“তুই এক কাঁধে হাত দিলি কেন রে! জানিস না, এক কাঁধে হাত দিতে নেই?”
আমি ভোম্বল জানিই না, এক কাঁধে হাত দিলে কী হয়। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয় রে?”
“ইসসস, মুখেই আনব না দিনের শুরুতে। তুই তিন বার আমার দু কাঁধ ছুঁয়ে দে”
আমি চিত্রার্পিতের মতো আদেশ পালন করলাম। অনেক কাকুতি-মিনতি করে জানতে পারলাম কী কারণে এক কাঁধে হাত দিতে নেই। তবে, সে কথা আমি মুখেও আনতে পারব না।
এটা মৌসুমীর সঙ্গে আমার কথোপকথন, স্কুলে ঢোকার মুখে। ওকে আমি এক কাঁধ ধরে ডেকেছিলাম পেছন থেকে। তাতেই এত সমস্যা। যত বড় হতে শুরু করলাম তত এই খুচরো বিপদ বাড়ল, তার সঙ্গে আশঙ্কা, তার সঙ্গে কনফিউশন। সকাল বেলায় এক শালিখ দেখলে দিন খারাপ যাবেই। এ বারান্দা থেকে ও বারান্দা, পাশের বাড়ির অ্যাসবেস্টসের বৃহৎ চাল, গলির মুখ, সব চোখ দিয়ে চষে ফেললাম যদি আর একটা শালিখ কোনও ভাবে দেখা যায়। দেখতে পেলাম না। মন খারাপ করে স্কুলে গেলাম। এবং পঞ্চম পিরিযডে সেলাই দিদিমণির মোক্ষম বকুনি। বিশ্বাস করতে একটুও বাধা রইল না যে, এ সেই সকাল বেলায় এক শালিখ দেখার ফল।
আমার এক বন্ধু তো অচেনা কাউকে রাস্তায় এক চোখ কচলাতে দেখলেও, তাঁকে দাঁড় করিয়ে দু-চোখ দেখে নিয়ে তবে ছাড়ান দিত। অন্য কারও এক চোখ দেখলে যে অকল্যাণ হবেই, এ তো e=mc2-এর চেয়েও অনেক পোক্ত প্রমাণ, তা-ও রোজকার জীবনে। সুতরাং এক চোখ দেখার পর, সেই ব্যক্তির কাছ থেকে দু-চোখ পিটপিট না দেখা অবধি, উক্ত ব্যক্তির স্থান পরিত্যাগ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।একটু বড় হওয়ার পর কিছু কিছু প্রজাপতির ল্যাজও গজায়। তারা পরীক্ষার দিন ইচ্ছে করে, পরীক্ষা শুরুর আগে এমন করে চোখ চুলকোয়, যাতে উদ্দিষ্ট বালিকাটি তার এক চোখ দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কেউ কেউ তো এত বিচ্চু ছিল যে ঠিক অব্যর্থ টাইমিং-এ হাতে কোয়েশ্চন পেপার পাওয়ার পর গলা খাঁখারি দিয়ে অন্যের অ্যাটেনশন টেনে এক চোখ দেখিয়ে দিত। তার পর টিফিনের সময় সে কী ঝগড়া। পরের হাফের পরীক্ষা প্রায় বানচাল হয়ে যায় আর কী! মধ্যস্থতায় দিদিমণি এসে উপস্থিত হলে, এক চোখের কুনজরে পড়া মেয়েটি ফুঁপিয়ে বলত, “আপনি জানেন না দিদি, ও আমায় ইচ্ছে করে এক চোখ দেখিয়েছে, যাতে আমার পরীক্ষাটা খারাপ হয়”। উত্তরে বিচ্চু মেয়েটি বলত, “মোটেই নয় দিদি, সত্যিই আমার চোখ চুলকোচ্ছিল আর কাশি পাচ্ছিল”। এমন কথা যে জজে মানবে না, সে কথা দিদিমণি ভালই জানতেন। এক চোখ যে দেখিয়েছে, তাকে একটু বকাবকি করে চলে যেতেন। কিন্তু সে দিন বিকেল থেকে বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে যেত। আমিও ঘোর সার্পোট করি। এরম ভাবে কেউ যেচে এক চোখ দেখায় পরীক্ষা শুরুর মুখে? মানবিকতা বলে কিছু নেই?
এ তো গেল স্কুল লেভেলের কথা। আমি তো শুনেছি মুশকো জোয়ান থেকে বয়স্ক মানুষেরাও এ সব দিয়েই জীবন নির্ধারণ করেন। ছোট বেলায় এক ভদ্রলোকের কথা শুনেছিলাম। আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে তিনি পুরনো দিনের দোতলা বাসের দোতলায় একই সঙ্গে অফিস যাচ্ছিলেন। আচমকা ব্রেক কষায় দুজনের মাথা ঠুকে যায়। আত্মীয়ের নির্ধারিত স্টপ এসে যাওয়ায় তিনি নেমে পড়েন। কয়েক পা হাঁটতেই পেছন থেকে পরিত্রাহী চিৎকার, ও মশাই শুনছেন, শুনছেন। থমকে দাঁড়ান সেই আত্মীয়। ভদ্রলোক হাঁফাতে হাঁফাতে এসে আত্মীয়ের মাথায় আরও এক বার নিজের মাথা ঠুকে নেন এবং অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলেন, “যদি কিছু হয় ওই আর কী!” মানে উনি বলতে পারেন না যে, যদি শিং গজায়! সেই ভয়ে উনি বাস থেকে নেমে আরও এক বার মাথা ঠুকে গেলেন।
পরীক্ষার দিন সকাল বেলা কিংবা টিফিন টাইমে আমার এক বন্ধু কিছুতেই রসগোল্লা খেত না, পরীক্ষায় এই রকম দেখতে নম্বর যাতে কোনও মতেই না পাতা ভরায়। শরীরের বাঁ দিকে টিকটিকি পড়লে যে কারও রাজরানি হওয়া আটকানো যায় না, এ আর কে না জানে! তবে হ্যাঁ, ডান চোখের পাতা লাফালে যে অঘটন ঘটবেই তা প্রমাণ পাওয়া যায়, রাস্তায় হুড়মুড়িয়ে সবার সামনে পড়ে গিয়ে চটি ছিঁড়ে গেলে। বাড়ির লোকজন সান্ত্বনা দেন, “অল্পের ওপর দিয়ে গেল”, এই বলে। ওই জন্যই যে সকাল থেকে ডান চোখ লাফাচ্ছিল, এ কথা যে কোনও দুধের শিশুও জানে। আর ডান হাত চুলকোলে যে গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা লাভ হয়, তা-ও প্রমাণিত। দিনের শেষে দুঃসম্পর্কের কাকিমা এসে আট আনা দিয়ে লজেন্স খেতে বলে থুতনিতে চুমু খায়, সে তো সকালে ডান হাত চুলকেছিল বলেই।
এমন কত পবিত্র জিনিস রোজ ঘটে মধ্যবিত্ত শৈশব-কৈশোর জীবনে। এমনকী তিতিবিরক্ত হওয়া মধ্যবিত্ত মধ্য-পঞ্চাশের কেরানির জীবনেও। একটু বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। এখন আর ঘটে না, আগে ঘটত। কেন ঘটত? আগেকার দিনের লোকজন সরল ছিল? সরল ছিল না হাতি! খুবই জটিল ছিল এখনকারই মতো। কেবল জীবনে বৈচিত্র্য কম ছিল। বিশ্বাসের ভিত পোক্ত ছিল। বিশ্বাস করার মতো এবং অবিশ্বাস করার মতো ব্যাপারস্যাপার খুব সহজে মিলত না। ফলে যে কয়েকটি হাতে গরম পাওয়া যায়, তা-ই দিয়েই দিন গুজরান করতে হত। হ্যাঁ, আরও একটা কথা, সব কিছুই অনিশ্চিত ছিল না। ফলে, সরল বিশ্বাসও ছেলেমানুষির হাত ধরে সেঁধিয়ে যেত বুড়ো হাড়ে। এক কাঁধে হাত দিলে বা ডান চোখ চুলকোলে যে সত্যি অঘটন ঘটে না, সে কথা নিশ্চয়ই মস্তিষ্ক জানত। কেবল মানতে চাইত না। হয়তো এই সব পাগলামির মধ্য়েই নিত্যকার অকিঞ্চিৎ জীবনের গুনগুনানি চলত। জীবনের এত আয়োজন ছিল না। মোটামুটি সাদা-কালো বড় জোর ইস্টম্যান কালার।
কিন্তু এখন তো আমাদের সাইকাডেলিক জীবন। সংস্কার থেকে কুসংস্কার, বিজ্ঞান থেকে অপরাধ, বোধ থেকে অবচেতন—সর্বত্র অবাধ ও অবোধ যাতায়াত। এখন আমরা পবিত্রতাকে ভাবি বোকামি, সরলতাকে ভাবি দুর্বলতা আর বিশ্বাস তো খুবই uncool। তাই জীবনের নানা ওঠাপড়া খুব গায়ে লাগে আমাদের। আর ঠিক সেই অভিমানেই ফুরফুরে এক্কাদোক্কা, বিকেলের হজমি আর এক শালিখ দেখার বিশ্বাস আমাদের ছেড়ে দূরে চলে গেছে।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।