(Goodbye Mountain)
চলচ্চিত্র: Goodbye Mountain
প্রকাশকাল: ২৫ জুলাই ২০২৫
পরিচালক: ইন্দ্রাশিস আচার্য
প্রযোজক: এন.কে. মহম্মদ
মুখ্য ভূমিকায়: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অনন্যা সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য
সঙ্গীত পরিচালনা: রণজয় ভট্টাচার্য
সিনেমাটোগ্রাফি: শান্তনু দে
এডিটর: লুব্ধক চ্যাটার্জি
কস্টিউম ডিজাইন: অবর্ণা রায়
সাউন্ড ডিজাইন: দিবাকর সাহা
আর্ট ডিরেকশন: রঞ্জিৎ গড়াই
প্রোডাকশন কন্ট্রোল: রিয়াস ওয়ানাদ
একটি অধ্যায় শেষ হয়, শেষ থেকে শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়। এই শেষের শুরু দীর্ঘ নয়, বরং তা পরিশীলিত এবং পরিমিতও বটে। এমন এক গল্পের সূত্রপাত দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি প্রদেশে। গল্পটি দু’জন মানুষের, আদতে এ গল্প আমাদের, অনেক হয়ে ওঠা ‘আমি’-র এবং না হতে পারা ‘তুমি’-র। কীভাবে দেখা হয় তাঁদের, কোনও পূর্বসূত্র বা পূর্বাভাস? না, সেসব কিছুই নেই, আছে এক অদ্ভুত পাগলামি আর সেই পাগলামি থেকেই একসঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। পাহাড়কে ভালবেসে, নাকি পরস্পরকে? এভাবেই কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনার সুতো দিয়ে গাঁথা হতে থাকে একটি চলচ্চিত্রের কাহিনিপট। দৃশ্য এগোতে থাকে সুতোতে টান পড়ে একটু একটু। আরও গভীর থেকে গভীরতর ভাবনা, আর এক অন্তহীন অপেক্ষা! ২২টা বছর যদি হঠাৎ ২২টা দিনে বদলে যায়, তাহলে? অপেক্ষার অবসান বুঝি সেখানেই হয়? (Goodbye Mountain)
আরও পড়ুন: স্বপ্নের চারাগাছে জল দেওয়ার গল্প ‘অঙ্ক কি কঠিন’
সূত্র এভাবেই ক্রমশ বাড়তে বাড়তে নির্মেদ একটি চলচ্চিত্রের অবয়ব ধারণ করে, চলচ্চিত্রটি ‘Goodbye Mountain’. পাহাড় শব্দটা নানা অভিব্যক্তি নিয়ে ধরা দেয় আমাদের মনে। কখনও সে বিশাল, কখনও স্থির, কখনও একঘেয়ে আবার কখনও পরতে পরতে রহস্যে পরিপূর্ণ। এমন পাহাড়ে একটি হোমস্টে। অর্জুন সেই হোমস্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থেকে যান দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি প্রদেশে। আর একজন তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠেন, আনন্দী। তারপর এক দীর্ঘ ব্যবধান, ২২ বছর। যে অপূরণীয় দূরত্ব তৈরি হয় তা সময় নিজের খেয়ালেই মিটিয়ে নেয় কখনও সখনও। একটি একটি করে দিন, একটি একটি করে পর্ব হয়ে ওঠে সিনেমার দৃশ্যজুড়ে। সেই প্রতিটি পর্বের ভিতর থাকে অজস্র গল্প। ২২ বছরের ব্যবধান মেটানোর সময়সীমা মাত্র ২২ দিন! অর্জুন ও আনন্দীর কাছে একটাই শর্ত, দু’জনের কেউ কাউকে কোনও প্রশ্ন করবে না। এক একটি পর্ব, কখনও রাতের গল্প, কখনও সে গল্প সত্যি অথবা মিথ্যার, আবার এপার-ওপারের মধ্যিখানে থাকা পাহাড়ের গল্পও বটে! (Goodbye Mountain)

এই স্বল্প সময়েই স্পষ্ট হয়ে যায় কত সমীকরণ। যে পাহাড়ে নিজেদের বাকি জীবন একসঙ্গে কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন অর্জুন ও আনন্দী, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ঠিক যেভাবে অনেক স্বপ্ন পূরণ হয় না, মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়াই সেখানে ভবিতব্য। অরিন্দম ও অর্জুনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে, এমন মিথ্যা সন্দেহে আনন্দী ছেড়ে যান অর্জুনকে। তারপর দীর্ঘ ২২ বছরে, অনেক স্রোত বয়ে গেছে তার নিজস্ব খাতে। আনন্দী বিয়ে করেছেন রথীজিৎকে, তাঁদের সন্তান রয়েছে; আর অর্জুন থেকে গেছেন একা, তার পাহাড়কে ভালবেসে। আর আনন্দীকে, তাঁকে ভালবাসেননি অর্জুন? (Goodbye Mountain)
“কম নন অর্জুনের ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও। শেষ কবে এমন পরিশীলিত অভিনয় চোখে পড়েছে ইন্দ্রনীলের মনে পড়ে না।”
দীর্ঘ সময় পর অর্জুন যখন আনন্দীকে ডেকে পাঠান, তখন তিনি জানেন, তাঁর মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। ডাক্তারের ক্রমাগত ওষুধ আর ইঞ্জেকশন টিকিয়ে রাখছে কেবল। তাই ওই ২২টা দিন আনন্দী ও অর্জুনের ফেলে আসা বহু সাক্ষ্যকে বহন করে। তাঁদের গান, এস্রাজ বাজানো, ঝর্নার ধারে ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি আবারও কিছু মুহূর্তের জন্য বাস্তব হয়ে ওঠে। হোম স্টে-তে নতুন গেস্ট আসছেন। তাঁদের ব্যবহারের উপযুক্ত সামগ্রী রেখে আনন্দী চলে আসেন অর্জুনের ঘরে। গল্পে-আলাপে সময় চলে যেতে থাকে দ্রুত। তাঁরা ঘনিষ্ঠ হন, হতে চান। পর্ব থেকে পর্বান্তরে একেকটা দিন কাটে, অর্জুনের শারীরিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এরপর আসেন রথীজিৎ। আনন্দীকে কলকাতা ফিরতে হবে। ২২টা দিন শেষ প্রায়। আর কোনওদিন ফিরে আসবেন না আনন্দী, সেই পাহাড়ি প্রদেশে। এই বিদায় তাহলে পাহাড়কে জানানো তাঁর শেষ বিদায়? (Goodbye Mountain)

মধ্যবিত্তের যাপন পর্বের এক অপূর্ব নির্মাণ ‘Goodbye Mountain’ সিনেমাটির দৃশ্য জুড়ে। অদ্ভুত রঙের ব্যবহার, হালকা আলোয় সিনেমাটোগ্রাফি চোখ ও মনে এক বিষণ্ণ শান্তি নিয়ে আসে। এই কৃতিত্ব অবশ্যই সিনেমাটোগ্রাফার শান্তনু দে-র। আনন্দী চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের অভিনয় প্রশংসনীয়। কোথাও তিনি উচ্চকিত নন। ফেলে আসা বছরগুলি পার করে এসে নিজের ভুল বুঝতে পারা আনন্দী সব ভুলে আবার নতুন কিছু ভাবনার প্রান্তে এসে উপস্থিত হন। সেই ভাবনা, নিজের ভিতরে কাজ করতে থাকা যন্ত্রণা, পাহাড় এবং অর্জুনকে ভালবেসে ফেলা আনন্দীর প্রতিটি সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন ঋতুপর্ণা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়। কম নন অর্জুনের ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও। শেষ কবে এমন পরিশীলিত অভিনয় চোখে পড়েছে ইন্দ্রনীলের মনে পড়ে না। নিজের ভিতরে কাজ করতে থাকা আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অভিমান, যন্ত্রণা, রাগ প্রায় প্রতিটি অভিব্যক্তিকে নিখুঁত পারদর্শিতায় ধরার চেষ্টা করেছেন ইন্দ্রনীল। কেবল উচ্চারণ কোথাও যেন বাধ সেধেছে। গান কিংবা কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে উচ্চারণ কখনও কখনও স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে বলেই মনে হয়েছে। (Goodbye Mountain)
“এই ধারার সিনেমা প্রডিউস করার ক্ষেত্রে কোথাও একটি রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করেই যায়। সেখানে এন.কে.মহম্মদকে অবশ্যই তারিফ করতে হয় এই সিনেমাটির প্রোডাকশনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য।”
ডাক্তার এবং রথীজিতের ভূমিকায় বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখেন অনন্যা সেনগুপ্ত ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। নিজেকে একটু একটু করে নির্বাসনে পাঠানো অর্জুনের প্রতি ডাক্তারের যে অদ্ভুত টান তৈরি হয় তাকে কোনও প্রেমজ সম্পর্কে সীমাবদ্ধ করা যায় না। সেই অভিব্যক্তি অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন অনন্যা। তাঁর মুখ-চোখের ভাষা খুবই প্রাণবন্ত-সাবলীল। ঠিক তেমনই সাবলীল অভিনয় অনির্বাণ ভট্টাচার্যের। বর্তমান স্ত্রী-র অতীত সম্পর্কে তিনি জানেন। সবকিছু বুঝতে পেরে তাঁর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চায় অর্জুনকে! অথচ মধ্যবিত্তের মানসিকতা নিয়েই নিজেকে সবরকম সিচুয়েশনে স্থির রাখেন, রাখার চেষ্টা করেন রথীজিৎ। এই প্রতিটি মানসিক টানাপোড়েন নিজের অভিনয়গুণে স্পষ্ট করেছেন অনির্বাণ। পাহাড়ে ট্রেক করতে আসা ছেলে-মেয়েদের দলটি স্বল্প সময়ের জন্য নিজেদের অভিনয়ের পরিসরকে প্রাণবন্ত রেখেছে। সঙ্গীত পরিচালনায় যথেষ্ট প্রশংসা দাবি করেন রণজয় ভট্টাচার্য। সিনেমাটির গল্পের পরতে পরতে থাকা সুর, তাল, লয়কে তিনি সঙ্গীতে একেবারেই যথাযথ ব্যবহার করেছেন। কোথাও বাড়তি গান চলে এসে স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করেনি। (Goodbye Mountain)

যে বাজারে, বাণিজ্যিক বা আধা বাণিজ্যিক সিনেমার দাপুটে প্রভাব কার্যকরী, সেখানে ইন্দ্রাশিস আচার্য নির্মিত চলচ্চিত্র যেন নিভৃত; সঙ্গোপনে নিজের কাজটুকু করে চলেন ইন্দ্রাশিস। সচরাচর এই কাজের বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন খুব দ্রুত হয় না। একটি সিনেমার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে থাকেন বহু মানুষ। অভিনেতা অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক ব্যতীত আরও যাঁরা একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রকল্পে জড়িয়ে থাকেন, তাঁদের পারিশ্রমিক অনেকাংশেই সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্যের উপর নির্ভর করে। তবে প্রথমেই যিনি চলচ্চিত্রটি প্রডিউস করেন, তাঁর ভূমিকাকে বিশেষভাবে স্বীকার করতে হয়। প্রচলিত কোনও ‘বিগ হাউজ’ নেই ইন্দ্রাশিসের, তিনি নিজেও চাকুরিজীবী। তাই এই ধারার সিনেমা প্রডিউস করার ক্ষেত্রে কোথাও একটি রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করেই যায়। সেখানে এন.কে.মহম্মদকে অবশ্যই তারিফ করতে হয় এই সিনেমাটির প্রোডাকশনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। (Goodbye Mountain)
“সমস্ত প্রশ্নের ভিতর থাকা গভীর প্রশ্নটি উত্থাপন করে ‘Goodbye Mountain’ এই একবিংশ শতকের ‘আধুনিক’ দর্শকের কাছে, “ভালোবাসা বৈধ না অবৈধ”?”
হল উপচে পড়া ভিড় কখনওই হবে না ‘Goodbye Mountain’-এর ক্ষেত্রে। কিন্তু নিভৃত প্রাণের দেবতা-র মতো একচিলতে আলোর সন্ধানে নিয়ে যাবে দর্শককে এই চলচ্চিত্র। মধ্যবিত্ত মানস, মধ্যবিত্ত যাপন, মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্ব এখানে একঘেয়ে ক্লান্তিকর নয়। সিনেমার ভিতরে থাকা অধ্যায় বিভাজন আমাদের সামনে যেন আয়নার মতো, একেকটা প্রতিবিম্ব ছুঁড়ে দেয় একেকটি প্রশ্ন। কখনও সে অনাহূত, কখনও স্বপ্ন বা সত্যির ভেদচিহ্নে সংশয়ী, কখনও আবার রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয়প্রার্থী। কিন্তু সমস্ত প্রশ্নের ভিতর থাকা গভীর প্রশ্নটি উত্থাপন করে ‘Goodbye Mountain’ এই একবিংশ শতকের ‘আধুনিক’ দর্শকের কাছে, “ভালবাসা বৈধ না অবৈধ”? উত্তর সন্ধানে একটি ৯৩ মিনিটের সংহত চলচ্চিত্র ক্লান্তিকর হয় না। সম্ভাব্য বহু উত্তরের অ্যানেকডোটসের দিকে হেঁটে যান দর্শক। (Goodbye Mountain)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।