Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বইয়ের কথা: রসিকের বিন্দুদর্শন

হিন্দোল ভট্টাচার্য

অক্টোবর ৩১, ২০২২

Book by Chinmoy Guha
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বইয়ের নাম – বিন্দু থেকে বিন্দুতে
লেখক – চিন্ময় গুহ 
প্রকাশক – পরম্পরা
প্রকাশকাল – ফেব্রুয়ারি ২০২২
বিনিময় – ৫৫০ টাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৯২
ভূমিকা – লেখক
প্রচ্ছদশিল্পী – কৃষ্ণেন্দু চাকী
প্রাপ্তিস্থান – পরম্পরা প্রকাশনী, কলকাতা – ০৯
অনলাইনেআমাজ়ন, ফ্লিপকার্ট
বাংলাদেশেবাতিঘর

পণ্ডিত ও রসিকের মধ্যে বিবাহ সচরাচর ঘটে না। যে অল্প সংখ্যক ঘটে, তাঁরা ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে। পণ্ডিত তাঁর পাণ্ডিত্যকে ব্যালেন্স করে সাহিত্য বা শিল্পের গভীরে প্রবেশ না করতে পারলে, সব পাণ্ডিত্যই জলে যায়। তত্ত্বের ভাণ্ডার তো এখন একটি সফটওয়্যারও হতে পারে। তা হলে আর যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যটি কোথায়? কিন্তু আবার কিছু কিছু রসিক আছেন, যাঁদের পাণ্ডিত্য, রসসন্ধানের বিপরীতে অবস্থান না করে, রসসন্ধানী মনকেই তীক্ষ্ণ ও অন্তর্ভেদী করে তোলে। তত্ত্ব, তথ্য, প্রজ্ঞা, প্রেম, পাঠকসত্তা এবং রসিক মনের এক মিলন ঘটে। খুব কম এই ঘটনাটি ঘটে বিশ্বসাহিত্যে। এই বাংলাতেও এমন ব্যক্তিত্বের সংখ্যা অল্পই। সৈয়দ মুজতবা আলী, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো অল্পই কয়েকজন ব্যক্তিত্বের কথা এখানে বলা যায়। সময়ের অমোঘ নির্দয় আচরণে বাংলা সাহিত্যের সে বাগানও শুকিয়ে গেছে। আরও যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করার মতো, তা হল, একটা সময়ে শিক্ষিত বাঙালি কমপক্ষে তিনটি ভাষা খুব ভালো করে জানতেন। অনেকে, তারও বেশি, যেমন রামমোহন রায়। ইংরেজি ভাষায় এখনকার বাঙালির চেয়েও অনেক বেশি বুৎপত্তি তো তখন ছিলই (প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বাঙালি এখন স্মার্টনেসের কায়দা যত শিখেছে, ইংরেজি ভাষা ততটা নয়। কিন্তু আরও দুঃখের যেটি, তা হল বাংলা ভাষাও ততটাই ভুলে গিয়েছে।) পাঠক হিসেবেও বাঙালি অনেক বেশি অগ্রণী ছিল। এখন ইন্টারনেটের যুগে সমসময়ের রাশিয়ান সাহিত্য, ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় শেকভের সমসময়েই অনুবাদ করেছেন শেকভের গল্প। জীবনানন্দের লেখায় উল্লেখ পাই এলিয়টের, রবীন্দ্রনাথের লেখায় ইয়েটসের। রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন এলিয়টের কবিতা। এইসব ঘটছে এলিয়ট এবং ইয়েটসের সমসময়েই। 

দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে প্রবল উন্নত হওয়া সত্তেও, পড়ে আছি একশো বছর আগের কামু কাফকা, এলিয়ট, ইয়েটসের কবিতা নিয়েই। বোদল্যের আমাদের কাছে এখনও আলোচ্য বিষয়। কিন্তু তারপর ইউরোপ, আমেরিকার সাহিত্য এগিয়ে গেছে অনেক। আমরা সে সব পড়ার চেষ্টাও করি না। প্রসঙ্গান্তরে হয়তো চলে যাচ্ছি, কিন্তু এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত সময়েই, এই মুহূর্তে একমাত্র চিন্ময় গুহকে ছাড়া আর কাউকেই তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না, যিনি উল্লেখযোগ্য সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছেন আজীবন। কিন্তু এই কাজে তাঁর পাণ্ডিত্য কখনও বাধা হয়নি। কারণ তাঁর রসিক মনই তাঁর প্রজ্ঞার প্রেরণা। স্বভাবতই, এই রসিক মনের মধ্যে এক মেধাবী কবিমন কাজ করে তাঁর মধ্যে। অধ্যাপক, লেখক, কবি, এবং প্রাবন্ধিক শ্রী চিন্ময় গুহ এমনই একজন বিরল বাঙালি, যাঁর ভাবনা বাংলাকে নিয়েই আন্তর্জাতিক। তিনি জ্ঞানকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়ে বোধির স্তরে পৌঁছে যান। আর সেই বোধি থেকেই উজ্জ্বল আলোকরশ্মির মতো আমরা পেয়ে যাই ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’, ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’, এবং ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’-র মতো গ্রন্থগুলি।

শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ মুজতবা আলী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

রসিক পাঠকের দিব্যচক্ষুর উন্মীলন ঘটে পড়ার সময়ে। এই দিব্যচক্ষু আসলে কিছুই না, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, যা লেখার ভিতরে লেখার আত্মাকে খুঁড়ে বের করে। আসলে, একজন প্রকৃত লেখকের ভিতরে যেমন আবহমান ইতিহাস ও সময়চেতনা কাজ করে, তিনি যেমন মুহূর্তের মধ্যে আবহমান সময়প্রবাহকে খোঁজার চেষ্টা করেন, ঠিক তেমন একজন প্রকৃত পাঠকও সেই কাজটিই করেন। বরং, লেখকের চেয়ে তাঁর কাজটি অনেক কঠিন। কারণ লেখক অপ্রত্যাশিতের স্পর্শ পেয়ে সেই মুহূর্তটিকে অনন্তের মধ্যে দেখতে পান, কিন্তু পাঠকের, এই দেখতে পাওয়ার কাজটি তাঁর পাঠক্রিয়ার মধ্যেই করতে হয়। তাই লেখকের মতোই, সব পাঠক, পাঠক নয়। তত্ত্বের সঙ্গে, টেক্সটের সঙ্গে, ভাবের সঙ্গে চৈতন্য এবং রসের যে সহজ সরল আলোকরেখা রয়েছে, তা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই পাওয়া যায়। বা, বলা ভালো, খুব অল্প কয়েকজনই এই আধারটুকু হওয়ার জন্য নিজেদের মনকে প্রস্তুত করতে পারেন। চিন্ময় গুহ এই অল্প কয়েকজন পাঠকের মধ্যে অন্যতম, যিনি যখন নিজের লেখাগুলি লিখছেন, সেগুলির মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির মতো প্রজ্ঞার সম্পূর্ণ চৈতন্য এসে মিশে যাচ্ছে। 

এইবার যে প্রসঙ্গে আমাদের আসতেই হবে, তা হল, ভাষা। অর্থাৎ, কীভাবে বলছেন তিনি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এক নিবিড় আলাপে আমায় বলেছিলেন আত্মীকৃত ও আত্তিকৃত লেখার কথা। আত্মীকৃত ও আত্তিকৃত লেখা বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনি, তা যখন বুঝলাম, তখন অল্প কয়েকজনই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন। এই বিরাট পাঠ-সাম্রাজ্যকে নিজের অস্তিত্বের মধ্যে সহজ সরলভাবে আত্মীয়ের মতো করে নেন যে লেখক, তিনি তো অবশ্যই আত্মীকৃত লেখা লেখেন। আর এই পাঠ-সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণ ধারণ করে, তার চেতনাকেও নিজের চেতনার সঙ্গে এক করে যিনি নেন, তিনি তাঁর পাঠকেও আত্তিকরণ করেন। অ্যাসিমিলেশন অর্থে, এখানে আত্তিকরণ বোঝানো হলেও, এই আত্তিকরণ, সেই অর্থকেও ছাপিয়ে যায়। চিন্ময় গুহ-র ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ পড়তে পড়তে সেই আত্তিকরণ এবং আত্মীকরণের অভিজ্ঞতাই আসে, যেখানে প্রজ্ঞা হাত ধরেছে চৈতন্যের। এই ‘চৈতন্য’-র সঙ্গে স্বভাবতই ধর্মের যোগ নেই। যোগ রয়েছে আমাদের আবহমান চেতনার সঙ্গে। 

দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে প্রবল উন্নত হওয়া সত্তেও, পড়ে আছি একশো বছর আগের কামু কাফকা, এলিয়ট, ইয়েটসের কবিতা নিয়েই। বোদল্যের আমাদের কাছে এখনও আলোচ্য বিষয়। কিন্তু তারপর ইউরোপ, আমেরিকার সাহিত্য এগিয়ে গেছে অনেক। আমরা সে সব পড়ার চেষ্টাও করি না। প্রসঙ্গান্তরে হয়তো চলে যাচ্ছি, কিন্তু এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত সময়েই, এই মুহূর্তে একমাত্র চিন্ময় গুহকে ছাড়া আর কাউকেই তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না, যিনি উল্লেখযোগ্য সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছেন আজীবন।

বিশ্লেষণের সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ও ভাবনার যে সাহিত্যোত্তীর্ণ সংযোগ, তা-ই ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ গ্রন্থে শ্রী চিন্ময় গুহ আমাদের উপহার দেন। আসলে খুব কম প্রবন্ধগ্রন্থ এই বাংলা ভাষায় সন্দর্ভের স্তরে উন্নীত। প্রবন্ধ কখন সন্দর্ভ হয়ে ওঠে, তা নিয়ে বিতর্ক এবং বিতর্কের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিসর থাকলেও, একটি কথা আমাদের মনে রাখা কর্তব্য, সুলিখিত প্রবন্ধ মানেই তা সন্দর্ভ নয়, যদি না তার ভিতরে থাকে লেখকের নিজস্ব নানা প্রশ্নের দ্বান্দ্বিকতা। পাঠক সেই দ্বান্দ্বিক পরিসরেই ঢুকে প’ড়ে নিজের ভাবনার জগতে এইসব কথাগুলির সঙ্গে সংসার করতে পারেন, আবার কলহেও লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু এই সন্দর্ভ হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত হল ভালোবাসা। যদি আমি লেখকের হৃদয়ের আন্তরিক ও দার্শনিক সঙ্কটকে না দেখতে পাই তাঁর লেখার মধ্যে, তাহলে আমিও সেই লেখার মধ্যে ঢুকতে পারব না। প্রথাগত প্রবন্ধে পাঠকের সঙ্গে লেখকের একটি দূরত্ব তো থাকেই। কিন্তু সন্দর্ভে সেই লেখার এক অংশ হয়ে ওঠেন পাঠক স্বয়ং। 

চিন্ময় গুহ-র রচনার প্রসাদ্গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কথাই যদি বলি, তাহলে, ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’-এর মধ্যে লেখক পাঠককে সেই আবহের মধ্যেই প্রবেশ করান, যেখানে পাঠক একটি প্রবহমান ডায়লগের অংশ হয়ে উঠছেন। অর্থাৎ বিষয়ের গভীরতা বা দুরূহতা এখানে প্রাচীর নয় বরং একপ্রকার অ্যাডভেঞ্চার। পাঠকের অ্যাডভেঞ্চার। এই অ্যাডভেঞ্চার পাঠককে বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে পর্যটকের মতো নিয়ে যায়। পাঠক যেন এমন এক গাইডের হাত খুঁজে পান, যিনি নিজেও একপ্রকার বিশ্লেষণ করে চলেছেন এবং সমানভাবে আবিষ্কার করে চলেছেন। ফলে, পাঠক অনুভব করেন, চিন্ময় গুহের পাঠক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর নিজেরও পাঠক্রিয়া চলেছে। তাঁর মনে জাগ্রত প্রশ্নের সঙ্গে তৈরি হয়েছে পাঠকের নিজের হৃদয়ে তৈরি হওয়া নানান কৌতূহল। বিশ্লেষণের পরতে পরতে মিশে যাচ্ছে পাঠকের নিজের অন্তরের কৌতূহল। তার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব, যা লেখকের নিজেরও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে, সমগ্র লেখাটি হয়ে উঠছে জীবন্ত। ফলে গ্রন্থটিও পড়া শেষ হচ্ছে না। বারবার আবিষ্কৃত হচ্ছে। চিন্ময় গুহর লেখার মাধ্যমে সাহিত্যের বিভিন্ন অলিগলি ঠিক এভাবেই আমাদের কাছে নতুনভাবে খুলে যায়। আমরা পর্যটকের মতোই সেই সব অলিগলিগুলি আবিষ্কার করার আনন্দ পাই। এই রসিক স্পর্শ চিন্ময় গুহের লেখার মধ্যে রয়েছে বলেই গ্রন্থগুলি পড়া শেষ হয়ে যায় না। মৃত হয়ে যায় না। চিন্ময় গুহর গ্রন্থগুলি তাই জায়মান। ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধই এরকম। আপনি বলতে পারবেন না, এই বিষয়গুলি তো পুরনো, কারণ পুরনো অনেক বিষয়ের নতুন অলিগলির মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটেছেন। ফলে, এই বইয়ের প্রবন্ধগুলি ‘প্রবন্ধ’ তকমাধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস না হয়ে, হয়ে উঠেছে ‘সন্দর্ভ’, যা হৃদয়ের কাছাকাছি সহযাত্রী।

chinmoy-guha
চিন্ময় গুহ

এই প্রসঙ্গেই বলতে পারি ‘দুঃখদীপের রবীন্দ্রনাথ’, ‘ বাজাও আমারে বাজাও’, ‘ ফরাসি কবিতার প্রেম’, ‘শেক্সপিয়র ও ফ্রান্স: সমুদ্রের সন্ধানে’, ‘শার্ল বোদলেয়রের ২০০– অভিশাপ  ও ঈশ্বর’, ‘এ পরবাসে- ভিভিয়েন এলিয়ট ও তাঁর সৃজনকর্ম’, ‘হের কয়নারের গল্প- যেন মিনিয়েচার চিত্রকলা’— এমন অসংখ্য সন্দর্ভের কথা। ‘বিদ্যাসাগর- অনুবাদ ও ভাষার নির্মাণ’— নামক প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক এবং বাংলা ভাষার বিভিন্ন সাহিত্য সম্পর্কে চিন্ময় গুহর প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, কী নিপুণভাবে তিনি বিশ্বসাহিত্যের এক মানচিত্র তৈরি করেছেন এই গ্রন্থে। সেখানে যেমন রয়েছে প্যারিসে কোনও এক বইয়ের দোকান, ঠিক তেমনই রয়েছে কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথ। যেমন তিনি বিশ্বের মানচিত্র আঁকছেন, তেমনই আমাদের সামনে টেনে নিয়ে আসছেন নিজেদের শিকড়। আত্ম-শিকড় তথা আত্ম-অনুসন্ধানের পথগুলিকে রুদ্ধ করে দিলে তো বিশ্বকে জানা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্বচেতনার এক পথিক তো তাই আত্মচেতনার শিকড়ের সন্ধানেই থাকেন। ‘নীরবতার আলো- শঙ্খ ঘোষের কবিতাদর্শন ও একটি অনুবাদ’, ‘রম্যাঁ রলাঁ ও তাঁর আগুনের উষ্ণীষ’, ‘রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ- এক স্বপ্নের সিম্ফনির খোঁজে রম্যাঁ রল্যাঁ’– এই প্রবন্ধগুলি লেখকের দার্শনিক জগতের মধ্যে আমাদের টেনে নিয়ে যায়। দার্শনিক ভাবনা– এই শব্দের কয়েনেজের আসলে কোনও অর্থই নেই। কারণ দর্শন ঠিক আলাদাভাবে কী, তা বোঝা সম্ভব নয়। যদিও এ কথা হয়তো ভাবা যায় জগতের বৃহত্তর সত্যসন্ধানের যে চিরসংকটময় ভাবনা, তার নাম দর্শন। 

চিন্ময় গুহর লেখার মাধ্যমে সাহিত্যের বিভিন্ন অলিগলি ঠিক এভাবেই আমাদের কাছে নতুনভাবে খুলে যায়। আমরা পর্যটকের মতোই সেই সব অলিগলিগুলি আবিষ্কার করার আনন্দ পাই। এই রসিক স্পর্শ চিন্ময় গুহের লেখার মধ্যে রয়েছে বলেই গ্রন্থগুলি পড়া শেষ হয়ে যায় না। মৃত হয়ে যায় না। চিন্ময় গুহর গ্রন্থগুলি তাই জায়মান। ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধই এরকম। আপনি বলতে পারবেন না, এই বিষয়গুলি তো পুরনো, কারণ পুরনো অনেক বিষয়ের নতুন অলিগলির মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটেছেন।

এই ভাবনা থেকে যদি পথ হাঁটি, তাহলে চিন্ময় গুহর এই গ্রন্থটি দীর্ঘকাল ধরে আমাদের অন্ধকার পথে আলো দেখাবেই। এখানে যেমন বোদল্যের-এর বান্ধবী ‘জান দুভাল’ সম্পর্কেও আমরা ভাবতে পারছি, তেমন ভিভিয়েন এলিয়ট সম্পর্কেও আমাদের জানলা খুলে যাচ্ছে। কিন্তু লেখক এখানে কোনওভাবেই জাজমেন্টাল নন। তিনি কোনও অভিমুখে আমাদের চালনা করছেন না, না নিজে চালিত হচ্ছেন। তিনি আমাদের সামনে খুলে দিচ্ছেন আরও আরও সম্ভাব্য সব পথের সদর দরজা। এইবার সেই পথে একজন পাঠক গিয়ে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতেই পারেন। এক সার্থক সন্দর্ভের কাজই এই। সেখানে লেখক যেমন নিজে ভাবেন, নিজে বিস্ময়ে অভিভূত হন, বিশ্লেষণের এক এক কুঠুরী পেরিয়ে যান, ঠিক তেমনই তাঁর সঙ্গে ধাপে ধাপে পথ চলেন পাঠক। সেখানে আগে থেকে কোনও সিদ্ধান্ত টেনে লেখা থাকে না কিছু। তা শিলালিপি নয়, তা এক খোলা মাঠ। এই মাঠে আপনি যত যাবেন, তত আবিষ্কার করতে করতে যাবেন। এই গ্রন্থের এক সম্পদ শেষ লেখাটি। যদি ভাবি শেষ লেখাটির ভাবনাপুঞ্জ অসংখ্য কবিতার মধ্যে নিহিত থাকে, তাহলে সম্ভবত অবাক হবেন কেউ কেউ, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পাঠক হিসেবে পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, ‘আত্মহত্যার পর- বেঁচে থাকা মানুষ’ একটি কাব্যগ্রন্থের অংশ। এটি এমন একটি সন্দর্ভ, যা একইসঙ্গে একটি সৃষ্টিও বটে। তার্কোভস্কির ফিল্মগুলি যেমন। 

সৃজনশীল সন্দর্ভ আমাদের বাংলা ভাষায় খুব কম পাওয়া যায়। হয় থাকে পাণ্ডিত্যের অহংকার, নয় থাকে জটিল গোলোকধাঁধাঁ এবং অস্পষ্টতার আবহ। কিন্তু চিন্ময় গুহ একদিকে যেমন কবি, তেমন গদ্যকার। তাঁর গদ্যভাষায় রয়েছে এক অপূর্ব ছন্দ। ভালো করে পড়লে, তাঁর গদ্যের একটা ‘cadence’ রয়েছে, যা অনেকের গদ্যে থাকে না। গদ্যের এই মায়াময় ভাষাই তাঁর সন্দর্ভগুলিকে করে তুলেছে আন্তরিক। সেখানে আমরা যেমন লেখককে দেখতে পাচ্ছি, তেমন দেখতে পাচ্ছি বাকি চরিত্রগুলিকেও। তবে কি এই সন্দর্ভগুলিকে একপ্রকার কথন বলা চলে? যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষে তথা বাংলায় কথনের আসরে নানা বিষয়ের অবতারণা করা হত। ঠিক তেমনই কি আমাদের গল্প বলেন চিন্ময় গুহ? আমরা তন্ময় হয়ে শুনি। ঢুকে পড়ি সেই সব জগতে। লেখকের সঙ্গেই পড়ি, ভাবি, কথা বলি, দুঃখিত হই, বিষণ্ণ হই। চিন্ময় গুহ তাঁর গদ্যভাষায় অবজেক্টিভ এবং সাবজেক্টিভ— এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির দেওয়াল ভেঙে দেন। ফলে পাঠকের কাছে বিন্দু থেকে বিন্দুতে যাওয়ার সুযোগ মেলে। একজন ব্যর্থ ছাত্র হিসেবে স্বীকার করছি, চিন্ময় গুহর একটি বইও আমি পড়ে শেষ করতে পারিনি। কারণ তাঁর বই যতবার পড়ি, ততবার মনে হয় এই বইটি পড়িনি আগে। ঠিক যেমন ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে বইটি আমার ভালো করে পড়া হয়নি। 

যে কোনও বিন্দু থেকেই এই বইটি বারবার নতুন করে পড়া যায়।

*ছবি সৌজন্য: Indian cultural Forum

Author Hindol Bhattacharjee

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

Picture of হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
Picture of হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com