নিজেদের এক ফালি জমি নেই। তবু অরগ্যানিক চাষবাসের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন ভূমিহীন এক দম্পতি। কেরালার কে পি ইলিয়াস এবং মহারাষ্ট্রের শমিকা, এই স্বামী-স্ত্রী যুগল দাম্পত্য জীবনে তাদের যৌথ ভালোলাগার বিষয়ে কাজ করে আজীবন সুখে কাটানোর অঙ্গীকার নিয়েছেন। কী সেই ভালোলাগার বিষয় যা নিয়ে বিপুল উৎসাহে কাজ করে যাচ্ছেন এই যুগল? তা হল অরগ্যানিক ফার্মিং বা জৈব পদ্ধতিতে চাষবাস। অরগ্যানিক চাষবাসের জগতে তাঁরা এনেছেন নতুন ভাবনার জোয়ার। কিছু বছর ধরে এই দেশে চুপি চুপি ঘটিয়ে ফেলেছেন এক কৃষি বিপ্লব। অভিজ্ঞ কৃষকদের পরামর্শ দেবার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও অরগ্যানিক ফার্মিং এর প্রতি আগ্রহ গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এত কিছু তারা করছেন বটে, কিন্তু তাঁদের নামে নেই এক খণ্ড জমিও।
অরগ্যানিক ফার্মিং-এ দু’জনেরই আগ্রহ বিয়ের আগে থেকেই। বলা ভালো, দু’জনের এই এক রকম
বিষয়ে কৌতূহল থেকেই তাঁদের যোগাযোগ, পরস্পরকে ভালো লাগা এবং প্রেম। কেরালার কোজিকোডে জেলায় চেরুভন্নুর গ্রামের নেহাতই দরিদ্র এক পরিবারের ঘরের ছেলে ইলিয়াস। ইলিয়াসের বাবা কারখানার শ্রমিক ছিলেন। ‘আমার শৈশবের দিনগুলো খুব একটা সুখের ছিল না। দারিদ্র্য তো নিত্যসঙ্গী ছিল। এমনকী মাধ্যমিকেও আমি ফেল করি। শুধু ভালো আঁকতে পারতাম। আমায় একটা আঁকা সংক্রান্ত কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল আমার মা। শহরের ব্যানার, পোস্টার এসব আঁকার কাজ। যেখানে কাজ করতে যেতাম তার পাশেই একটা দোকান ছিল, একোয়ারিয়াম আর নার্সারির। দোকানের মালিকের নাম ছিল জোজি, চাষবাস সংক্রান্ত অনেক বই সংগ্রহ করতেন তিনি। ‘ওরে ভূমি ওরে জীবন’ নামে একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনও রাখতেন । সেখান থেকেই প্রথম অরগ্যানিক ফার্মিং-এর ব্যাপারে আমি জানতে পারি’ জানান ইলিয়াস।
এই আগ্রহই পরে তাঁর জীবিকা হয়ে গেল। তৈরি হল তাঁর নিজস্ব সংগঠন ‘কেরালা জৈব কর্ষক সমিতি’ এই বেসরকারি সংস্থাটি রাজ্যের জৈব কৃষকদের একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করে আসছে। এভাবেই ইলিয়াসের জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করল। ‘২০০২ সাল থেকে নানা অনুষ্ঠান আর কর্মশালায় যোগদান করে আসছি। অরগ্যানিক ফার্মিং-এর ব্যাপারে নানা বিস্ময়কর তথ্য জানতে পেরেছি, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যা আমায় মুগ্ধ করেছে তা হল, কোনও রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াও কীভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব’ জানান ইলিয়াস।
সার ও কীটনাশকের বিষক্রিয়ার জন্য নানা দুর্ঘটনার সাক্ষী আছে কেরালাবাসী। ইলিয়াস এই বিষয়ে নানা ইকো ক্যাম্প আয়োজন করতে শুরু করেন। একসময় নিজেই চাষবাস করবেন স্থির করেন। চাষবাসে তাঁর এত উৎসা দেখে তাঁর বন্ধুরা নিজেদের কিছু জমি তাঁকে দেন চাষের জন্য। নানা জায়গা ঘুরে দেশীয় নানা ধরণের বীজ সংগ্রহ করে সেগুলি সংরক্ষণ করে রাখার কাজ শুরু করেন। অরগ্যানিক ফার্মিং-এর ওপর সারা দেশব্যাপী নানা মিটিং কনফারেন্স- এ যেতেন তিনি। এভাবেই আলাপ হয় শমিকার সঙ্গে।
শমিকার জীবনের সঙ্গে অনেকটাই অমিল ছিল ইলিয়াসের জীবনের। শমিকা বেশ শিক্ষিতা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে বায়োডাইভারসিটি নিয়ে স্নাকতোত্তর তিনি। অনেক ভাল ভাল চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘অরগ্যানিক ফার্মিং অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’তে কাজ করছেন, শুধুমাত্র অরগ্যানিক ফার্মিং নিয়ে কাজ করতে চান বলে। কুর্গে, কফি চাষ নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর পিএইচডির সময়ে বিদর্ভর কৃষক আত্মহত্যা বিষয়টি তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে, তিনি গবেষণার কাজ ছেড়ে কৃষকদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে শুরু করেন।
‘ওঁর আমার দু’জনেরই পরিচিত এক বন্ধু আমায় ওঁর নম্বর দিয়েছিল, এমনিই যোগাযোগ করেছিলাম।আমাদের দু’জনেরই অনেক বিষয়ে মিল প্রথম থেকেই আমরা লক্ষ করেছিলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অরগ্যানিক ফার্মিং, কৃষকদের উন্নয়ন সবগুলোতেই আমাদের দু’জনের এত যৌথ আগ্রহ যে ভাব জমতে বেশিদিন লাগেনি’ আলাপ শুরুর দিনগুলি সম্পর্কে জানান ইলিয়াস। এরপর তাঁরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছেন, বিয়েটাও সেরে ফেলেছেন। ২০১৮ সালে অরগ্যানিক খাদ্যদ্রব্যের দোকান খুলেছেন এই দম্পতি। কেরালা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কর্ণাটকের কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য এনে বিক্রি করেন তাঁরা কিন্তু সেগুলিতে দেওয়া থাকে কৃষকদের যাবতীয় তথ্য যাতে ক্রেতারা তাঁদের থেকে সরাসরি কিনতে পারেন।