ঝিমলি বড্ড অদ্ভুত। লোকে ভ্যাপসা গরমে হাফ বয়েলড হয়ে ‘হায় শীত, আয় শীত’ করে হাঁফায়। ঝিমলি কী করে? ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ বার একটাই লাইন বিড়বিড় করে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’!
ঝিমলি হাল আমলের। বয়স ত্রিশের ঘরে। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করে। এই রকম আপাদমস্তক ঝাঁ-চকচকে হয়েও ‘বৃষ্টি’র ব্যাপারে ঝিমলি পুরোপুরি সেকেলে। ওর বন্ধুরা যখন ঘোলা জলে পা ডোবাতে হবে ভেবে নাক কুঁচকায় – ঝিমলি অনায়াসে লেগিংস গুটিয়ে ছপাৎ ছপাৎ জল ভাঙে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে মন খুলে ভেজে। এই তো কদিন আগে রাস্তায় কালবৈশাখীর মুখোমুখি ঝিমলি। দোকানপাট দুদ্দাড়িয়ে বন্ধ করতে ব্যস্ত দোকানি। রাস্তার লোক ঝড় আর বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি এড়াতে আড়াল খুঁজছে। ঝিমলি সেদিন বাসস্ট্যান্ডের রাধাচূড়ার নীচে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল। ছাতাও খোলেনি। আড়ালও খোঁজেনি। সেদিন যত না বৃষ্টিতে ভিজেছিল তার থেকেও বেশি ফুলের পাপড়িতে ঢেকে গিয়েছিল ঝিমলি। হাওয়ার তাড়ায় গাছের সমস্ত ফুল অঝোরে ঝরেছিল ওরই গায়ে। এভাবে বেপরোয়া না হলে ঝিমলি এভাবেও কি ‘ফুলকুমারী’ হতে পারত?
‘বৃষ্টি’ নিয়ে এই অবসেশন অবশ্য ঝিমলির ছোটবেলা থেকেই। উত্তর কলকাতায় মামাবাড়ি। আধঘণ্টা তেড়ে বৃষ্টি পড়লেই আমহার্স্ট স্ট্রিট, সুকিয়া স্ট্রিটে হাঁটুজল। মামাবাড়িতে দাদু-দিদা ছাড়াও সেজো-ছোটো মামা, মামির জমাটি আসর। সেই আসর ট্রান্সফার হত ঝিমলিদের ফ্ল্যাটে। বর্ষা এলেই। সবাই কাঁধে ব্যাগ, হাতে ঝোলা নিয়ে জল ভাঙতে ভাঙতে কিংবা কর্পোরেশনের ‘নৌকো’-য় চড়ে চলে আসতেন। ঝিমলিদের বাড়ি উত্তর-পূর্বে। ওখানেও জল দাঁড়াত। তবে উত্তর কলকাতার মতো নয়। ওই কটা দিন ঝিমলিদের ফ্ল্যাট যেন যজ্ঞিবাড়ি। মায়ের সঙ্গে দিদা, মাসি হাত লাগাতেন রান্নায়। বাবা-দাদু-মামারা মিলে দেদার আড্ডা। তখন জল নামতে সময় নিত পাক্কা দু’দিন। স্বাভাবিকভাবেই স্কুল-পড়া থেকে অলিখিত ছুটি। এর পরেও ঝিমলি বৃষ্টি চাইবে না।
‘বৃষ্টি’র সঙ্গে ঝিমলির আরও ক’টা উপকরণ লাগে। বাদলা দিনকে মনের মতো করে উপভোগ করবে বলে। সেগুলো কী? মায়ের হাতের রেজালা খিচুড়ি, তেঁতুলের আচার আর ভূতের গল্পের বই। নাঃ! বৃষ্টির দিনে আর পাঁচজনের মতো ডিভিডি চালিয়ে বসে না সে। যদিও ‘আধুনিক বর্ষা’ বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে ‘আষঢ়স্য প্রথম দিবস’-এ হাজিরা দেয় না। তাতে কী? ঝিমলি জানে, ‘বৃষ্টি’ও ওকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারে না। তাই হাওয়া বদলের গন্ধ পেলেই টুক করে একদিন সি. এল. নিয়ে নেয়। সেদিন শুধু ও আর ওর বৃষ্টি। ঘুম চোখে তড়বড়িয়ে ওঠা নেই। নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছোটা নেই। কিউবিকলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার নিয়ে খুটুর খুটুর নেই। ওই দিন কী করে ঝিমলি? একাত ওকাত হতে হতে মেঘলা আকাশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে।ঝেঁপে বৃষ্টি এলেই বাসি মুখে ছাদে ছুট। পয়লা বর্ষায় ভিজবেই ভিজবে। কোনকালে ‘মেঘদূত’-এর বাংলা অনুবাদ পড়েছিল। ভাবটুকু ত্রিশে এসেও আবছা হয়নি। তাই আষাঢ়ের প্রথম দিনে মনে মনে বিরহী যক্ষপ্রিয়া সাজে। আর মনের সুখে ভেজে। প্রথম প্রথম মা ধমকে ধামকে ছাদ থেকে নীচে নামাতেন। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর ঝিমলি তো দাঁত মাজাটাও বৃষ্টির জলে সারতে পারলে বাঁচে!
বৃষ্টির জলে একপ্রস্থ স্নান সেরে ঝিমলি আবার বিছানায়। গায়ে মেখে উপভোগের পর বৃষ্টিকে জানালার গ্রিলের বাইরে দিয়ে চোখ দিয়ে চাখে। এভাবে দেখতে দেখতেই জল খাবারের পাট চোকায়। কিন্তু বিছানা ছাড়ে না। মেয়ের এই লক্ষণ ভালোই জানেন মা। এবার একবাটি আচার দিতে হবে। আচারের বাটি হাতের গোড়ায় পেলেই ওমনি শোয়া থেকে আধশোয়া। খাটের পাশের র্যাক থেকে একটা ভূতের বই টেনে নিয়ে আচারে আঙুল ডুবিয়ে একটু একটু করে জিভে ঠেকায় ঝিমলি। অল্প অল্প করে বইয়ে মন দেয়। অনেকটা করে বৃষ্টির দিকে পলক না ফেলে আনমনে তাকিয়ে থাকে।
ঝিমলির এই ‘বৃষ্টিবিলাস’ তার অনেক চেনাজানার কাছেই ‘আদিখ্যেতা’। কেউ বলে ন্যাকামি। অফিস কলিগরা তো সোজাসুজি ‘ধ্যাষ্টামো’ ট্যাগ আটকে দিয়েছে। একথাও অনেকে বলেছে, বৃষ্টি শুধুই ভালো? একটুও মন্দ নেই তাতে? মাঝে-সাঝে ভারি আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলেবল। কিন্তু যখন ছিঁচকাঁদুনের মতো নাগাড়ে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কেঁদেই চলে কয়েকদিন, তখন? জলের তোড়ে পাহাড় সমতল এক। এখানে ধস। ওখানে নদীর পাড় ভাঙছে। কত লোক মাথার উপরের ছাদটুকু হারিয়ে অসহায়। এসবের চেয়ে নাকি শীত অনেক ভদ্র-সফিসটিকেটেড। এক ত্বকে টান ধরানো ছাড়া আর কিছু করে না। খাও-দাও, ঘোরো-ফেরো। জমিয়ে মস্তি কর। শীত ‘অন’ মানেই সমস্যা‘গন’।
এসব যুক্তি শুনে মুচকি হাসে ঝিমলি। মনে মনে লম্বা শ্বাস ফেলে। ওরা তো জানে না, বৃষ্টির ‘সব্বোনেশে’ রূপ ঝিমলির থেকে ভালো আর কে জানে! ঝিমলি তখন গ্র্যাজুয়েশনের সেকেন্ড ইয়ার। কলেজ ফেরতা টিউশনি সেরে বাড়ির পথে। বাসে বসেই হাওয়ায় ‘ভেজা’ গন্ধ পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের ক্লান্তি সরিয়ে সে নিমেষে চাঙ্গা। বাস থেকে নামতেই টোপা বৃষ্টির ঝাঁক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। যথারীতি ছাতা গুটিয়ে ভিজতে ভিজতে ফিরছে। হঠাৎ কানে এল ভরাট গলা, ‘হাই মন্দাকিনী’! চমকে পিছনে ফিরতেই বৃষ্টিতে ঝাপসা একটা চেহারা চোখ টানল। লম্বাটে, ছিপছিপে একটি ছেলে তারই মতো ভিজছে। হ্যাঁ, ঝিমলি সেদিন সাদা কুর্তি পরেছিল।
বৃষ্টির হাত ধরে ‘সায়ন’ এসেছিল ঝিমলির জীবনে। দু’জনের একটাই মিল। ‘বৃষ্টি’ ভালোবাসে। সারাবছর তত কথা হত না তাদের। বৃষ্টি এলেই ‘ঝিমলি’কে লাগত সায়নের। কথা, স্পর্শ, আশ্লেষে এক এক সময় দম আটকে আসত। তবু সায়নকে ঠেকাতে পারত না। এক বৃষ্টির সন্ধ্যাতেই সায়ন বলেছিল, ‘মনামীও এমন বৃষ্টি পাগল ছিল। বৃষ্টির সন্ধেয় এসেছিল। এক ভেজা রাতে কর্পূরের মতো উবে গেল’।
সেই থেকে বর্ষা এলে মনামীকে খোঁজে সায়ন। ঝিমলিকে সেই সন্ধেয় একবারের জন্যেও ছুঁয়ে দেখেনি। বরং বড়ো চোখ টান করে ওর মধ্যে আতিপাতি খুঁজেছিল ‘বর্ষা সঙ্গিনী’কে। সেই প্রথম, উদগ্র চাওয়ার নিষ্পেষণ ছাড়াই দম আটকেছিল ঝিমলির।সে ‘মনামী’র রূপক। সায়ন সেই যে গেল, আজও ফেরেনি। বন্যা আটকানো যায়। বাঁধ নতুন করে গড়ে ওঠে। ঘরছাড়া ঘর ফিরে পায়। কিন্তু বর্ষায় এই সব হারিয়ে ‘ভিখারি দশা’ তো আজও কাটল না ঝিমলির!
এই জন্যেই ‘বৃষ্টি’কে মনে প্রাণে চায় সে। আকাশের বুকে মেঘ জমলে দিনের আলো নিভবে। বিরহী যক্ষের অপেক্ষার প্রহর বর্ষার জলে ভিজে মিলন রসে ভরে উঠবে কানায় কানায়। ঝিমলি তখন চাতক পাখি। মেঘ চুঁয়ানো জলে ভেজাবে শরীরকে। মন ভিজবে চোখের জলে। এই একটা বিষয়ে বড্ড সাবধানী সে। বৃষ্টিকে চোখের পাতা ছুঁতে দেয় না। সায়নের জন্য। যদি ফিরে আসে। তাহলে দেখবে, ‘পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছে’!
lekhati pore valo legeche. Aro erokom lekha chai.
jhimlir songe khub mil amar. lekha vali legeche.
lekhar badhuni mondo noy. Tobe baban vul ache. Valo legeche.
Evabeo Bristi-k valobasa jay? Konodin evabeo vabini to. Thanks Biyas. Jhimlir chokh die Birstir natun rup dekhanor jnyo.
khub, k-u-b, k–h–u–b valo lekha. Prochondo gorome Bristi-veja ei lekha mon thanda korlo. Thanks Biyas
darun, darun, asadharon 🙂
amio bristi valobasi. kintu jhimlir moto kore noy. jhimli notun kore bristir preme pote sekhalo
kobe kolkatay e-rokom bristi asbe? kobe jhimlir moto vijbo?
tip tip borsa paani…paani ne aag lagaye…lekhata pore gaanta mone porlo
Khub sundor bornona .
Amar valobasar Rup ke mone pore , Rup kothay tumi?
Khub valo laglo thanks Biyas
শিলাজিতের গানটা মনে পড়ল…
“ঝিমলি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস”…
আমার ভীষণ প্রিয় গান…লেখাটাও ভালোলাগল…