(Homestay)
ডমিনিক ল্যাপিওর এবং ল্যারি কলিন্সের লেখা বই “ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট”-এর পাতায় পড়েছিলাম “…the 565 maharajas, nawabs, rajas and rulers… still reigned as absolute, hereditary sovereigns over one third of India’s land surface and a quarter of her population. They reflected the fact that under the British there had been two Indias, the India of its provinces, administered by the Central Government at Delhi and the separate India of her princes… Whatever their political proclivities, however, the future of India’s ruling princes, with their average of 11 titles, 5.8 wives, 12.6 children, 9.2 elephants, 2.8 private railway cars, 3.4 Rolls Royaces and 22.9 tigers killed, posed a grave problem in the spring of 1947”.(Homestay)
স্বাধীনতার প্রাক্কালে সারা ভারত জুড়ে খেতাবি রাজাদের এই বাড়-বাড়ন্ত নিয়ে কিঞ্চিৎ রসবিলাস করেছিলেন দুই লেখক। বাস্তবে ১৭৯৩ সালে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত”-র ফলে, বাংলা সহ, দেশের বিভিন্ন জায়গায়, এই প্রাদেশিক রাজা, জমিদার এবং ভূ-স্বামীদের সামাজিক অবস্থান এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে, তাঁরা দিনের পর দিন হয়ে ওঠেন ধনবান। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাজ পরিবারের মানুষেরা ব্রিটিশ রাজ বাহাদুরের সঙ্গে সরকারি কাজ, ব্যবসা, সামাজিক মেলামেশা এবং সৎ কর্মের সূত্রে ভূষিত হন নানা উপাধি এবং খেতাবে। যুদ্ধ বিগ্রহ করে এঁরা কেউই রাজা হননি। এঁরা অনেকেই স্বায়ত্ত শাসনের সুবিধা পেতেন। তাঁদের অপার ঐশ্বর্যের অন্যতম সূচক ছিল সুরম্য প্রাসাদ বা অট্টালিকা যার অন্দরমহল, বারমহল ঘিরে তৈরি হত এক ভিন্ন জগৎ। জীবনের দৈনিকতার মধ্যেই জন্ম নিত কত সুখ দুঃখের কাহিনি। (Homestay)
কখনও বা তমসাবৃত কোনও এক অধ্যায়, সময়ের স্রোতে লোকমুখে হয়ে যেত রহস্য, রোমাঞ্চের টকে ঝালে মোড়া কোনও জনশ্রুতি। স্বাধীনতার পর এঁদের এলাকা ভারতের সঙ্গে মিশে গেলে সরকারি পক্ষ থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত প্রাপ্য তুলে দেওয়া হল এবং তাঁরা ধনী ও সাধারণ নাগরিক হয়ে রইলেন দেশের নানা প্রান্তে। তার সঙ্গে পড়ে রইল সেইসব প্রাসাদোপম অট্টালিকা, যার পরতে পরতে সময় কেটে গেল জীর্ণতার আলপনায়। কড়ি বরগা, খিড়কি, ফটক, আলশে, জাফরি, খিলানে জমে উঠল বিষণ্ণতার ভিড়- বালাখানা, নাচঘর, চণ্ডীমণ্ডপ, দুর্গাদালান, রসুইঘর, নাটমন্দির, বৈঠকখানা, কাছারিঘর জুড়ে শূন্যতা। (Homestay)

মনে হবে “প্রাচীন অট্টালিকার সেসব ধ্বংসাবশেষ– কোথাও একটা থাম, কোথাও একটা দেউড়ির খিলান, কোথাও কোনও মন্দিরের ভগ্নাংশ, মহাকালের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যর্থ আশায় দাঁড়িয়ে আছে”। (Homestay)
পরিবার ছোট হয়। যে মানুষেরা একদিন ছিলেন প্রাসাদের বাসিন্দে, কেউ বা এসে দাঁড়ান জীবনপথের প্রান্তে, কেউ বা জীবিকার তাগিদে ছড়িয়ে পড়েন দেশে বিদেশে। সে অট্টালিকা ক্রমশ চলে যায় স্মৃতির অন্তরালে। শরিকি মালিকানার জালে জড়িয়ে পড়ে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খসে পড়ে তার পলেস্তারা, রঙ আর বাহারি পঙ্খের কাজ। এবার তার গায়ে লাগে এক নতুন তকমা- “হেরিটেজ প্রপার্টি” বা “ঐতিহ্যবাহী সম্পত্তি”! (Homestay)
“কলকাতা শহর, তার আশেপাশের জেলা, উত্তরবঙ্গেও এখন হেরিটেজ হোমস্টেয়ের ছয়লাপ। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের কালে যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মিশেল ঘটেছিল তার প্রভাব ভীষণভাবে দেখা যায় এই সব প্রাসাদের স্থাপত্যে।”
ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যাকে পর্যটকের কাছে তুলে ধরা যাবে এক রুচিসম্মত, আরামদায়ক, রাজ রাজড়ার স্মৃতি বিজড়িত সময় যাপনের ব্যবস্থা হিসেবে, যার পোশাকি নাম “হোম স্টে”! (Homestay)

আসলে নস্টালজিয়া নিয়ে আমরা বাঁচতে ভালবাসি। সে নিজের শৈশব হোক বা ইতিহাসের পাতায় পড়া কোনও রাজা-রাণীর কাহিনি। রাজা-রাজড়াদের অন্দরমহলের জীবনযাত্রা, যার বেশিটাই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে তাকেই অনুভব করবার ইচ্ছে, উদগ্র বাসনা থেকেই মানুষ পৌঁছে যায় আধুনিক সাজে সজ্জিত কোনও পুরনো হাভেলি বা অট্টালিকায়। (Homestay)
শহরের কেজো জীবনযাত্রার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মুক্তি চায় তার ক্লান্ত প্রাণ, অতীতের নস্টালজিয়া তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় আলো আঁধারির স্মৃতিপথে। সে দু-দণ্ড শান্তি পায় দূর দেশে কোনও এক প্রাসাদের সঙ্গোপনে। (Homestay)
“কৃষক ও জলদস্যুদের বিদ্রোহ দমন করার বিনিময়ে, তাঁকে বর্তমান বাংলার অদূরে ৩০০,০০০ একরেরও বেশি জমি উপহার দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সাল থেকে এখানে তিলে তিলে গড়ে ওঠে হোম স্টে।”
ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে গড়জাট পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঢেঙ্কানলের সিং দেও রাজ পরিবারের প্রাসাদ “ঢেঙ্কানল প্যালেস” প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খসে পড়া পলেস্তরা, উই ধরা কড়ি বরগা, দরজা জানালা খানিক মেরামত করে ১৯৯০ সাল নাগাদ পরিবারের বঁধু মিনাল ঝালা সিংদেও শুরু করেছিলেন হোম স্টে, যা আজ ওড়িশার পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান। (Homestay)

শুধু বিলাসবহুল পরিবেশে সময় কাটানোই নয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় কারুকাজ যেমন ডোকরা, পটচিত্র, ইক্কত শাড়ি ইত্যাদির ভাণ্ডার, যা কেনা যায় একেবারে শিল্পীদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে। (Homestay)
কলকাতা শহর, তার আশেপাশের জেলা, উত্তরবঙ্গেও এখন হেরিটেজ হোমস্টেয়ের ছয়লাপ। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের কালে যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মিশেল ঘটেছিল তার প্রভাব ভীষণভাবে দেখা যায় এই সব প্রাসাদের স্থাপত্যে। কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে ধান্যকুরিয়া প্রাসাদ গ্রাম উল্লেখযোগ্য। ১৭০০ শতাব্দী থেকে দাস, গায়েন, সাহু, বল্লভদের মতো বহু ব্যবসায়ী পরিবার এখানে তৈরি করেছিলেন ইউরোপিয়ান আদলে অট্টালিকা। (Homestay)

এক ঝলকে দেখলে মনে হয় এই বুঝি সেই রূপকথার সিন্ডেরেলার ক্যাসল। Corinthian Pillar, Arch, Embrasure প্রভৃতি ইউরোপিয়ান ভাবধারা এবং দেশজ ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন স্বাদের স্থাপত্য কীর্তি। এখানে রয়েছে সাহু বাড়ির হোম স্টে। কলকাতা ছাড়িয়ে, দেড় ঘণ্টার দূরত্বে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বাওয়ালি রাজবাড়ি ঘিরে রয়েছে মন্ডল রাজবংশের এক অসাধারণ পারিবারিক ইতিহাস, যা চারশো বছরেরও বেশি পুরনো, এবং যার সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবর, তাঁর সেনাপতি জয়পুরের মহারাজা সওয়াই মান সিং এবং উত্তরপ্রদেশের একজন প্রতিশ্রুতিশীল সেনা কর্মকর্তা শোভা রাম রায়ের মাধ্যমে। (Homestay)

কৃষক ও জলদস্যুদের বিদ্রোহ দমন করার বিনিময়ে, তাঁকে বর্তমান বাংলার অদূরে ৩০০,০০০ একরেরও বেশি জমি উপহার দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সাল থেকে এখানে তিলে তিলে গড়ে ওঠে হোম স্টে। হুগলি জেলার “ইটাচুনা রাজবাড়ি” বা নবদ্বীপ সংলগ্ন মহেশগঞ্জ এস্টেটে “বালাখানা হেরিটেজ হোম স্টে”, ঝাড়গ্রাম জেলার “দেব রাজবাড়ির হোম স্টে”, মুর্শিদাবাদের “কাশিমবাজার রায় রাজবাড়ি”- পর্যটনের ম্যাপে এখন এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। (Homestay)
“পুরনো রাজবাড়িতে ভূতের উপদ্রব নিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যাও কম নয় এবং সেগুলিও কম বেশি ধুঁয়ো দিয়েছে আমাদের বিশ্বাসে। কিন্তু আজ অবধি তেনাদের চাক্ষুষ দর্শনপ্রাপ্তি ঘটেছে বলে শুনিনি!”
খানিক উত্তরে যাওয়া যাক…
দার্জিলিঙয়ের কাছে ২৭ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট জনপদ তাকদাহ। মনোরম পাহাড়ি দৃশ্য এবং চা বাগানের জন্য সুপরিচিত, তাকদাহ একসময়ের ব্রিটিশ সেনানিবাস এলাকা হিসেবে পরিচিত। বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী বাংলো এই বিশাল চা বাগানের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত যা তৈরি হয়েছিল সম্ভবত ১৯১১ সাল নাগাদ। এর বাসিন্দা ছিলেন সৈন্য বাহিনীর ছোট বড় অফিসার। চা বাগানের আশেপাশের এলাকাটি তাকদার আরেকটি প্রধান আকর্ষণ, যেখানে স্থানীয় অর্কিড ফুল, পাইন এবং দেবদারু গাছ প্রকৃতির ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে। বাংলোগুলি এক শতাব্দীরও বেশি পুরানো হলেও, তার কয়েকটি ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে সেখানে তৈরি হয়েছে হেরিটেজ হোমস্টে। রাজবাড়ির তকমা না থাকলেও, পাশ্চাত্য স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে বাংলোর প্রতিটি কোণে। (Homestay)

১২ নম্বর বাংলোর বর্তমান মালিক মিঃ নরবু শুনিয়েছিলেন এক অদ্ভুত গল্প। অতিমারির সময়ে তাঁর সঙ্গে সমাজ মাধ্যমে পরিচয় হয় জনৈকা বিদেশিনীর। কথা প্রসঙ্গে জানা যায় তাঁর পূর্ব পুরুষরা একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন তাকদাহের সেনা ছাউনিতে, চাকরি সূত্রে। অতিমারির পর তিনি এসেছিলেন তাকদাহে বাপঠাকুরদার ভূমি একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য! এও আসলে সেই নস্টালজিয়া, যার আকর্ষণে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়! (Homestay)

তবে হেরিটেজ হোমস্টে নিয়ে কথা হবে আর ভূতেরা সেখানে থেকে যাবে ব্রাত্য, এ হতে পারে না! পুরনো রাজবাড়ি বা বাংলোয় থেকে যাওয়া এই বাস্তু ভূতেরা সেই “ক্ষুধিত পাষাণ”-এর আমল থেকে আমাদের, অর্থাৎ যারা এখনও মরণের এপারে, তাদের মাতিয়ে রেখেছে। পুরনো রাজবাড়িতে ভূতের উপদ্রব নিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যাও কম নয় এবং সেগুলিও কম বেশি ধুঁয়ো দিয়েছে আমাদের বিশ্বাসে। কিন্তু আজ অবধি তেনাদের চাক্ষুষ দর্শনপ্রাপ্তি ঘটেছে বলে শুনিনি! (Homestay)
অতীন্দ্রিয় সম্পর্কে এই গাল-গল্পেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জন্ম নেয় রাজপরিবারের অন্দরমহলে, তারপর ক্রমশ তারা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। হয়তো বা একে ঘিরে যে রোমাঞ্চ তাও সেই হেরিটেজ হোম স্টে-এর অতিথি হিসেবে উপরি পাওনা! (Homestay)
ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি চটি, সরাই, পান্থশালা, হোটেল, গেস্ট হাউজ, হলিডে হোম পেরিয়ে এবার মজেছে হোমস্টেতে। পায়ের নীচে সর্ষে লাগানো বাঙালি, পথের টানে বেরিয়ে কোথাও যেন ঘরের উষ্ণতার স্বাদ পায় হোমস্টে-এর আলিঙ্গনে, তার আতিথেয়তার আস্বাদনে। সুদূর অতীতের ফেলে আসা রীতি, রেওয়াজ, স্বাদ, গন্ধ তাকে নাড়া দিয়ে যায়– আর এভাবেই দেশ ভ্রমণের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে সে পেয়ে যায় ঐতিহ্যময় ইতিহাসের সন্ধান। (Homestay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।
