঁদু’, যার চমৎকার ইংরেজি সংস্করণ তখন বাজারে এসেছে। নামকরণ হয়েছে ‘ক্রস পার্পস’, অর্থাৎ ভুল বোঝাবুঝি। তীব্র বেদনার এক নাটক, যেখানে ভুল বুঝে ঘরে ফেরা পুত্রকে মা ও বোন মিলে টাকা হাতানোর জন্য খুন করছে। যখন জানা গেল দীর্ঘকাল প্রবাসে থেকে টাকা করে ঘরে ফিরেছিল ছেলে শুধু মজা করার জন্য পরিচয় গোপন করে, সে এক বুকফাটা কান্নার পরিস্থিতি। স্বল্প পরিসরে এমন নাটক বুনেছিলেন কামু, যে পড়া শুরু করলেই ভয়ে বুক কাঁপে। পরিচালনার ভার পড়েছিল আমার ওপর এবং নাটকটা নিয়ে একটু ছড়িয়ে আলোচনার জন্য একদিন ফাদার পিয়ের ফালঁ-কে নিয়ে আসা হল ইংলিশ সেমিনার রুমে।
ফাদার ফালঁ তখন ইউনিভার্সিটির ফরাসি সাহিত্য বিভাগের কর্তা। সেন্ট জেভিয়ার্সে উনি আমাদের মরাল সায়েন্সও পড়িয়েছিলেন এবং সেই সূত্রে কিছুটা কিছুটা কামু নিয়ে বলেছিলেন। ‘ক্রস পার্পস’ নিয়ে এত সুন্দর বোঝালেন দু’তিন দিন, যে নাটকটা চোখের সামনে ভাসতে শুরু করল। কিন্তু নাটকটা আমাদের করা হল না। কারণ, সেটা ফরাসির অনুবাদ। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের হয়ে নাটক করতে হলে তা হতে হবে মূল ইংরেজিতে। তখন ফের নাটক খোঁজা শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত যে নাটকে সবাই সায় দিল তা ভাষায় ইংরেজি তবে মার্কিন দেশের। টেনেসি উইলিয়ামস-এর ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’। এই নাটক নিয়ে করা সিনেমাটাও তখন সবার চোখের সামনে ভাসছে, বিশেষ করে নায়ক স্ট্যানলি কোয়ালস্কি-র চরিত্রে মার্লন ব্র্যান্ডোর দুর্ধর্ষ অভিনয়।
আমাদের প্রেসিডেন্সির এমএ-র ছাত্রীদের মধ্যে সারাক্ষণ স্বপ্নে বিভোর রূপবতী নায়িকা ব্লঁশ দুবোয়া করার মতো কেউ নেই দেখে ইউনিভার্সিটির ইংলিশ এমএ-এর দীর্ঘাঙ্গী ও সুন্দরী কাশ্মীরি মেয়ে রীতা দার-কে বাছা হল। কিন্তু কোয়ালস্কি করবে কে? ওই শক্তপোক্ত, মারকুটে পুরুষালি রোল করার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছিল না আশপাশে। শেষে আমাদের মধ্যে কে একটা যেন নাম তুলল প্রেসিডেন্সিরই এক প্রাক্তনীর, যারও বিষয় ছিল ইংরেজি। ভালো ডিবেট করত, ইংরেজি ডেলিভারিটা খুব সাবলীল এবং চেহারাটাও সুন্দর। আর নাম? সুন্দর! সুন্দর চ্যাটার্জি।
যদ্দূর জানি সু্ন্দরের নাটকে অভিনয়েরও অভিজ্ঞতা ছিল। ও রাজিও হল এবং শিডিউল তৈরি করে সপ্তাহে দু’দিন করে রিহার্সালের সময়ও বার করা হল। রিহার্সালের জায়গা ঠিক হল পূর্ণ দাস রোডের সদ্য গড়ে ওঠা একটা নতুন বাড়ির খালি ফ্ল্যাট। সেটা কিনেছেন সেন্ট জেভিয়ার্সে থার্ড ইয়ারে পড়া আমাদের এক বন্ধুর বাবা। সেই ছেলে শিবনাথ সেনের মতো উদ্যোগী মানুষ খুব কম দেখেছি জীবনে। কফি হাউজে বসে আমাদের জায়গার সমস্যার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিল, “তিন মাসের মধ্যে আমরা ওই ফ্ল্যাটে যাচ্ছি না। তোমরা তদ্দিন ওখানে কাজ করতে পারো।” আমরা ওকেও একটা রোলে নিয়ে নিলাম।
চমৎকার চলছিল রিহার্সাল। সুন্দরকে বোঝানোর কিছু ছিল না। দিব্যি ঢুকে পড়েছিল কোয়ালস্কির চরিত্রে। একটা দৃশ্যে কোয়ালস্কি দেমাকের তোড়ে ব্লঁশকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিচ্ছে। সুন্দর এত সাবলীলভাবে করেছিল দৃশ্যটা যেন মার্লন ব্র্যান্ডো ঘুরছে ওর মগজে। এভাবে দিন তিনেক কাজের পর সুন্দর হঠাৎ রিহার্সালে ডুব দিল। সেটা পরপর দু’বার হওয়ার পর শুভরঞ্জন খোঁজ নিয়ে জানল যে ও আর এই নাটকে থাকতে পারছে না, কারণ সত্যজিৎ রায়ের আগামী ছবিতে ও নায়কের রোল করছে! আমাদের সবার মাথায় তো বজ্রাঘাত। এই নাটকটাও তাহলে বাতিল হল। ক’দিন পরই জানাজানি হল সত্যজিৎবাবু তাঁর নতুন ছবির কাহিনি বেছেছেন তরুণ লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং নায়ক সিদ্ধার্থের ভূমিকায় নিয়েছেন এক আনকোরা নতুন ছেলেকে, যার সিনেমার জন্য নতুন নামকরণ করেছেন ধৃতিমান। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। যাকে আমরা এতদিন চিনে আসছিলাম সুন্দর চট্টোপাধ্যায় বলে!
‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ না-হওয়াতে হতাশ তো আমরা হয়েইছিলাম, তবে ভেঙে যে পড়িনি তা এই জন্যই, যে খুব শিগগির আমরা তাল কষলাম খড়গপুর আইআইটি-র বাৎসরিক ইংরেজি নাট্য প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার। কফি হাউজে বসে আড্ডা হচ্ছিল নাটক করতে না-পারা আমাদের। হঠাৎ করে কে একটা খবর আনল আইআইটি-র কন্টেস্টের। অমনি রীতা, শুভ, কল্যাণী, সুক্তি এবং বন হই হই করে। এই বন নামের মেয়েটির পদবী সরকার, কিন্তু আসল নামটা মনে করা কঠিন। সে-সময় ব্রুক বন্ড Bon নামে এক নতুন কফি আনে বাজারে। সেই বন কফির বিজ্ঞাপনে মডেলিং করত মেয়েটা। মা কালীর মতো কালো রং কিন্তু কী অপূর্ব রূপসী! ফিল্মস্টার তব্বুর মতো একটা ব্যাপার।
বন-এর বিজ্ঞাপন থেকে বন-ই হয়ে গেছিল ও আমাদের কাছে। ও কোনও রোল নেবে না, কিন্তু ওরই মস্ত উৎসাহ, যাতে আমরা একটা নাটক নিয়ে খড়গপুর ঘুরে আসি। ওর কথায়, “This is more of a study of literature than attending class lectures.” আর ওর দাবি আমিই যেন নাটকটার ডিরেকশন দিই। বাকিরাও সেটা চাইতে দু’দুটো স্টেজের মুখ না-দেখা নাটকের পরিচালক আমাকেই ভার নিতে হল একটি চমৎকার, হিউমার ছড়ানো নাটকের, যার চরিত্র বলতে শেকসপিয়ার, রানি এলিজাবেথ, তাঁর একটি-দু’টি সহচরী ও এক সান্ত্রী।
কফির টেবিলে বসে ঠিক হয়ে গেল সত্যব্রত করবে শেকসপিয়ার। এই সত্যব্রত— আগেও বলেছি এই স্মৃতিকথায়— কেরিয়ার শেষ করেছিল পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে। তারপর হঠাৎ একদিন হৃদরোগে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। সকালের কাগজে কয়েক বছর আগে ওর মৃত্যুর খবরে প্রথমেই মনে ঝলকে উঠেছিল শেকসপিয়ারের মেক আপে স্টেজে ওর সেই চেহারা। রানির কাছে যখন স্বপ্নিল চোখে একটা ছড়ানো-বিছোনো নাট্যশালা দাবি করছে। ওই দৃশ্যের অভিনয়টা আমি বিশদে করে দেখাতে খুব খুশি হয়েছিল সত্যব্রত এবং মিষ্টি করে বলেওছিল ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।
এলিজাবেথের রোলটা করেছিল রীতা আর সান্ত্রীর ভূমিকাটা শুভ। বলতে নেই, তিন-চার দিনের প্রস্তুতিতে বেদম দাঁড়িয়ে গেছিল নাটক। আর আমরা যেদিন জনা দশেক ছেলেমেয়ে জড়ো হলাম হাওড়া স্টেশনে সেদিন কী যে এক মুক্তি আর স্ফূর্তির ঢেউ সবার মধ্যে, তা বলার বাইরে। রত্না (যার আসল নাম ভুলে আমরা ‘বন’ বলেই ডাকি) আর কল্যাণী (যারও একটা ডাকনাম ছিল ‘শিপস্’) ম্যানেজারির দায়িত্ব নিয়ে নিল। আর দলের তিন ছোকরা সত্যব্রত, শুভ, অশোক সিনহা ও আমি ওদের খচাতে লাগলাম ট্রিপটাকে খড়গপুর হয়ে দিঘায় নিয়ে শেষ করতে! গোটা রেল জার্নিটা এরকম ইয়ার্কি-ফাজলামি করেই কেটে গেল। একসময় রীতা বলেই ফেলল, “তোমরা যা করে যাচ্ছ আমি হয়তো ডায়ালগগুলো সব ভুলেই বসব।”
আইআইটি-র সেই নাটক বহুত হাততালি আর হাসি কুড়িয়েছিল, কিন্তু পুরস্কারের কপাল ছিল না আমাদের। কারণ তখনকার ধুরন্ধর ইংরেজি নাট্যকর্মী নীরেন্দু দত্তমজুমদার ওর তুখোড় দল, প্রফেশনাল ব্যাকড্রপ, লাইটিং, সাজসরঞ্জাম নিয়ে পৌঁছে গেছিল। আর ওদের নাটকও সেই সময়ের নিত্য আলোচিত এডোয়ার্ড অলবি-র ‘জ়ু স্টোরি’। তবে পুরস্কার ঘোষণার পর দর্শকদের অনেকেই এসে আমাদের কাজের খুব তারিফ করে গেলেন। একজন তো বিশ্বাসই করলেন না আমরা সবাই একই ক্লাসের স্টুডেন্ট আর আমরা নাটকটা দাঁড় করিয়েছি চার দিনে! তবে নাটকের চেয়েও যেটা মনে দাগ কেটে বসে, সেটা রাতের পর আমাদের দল করে ক্যাম্পাস বেড়ানো। কী হাসিমস্করা, হইহই আর গান! আমাদের বয়েস সেদিন কমল না বাড়ল ভগাই জানে। ওই তীব্র আনন্দের মধ্যেই রত্না, থুড়ি, বন আমায় এক পাশে ডেকে খারাপ খবরটা দিল। বলল,
— কী বিউটিফুল সময় কাটছে আমার ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু আগামী মাসেই আমায় চলে যেতে হবে আমেরিকা। বর সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রত্না যে বিবাহিত সেটা জানা ছিল। সুরুলের জমিদারবাড়ির মেয়েটির মধ্যে একটা শান্তিনিকেতনী ভাবের সঙ্গে নিপুণ সহবাসে থাকত একটা আধুনিক বিলিতি মেজাজ। রবীন্দ্রনাথ ও ইংরেজিয়ানার মিশেলে ওর একটা স্নিগ্ধ টক্কর ছিল বন্দনার সঙ্গে, আর এই দু’জনের সঙ্গেই কাটানো সময়গুলো আমাকে ঋদ্ধ করেছিল। ওর চলে যাওয়ার কথার ধাক্কাটা সামলাতে তাই বলেছিলাম,
– তাহলে তো তোমার একটা ট্রিট পাওনা হয়।
একটু জোর করেই ও হেসে বলেছিল,
– কী রকম?
– এই ধরো কফি হাউজে একটা লাঞ্চ।
ও বলল:
– না, ট্রিটটা দেব আমি। আর সেটা কফি হাউজে নয়, পার্ক স্ট্রিটে কোথাও।
– তাহলে আমার কী করণীয়?
রত্না, থুড়ি বন, অনেকক্ষণ পর এই প্রথম হেসে বলল,
– একটা বই দিও।
রত্না আমেরিকা পাড়ি দেবার আগে এক অপূর্ব ডিনার খাওয়াল আমাকে ম্যাগনোলিয়ায়। ব্যান্ডের কাছে রিকোয়েস্ট রেখেছিলাম, ‘কে সেরা সেরা, হোয়াটএভার উইল বি, উইল বি’ গানটার জন্য। ওরা রেখেওছিল। আর ওই গানের সময় আমি ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম উপহারের বইটা—
আঁতোয়ান দ্য স্যান্তাকস্যুপেরির ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Deccan Herald, Scroll, Tripadvisor, Gulf News
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।