(Bengali Novel)
বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব, রাস্তায় জ্যাম না থাকলে মিনিট পনেরো। এই সময় যাওয়ার পথে গাড়িতে উঠেই নিয়মিত দুটো ফোন সেরে নেয় মোহনা। এর খুব একটা হেরফের হয় না। (Bengali Novel)
প্রথম ফোনটা ডায়াল করা মাত্র ওপ্রান্ত থেকে শিপ্রা বললেন- বেরোলি?
-হ্যাঁ মা। তুমি কী করছ? রান্না হল?
-হ্যাঁ, অনেকক্ষণ।
-মনি এসেছে?
-হ্যাঁ। আজ সে আবার মেশোমশাইয়ের প্রিয় পার্শে এনেছে বাজার থেকে।
-তা হলে তো ভালই। বাবা কী করছে?
-কী আবার করবে? সকাল থেকে খবরের কাগজ হাতে, সেটা শেষ না হতেই টিভি চালিয়ে পৃথিবীর খবর শুনবে। আর আমার মাথা খাবে!
-তোমার মাথা কী করে খাবে মা? বাবা আজকাল জ্যান্ত মানুষ চিবিয়ে খাচ্ছে বুঝি! বলে হেসে উঠল মোহনা।
-সেই তো! তুই হলি বাবার মেয়ে। তার নামে অভিযোগ শুনবি কেন? আমার যত জ্বালা!
-আঃ মাঃ, হল কী সেটা তো বলো? (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: চতুর্থ পর্ব
-ওই যে টিভিতে দিন রাত এত জন মরল, এতজন আক্রান্ত, কোন রাজনৈতিক নেতা কী দুর্নীতি করে কার হেফাজতে গেল, ক’কোটি টাকা পাওয়া গেল, ডি এ পাচ্ছে না, বেকার ছেলেরা রাস্তায়… তোর বাবা এসব শুনবে, আর আমাকে সেগুলো রিলে করবে। এত নেগেটিভ খবর সকাল থেকে শুনতে আমার ভাল লাগে? এর আগে ছিল ভোট, এখন রোগ, সমাজের রোগ। এই জন্য আমি আজকাল ফেসবুক পর্যন্ত দেখি না। বিরক্ত লাগে! (Bengali Novel)
-একেবারে ঠিক করেছ মা। এত নেই-এর খবর মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু বাবাকে বোকো না। এই বয়সে সকলেরই একটা প্যানিক অ্যাটাক হয়। মন বিষণ্ণ থাকে। তার থেকে ভাবনাটা ঘুরিয়ে না দিলে মুশকিল। (Bengali Novel)

-আসলে মানুষটা করবেই বা কী! আগে যাও বা রাস্তায় বেরোত, আড্ডা দিত, তাদের অনেকেই এখন আর নেই। অনেকের ছেলে-মেয়েরাই বাবা-মাকে নিয়ে চলে গেছে নিজেদের কাছে। তার উপর রোজই কোনও না কোনও মৃত্যুর খবর পাচ্ছে। আর ভেঙে পড়ছে। শিপ্রা এবার বরের সপক্ষে যুক্তি সাজালেন। (Bengali Novel)
-বাবা ওষুধগুলো সব খাচ্ছে তো?
-তা খাচ্ছে। তবে রোজই বলে এসব খেয়ে কী বাঁচব? রোগ ধরলে কিছুই আর বাঁচাতে পারবে না।
-আঃ মা, যতসব ভুলভাল কথা। বাবাকে অযথা চিন্তা করতে বারণ করো। (Bengali Novel)
-এটাই তো বোঝাই রে। শুনলে তো! কিন্তু তোর এই রোজ অফিস যাওয়াটা না গেলেই নয়? এত গরম পড়েছে, দু-দিন ছুটি নিলেও তো পারিস। বৃষ্টি নামলে না হয় যেতিস… শিপ্রার কণ্ঠস্বরে মেয়ের প্রতি চিন্তা ও উদ্বেগ।
-কিছু হলে হবে। কোভিডের সময় তো ঘরেই ছিলাম দু’মাস। তাকে আটকানো গেল? হল তো! (Bengali Novel)
“আমাকে থামিয়ে সত্য কী লোকাতে পারবি? আসলে তুই কেন অফিস যাস রোজ আর কেউ না জানলেও আমি বুঝি।”
-সে তো তোর জন্যই হল। অফিস যেতে না পারলে কী হবে, লোকজন আসা তো বন্ধ করেনি। সেইজন্যই এত চিন্তা। রাই আর তোর শাশুড়ি মা এত অসহায় হয়ে গেছিল। জামাই এখানে থাকলে একটু বল পেত। সেও তো… শিপ্রার কথা শেষ হওয়ার আগেই মোহনা বলে উঠল-
-মা, তুমি থামো তো!
-আমাকে থামিয়ে সত্য কী লোকাতে পারবি? আসলে তুই কেন অফিস যাস রোজ আর কেউ না জানলেও আমি বুঝি।
-কী বোঝো তুমি? (Bengali Novel)

-ছোট্ট থেকে স্বাধীনচেতা তুই। বদ্ধ ঘরে একটানা থাকতে পারিস না। অফিসটা হচ্ছে তোর মুক্তির জায়গা। সেখানে তুই নিজের মনের স্বাধীনতাগুলোকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করিস।
-তা হলে তুমি বলছ, অফিসে আমার কোনও কাজ থাকে না? শুধু নিজের মতো সময় কাটাব বলে যাই?
-ও মা একথা কখন বললাম! তবে এটা তুই অস্বীকার করতে পারবি না, তোর এত কাজ নেই, যে না গেলে হবে না, ব্যবসা উঠে যাবে এমনটা। এখন তুই বাড়িতে বসেও কাজগুলো সামলাতে পারিস। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: তৃতীয় পর্ব
-মা তুমি যখন স্কুলে পড়াতে, তখন একদিনও কামাই করতে? তুমুল বৃষ্টি, আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তোমাকে চাইছি, তাও তুমি আমাকে মনির কাছে রেখে স্কুলে চলে যেতে। বলতে- না গেলে বাচ্চাদের পড়াবে কে? বাবাও অফিস চলে যেতেন। কই তখন তোমার মনে হত না তো, তুমিও একই স্বাধীনতা পেতে খানিকক্ষণের জন্য বাইরে যাচ্ছ। রাইয়ের তো আম্মা রয়েছেন, নাতনির বিষয়ে তার খেয়াল আমার থেকে হাজার গুণ বেশি। আমার তো ঠাম্মাও ছিল না। জন্মের তিন বছরের মাথাতেই চলে গেলেন। আমি মনির ভরসাতেই কাটাতাম মা। (Bengali Novel)

-তুই কোন প্রসঙ্গ থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিস মোহনা। তখনকার পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি কী এক! তোর শরীর কখনওই খুব সুস্থ নয়। মা হিসেবে আমার চিন্তা হবে না?
-নিশ্চয়ই হবে। তবে আমার কিন্তু মনে আছে জন্ডিস হয়ে যখন পড়েছিলাম, সেটা বেশ খারাপ পর্যায়ে চলে গেছিল, পরে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়েছিল, তুমি তাতেও ছুটি নাওনি।
-তোর দেখছি আমার প্রতি অনেক অভিযোগ। এই বয়সে এসে বুঝতে পারছি তুই আমার চাকরি করাটা মনে মনে মেনে নিসনি।
-আমি তা বলিনি। আমার কোনও অভিযোগ নেই। অযথা চিন্তা করো না। সাবধানে থেকো। বাবাকে বলো রাতে ফোন করব। একটা ফোন আসছে তখন থেকে, ধরে নিই। বলে বিতর্কের অবসান ঘটাতে চাইল মোহনা। (Bengali Novel)
“ভোরবেলা উঠে রান্না থেকে আরম্ভ করে সকলের টিফিন, মোহনাকে রেডি করে স্কুলে পাঠানো সবই তো একা হাতেই করেছে। মনি তো এ বাড়িতে এল মোহনা মাধ্যমিক দেওয়ার পর। তার আগের দিনগুলো কী তার মনে পড়ে না?”
-রাখ। তাড়াতাড়ি ফিরে যাস। অফিসেই থাকবি তো?
-হ্যাঁ মা। একটা মিটিং আছে। সেটা হয়ে গেলে ফিরে যাব। (Bengali Novel)
-বেশ। সাবধানে যাস। রাখলাম। শিপ্রা ফোন রেখে দিয়ে একটা শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা আজকাল কথায় কথায় অভিযোগ করে তাঁর চাকরি নিয়ে। কিন্তু একবারও ভাবে না আজ যেমন সে সারাদিন সংসারের চারদেওয়ালের মধ্যে একই কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে যায়, সেও তো তেমনই যেত। তাছাড়া তাঁর স্কুলের চাকরি এগারোটা থেকে চারটে ছিল। পাড়ার মধ্যেই। পাঁচ মিনিটও লাগত না পায়ে হেঁটে। এইটুকু সময় কী তাঁর প্রাপ্য ছিল না, সংসারের থেকে! কোনও কাজ তো সে ফেলে রেখে যায়নি কখনও। ভোরবেলা উঠে রান্না থেকে আরম্ভ করে সকলের টিফিন, মোহনাকে রেডি করে স্কুলে পাঠানো সবই তো একা হাতেই করেছে। মনি তো এ বাড়িতে এল মোহনা মাধ্যমিক দেওয়ার পর। তার আগের দিনগুলো কী তার মনে পড়ে না? (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: দ্বিতীয় পর্ব
আবার একটা নিঃশ্বাস বড় করে টেনে- মনি একটু চা দিবি? স্নানে যাব, বলে হাঁক দিল।
ভেতর থেকে উত্তর ভেসে এল- দিই বউদি।
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিতস্তা ঘোষাল ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি', 'সারস্বত সম্মান', 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার', 'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, 'দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান', 'বিজয়া সর্বজয়া', 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে?