১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর একটি স্থায়ী সংবিধান (Constitution of India) রচনার জন্য গঠিত হয় কমিটি৷ তৈরি হয় খসড়া সংবিধান৷ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর নির্বাচিত সংবিধান পরিষদে সেই সংবিধান গৃহীত হয়। তাই এইদিন দেশের সংবিধান দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
আরও পড়ুন: যে স্বাধীনাকে মনে রাখিনি
১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত হয় সেই সংবিধান (Constitution of India)। সংবিধান পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৯। ভীমরাও আম্বেদকর অবশ্যই সংবিধানের জনক, কিন্তু সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মহিলা সদস্য। সংবিধান দিবসে তাদের অবদান মনে করা দেশবাসীর কর্তব্য। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম সর্বজনবিদিত, যেমন— সরোজিনী নাইডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, সুচেতা কৃপালানি। এঁদের সঙ্গে ছিলেন দক্ষ এবং একাধিক গুণের অধিকারী— আম্মু স্বামীনাথন, হংসা জিভরেজ, মেহতা দুর্গাবাঈ দেশমুখ, রাজকুমারী অমৃত কাউরের মতন সদস্যরা। দাক্ষায়নী ভেলায়ুধান এবং বেগম আইজাজ রাসুল ছিলেন যথাক্রমে সংবিধান পরিষদের একমাত্র দলিত এবং মুসলিম মহিলা সদস্য। ছিলেন ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে অ্যানি ম্যাস্কারিন। আরও পাঁচ বঙ্গতনয়া ছিলেন সদস্য রূপে। তারা হলেন— কমলা চৌধুরী , লীলা রায়, পূর্ণিমা ব্যানার্জী, রেনুকা রায় এবং মালতী চৌধুরী। এই পাঁচ বঙ্গতনয়া আজ বিস্মৃত। ভারতীয় সংবিধান রচনায় এঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পাঁচ বঙ্গ-তনয়ার জীবন এবং কর্ম একটু বিশদে দেখে নেওয়া যাক।
কমলা চৌধুরী: জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের লাহোরে। পড়াশোনা করেছিলেন বাংলার শান্তিনিকেতনে। তারপর ১৯৪৯ সালে তিনি আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক মনোবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। দেশে ফিরে অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আইআইএম আহমেদাবাদের। ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের প্রথম শিক্ষক ছিলেন ডক্টর চৌধুরী। পরবর্তীকালে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ১৯৩০ সালে গান্ধীজির চালু করা সিভিল অ্যাটর্নি জেনারেশন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ৭০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
কমলা চৌধুরী নিয়মিত সাহিত্যসাধনাও করতেন, তাঁর গল্পগুলি সাধারণত মহিলাদের আভ্যন্তরীণ জগতের সঙ্গে বা একটি আধুনিক জাতি হিসাবে ভারতের উত্থানের সাথে সম্পর্কিত।

লীলা রায় (নাগ): আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গিরীশচন্দ্র নাগ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢাকার ইডেন স্কুলে। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম.এ ডিগ্রিধারী। তাঁর এক ক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা রায় সম্পর্কে তিনি তাঁর ‘স্মৃতিকথা’ নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, “এঁর মতো সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরি হল, ‘নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।’ তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ‘জয়শ্রী’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন।”

পূর্ণিমা ব্যানার্জী: ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কমিটির সচিব ছিলেন। অল্প বয়সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। ৩০ ও ৪০-এর দশকে উত্তরপ্রদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মুখ। লবণ সত্যাগ্রহ এবং ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার হন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী অরুণা আসাফ আলির ছোট বোন। মা অম্বালিকা দেবী ছিলেন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের মেয়ে, যিনি ব্রাহ্মদের জন্য বহু স্তোত্র রচনা করেছিলেন। আবার বাবা উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির ভাই ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি ছিলেন সেই সময়ের বিশিষ্ট চলচিত্র নির্দেশক, যিনি ডিজে নামেই বেশি পরিচিত। গণজাগরণ পরিষদে পূর্ণিমা ব্যানার্জীর বক্তৃতাগুলির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার।

রেণুকা রায়: আইসিএস সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও অল ইন্ডিয়া উওমেন্স কনফারেন্স-এর সদস্যা সমাজকর্মী চারুলতা মুখোপাধ্যায়ের কন্যা তিনি। প্রথম দিকে গান্ধিজির আহ্বানে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীকালে গান্ধিজির কথাতেই লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে স্নাতক হন। তাঁর দাদু অধ্যাপক পি কে রয় ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ এবং অক্সফোর্ডের প্রথম ভারতীয় ডি ফিল। দিদা সরলা রায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় মহিলা সদস্য এবং গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। রেণুকা রায় ১৯৪৩ -৪৬ সালে সেন্ট্রাল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য হন। ১৯৫২-৫৭ পশ্চিমবঙ্গ লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য হয়ে রাজ্যের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ তে তিনি মালদা থেকে সাংসদ ছিলেন। ১৯৮৮ তে পান ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান। সংবিধান তৈরির সময় তিনি মহিলাদের অধিকার নিয়ে বহু মতামত দিয়েছেন।

মালতী চৌধুরী: মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মালতী চৌধুরী বিশিষ্ট নেত্রী ও সমাজসেবী। জন্ম ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার এক অবস্থাপন্ন ব্রাহ্ম পরিবারে। পিতা কুমুদনাথ সেন ছিলেন ব্যারিস্টার। মাতা স্নেহলতা সেন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের কামারখাড়ায়। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। ওড়িষ্যার একদা মুখ্যমন্ত্রী নবকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ১৯২৭ সালে শান্তিনিকেতনেই। মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবে তিনি ১৯৩০-এ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং গ্রেফতার হয়ে ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে প্রেরিত হন। ১৯৩২ সাল নাগাদ হাজারিবাগ জেলে ছিলেন। ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবাসও করেছেন। গান্ধীজীর পদযাত্রাতে উড়িষ্যা রাজ্যে সঙ্গী হন। ১৯৪৭ সালে কিছুকালের জন্যে উড়িষ্যার প্রদেশ কংগ্রেস সভানেত্রী হয়েছিলেন। উড়িষ্যা সরকার তাঁকে ‘উৎকল রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়া ঠাকুর সাহিত্য পুরস্কার, দেশিকোত্তম, শিশু কল্যাণমূলক কাজে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

সেইসময় নারী স্বাধীনতা বা নারী শিক্ষার প্রচার এবং প্রসার ছিল না। মহিলারা ছিলেন উপেক্ষিত এবং অবহেলিত। প্রচুর সংগ্রাম করে একজন মহিলাকে তখন প্রতিষ্ঠা পেতে হত। সুতরাং সহজেই অনুমেয় , কতখানি দক্ষ ছিলেন বলেই এই মহীয়সীরা সংবিধান রচনার মতন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত হতে পেরেছিলেন।
ভারতীয় সংবিধান দিবসে, সংবিধান রচনায় সাহায্যকারী ১৫ জন মহিলা সদস্যার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র: ‘Our Constitution: An Introduction to India’s Constitution and Constitutional Law’ – Subhash C. Kashyap
বাংলায় অনুবাদ পার্থ সরকার।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Wikipedia, Instagram
প্রকাশক, সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ। নানা ক্রিয়েটিভ কাজকর্মে জড়িয়ে থাকতে
ভালবাসেন, আর ভালবাসেন নিজস্ব লেখালিখি।
One Response
খুব ভালো লেখা। কনস্টিটিউশন যে কতো লোকের কন্ট্রিবিউশন আছে , কি বিশাল কর্মযজ্ঞ, সেটা এখন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জানা। অবাক হবার মত বিষয় যে সেযুগে কতো নারী অবদান রেখে গেছেন।