সৃজনী কী বলে আমায় চমকে দিল?
সেটা বলবার আগে এই মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের গল্পটা সেরে ফেলি।
ঘটনা দু’বছর আগের। তার একটু কমও হতে পারে। একদিন দুপুরে ভাতের হোটেল থেকে ঘরে ফিরে ঘুমোনোর আয়োজন করছি। এমন সময় দরজায় খটখট। আমি খুব বিরক্ত হলাম। ঘুমোনোর সময় কে জ্বালাতে এলও রে বাবা?
একথা শুনলে কেঊ মনে করতে পারে, আমি রোজই দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ভুড়ি ভাসিয়ে ঘুম মারি। ঘটনা তা নয়। অনেক দুপুরেই আমাকে রোজগারপাতির ধান্ধায় বেরোতে হয়। টিউশন, প্রুফ দেখা, অড জবস্ থাকে। হাবিজাবি আরও কাজ ঘাড় পড়ে। সেসব আবার বিনি পয়সার খাটনি। বেকারদের কাজের চাপ খুবই বেশি। সবাই জানে, বেকার মানে বিরাট আরাম। কাজ বলতে গলির চায়ের দোকানে বসে ঘন ঘন চা সিগারেট, আর বাড়ি ফিরে হাই তোলা। তাও আবার নরমাল হাই নয়, আড়মোড়া ভাঙা হাই। এদের ছেড়ে রাখা উচিত নয়। দোকান-বাজার, ট্রেনের টিকিট, আধার কার্ডের লাইনে পাঠিয়ে দিতে হয়।
‘ঘরে বসে কী করবি? হাইও তো একসময়ে ফুরিয়ে যাবে। তার চেয়ে যা বরং কোনও একটা লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়।’
‘কোন লাইলে দাঁড়াব দাদা?’
‘এটা কেমন কথা হল? গরিব দেশে লাইনের অভাব? রেশন, কেরোসিন, জল, হাসসপাতাল, এটিএম, পেটিএম, ঘেটিএম যেখানে লাইন পাবি দাঁড়িয়ে যাবি।’
‘ঘেটিএম! সেটা আবার কী লাইন!’
‘ঘেটিএম লাইন হল পাবলিকের ঘাড় মটকানোর লাইন। যাই হোক, তুই দেরি না করে বেরিয়ে পড়। হাতের কাছে যে লাইন পাবি দাঁড়িয়ে পড়বি ফট্ করে।’
আমার এই ঝামেলা কম। মোবাইল ফোন নেই বলে চট করে কেউ ধরতে পারে না। আমার বাড়ির ঠিকানাও বেশি মানুষ জানে না। তারওপর মাঝে মাঝে আমি ‘তালা ভড়কি’ দিয়ে রাখি। ‘তালা ভড়কি’ হল ভিতরে আছি কিন্তু বাইরে তালা। দরজার কড়ায় তালা মেরে পিছনের বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকি। এই কাজ সবসময় করতে পারি না। বাড়ির পিছনে আসতে গেলে পাঁচিল টপকাতে হয়। তারপর আমার ঘরের বারান্দা। সেখানে রেলিং। সেটাও টপকাতে হয়। একদিন বাড়িওলা ভদ্রলোক আমাকে ধরলেন।
আমি গদগদ হয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন মেসোমোশাই? কয়েকদিনের মধ্যেই বকেয়া ভাড়া সব মিটিয়ে দেব। শুধু বকেয়া নয়, ভাবছি এক মাসের অগ্রিমও দিয়ে রাখব। কেমন হবে?’
বাড়িওলা অনেকদিন থেকে আমার ধারবাকির অত্যাচার সহ্য করে আসছেন। বহুবার আমি তাকে ভাড়া মিটিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং রাখতে পারিনি। অন্য যে কোনও বাড়িওলা হলে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিত। এই ভদ্রলোক দেননি। একবার আমি নিজেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। চারমাসের ভাড়া বাকি পড়েছিল। কঁাধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বাড়িওলাকে গিয়ে বললাম,‘মেসোমোশাই চললাম। চারমাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। এরপর আপনার ঘরে থাকাটা লজ্জার ব্যাপার।’
বাড়িওলা থমথমে গলায় বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
আমি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলেছিলাম,‘এখনও পাকাপাকি ভাবে কিছু ঠিক করতে পারেনি। ভাত-ডাল রেস্টুরেন্টের এক কর্মী বলেছে, কটাদিন ওর ঘরে থাকতে দেবে। তবে দিনে নয়, রাতে। রাত বারোটার পর। বাকি সময়টা কোনও পার্কে টার্কে কাটিয়ে দেব। পার্কগুলো আজকাল খুবই সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে। মনে হয়, আমার মতো মানুষদের কথা ভেবেই করেছে। মেসোমোশাই, চিন্তা করবেন না, আমার জিনিসপত্র আপনার এখানেই রইল। ভাড়া মিটিয়ে তবে নিয়ে যাব।’
বাড়িওলা ভদ্রলোক আরও গম্ভীর গলায় বলেছিলেন,‘সাগর, তোমাকে কে বাড়ি ছাড়তে বলেছে? আমি?’
আমি তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলি, ‘ছিছি। আপনি কেন বলবেন মেসোমোশাই? আপনি সেরকম মানুষই নন। সেটাই আমার কাছে বেশি লজ্জার। আমি নিজে থেকেই বিদায় নিচ্ছি। বলতে পারেন, নিজেই নিজেকে তাড়াচ্ছি।’
বাড়িওলা সেদিন জোর ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘চোপ্, একদম চোপ্। অনেক হয়েছে। ভাড়াও বাকি রাখবে আবার আমার সঙ্গে ফাজলামিও করবে? ছোকরা তোমার সাহস তো কম নয়। যাও, দূর হয়ে যাও।’
সেদিন রাত আটটার সময় এর থেকেও বেশি জোর ধমক দিয়ে আমাকে পাড়ার পার্ক থেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিলেন।
‘সাগর, তুমি জানও আজ কী বার? জানও তুমি?’
আমি আমতা আমতা করি। বলি,‘মনে হয় সোমবার।’
ভদ্রলোক চোখ পাকিয়ে বলেছেন,‘তাহলে? তুমি জানও না, সোমবার বাড়ির বাইরে গেলে গৃহকর্তার অকল্যান হয়? জানও না ?’
আমি মাথা চুলকে বলি,‘সরি, জানতাম না।’
‘অলস, অর্কমণ্য, অশিক্ষিত ছেলে শাস্ত্রের কথা জানবে কী করে? চল এক্ষুনি বাড়ি চল । কিন্তু খবরদার কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন তোমাকে আর দেখতে না পাই। ’
বাড়ি ফিরে জানতে পারি, সেদিনটা মোটেও সোমবার ছিল না, ছিল বুধবার। বাড়িওলা ভদ্রলোক আমাকে হাবিজাবি বলে ফিরিয়ে এনেছেন। বকেয়া ভাড়া ফিরিয়ে দেওয়া যায়, এই ভালবাসা কি ফেরানো যায়? আমার অনেকদিন থেকেই বিশ্বাস, সামনে যতই রাগ দেখান, এই মানুষটা নিজের ভিতরে একজন ছন্নছাড়া, অলস সাগরকে পালন করেন। তাকে ভালবাসেন। সেদিন এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল।
যাক, পাঁচিল টপকানোর প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
বাড়িওলা আমার ভাড়ার কথায় বিন্দুমাত্র গা না করে বললেন,‘সাগর, তুমি নাকি কোনও কোনওদিন পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকও? এই কথা কি সত্য?’
আমি হাত কচলে বলি,‘আধখানা সত্যি।’
‘আধখানা সত্যি মানে! তুমি কি আধখানা পাঁচিল টপকাও?’
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম,‘মেসোমোশাই, এটা তালা-ভড়কি।’
‘কী ভড়কি?’
আমি বলি,‘তালা ভড়কি। দরজায় তালা আছে, কিন্তু তালা নেই।’
বাড়িওলা চোখ পাকিয়ে বলেন,‘আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ?’
আমি বলি,‘আত্মগোপন করবার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে এই পথ নিতে হয়েছে। দরজায় তালা দিয়ে আমি বারান্দা টপকে ঢুকি মেসোমোশাই।’
বাড়িওলা দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে ওঠেন।
‘দেখ সাগর, তোমার অনেক বেয়াদপি সহ্য করছি, কিন্তু নিজের বাড়িতে চোরের মতো ঢোকবার বেয়াদপি সহ্য করব না। যদি আর কখনও এই ঘটনার কথা শুনতে পাই, তাহলে তোমাকে বাড়ি থেকে শুধু বের করে দেব না, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব। সেটা কি তোমার জন্য ভাল হবে?’
এরপর থেকেই আমি ‘তালা ভড়কি’ সিস্টেমে যাবার সময় সাবধান থাকি। পাঁচিল টপকানোর সময়ে কেউ যেন দেখে না ফেলে। বাড়িওলাকে রিপোর্ট না করে।
আমার রোজগারের কোটা আছে। সাপ্তাহিক কোটা। রোজগারের সেই কোটা পুরণ হয়ে গেলে আমি গুটিয়ে যাই। আসলে জীবন দু’রকম। সিংহের জীবন এবং ইঁদুরের জীবন। পেট ভরা থাকলে সিংহ শিকার ধরে না। সে শুয়ে বসে কাটায়। তখন তার অলস জীবন, অখন্ড অবসর। মাঝে মাঝে এত বড় হাই তোলে যে মনে হয়, আস্ত পৃথিবীটা কোৎ করে গিলে নেবে। নেহাত গিলছে না তাই। তার থেকে ঝিমোনো ভাল। ঝিমোলেও তো সে জঙ্গলের রাজাই। আর ইঁদুরেরবেলায় ঘটনা উলটো। পেট ভরার পরও সে খাই খাই করে যায়। এদিকে ছোটে, ওদিকে ছোটে। শেষ পর্যন্ত কলে পা আটকে পড়ে। সুতরাং নিজেকেই বেছে নিতে হবে আমি কোন জীবন চাই। সিংহ না ইঁদুর?
একবার রেবাকে এই কথা বলে এমন একটা ভান করেছিলাম যেন আমি বিরাট মাতব্বর কেউ। বড় দার্শনিক। রেবা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিল,‘এটা
একটা খুবই নিম্নমানের দর্শন। ইন ফ্যাক্ট আমার ধারনা এটা কোনও দর্শনই নয়। যাই হোক, তুমি নিজেকে কী মনে করও সাগর? সিংহ?’
রেবার বিদ্রুপে আমি বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে গা জ্বালানো হাসি। বলি,‘না, আমি সিংহের থেকে একটু বেশি রেবা।’
রেবা ভুরু কুঁচকে বলল,‘সিংহের থেকে বেশি মানে!’
আমি বললাম,‘সিংহ পুরো পেট ভরলে তবে বিশ্রামে যায়, আমি আধপেটাতেই খুশি থাকতে জানি। খুশি থাকাটা শুধু শরীরের বিষয় নয়, মনেরও বিষয়। চারপাশের দুনিয়াটা যখন শরীর শরীর করে পাগল হয়ে যাচ্ছে, আমি নিজেকে নিয়ে একধরনের এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে রয়েছি।’
‘এক্সপেরিমেন্টে তুমি কি সফল?’ রেবা জানতে চায়।
আমি হেসে বলি,‘অবশ্যই নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার। এক জীবনে তার ফল নাও পাওয়া যেতে পারে। একজনের পর আরেকজন এসে কাজ শুরু করে। এই ক্ষমতা না আছে সিংহের, না ইঁদুরের।’
রেবা কড়া গলায় বলেছিল,‘এসব প্যাঁচ মারা কথা বলে তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিতে চাইছো সাগর। আমাকে ইমপ্রেস করতে চাইছ। এটাও তোমার একধরনের এক্সপেরিমেন্ট। একসময়ে এতে তুমি খানিকটা সফল হতে, কিন্তু এখন আর হবে না। আমি আর কোনও কিছুতেই তোমার প্রতি ইমপ্রেসড হব না। অতএব এখানেই আমি এই আলোচনার ইতি টানছি।’
রেবার এসব বানানো কথা। ও সবসময়েই আমার প্রতি মুগ্ধ। কুয়াশার মতো সেই মুগ্ধতা তাকে ঘিরে থাকে। কখনও আবছা, কখনও ঘন। আমারই লজ্জা করে। রেবার মতো মেয়ের এত ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।
সেদিন দরজা খুলে দেখি মনোজ। তমালের গাড়ির চালক। কোনও জরুরি খবর দেওয়ার থাকলে তমাল তার চালককে দিয়ে চিঠি পাঠায়। আমার দরকারে টাকাও পাঠিয়েছে অনেকবার। ঘুমোনোর সময় এসেছে বলে বিরক্ত লাগলেও, মনোজের ওপর রাগ দেখাতে পারি না।
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘দাও, দেখি কী চিঠি এনেছ।’
মনোজ বেজার মুখ করে বলল,‘চিঠি নেই, স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। গাড়িতে যাবেন।’
আমি থমকে যাই। এই ভরদুপুরে তমাল আমাকে অফিসে ডাকছে কেন? আবার কোনও চাকরি বাকরি ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেবে নাকি? তাহলে তো মস্ত ঝামেলা। গিয়ে হয়তো দেখব, অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে বসে আছে। পালাবার পথ পাব না।
‘মনোজ, তোমার মোবাইল ফোনটা দাও তো তোমার স্যারকে একবার ফোন করি।’
মনোজ আমতা আমতা করে বলল,‘স্যার আপনাকে ফোন করতে বারণ করেছেন।’
আমি বললাম,‘ঠিক আছে আমি করব না, তুমি কর।’
মনোজ থতমত খেয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। আমি বললাম,‘তোমার চিন্তা কী? তোমাকে তো তোমার স্যার ফোন করতে বারণ করেনি।’
মনোজ তারপরও দোনামোনা করতে লাগল। আমি নরম গলায় বললাম,‘দেখ মনোজ, আমি তোমার স্যারের সঙ্গে কথা না বলে ঘর থেকে বেরোব না। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। দুপুরের ভাত-ঘুম। তুমিও ইচ্ছে করলে আমার পাশে শুয়ে পড়তে পারও। বিকেল উঠে এক কাপ চা খেয়ে তারপর না হয় ফিরে যাবে।’
কথা শেষ করে আমি হাই তুললাম। সিংহ হাই নয়, ইঁদুর হাই। খুবই ছোটো।
আমার শান্ত ভঙ্গি দেখে সম্ভবত মনোজ বুঝতে পারল, ফোন না করে উপায় নেই। সে ফোন কানে তুলল।
একবারেই বসের লাইন পেয়ে গেল মনোজ। এটাই নিয়ম। সবাই নিজের গাড়ির চালকের ডাকে আগে সাড়া দেয়। আমি নিশ্চিত খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও যদি তার গাড়ির চালক কখনও ফোন করেন, তিনি জরুরি মিটিং বাদ দিয়ে সেই ফোন ধরবেন। মহাভারতের যুগে যদি মোবাইল ফোন থাকত তাহলে অর্জুন এর ব্যতিক্রম হতেন না। শ্রীকৃষ্ণের ফোন পেলে আগে ধরতেন।
মনোজ ফোন ধরলেও তমালের সঙ্গে কথা বললাম আমি।
‘কী হয়েছে? ডেকেছিস কেন?’
তমাল চাপা গলায় বলল,‘সাগর, একটা মেয়েকে কটাদিন তোর কাছে লুকিয়ে রাখতে হবে।’
আমি আঁতকে উঠলাম। তমাল এসব কী বলছে!
গত পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/sagar-i-love-you-bengali-novel-by-prachet-guptapart-3/
২য় পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/novel-by-prachet-gupta-2/
প্রথম পর্বের লিংক – https://banglalive.com/novel-by-prachet-gupta/