সালটা ১৯৬৫। তখন আইএফএ-র দফতর ধর্মতলা স্ট্রিটে। জ্যোতি সিনেমার কাছেই এক পুরনো বাড়ির দোতলায়। ফুটবলে দলবদলের সময়টায় নিচের ফুটপাথে একটা সামান্য জটলা হত। মেরেকেটে ১৫-২০ জন। তা-ও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান স্পোর্টিংয়ের কোনও তারকা খেলোয়াড় বদলের গুজব থাকলে। আর দলবদলের পালা শেষ হতেই যে যার টিম নিয়ে তৈরি হত। মানে রোজ সকালে হত ট্রেনিং।
খেলার মাঠে সাংবাদিক হিসেবে আমি তখন একেবারে আনকোরা। সবে ময়দানে যাতায়াত শুরু করেছি। ট্রেনিং দেখব বলে টানা তিনদিন গেলাম ইস্টবেঙ্গল মাঠে। কিন্তু কোথায় কী! একদিনও ফুটবল নিয়ে লাথালাথি নেই। ফুটবল মাঠে ফুটবলই নেই! লাল হলুদ দলের ক্যাপ্টেন তখন সুকুমার সমাজপতি। তাঁকে দেখি, খেলোয়াড়দের দেখি। আর দেখি রোজ মাঠের দক্ষিণ দিকে লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোককে। পরনে ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি। শুনলাম, উনি জ্যোতিষ গুহ। সকলেই জানে জে সি গুহ নামে। ফুটবল মাঠের তিনি মিথ। তিনিই প্রথম ভিন রাজ্য ও ভিন দেশ থেকে ফুটবলার এনে ক্লাবকে শক্তিশালী করার পথিকৃৎ।

ভেঙ্কটেশ, আপ্পারাও, ধনরাজ, আহমেদ ও সালেকে তখন বলা হত ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডব। জ্যোতিষবাবুই তাঁদের সকলকে নিয়ে এসেছিলেন। তার আগে কলকাতার ফুটবলারদের বেতন বা ভাতা বা চাকরি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। জ্যোতিষবাবু বিখ্যাত বার্ড কোম্পানির সিইও, দক্ষিণ ভারতের এম এস বালা-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধনরাজ-আহমেদদের ক্লাবে আনেন। বার্ড কোম্পানিতে চাকরি, কাউকে কাউকে মাসিক বেতন এমনকি বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করে দেন। অনেকটা বিদেশি কায়দায়। আর কলকাতার ফুটবলে প্রাণ এনে দেন এই খেলোয়াড়রাই।
আমি দূর থেকে ওঁকে দেখতাম। শালপ্রাংশু। ঋজুদেহী। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে ক্লাবের ফুটবলারদের অ্যাথলেটিক্স চর্চা নিরীক্ষণ করতেন। একেবারে একলা। দেখতাম ওই সময় কেউ ওঁর ধারেকাছে কেউ যায় না। আগেই শুনেছিলাম, ১৯৩৪ সালে জ্যোতিষ গুহ ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গোলকিপার। ১৯৪১-এ সহকারি সচিব। ১৯৪৬-এ সচিব। তার আগে লন্ডনে যান ব্যারিস্টারি পড়তে। কিন্তু ফুটবলের নেশা তাঁকে নিয়ে যায় আরসেনাল ক্লাবে। সেখানে তালিম নেন। ব্যারিস্টারের বদলে ফুটবল ট্রেনার হয়ে দেশে ফেরেন। বিদেশ থেকে ফুটবল কোচিংয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার ব্যাপারে ভারতে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। কলকাতায় ফিরে কর্মকর্তা হিসেবে ক্লাবে যোগ দেন। দেশ-বিদেশের ফুটবল ক্লাবে খোঁজ করে নতুন প্রতিভাদের কলকাতায় নিয়ে এসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলিয়ে বিখ্যাত করে তোলা, সুখেদুঃখে খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়ানো, একইসঙ্গে চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব আর অন্যদিকে তীক্ষ্ণ ফুটবলবোধ— এগুলোই অনন্য করে তুলেছিল তাঁকে।

একদিন ফুটবলারদের দৌড় আর লম্ফঝম্প শেষ হতেই ভয়ে ভয়ে ওঁর কাছে গেলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। বললেন,
— হ্যাঁ দেখছি তাই! তুমি রোজ এখানে এসে ওদের দেখ কেন?
— প্র্যাকটিস দেখতে আসি। কী ভাবে খেলোয়াড়েরা তৈরি হয়। আমি তো একেবারে নতুন।
শুনেই উনি কৌতূহলী। বললেন,
— কী জানতে চাও বলো?
— আপনার তো ফুটবল টিম। কিন্তু ফুটবল প্র্যাকটিস তো হচ্ছে না। রোজ দৌড়, লাফ, নানারকম শারীরিক কসরত, তাই ভাবছি।
উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— শোনও! কোনও খেলায় ভালো হতে গেলে আগে চাই শরীর। ফিটনেস। যে সবচাইতে ফিট থাকবে, সে ভালো খেলবে। বিদেশি বইপত্তর পড়লে জানবে, উন্নত সব দেশে সবার আগে ছেলেমেয়েদের ফিটনেসের জন্য অ্যাথলেটিক্স চর্চা শুরু হয়। জিমন্যাসটিক্সও করানো হয়। তার ব্যবস্থা তো এখানে নেই! তুমি বল ধরে অপোনেন্টের ডিফেন্স চিরে এগবে। তোমার দৌড়ে তো গতি চাই! ওদের ফরোয়ার্ডদের কাটিয়ে ডিফেন্স ভেদ করতে হবে। সেই জন্য দরকার টেকনিক, ড্রিবলিং। আর এসবের জন্য চাই ফিটনেস। আর দেখবে বিদেশি গোলকিপারদের কী নমনীয় শরীর! চিলের মতো ছোঁ মেরে বল ধরতে হয়। ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় গোল বাঁচাতে। কিম্বা লাফিয়ে উঠে বল ক্লিয়ার করতে। বিদেশে এসবের তালিম দেন অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্ট কোচ…
কিন্তু কলকাতা ময়দানে ষাটের দশক পর্যন্ত সে সবের চল সে ভাবে হয়নি। জ্যোতিষ গুহ স্থির করলেন ফুটবলারদের শরীর তৈরির দায়িত্ব দেবেন অ্যাথলেটিক্সের নামি কোচ সুজিত সিনহাকে। তিনি একমাস ধরে ফুটবলারদের নিয়ে লেগে রইলেন। তারপর এলেন ফুটবল কোচ স্বরাজ ঘোষ। তখন সুজিতবাবু বসলেন সাইডলাইনে। স্বরাজবাবু বল নিয়ে ফুটবলারদের সঙ্গে মাঠে। স্বরাজবাবুও বিদেশে তালিম নেওয়া কোচ ছিলেন। সুজিতবাবু আর স্বরাজবাবুর সে কী চমৎকার মেলবন্ধন! সবই কিন্তু জ্যোতিষ গুহর মস্তিষ্কপ্রসূত। আর ট্রেনিং চলাকালীনও তিনি এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন মাঠের দক্ষিণ দিকে লাইনের বাইরে। একদিন সেই ছবিও বের হল খবরের কাগজে।
ছবি বেরনোর পর একদিন গিয়েছি। আমাকে দেখে বললেন, ‘ওয়র্ল্ড সকার পড়বে। লন্ডন থেকে বের হয়। অনেক কিছু জানতে পারবে।’ তারপরেই সুজিতবাবুকে ডেকে বললেন, ‘কে কেমন দৌড়চ্ছে স্টপওয়াচে দেখ।’ এতটাই ছিল তাঁর সবদিকে নজর, ব্যক্তিত্ব, স্থৈর্য। ছিলেন ক্লাব অন্তপ্রাণ। শুধুমাত্র ফুটবলকে ভালোবেসে। এ দিকে ততদিনে ফুটবল ট্রেনিং চলেছে হপ্তা দু’য়েক। রোজই দেখতাম সাতসকালে চলে আসেন জ্যোতিষ গুহ। সঙ্গে দুই কোচ। ট্রেনিং শেষে টেন্টে এসে পাশের ঘর থেকে খেলোয়াড়দের গুলতানি শুনতেন জ্যোতিষবাবু। ওঁদের মন বুঝতে চাইতেন। ওদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে চাইতেন। এবং সে কাজে তিনি সফল ছিলেন।
দেখতাম, মাঝে মাজেই মিটিংয়ে বসতেন দুই কোচ ও জ্যোতিষ গুহ। সকলের ভালোমন্দ শুনতেন। কাকে কী টিফিন দেওয়া দরকার, তা-ও শুনতেন। তখন তো অনেকেই পঞ্চাশের দশকের মতো ফুলটাইম খেলোয়াড় নয়। সকলেই প্রায় চাকরি করেন। সকালে ট্রেন ধরে বা বাসে করে ক্লাবে আসেন। তারপর ট্রেনিং। অবশেষে স্নান সেরে কিছু খেয়ে অফিস। সবার রুটিন ছিল জ্যোতিষবাবুর নখদর্পণে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সামাজিক দিকটা লক্ষ করতেন। কারণ সেটার ওপর তাঁর খেলার ভালোমন্দ নির্ভর করত। এখন ভাবি আজ থেকে ৫৫-৫৬ বছর আগে কতটা দূরদর্শী ছিলেন জ্যোতিষ গুহ। তিনি নিজে খেলোয়াড়দের জন্য মেনু তৈরি করতেন দুই কোচের সঙ্গে আলোচনা করে। ডায়েট চার্ট তৈরি করে দিয়ে দিতেন ক্যান্টিনে। এমনকি খেলোয়াড়দের জন্য মনোবিদের পরামর্শও যে প্রয়োজন, সেদিকেও প্রথম দৃষ্টি ফেরান জ্যোতিষবাবু।

একদিন বড়ো ম্যাচের সকালে টেন্টে গেলাম। আজ কেমন প্রস্তুতি চলছে দেখতে। মাঠে গিয়ে দেখি কেউ নেই। একদম সুনসান। শঙ্কর মালি বললে, গুহ সাহেব ভেতরে। আর সিনহাবাবু, স্বরাজবাবু খেলোয়াড়দের কাছে। আজ আর প্র্যাকটিস নয়। টিম মিটিং। মিটিংয়ে স্ট্র্যাটেজি আলোচনা করছেন দুই কোচ। তারপরে একটু হাল্কা লাঞ্চ। তারপর বিশ্রাম। খেলা চারটে নাগাদ। সকলেই ঘুমোবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম কি হয়? সকলেই উশখুশ করছে। বড়ো ম্যাচ বলে কথা।
ক্রমে ম্যাচের সময় এগিয়ে এল। খেলোয়াড়রা টয়লেট ঘুরে এসে একে একে তৈরি হচ্ছে। জার্সি পরছে। বুট পরে নিল। তারপর একে একে লনে। বিশাল স্ট্যান্ডে লাল হলুদ পতাকা উড়ছে। খেলোয়াড়রা অর্ধবৃত্তাকারে। কোচ স্বরাজবাবু কয়েকটা কথা বললেন। তারপর জ্যোতিষ গুহ পতাকা দেখিয়ে বললেন, “এই পতাকার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের। হারা চলবে না কোনও মতেই। লাল-হলুদ রংটা মনে রাখবে। প্রতিটি ইঞ্চির জন্য যুদ্ধ করতে হবে। তোমাদের এ যুদ্ধ জিততেই হবে। যাও, বয়েজ, নেমে পড়ো।” ব্যাস। এটুকুই।

খেলোয়াড়রা সারবেঁধে দাঁড়িয়ে। সকলের আগে ক্যাপটেন সুকুমার সমাজপতি। জ্যোতিষবাবু প্রত্যেকের মাথায় হাত দিচ্ছেন আর ছোট্ট করে একটা স্নেহের থাপ্পড়। তারপর প্লেয়াররা মাঠে ঢুকছে আর গ্যালারিতে গর্জন। আকাশছোঁয়া গর্জন। জ্যোতিষবাবু যেন তৃপ্ত। প্রতিটি ম্যাচের আগে তাঁকে এমনই দেখতাম। টিম জিতে ফিরলে যেমন, তেমনই হারলেও সকলের পিঠ চাপড়ে দিতেন। কোচ উষ্মা প্রকাশ করলেও জ্যোতিষবাবু কখনও বকাবকি করতেন না। খেলোয়াড়দের গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, ‘‘খেলায় হারজিত থাকবেই। ও নিয়ে মনখারাপ করবে না। আজ বিশ্রাম নেবে। রাতে ভালো করে ঘুমোবে। সামনে অনেক ম্যাচ পড়ে আছে।’’ সকলে স্নান সেরে যখন বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি, তখন কয়েকটা ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘‘মোহনবাগান তোমাদের এই সব দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছিল। এই সব সামান্য ফাঁকফোকর শুধরে নিও। দেখবে, পরের ম্যাচে তোমরাই হারিয়েছ মোহনবাগানকে।’’ তারপরেই ক্লাবের ক্যান্টিনে নির্দেশ— ‘‘এদের আজ ভাল করে খেতে দাও। কাল অনেক ধকল গিয়েছে।’’ ঠিক যেন অভিভাবক!
অনেক পরে হাবিব কিংবা নঈমের সঙ্গে দেখা হলে বলত, ‘গুহ সাবের তুলনা হয় না।’ সমাজপতি তো এখনও জ্যোতিষ গুহর কথা উঠলেই আপ্লূত হন। তাই আজ মনে হচ্ছে শতবর্ষের ইস্টবেঙ্গলে জ্যোতিষ গুহই সুপারস্টার।
প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জীবের পিতৃদত্ত নাম চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস| বয়স ৮২ পেরোল ২০২০-তে| গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে কলকাতা ময়দান চষেছেন পেশাগত ভালোবাসায়| ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের নানা ঘটনা, উত্থান-পতনের সাক্ষী তিনি| চাকরি করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়, তার পর সম্পাদক ছিলেন 'খেলার আসর' সাপ্তাহিকের| বছর কয়েক আগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁকে সম্মান দেয়|