অল ইংল্যাণ্ড লন টেনিস ক্লাবের চেয়ারম্যানের মতো কেউকেটা একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মতো চুনোপুঁটির মিলটা ইদানীং কোথায় বলুন তো পারলেন না তো না পারাটাই স্বাভাবিক এটা তো আর ট্রাডিশন্যাল জি.কে–র আওতায় পড়ে না। এটা হল এলিমিনেটিং কোশ্চেন। মোদ্দা কথা হল আমরা দুজনেই হেভি টেনশনে আছি। টেনশনের কারণ আবার কী ২০১৮–র রাশিয়া বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে ইংরেজদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ চড়চড় করে উঠছে – পাল্লা দিয়ে চেয়ারম্যানেরও সুগার–প্রেসারের কাঁটা উর্দ্ধমুখী। হ্যাটট্রিক করে সোনার বুটের আশায় হ্যারি কেন দাঁত ক্যালাচ্ছে আর এদিকে উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে ‘হ্যারিকেন’ আছড়ে পড়ছে। পনেরোই জুলাই – বিশ্বকাপ আর উইম্বলডন ফাইন্যাল – দুটো মেগা ইভেন্ট একদিনেই – প্রায় একই সময়ে। মখমলের মতো সবুজ ঘাসের গালচে, দুধ সাদা পোষাক আর স্ট্রবেবির ঐতিহ্যে স্যান্ডুইউচ হয়ে থাকা উইম্বলডনে তো ইচ্ছা করলেও ডেট চেঞ্জ করায় উপায় নেই। এখন ভাবুন তো – যদি কপাল গুণে ইংল্যাণ্ড – ব্রাজিল কিংবা ইংল্যাণ্ড – ফ্রান্স ফাইন্যাল হয় তাহলে ফেডেরার – নাদালের টেনিস ফাইন্যাল দেখতে যাবে টা কে দর্শকাসন খাঁ খাঁ – রয়্যাল বক্সে রাজপরিবার আর হাতে গোনা কয়েকটা লোক বসে বসে মাছি মারছে। বলা যায় না রানীও হয়তো ব্রেক চলাকালীন স্মার্ট ফোনে বিশ্বকাপ ফাইন্যালে উঁকি ঝুঁকি মারছেন। কানাঘুষোয় এটাও শোনা যাচ্ছে চোট টোট ফ্যাক্টর নয়, বিশ্বকাপে মাঠে থেকে সাউথগেটের টীমকে তাতাবার জন্যই নাকি অ্যাণ্ডি মারে এবারের উইম্বলডন থেকে নাম তুলে নিয়েছেন।
আমার অবস্থা অনেকটা এই রকমের। গ্রুপ লিগ অবধি কোন রকমে সামাল দিয়ে ছিলাম, নক্ আউটে এসে আর পারা যাচ্ছে না। যেমন ধরুন ভোরবেলা খাটাল থেকে দুধ আনতে গেছি। দুধ দোয়াবার নর্ম্যাল টাইম সাড়ে ছটা – ছটা চল্লিশ ডেড লাইন। তার মধ্যে না পৌঁছালে দুধ পাওয়ার ব্যাপারে কোনো গ্যারেন্টি নেই আর পেলেও সজল চোখে সজল সেই দুধ নিয়ে আসা। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেখছি উলোট পুরাণ। সাড়ে ছটায় গিয়ে দেখি আগের ব্যাচের লোকেরাই দুধ পান নি। বসার জন্য পেতে রাখা চারটে বেঞ্চির সবকটাই রিজার্ভড্। দু–চারজন আশে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম এরা আর.এ.সি – মানে আমি ওয়েটিং–এ আছি। পৌনে সাতটা নাগাদ খাটাল মালিকের দুই সুপুত্র হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে নিতান্ত অনিচ্ছায় বালতি নিয়ে ফিল্ডে নামতেই সবাই হঁ হাঁ করে ওঠে, “কী ব্যাপার হে এত দেরী”
করুণার চোখে দুধপ্রত্যাশী জনগনের দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রাতৃদ্বয় ইনস্টলমেন্টে উত্তর দেয়, “ বিশ্বকাপ … টাইব্রেকার …… রাত আড়াইটে….।”
অফিসে গিয়েও কি আর বিশ্বকাপ ফাঁড়া থেকে নিস্তার পাবার জো আছে বড়বাবুর মেয়ে জামাই নাকি বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়া গেছে আর কপাল পুড়ছে আমাদের। ভাগ্যদোষে আমার চেয়ারটা বড়বাবুর পাশেই হওয়ায় রাশিয়া দর্শনের ধারাবিবরণী আমাকেই গিলতে হয়। এই যেমন দিন চারেক আগে বললেন, “বুয়েছ কিনা জয়ন্ত, একখানা দেশ বটে রাশিয়া। আমার মেয়ে জামাই যে হোটেলে আছে না, সে এক রাজপ্রাসাদ – আমাদের দেশের ফাইভ স্টার হোটেল কোথায় লাগে ব্রেকফাস্টে কফি দেয় অরিজিন্যাল সিলভার কাপে – ভাবতে পারো” আচ্ছা এরপর প্লাস্টিকের কাপে চা খেতে গিয়ে বিষম লাগবে না গত পরশু অফিস পৌঁছে ব্যাগ–ছাতা সবে টেবিলের উপর রেখেছি– অমনি পাকড়াও করলেন আমাকে, “কাল কী কাণ্ড হয়েছে জানো আমার নাতি গোটা বেলজিয়াম টিমের অটোগ্রাফ নিয়েছে। ওদের ক্যাপ্টেনটা – হ্যাজার্ড না ব্যাজার্ড নাতির গাল টিপে চকলেট দিয়েছে।” স্পষ্ট শুনতে পেলাম পাশের টেবিল থেকে নিলয় ফুট কাটল, ‘‘এতটা গুল হজম করতে পারবেন না জয়ন্তদা, অ্যান্টাসিড খেয়ে নেবেন।”
সেরাটা বড়বাবু দিলেন আজকে, “বুয়েছ জয়ন্ত, কাল যা হয়েছে সে তো সাংঘাতিক।” চোখ মুখে বিষ্ময়ের সমুদ্র ফুটিয়ে বললাম, “এবার কি মেসি গাল টিপেছে” ‘‘আরে না না ;— আমার নাতিটা বুয়েছ কিনা ওদের হোটেলের লনে ফুটবল নিয়ে প্র্যাকটিস করছিল। ব্যস্ – রিয়্যাল মাদ্রিদের কোন কর্মকর্তার চোখে পড়েছে – বলেছে এ তো গড্ গিফ্টেড ফুটবল ট্যালেন্ট। স্পেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি; রিয়্যাল মাদ্রিদের জুনিয়র টীমে নাকি ঢুকিয়ে দেবে। কী করা যায় বলো তো।” বলব কী, আমি ভাবছি এ জিনিস হজম করার জন্য উপযুক্ত হজমি কোথায় পাই
সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরেছি; জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ পাই নি – কলিংবেলের উপর্যুপরি আর্তনাদ। দরজা খুলতেই দেখি এলাকার স্বঘোষিত সিন্ডিকেটজ্ঞ মস্তান পল্টুদা। সঙ্গে ডাইনে – বাঁয়ে – সামনে – পেছনে ফেউ–এর দল গৌরচন্দ্রিকা না করেই বললেন, “সামান্য কিছু চাঁদার জন্য এলাম ঘোষবাবু।”
চাঁদা! অবাক হলাম, “পুজোর তো এখনো ……”
স্বনামখ্যাত দাদা ভুল শুধরে দেন, “পুজো না, যজ্ঞ – অখণ্ড হোম, কীর্ত্তন, বাঙালী ভোজন, বস্ত্রবিতরণ– বুঝলেন কিনা”
ফেল করা ছেলের মতো ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললাম, বুঝিনি।
“আরে দাদা,” স্বশাসিত পল্টুদার মুখ ঝলসে ওঠে, “লাতিন আমেরিকার টীমগুলোর সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। মেসিদা তো অলরেডি ফুটে গেছেন। এখন বুর্জোয়া জার্মান, ফ্রান্সকে হারিয়ে ব্রাজিলের হাতে কাপটা তুলে দেওয়ার জন্যেই অখণ্ড নামগান – যাগযজ্ঞ-”
“তো এই যাগযজ্ঞের চাঁদাটা …..”
“জানে তো পল্টু মিত্তির সবসময় জনগনের পাশে থাকে। চাপ নেবেন না। ছোট ছোট ভায়েরা এসেছে – ভালবেসে পাঁচশো টাকা দিন।”
“পাঁচ …. হিক্কা তুললাম, শো …।”
“আপনার যেমন কথা! আটশো টাকার ইলিশ কিনতে পারছেন (কী সাংঘাতিক নেটওয়ার্ক! ঠিক জেনে নিয়েছে!) আর এতবড় মহান একটা কাজে সামান্য কটা টাকা ঠেকাতে পারবেন না”
পল্টু মিত্তির অ্যাণ্ড কোম্পানীর পাস্ট রেকর্ডের কথা মাথায় রেখে পাঁচশো টাকা ব্রাজিলের মঙ্গলার্থে (নাকি আমার অমঙ্গল ঠেকাতে) দান করতে দ্বিধা করলাম না।
তবে সেরা ধাক্কাটা খেলাম রোববার সন্ধেবেলায়। অন্যান্য দিন সময় পাই না; তাই ছুটির দিনে বিকেলের দিকে বাড়ির কাছে পার্কে একটু হাঁটতে যাই। শরীরটাকে তো রাখতে হবে। সেদিনও অভ্যাস মতো পাঁচটা চক্কর মেরে একটু দম নেওয়ার জন্য কোণের দিকে একটা বেঞ্চে বসেছি। বিকেলের আলো মরে তখন অন্ধকারের পর্দা নেমে আসছে দ্রুত। চারপাশ ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে। হঠাৎই বাঁদিকের একটা বেঁটে ঝাঁকড়া গাছের ওপাশ থেকে রিনরিনে মিঠেলা একটা গলা ভেসে এল, “তুমি সত্যি আমাকে ভালবাসবে”
রোমিওর আস্ফালন শোনা গেল, “বাসব না মানে আমি রোনাল্ডোর মতো, মেসির মতো তোমাকে ভালবাসব।”
সঙ্গে সঙ্গে রিনরিনে স্বর খ্যানখেনে হয়ে গেল, “ইল্লি আর কী রোনাল্ডো, মেসি তো দুদিনের যোগী। যদি গ্রিজম্যান কিংবা মদ্রিচের মতো চিরদিন ভালোবাসতে পারো, তা হলে না হয় ……” শেষটুকু শুনতে আর ভরসা হয় নি। পত্রপাঠ গাত্রোত্থান করে হাঁটা দিয়েছি বাড়ির দিকে।
বি.দ্র.- ফেসবুকে হপ্তাখানেক আগে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল – “প্রকাশিত হল বহু প্রতীক্ষিত ‘বিশ্বকাপ পাঁচালী’। আপডেট থাকতে চান জানতে চান রোনাল্ডোর কোন কোন দেশে কটা বান্ধবী আছে অথবা মেসি কোন পায়ের বুট আগে পরেন। জানেন কি এমবাপে ব্রেকফাস্টে কী খান নিজে জানতে, অন্যকে জানাতে কিনুন সত্বর। অর্ডার দিয়ে আমি বইটা আনিয়েছি। মুখস্থও করেছি কয়েকটা লাইন – “বিশ্বকাপের খেলা অমৃত সমান। টিভিতে দেখায় রাতে, দ্যাখে পুণ্যবান। অর্বাচীন কহে ইথে কিবা ফলোদয় মূর্খ, এতে স্বর্গবাস — জানিও নিশ্চয়। রোনাল্ড, নেমার, মেসি – ত্রিদেব সম সর্ব গুণ ধরে এরা – সত্ত্ব, রজ, তমঃ।।”
শোনা যাচ্ছে একটি ইংরেজী এডিশনও বেরোচ্ছে – ‘ফ্রম আলপিন্ টু এলিফ্যান্ট অব্ দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ।” কিনবেন নাকি