(Memoir)
স্মৃতি, সে কি আর মোছা যায়? আমি কোন জলের সেলাইয়ে লিখে রাখব নাম? স্মৃতি ভেসে ভেসে চলে। একূল থেকে ওকূল আসে। পাড় ভেবে আমরা শুধু ঘুরপাক খাই। এটাই নিয়তি। নিয়তির দোলনায় মানুষ দুলতেই থাকে। তারপর ছোট্ট শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে। চিরঘুম। শান্তির ঘুম। (Memoir)
সাল ২০১৪, ‘তবুও প্রয়াস’-এর বেশ কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছে। তখনও আমরা মুদ্রণের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। কোনও সংখ্যায় ছাপা ভাল হচ্ছে তো, কাগজ ভাল নয়। আবার কখনও ল্যামিনেশন ঠিকঠাক হচ্ছে না, বা বাইন্ডিং দুর্বল। পত্রিকা ছাপার ব্যাপারটা নিয়ে যখন উদ্বিগ্ন, সেইসময় তাপসদার সঙ্গে আলাপ। তাপসদার সঙ্গে আলাপ ধ্যানবিন্দুর অভীকদার মাধ্যমে। ‘তবুও প্রয়াস’ তখনও প্রকাশনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। ‘বাংলার কুটির শিল্প’ সংখ্যা দিয়ে তাপসদার সঙ্গে আমাদের যাত্রা শুরু। একটা নিঁখুত প্রোডাকশন এল। এরপর বারোটা বছর অতিক্রম হয়ে গেল, কিন্তু ‘তবুও প্রয়াস’-এর অফসেট ছাপাতে বিকল্প কখনও ভাবতে হয়নি। (Memoir)
আরও পড়ুন: তবুও প্রয়াস: সত্যি গোপাল, মিথ্যে গোপাল
তাপসদা আছে মানে আমাদের চাপ নেই। কোনও বইয়ের অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু কাজ রেডি নেই। তাপসদা আছে হয়ে যাবে… কাঁচুমাচু মুখ করে ‘তাপসদা, এই বইটা অমুকদিন লাগবে…’ কর্কশ গলায় বলে দিত, ‘পারব না। তোরা মনে করিস, ট্রেসিং ধরে দিলেই বই হয়ে যাবে?’ তারপর ট্রেসিংটা নিয়ে বইপ্রকাশের দিন কিছু কপি ঠিক ব্যবস্থা করে দিতেন। আমরা জানতাম তাপসদার হাতে কাজ ধরিয়ে দিলে বাকিটা ওঁর দায়িত্ব। (Memoir)
প্রকাশনার শুরুতে আমি, সন্তুদা, তাপসদা দিনের পর দিন রাজুদার চায়ের দোকানে বা তার নরসিংহ লেনের প্রেসের রোয়াকে বসে কত আড্ডা দিয়েছি। প্রোডাকশন নিয়ে আলোচনা করেছি। বই তৈরিতে যেটুকু আমার হাতেখড়ি, তা তাপসদার থেকে। তাপসদার হাত দিয়ে ‘তবুও প্রয়াস’-এর কত বই যে বেরিয়েছে তার ঠিক নেই। আর গোটা কলেজ স্ট্রিটের কত বই তার হিসেব তাপসদাও বলতে পারতেন না। (Memoir)

বইয়ের হিসেব না হয় বাদ দিলাম… এই এত এত বই তাঁর হাত দিয়ে বেরোচ্ছে তার টাকাপয়সার হিসেব? সেটাও, রাখতেন না। ‘তবুও প্রয়াস’ ও আমার সঙ্গে তাঁর একযুগের সম্পর্ক। কিন্তু আজ অবধি কোনও পাকা বিল পাইনি। ওই মৌখিক আনুমানিক হিসেব। কী অদ্ভুত এক মানুষ! বইয়ের পর বই ছেপে যাচ্ছেন যেটুকু প্রয়োজন চেয়ে নিচ্ছেন বা বলা যায় আমরাই দিচ্ছি তারপর আর কোনও হিসেব নেই! (Memoir)
সেবার আমি ইয়ার্কি ছলে, ‘তাপসদা, তোমায় বোধহয় বেশি টাকা দেওয়া আছে, সেজন্য হিসেব দিচ্ছ না!’ সেই নির্মল হাসি… ‘দাঁড়া, দাঁড়া হিসেব করি দেখবি কে কত পাই’। এত হিসেব-হিসেব করতে করতে জীবনের হিসেবটুকুই আর হল না। (Memoir)
“মানুষটার একটা বড় গুণ ছিল অসম্ভব ভাল স্মৃতি শক্তি। কোন বই কী কাগজে ছাপা হবে, কোন ল্যামিনেশন হবে, কী বাইন্ডিং হবে, কত কপি ছাপা হবে… একবার বললেই স্মরণে থেকে যেত।”
কাজপাগল মানুষ। সাইকেল নিয়ে কলেজস্ট্রিটের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছুটছেন। কোনও ক্লান্তি নেই। কখনও আবার কারও বই ট্রান্সপোর্ট করাতে ছুটছেন ধর্মতলা। কিছুদিন ধরে অসুবিধা হচ্ছিল। এর আগেও একবার হার্ট সার্জারি করেছেন। কিন্তু পুজোর বইয়ের কাজ, পত্রিকার কাজ মিটিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। তাঁর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। সবার সব কাজ মিটিয়ে যখন গেলেন তখন বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। সবার কাজের দায়িত্ব নিয়েও নিজের জীবনটা অগোছালো রাখলেন। (Memoir)
সংসার করেননি। একসময় ভাল ফুটবল খেলতেন। সেটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। টাকা-পয়সার কোনও হিসেব রাখতেন না। এত এত বই ছাপছেন, না কোনও অফিস, না কোনও ঘর। সঙ্গী বলতে একটা সাইকেল আর বোতামওয়ালা ফোন। (Memoir)
সাইকেলের ক্যারিয়ারে কারও ট্রেসিং বা কভারে ডামি কপি। পুরো বইপাড়া যেন তাঁর অফিস। কাউকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিসেব দিচ্ছেন। কারও সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে প্রোডাকশন বুঝিয়ে নিচ্ছেন। (Memoir)
“একথা কলেজস্ট্রিট পাড়ার অধিকাংশ ছোট বা নতুন প্রকাশক স্বীকার করবেন, আজ তাঁদের প্রকাশনা গড়ে ওঠার পিছনে তাপসদার বিরাট এক অবদান ছিল।”
মানুষটার একটা বড় গুণ ছিল অসম্ভব ভাল স্মৃতি শক্তি। কোন বই কী কাগজে ছাপা হবে, কোন ল্যামিনেশন হবে, কী বাইন্ডিং হবে, কত কপি ছাপা হবে… একবার বললেই স্মরণে থেকে যেত। দু-একবার হয়তো গণ্ডগোল করতেন কিন্তু সেটা ধরার বাইরে। কাগজে লিখে দিলে হারিয়ে ফেলতেন। (Memoir)
মেলায় হয়তো কয়েকশো বই তাঁর ছোঁয়ায় প্রাণ পেত। সে সবটুকুও স্মৃতি থেকেই। কাজের প্রতি এই ভালবাসা না থাকলে স্মৃতিও বেইমানি করে। স্মৃতি আমাদের অলস জানালা। না খুললে সেখানেও জং পড়ে। কিন্তু যে স্মৃতি ভালবাসায় মোড়া, তা হীরের চেয়েও চকচকে। (Memoir)

একথা কলেজস্ট্রিট পাড়ার অধিকাংশ ছোট বা নতুন প্রকাশক স্বীকার করবেন, আজ তাঁদের প্রকাশনা গড়ে ওঠার পিছনে তাপসদার বিরাট এক অবদান ছিল। বিপুল কোনও লগ্নি ছাড়াই, বই ছাপা হয়ে যাচ্ছে দু-তিন কিস্তিতে টাকা দিয়ে। কেউ কেউ বই বেচে টাকা দিচ্ছেন। কারোর সঙ্গেই জোরাজুরি নেই। বলতেন, ‘আমি কখনও কারও ক্ষতি করিনি। আমার টাকা কেউ মারবে না। আমার দিদি আমায় দেখাশোনা করে। আমি নিজে আর কতটুকু খরচ করি। বছরে দু-বার পাহাড়ে যাই। ওটুকু হলেই যথেষ্ট।’ এত অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, কোনও সঞ্চয়ের জন্য না। তাঁর বছরে দু-বার পাহাড়ে গেলেই হবে। ট্রেকিং করতেন। ভালবাসতেন পাহাড়কে। পাহাড়কে ভালবেসেই বোধহয়, পাহাড়সম মন গড়ে তুলেছিলেন। (Memoir)
তাঁর লড়াকু মনোভাব হয়তো প্রথম জীবনের খেলা থেকেই এসেছিল। দিনরাত ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করতেন। কোনও কাজে বিরক্তি বা না ছিল না। শুধু কি বই ছাপা? যেকোনও প্রয়োজনে তাঁকে বললেই সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। বই দেওয়ার ব্যাগ লাগবে, বন্ধুর সেন্টারে অ্যাডমিট কার্ডের কভার লাগবে, ভাল ডায়রি লাগবে, প্যাকেজিং-এর কাগজ লাগবে— তাপসদাকে একবার জিজ্ঞাসা করলেই বিস্তারিত জানিয়ে দিতেন। (Memoir)
“অনেকদিন কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হয়নি। তাপসদার সঙ্গে দেখা হয়নি। এরপর আর অভিমান করবে না, বলবে না, কলেজস্ট্রিট গেছি, তাপসদার সঙ্গে দেখা করিনি বলে।”
এই মনে হচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে তাপসদা উঠছে… তাপসদার মৃত্যুটা আমাকে এত আঘাত দিয়েছে! অথচ, লোকটা সারাবছর আমাকে বকে গেল। তুই বইয়ের মাপ শিখলি না… অমুক জানিস না… তমুক জানিস না… কোনওদিন মিষ্টি করে কিছু বলত না। এই লোকটিকেই ভিতরে ভিতরে এত ভালবেসেছি টের পাচ্ছি।’ দেবোত্তমের কথাগুলো শুনতে শুনতে নিজের চোখও ছলছল করছিল। (Memoir)
দু-বছরে এত কাছের মানুষের মৃত্যু দেখেছি… কখনও কখনও বুকের কাছে চিনচিন করে ওঠে। নিজেকে সামলে নিতে হয়। অনেকদিন কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হয়নি। তাপসদার সঙ্গে দেখা হয়নি। এরপর আর অভিমান করবে না, বলবে না, কলেজস্ট্রিট গেছি, তাপসদার সঙ্গে দেখা করিনি বলে। আর কখনও বলবে না, সেলিম একটা উপকার করতে হবে— বাড়ির ইলেকট্রিক বিলটা দিতে হবে। বইমেলায় দেরিতে কাজ দিয়ে আর তাগাদা দিতে হবে না। মেলার মধ্যে সাইকেল ক্যারিয়ারে বই বেঁধে হাঁফাতে হাঁফাতে আর আসবে না আমাদের তাপসদা। (Memoir)
আরও পড়ুন: যে-লেখার শিরোনাম দেওয়া গেল না
দেখতে দেখতে বইমেলা চলে আসবে। গুচ্ছ গুচ্ছ বই ছাপাও হবে। কিন্তু হাসিমুখের কর্কশগলার সেই মানুষটি আর থাকবে না। বাইরে কর্কশ, ভিতরে এই অদ্ভুত সারল্যের এমন মানুষটিকে আর বইপাড়ায় দেখা যাবে না। গোটা বইপাড়া যখন চৈত্রের রোদে পুড়বে, ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল নিয়ে আর কেউ ছুটবে না। বৃষ্টি আসবে ভেবে আমাদের চোখের জল শুকিয়ে যাবে। (Memoir)
তারপর আবার আমরা ভাসব। আবার আমরা ডুবব। নৌকো ভেবে ডুবুরিকে খুঁজব। কিন্তু ডুবুরি কি জানবে আমাদের সেই নৌকার কথা, যে নৌকা ভাসতে চেয়ে গোটা নদীকে ভালবেসেছে… পৌঁছাতে চায়নি কোনও পাড়ে… (Memoir)
ছবি ঋণ: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সেলিম মণ্ডল থাকেন নদিয়ার চাপড়ায়। ‘তবুও প্রয়াস’ ও ‘ফারেনহাইট' পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি কবিতা, গদ্য, গল্প লিখে থাকেন। গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরতে ভালোবাসেন। লোকসংস্কৃতির প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার জন্য কয়েকটি পত্রিকা থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা।