(Aalo)
আজ থেকে পনেরো বছর আগের পৃথিবীটা একটু অন্যরকম ছিল। আমাদের ছিল মফস্বলের বিকেলে জনহীন স্টেশন, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার কাঁচা দুঃখ, মাঠের আল ধরে দুই কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া সত্যদার কোচিং, আর ছিল সদ্য চুমু খাওয়ার মুহূর্ত। যা কিছু প্রথম সব আলো হয়েই থেকে যায় জীবনের চলার পথে। তাল কাটে, ছন্দ মেলে না, তবুও চাপা আলোর নিশান আমাদের স্বপ্ন দেখায়। এমনই এক যুগ-সন্ধিক্ষণে আমরা ভিটে মাটি ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়ি, বড় শহরের উদ্দেশে। জমানো পুঁজি ভেঙে আমাদের বাবা-মা, সন্তানদের থেকে শারিরীক দূরত্বে গেলেও, একটা আলাদা আনন্দ আনে পরিবারে। আর সেই আমাদের প্রথম একা হওয়া। পরিবার ছাড়লেও নতুন অনেক পরিবার তৈরি হয়ে যায়। শৈশবের সঙ্গে খুব একটা সামঞ্জস্য না থাকলেও সমান্তরাল এক পৃথিবীর সুখ-দুঃখে ভরা নতুন উপন্যাস লিখিত হতে থাকে চুপিচুপি। (Aalo)
আরও পড়ুন: আলো: পর্যটক, উন্নয়ন ও পাহাড়: আলো ক্রমে আসিতেছে?
যে আলো আমরা মায়ের সূত্রে পাই, তার গতিপথ ক্রমশ বদলাতে থাকে। আমার জীবনেও ঢুকে পড়ে প্রথম দশকে একা বাঁচতে শেখার আলো। জুন মাস এলে মনে পড়ে অনার্সের জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট– ইন্টারভিউ– ভর্তি হওয়া। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের বন্ধুদের সেই প্রথম ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া। অনেক দূর থেকে আমি গিয়ে পড়লাম বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে। রেসিডেন্সিয়াল হস্টেল। যে জীবনে ছিলাম, তার চেয়ে ভিন্ন-ব্যতিক্রমী একটা নির্জন জীবন। (Aalo)

মে-জুন-জুলাই মাসের বৃষ্টি স্মৃতিউদ্রেককারী– মনখারাপের৷ নতুন বন্ধু, নতুন অভ্যাস, নতুন করে স্বাবলম্বী হওয়ার আনন্দও। বৃষ্টির বিকেলে গঙ্গার ওপারে কাশীপুর শ্মশানের দিকে চেয়ে থাকা বন্ধুর বাবার সদ্য পোড়ানো চিতার দিকে। এই মাসগুলোতে এসব কিছু ভেদ করে বৃষ্টি আসে। হাইরাইজ ভেদ করে বিকেলের সূর্যের আলো শরীরে লাগলে মনের আলোর বদল হতে থাকে। এ সময়ের বৃষ্টি মানে প্রথম কলকাতা আসার দিন। প্রথম কলেজস্ট্রিট, প্রথম শ্যামবাজার, প্রথম পাটুলির ঝিলপাড়, প্রথম আকাশবাণী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতেও বৃষ্টি পিছু ছাড়েনি। (Aalo)
এসব ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনকার সকালটাও সুন্দর হয়ে ওঠে। একটানা একটা গান চলতেই থাকে। স্মৃতিরোমন্থন আসলে পিছুটান, চাইলেও ফেলে আসা যায় না। আশ্চর্য হয়ে একটা গোটাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। সেই মুহূর্তের গান আসলে স্মৃতির আলো। (Aalo)

বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার– আপাত অর্থে ‘মেয়েলি’ কাজ করছে একদল ছেলে। বাড়ি থেকে বহুদূর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে এসে শিখে নিচ্ছে জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ছেলে-মেয়ের বিভেদ মুছে ফেলে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠছে। সেখানে তুমুল আনন্দে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়া আছে, বিষণ্ণতায় অন্যের কাঁধে মাথা রেখে কান্না আছে, শরীরখারাপে বন্ধুর জন্য খাবার এনে দেওয়া আছে, প্রতি সন্ধেয় একসঙ্গে পড়তে বসা আছে, সকালের ক্লাসে নিজের পাশে বন্ধুর জন্য জায়গা রেখে দেওয়া আছে, আর আছে মায়ের মতো যত্ন। বই পড়া বিদ্যা যে আসলে জেন জি-র সমাজে খুব একটা কাজে আসছে না, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। (Aalo)
“ছয়টি শীত পার করা সেই চঞ্চল ছটফটে বন্ধুজন আমার সঙ্গে ভাগ করে নিত সকালের টুথপেস্ট, বিলম্বিত দুপুর, বিকেলের চা, সন্ধের বেগম আখতার, মধ্যরাতের হিমভেজা গড়ের মাঠ। মনে মনে আমরা বন্ধু পাতিয়েছিলাম।”
আমাদের সেই হস্টেল জীবনও আসলে শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমিত ছিল না, সে-জীবন আমাদের বলতে চাইত বাইরের পৃথিবীটা অনেক বড়, তাকে যুঝতে হলে নিজের আরামের মধ্যে থেকে বেরোতে হবে। তাই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে খুঁটিনাটি সবটা শিখে নেওয়া কিন্তু মন্দ না। যদিও অন্যদের থেকে আমাদের সেই হস্টেল জীবন একটু আলাদাই ছিল। কারণ সেখানে কোনও ‘কিংবা’, ‘অথবা’ এসবের গুরুত্ব ছিল না। ‘করতেই হবে’ – এই আদেশ আয়ত্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল বটে, কিন্তু এ-জীবনে এসে এতদিন পর বুঝি একার পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর, কোনওকিছু আটকে থাকে না, বরং করেকম্মে নেওয়া যায়। জীবনে আলো এসে পড়ে তার নিজস্ব স্বভাবে। (Aalo)

আবার পিছন ফিরে তাকাই। শূন্যতা দেখার চোখ আমার নেই। বরং যা-কিছু স্নেহের, যা মরমে গেঁথে দিল অনেকগুলো বছর, তাকে চোখ মেলে দেখি। দেখি আলোর উড়াল। বহুদিন কোনও যোগাযোগ না রাখলে কি বন্ধুর মন আর আমার মন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! যায় না। কিন্তু আমার কথা অন্য। ছয়টি শীত পার করা সেই চঞ্চল ছটফটে বন্ধুজন আমার সঙ্গে ভাগ করে নিত সকালের টুথপেস্ট, বিলম্বিত দুপুর, বিকেলের চা, সন্ধের বেগম আখতার, মধ্যরাতের হিমভেজা গড়ের মাঠ। মনে মনে আমরা বন্ধু পাতিয়েছিলাম। তারপর রক্ত শিরায় শিরায় সঞ্চালন হতে থেকেছে পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা। একদিন সে শিকড়চ্যুত হল। হাসপাতাল থেকে বাড়ি– নির্নিমেষ জীবনের দিকে যাত্রা– সে যে কী দুর্গম! তারপর হঠাৎ মুষড়ে পড়ল বৃষ্টি। একরাশ মিথ্যে দিয়ে আমায় সাজাল চুয়া-চন্দনে। (Aalo)

যার গোটা শরীর জুড়েই মিথ্যে– দেখা মিথ্যে, যাপন মিথ্যে, ভালোবাসা মিথ্যে, যৌনতা মিথ্যে, বন্ধুত্বও মিথ্যে। মাঝে মাঝে সেসব মিথ্যেকে স্মরণ করা উচিত। কারণ কিছু বন্ধুবিয়োগ শান্তি দেয়। যন্ত্রণার মলম হয়ে ওঠে তার না-থাকা। কিছু বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে ওঠে প্রিয় নেশার মতো। এই বিচ্ছেদ ব্যথা দেয় না, মুক্তি দেয়। এই মুক্তি আগামীর সম্ভাবনা, আমার ক্ষতচিহ্নে ফুটে ওঠা ফুল। আলো-বাতাস না পেলে ফুল মরে যায়, তাই আলোর পথ আমাদেরই নির্মাণ করতে হয় প্রতিটা পদক্ষেপে। (Aalo)
“অতি দ্রুত কিংবা খানিক ধীর লয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানি আমাদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ‘বাড়ি’ নামক ধারণা বদলাতে থাকে। বাবা-মায়ের পর কখনও বন্ধু অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে ওঠে বাড়ি, আমরা আশ্রয় পাই।”
আলো শুধু স্মৃতির হাত ধরে না, আগামীর ছন্দের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার ধর্ম। এই যে উচ্চশিক্ষা বা পেশার প্রয়োজনে আমরা ছোট গ্রাম বা মফস্বল থেকে বড় শহরে আসি, হয়তো তার সবটা জুড়ে আলো থাকে না। কিন্তু চলার পথে অন্ধকারের কালো না থাকলে আলোর দীপ্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। স্কুল, টিউশন পেরিয়ে হস্টেল অথবা মেসজীবন আমাদের সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে জেগে ওঠা আলোর মুহূর্ত রচনা করে চলে বারবার। পরিবার ছেড়ে একবার অন্তত একা থাকতে না জানলে একটা বৃহৎ জীবনের খোঁজ আমরা হারিয়ে ফেলতে থাকি। আমাদের আপাত জীবনের মধ্যবিত্ততা কখনও আগুনের ফুলকির মতো দ্রিমিদ্রিমি জ্বলে ওঠে, অসহ্য হয়ে যায় কিছু মুহূর্ত। তারপরেও একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়। (Aalo)
আরও পড়ুন: আমাদের রেখা, আমাদের ঋতুপর্ণ
বহুদূর থেকে এসে পড়াশোনা বা পেশার নতুন জীবনের আলোয় আমাদের নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। ক্ষুদ্র ‘আমি’র খোলস ছেড়ে ক্রমশ বৃহৎ ‘আমি’র উদ্দেশ্যে আমাদের রওনা দেওয়া– দুর্বিষহ হলেও সত্যি– একাকিত্ব এলেও সত্যি। তারপর অতি দ্রুত কিংবা খানিক ধীর লয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানি আমাদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ‘বাড়ি’ নামক ধারণা বদলাতে থাকে। বাবা-মায়ের পর কখনও বন্ধু অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে ওঠে বাড়ি, আমরা আশ্রয় পাই। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আলো ছড়ানোর আগে নিজেকে আলোকিত হতে হবে। আমার সেই ফেলে আসা দেশের বাড়ি, হস্টেল, মেস আমাকে শিখিয়েছে আলো খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়া। (Aalo)
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নয়, বরং সচেতনে আলোর ঝলকানিতে আমার নব আঙ্গিকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হতেই থাকবে প্রতিটা দশক আর যুগে। জীবন সেই উৎসারিত আলোর মতোই তীব্র, উজ্জ্বল, রোমহর্ষক। আমাদের সব আলো ভাল হোক। (Aalo)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত ভার্সনে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
একজন কবি, গদ্যকার এবং সাংবাদিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘গওহর জান’, ‘উড়তে চললাম কমরেড’, ‘ঘুম হও অজস্র অপরাজিতা’, ‘বিলম্বিত দুপুর’, ‘ও ডার্লিং তুমি শুধু দৃশ্যমান হাওয়া’। একটি দৈনিক অনলাইন মিডিয়ার সহযোগী সম্পাদক ও বিষয়বস্তু প্রধান।