(Shirshendu Mukhopadhyay)
শীর্ষেন্দুদার নাকি নব্বই বছর বয়স হল! ধুর, মানা যায় নাকি! এখনও তো দিব্য ট্র্যাক সুটের প্যান্ট আর টিশার্ট পরিহিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহিরুহ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে দেখা যায় দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্কের রাস্তায় সান্ধ্যভ্রমণ করতে। লেখা তো জীবনের নিত্যসঙ্গী, কিন্তু অনায়াসে বক্তব্য রাখেন পিকাসোর ছবির বিষয়ে আবার কখনও স্মৃতিচারণে ডুবে যান সমরেশ বসুর সঙ্গে কুম্ভমেলার অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে। বিজ্ঞানমনস্ক গুরুগম্ভীর ব্যক্তির তকমা নিয়ে তেনাদের মানে ভূতেদের ভৌতিক কার্যকলাপ অস্বীকার করেন না।
তাঁর লেখা কাহিনি অবলম্বনে, বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, ছবি নিয়ে এখনও আগ্রহ আছে। কিন্তু নিপাট বিশ্লেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবির পর্দায় চোখ রাখা, তাঁর না পসন্দ। বলেন একজন দর্শকের আগ্রহ নিয়েই ছবি দেখতে হয়, নাহলে ছবি দেখার মজাটাই অধরা রয়ে যায়। মজা লাগে যখন দেখি শহর কলকাতার একটা পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে একই মঞ্চে ক্লাইভ লয়েড, যোগেন চৌধুরী এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একই সঙ্গে সম্মানিত হন! একই জায়গায় ক্রিকেট ব্যাট, লেখার কলম আর চিত্রকলার তুলি। কি অদ্ভুত সহবস্থান! (Shirshendu Mukhopadhyay)

শান্তিনিকেতনের অতিথিনিবাসের বাগানে ঠান্ডা শেতল সাঁঝবেলায় দাঁড়িয়ে আমাদের ভূতের গল্প শুনিয়েছেন! আধাত্মিক পথের পথিক শীর্ষেন্দুদা সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। ২০১০ সালে কবীন্দ্র রবীন্দ্রের জন্মসার্ধশতবর্ষে শান্তিনিকেতনের ‘লিপিকা’ প্রেক্ষাগৃহে, রবীন্দ্ররচনা ভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ নিয়ে ওঁর সামনে হাজির হলে স্নিগ্ধ মুখে কড়া নির্দেশ, ‘যেতে পারি কিন্তু দু’দিনের সফরে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাদ্য পরিবেশন করতে হবে, এমনকি পেঁয়াজবর্জিত’!
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাত্ত্বিক রূপটি বড় সুন্দর। কিঞ্চিত রোমাঞ্চবোধ করেছিলাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে ওঁর সহযাত্রী হতে পেরে। ফেরার পথে ওই শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসেই শীর্ষেন্দুদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত চিত্রকর যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে। ট্রেনযাত্রার সময়ই দেখেছিলাম চা নামক পানীয়টির প্রতি শীর্ষেন্দুদার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও ট্রেনের লেবু চা তাঁর বড্ড প্ৰিয়! (Shirshendu Mukhopadhyay)
২০০৮ সালের কোনও এক সময় শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে পরিচয়, তারপর থেকে পথচলার নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা। এই ঘনিষ্ঠতা শ্রদ্ধার আর স্নেহের। তিনি এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যাঁকে দূরাভাষে খুব সহজেই পাওয়া যায়! ইংরেজি শব্দ ‘হ্যালো’-র পরিবর্তে তিনি ‘হ্যাঁ বলুন’ বলে কথোপকথন শুরু করেন। এইরকম ‘হ্যাঁ বল’ বলার পরে একদিনের কথোপকথন আজও মনে আছে। তার আগে বলে নিই যে ততদিনে ‘বলুন’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে আমার ক্ষেত্রে ‘বল’ হয়েছে। সেই সময় আমি শহরের এক দৈনিক সংবাদপত্রে কর্মরত, ২০২০ সাল আর করোনাকাল। সবার সঙ্গেই দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ বন্ধ। আমরা গৃহবন্দী। (Shirshendu Mukhopadhyay)
“উনি মনে করেন যে চলচ্চিত্র যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুকারিতা করে যায়, তবে সেখানে কোনও কল্পনার অবকাশ থাকবে না এবং একই সঙ্গে উক্ত ছবিটিও উচ্চমানের চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে না।”
আগস্ট মাস, আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, প্রণব মুখোপাধ্যায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে নতুন দিল্লির সেনা হাসপাতালে ভর্তি। প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ এবং কাছের মানুষদের থেকে জানতে পারি চিকিৎসকদের চেষ্টা আর তৎপরতা সত্ত্বেও খুব বেশি আশা নেই। প্রণববাবুর স্নেহধন্য হয়েও কর্তব্যর খাতিরে ওঁর আসন্ন মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আগাম শোকসংবাদ প্রস্তুত করার কাজে তখন আমি নিয়োজিত। (Shirshendu Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: প্রিয় গান ও দ্বিজেনদা
ওঁর সম্পর্কে সব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ আর বক্তব্য সংগ্রহ করছি। একদিন ফোন করলাম শীর্ষেন্দুদাকে। ফোন করে আমার উদ্দেশ্য জানাবার পরে মার্জনা চেয়ে নিলাম, জীবিত একজন ব্যক্তির আগাম সংবাদ তৈরির জন্য। কী করব, আমি নিরুপায়! সাংবাদিকদের কাজটাই যে এমন! দূরাভাষের ওপার থেকে শীর্ষেন্দুদা আস্বস্ত করে বললেন, ‘লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ নেই, সংবাদপত্রে এইরকম ধারাতেই কাজ করতে হয়।’ (Shirshendu Mukhopadhyay)

আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘খোঁজ করলে হয়তো দেখবে আমারটাও কোনও সংবাদপত্র আগাম লিখে রেখেছে।’ কলকাতা দূরদর্শনের ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ বিভাগে একবার ‘চলচ্চিত্র ও সাহিত্য’ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে সমগ্র আলোচনাটির সঞ্চলনা করেছিলাম। আলোচক হিসেবে ছিলেন দিব্যেন্দু পালিত এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তখন দেখেছিলাম শীর্ষেন্দুদার চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ। উনি বলতেন, ‘অনেক সময় গল্প নির্বাচন করে চিত্রনির্মাতারা সাহিত্যিকের কাছে আসেন চিত্রনাট্য দেখাবার জন্য, কিন্তু আমি মনে করি সেটা দেখে কোনও লাভ নেই কারণ আমি তো চলচ্চিত্রকার নই, তাই আমি যদি চিত্রনাট্য দেখে কোনও পরিবর্তন করে দিই তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।’ (Shirshendu Mukhopadhyay)

উনি মনে করেন যে চলচ্চিত্র যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুকারিতা করে যায়, তবে সেখানে কোনও কল্পনার অবকাশ থাকবে না এবং একই সঙ্গে উক্ত ছবিটিও উচ্চমানের চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে না। মনে আছে ওই অনুষ্ঠানে দিব্যেন্দুদাও শীর্ষেন্দুদার বক্তব্যকে সর্মথন করেই নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বসাহিত্যর প্রতিও শীর্ষেন্দুদার অসীম আগ্রহ। মনে করি একজন ভাল সাহিত্যিকের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। (Shirshendu Mukhopadhyay)

গত কয়েক বছরে যোগেন চৌধুরী সেন্টার ফর আর্টসের জন্য একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজন করার পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেশি বেড়েছে। এমন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া তো ভাগ্যের বিষয়! আজ নব্বই বছরেও তিনি সক্রিয়। আশা রাখি শীর্ষেন্দুদার জন্ম শতবর্ষে তাঁর উপস্তিতিতে আবার আরও একটি নতুন লেখা লিখতে পারব ওঁকে নিয়ে। (Shirshendu Mukhopadhyay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি ঋণ: লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
