ইতিহাস তৈরি করে কে? রাজায় রাজায় ভয়ানক যুদ্ধ হল, অনেক লোক মারা গেল, কাটা গেল- এক রাজা জিতলেন অন্যজন হারলেন। তাঁর গর্দান গেল। রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন হল, ধন সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিয়ে নেওয়া হল, এমনকি স্ত্রীধনও। এই হল ইতিহাস! ১৫২৬, ১৫৫৬, ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭- এই কয়েকটা সংখ্যাতেই কি তবে ইতিহাস আবদ্ধ? তাহলে, এই যে লোকগুলো ভাড়াটে সৈন্যের মতো যুদ্ধে প্রাণ হারাল, তাঁদের পরিবার, তাঁদের জীবন নিয়ে লিখে কী হবে? কিন্তু এই যুদ্ধ অথবা যে কোনও বিশেষ ঘটনা তৈরি হয় সাধারণ মানুষকে দিয়েই, সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ মানুষের মনে এবং জীবনেই।
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬। আমাদের অনেকেরই দিনটা মনে আছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তার মাত্র দু’বছর আগে ভূপালের ভয়াবহ গ্যাস দুর্ঘটনা মানুষের স্মৃতিতে টাটকা। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। কারণ আর মাসখানেকের মধ্যে ফুটবল বিশ্বকাপ আসছে, আর ফর্মে আছেন এক সুদর্শন যুবক মিশেল প্লাতিনি, এক ডাক্তার- সক্রেটিস আর এক রাজপুত্র ডিয়েগো মারাদোনা। ঠিক সেইদিন রাত্রে সেই সুদূর ইউক্রেনের চেরনোবিলে হল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ৪ নম্বর রিয়্যাক্টরটা ফেটে গেল। অবশ্যই এখন বলছি মর্মান্তিক, তখন খবরের কাগজে তেমন কিছু বেরুল না- সিরিয়াস দুর্ঘটনা, কিছু লোক মারা গেছে এই পর্যন্তই। কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব ঠিক কতটা, সোভিয়েত রাশিয়ার লৌহ যবনিকা ভেদ করে বাইরের পৃথিবীতে সে খবর স্মার্টফোনের অভাবে অর্ধোন্মোচিত থেকে গেল।
তার অনেকদিন পরে লেখা হল এক অনন্যসাধারণ ইতিহাসের বই- কথিত ইতিহাস বা ওর্যাল হিস্ট্রি। ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল।’ লেখক এক বেলারুশীয় মহিলা- স্বেতলানা আলেক্সিভিচ। মাত্র দু’শো পাতার এই বই না পড়লে জানা যাবে না কীভাবে সরকার ঢাল তরোয়াল ছাড়া হাজার হাজার মানুষকে এই রিয়্যাক্টারে পাঠিয়েছিল তা মেরামতের জন্য। বলাই হয়নি তাদের তেজস্ক্রিয়তার কথা। বলাই হয়নি প্রথম দমকল বাহিনীকে, যে তেজস্ক্রিয়তায় তোমাদের গা থেকে চামড়া, মাংস গলে পড়ে যাবে, আর তোমাদের মৃত্যু হবে নিদারুণ, ভয়ঙ্কর। শুধু তোমাদের কাছে নয়, তোমাদের প্রিয়জনদের কাছেও। বলাই হয়নি সৈন্যদের, যে তোমাদের আর কোনওদিন সন্তান হবে না বা তোমাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রবল। স্বেতলানা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কয়েকশো লোকের- পুরুষ, মহিলা, দমকল। হাসপাতালের লোক, রাজনীতিবিদ, সাধারণ গ্রামের অধিবাসীদের- এতদিন ধরে পড়ে থেকেছেন উনি এই কুড়ি বচ্ছর পরেও, যে ওঁর নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে।

কী হয়েছিল সেদিন? একটা রুটিন পরীক্ষায় গন্ডগোল হয়। ৪ নম্বর রিয়্যাক্টারে বিস্ফোরণ হয়ে রিয়্যাক্টারের ১০০০ টনের কংক্রিট আর স্টিলের ছাদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ৩১জন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। ২০০ জন, তার কয়েকদিনের মধ্যেই। আশেপাশের গ্রাম থেকে কাউকে সরানো হয়নি তৎক্ষণাৎ, তার তাৎপর্যই হবে যে দুর্ঘটনা যথেষ্ট সিরিয়াস। পরে লাখখানেক লোককে রাতারাতি খালি করতে বলা হল ইউক্রেন আর বেলারুশ থেকে। বেলারুশের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটির কাছাকাছি। গোটা দেশের জনসংখ্যা কলকাতার চেয়ে কিছু কম। একটা তুলনা টেনেছেন গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ করেন, বেলারুশের ছ’শো উনিশটা গ্রাম ধ্বংস করেন, চেরনোবিল দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয় চারশো পঁচাশিটা গ্রাম।

হাজার হাজার লোককে, আনকোরা লোককে সেই আগুন নেভানোর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল। আগুন শেষমেশ যখন নিভল, তখন সেই লোকগুলো রিয়্যাক্টারের ছাদে গিয়ে তেজস্ক্রিয় ছাই সরানোর কাজ পেল- বাঁচেনি প্রায় কেউই দু’তিন সপ্তাহের বেশি। অথচ এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করার উপায় নেই সোভিয়েত রাশিয়ায়। স্বেতলানা এই সব লোকেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আর প্রতিটা সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করেছেন। এই সংকলন মানুষের কথা বলার সাহিত্যে কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। একটা দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক।
একজন বাবার কথা-
“আমার মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল গেলাম। কালো কালো দাগ হয়ে গিয়েছিল ওদের শরীরে। দাগগুলো কখনও বেরয়, কখনও মিলিয়ে যায়। ব্যথা নেই কোনও। আমার মেয়ের বয়েস ছয়। ওকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলাম- আমার কানে কানে বলল “বাবা আমি বাঁচতে চাই, আমি তো এখনও ছোট” আর আমি ভাবতাম ও কিছুই বোঝে না। ভাবতে পারেন, হাসপাতালে একটা ঘরে সাতটা ছোট্ট মেয়ে! সাতজনের মাথায় চুল নেই। ওর কষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না আমার স্ত্রী। বলল একদিন “এই কষ্ট পাওয়ার চেয়ে ওর মরে যাওয়াই ভালো, কিংবা আমি মরে গেলেও হয়- ওর এই কষ্ট আর দেখতে হয় না।” আমি ভুলতে চাই না, আমার মেয়ে মারা গেছে চেরনোবিলের জন্য, আর আমাকে বলে কি না ভুলে যাও! আমি সাক্ষী হয়ে থাকতে চাই।”
ল্যুদমিলা ইগ্নাতেঙ্কো – দমকলকর্মীর স্ত্রী।
“ও বদলে যাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন রকম দেখতে লাগছে। জিভ পুড়ে গেছে, গালও। পাতলা আস্তরণের মতো চামড়া উঠে যাচ্ছে। ভাগ্যিস এত তাড়াতাড়ি সব কিছু হচ্ছে! নয়তোও আমি সহ্যই করতে পারতাম না। গোটা গায়ে ফোড়া বেরিয়েছে। আমাকে দেখার জন্য মাথা ঘোরালো- একগোছা চুল বালিশে লেগে রইল। বললাম “চিরুনির খরচ বেঁচে গেল। দু’দিন বাদে সব চুল উঠে গেল এমনিই। নার্সকে বললাম “ও আর বাঁচবে না।” নার্স বলল “কী আশা কর? ১৬০০ রঞ্জেন রেডিয়েশন পেয়েছে। চারশো রঞ্জেনেই কেউ বাঁচে না। আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছিল। আমি বলতাম “তোমাকে ভালবাসি। কতটা নিজেই জানতাম না।”

তেজস্ক্রিয় রশ্মি এমন জোরালো ছিল যে বেলারুশ, রাশিয়া পেরিয়ে, পূর্ব ইউরোপ পেরিয়ে সুইডেন বা ফিনল্যান্ডেও ধরা পড়েছিল তেজস্ক্রিয়তা। সোভিয়েত রাশিয়া তখন নিশ্চুপ- একটা খবরও বেরয়নি বাইরের পৃথিবীতে। তিনদিন পর সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা একটা ছোট বুলেটিন বার করে এই মর্মে যে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এ বইতে লেখা রয়েছে একের পর এক মনোলগ। মনোলগ মিথ্যে আর রাজনীতি নিয়ে, মনোলগ ওখানকার লোকেরা কী জানত না- মৃত্যু কত সুন্দর হতে পারে!
একটি ষোলো বছরের মেয়ে বলছে, যদি আমার কোনও বিকলাঙ্গ শিশু হয়, তাহলে সে তাকে অন্য সাধারণ বাচ্চার মতোই ভালোবাসবে। মনোলগ এক নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারের- যার দায়িত্বও ছিল দুর্ঘটনার পর তেজক্রিয়তা মাপা। পার্কে বসা এক মহিলা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন বাচ্চাকে- সে দুধে ছিল প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় সিজিয়াম- চেরনোবিলের ম্যাডোনা। বুকের দুধের পরিবর্তে শুরু হল গুঁড়ো দুধ খাওয়ানো- দেশের অন্য প্রান্ত থেকে আমদানি করে।
টিভিতে তখন গর্বাচভ বলছেন “ আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি”। ২০১৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান স্বেতলানা আলেক্সিভিচ। মৌখিক ইতিহাস লেখার জন্য। যে ইতিহাস তৈরি হবে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম- রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক, সেই ইতিহাসকে একপেশে বলে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস পাবে না। ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের দিয়েই। তাই আমাদের বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা শাসকদের বিরাট প্রজাপ্রেম দেখাতে ব্যস্ত থাকেন, প্রজারা অত্যাচারিত বা নিপীড়িত বা চাপে পড়ে ধর্মান্তরিত কিনা, তা দেখবার প্রয়োজন মনে করেন না। তাই ইংল্যান্ডে স্কুলে পড়ানো হয় না ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ওসব অপ্রিয় সত্য ভুলে যাওয়াই সুবিধা।
স্বেতলানার এই বই সকলের পড়া দরকার। অত্যন্ত দরকার। এ শুধু এক দুর্ঘটনার কালপঞ্জি নয়, এই বই এক সামাজিক দলিল। পড়তে পড়তে আক্ষেপ হতে বাধ্য, যে ভূপালের দুর্ঘটনা আমাদের সামগ্রিক স্মৃতি থেকে কত সহজে মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে। হত না, যদি সেদিনের সাধারণ মানুষের কথা অরাজনৈতিকভাবে লেখার জন্য কেউ উদ্যোগী হতেন। সাহসী, বলিষ্ঠ স্বর আমাদের তো কম নেই, কিন্তু তাঁরা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এ বিষয় নিয়ে বেশি লেখালেখির মধ্যে যাননি। আসলে সেসবের ঝক্কি অনেক। কী দরকার?

স্বেতলানা ২০১৫ সালে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। এই বইয়ে তিনি এক অদ্ভুত ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন, যেখানে সাধারণ লোকেরা প্রাণ খুলে কথা বলেছেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা যেসব কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছিল এতদিন, তা অর্গলমুক্ত হয়েছে এই বইয়ে। মা, বাবা, ভাই, বোন, দমকলকর্মী, সাফাইকর্মী- এক্কেবারে সাধারণ লোকেরা। তিনি মাথা ঘামাননি গরবাচভ কী বললেন তাই নিয়ে। তা তো সরকারি নথিতে আছেই। গল্পগুলো পড়তে কষ্ট হয়, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, লোকের রাগ প্রকাশ পায় এমনকী হতাশার মধ্যে কাষ্ঠহাসিও দেখতে পাই। পরিসংখ্যান দেখে আঁতকে উঠতে হয়।
কিন্তু পরিসংখ্যানের পিছনে আছে মৃত্যু, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, প্রজনন ক্ষমতা লোপের করুণ কাহিনি। এই বই পড়তেই হবে, ধরলে ছাড়তে পারবেন না আর পড়লে কষ্ট হবে নিদারুণ। এই বই পাঠককে এক মানসিক অবস্থায় পৌঁছে দেয় যেখানে শোক পাওয়াই স্বাভাবিক হয়ে যায়। পাঠক একাত্ম হয়ে যায় সাধারণ বেলারুশবাসীর সঙ্গে। এই বইয়ে যেমন ধরেছেন লেখক অসংখ্য বেলারুশবাসীর কথা, ঠিক সেরকম, পাঠকও ভাববেন- “What should I tell you? Death is the fairest thing in the world. No one’s ever gotten out of it. The earth takes everyone—the kind, the cruel, the sinners. Aside from that, there’s no fairness on earth.”
গ্রন্থ: ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল
লেখক: স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচ
প্রকাশক: ডালকি আর্কাইভ প্রেস
বিনিময়: ১৯৯৬ টাকা (হার্ডকাভার), ১৪৬৬ টাকা (পেপারব্যাক)
*ছবি সৌজন্য: Amazon, Wikipedia, Guardian
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।
2 Responses
অসামান্য বইয়ের অসাধারণ সমালোচনা।
চেরনোবিলের সেদিনের ঘটনা আজও সেখান কার মানুষ জনের শরীরে ও মনে ছাপ রেখে দিয়েছে। বহু পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমে সেই ছাপ শারীরিক গঠনে বয়ে নিয়ে চলেছে। বিখ্যাত লেখার অসাধারণ সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।