(Bengali Novel)
মোহনার কল রেখে দেবার পর রূপাঞ্জন খানিকক্ষণ মোবাইলটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এই পার্থিব পৃথিবীতে যে কয়েকজন মানুষের প্রতি, নিজের স্ত্রী সন্তান ছাড়া টান অনুভব করেন, তাঁদের মধ্যে একজন মোহনা। সম্পর্কটার বয়সও তো হল নয় নয় করে প্রায় পনেরো বছর। তখন মোহনা এই পেশায় আসেনি। তার আর মোহনার অফিস একই বিল্ডিং-এ। মোহনার এইটথ ফ্লোর, ওঁর নাইনথ। যদিও দপ্তর আলাদা। লিফটে দেখা হত, কিম্বা ক্যান্টিনে। অল্প চোখাচোখি, একটু হাসি। ধীরে ধীরে মৌখিক পরিচয়। (Bengali Novel)’
মোহনাই প্রথম কথা বলেছিল।
-কোন অফিসে আছেন আপনি?
-শিপিং। আপনি?
-ট্রেডিং।
উত্তরটা শুনে খুব হেসেছিল সে। একজন শিপিং অন্য জন ট্রেডিং। বেশ মজার।
-হুম। আপনি কোথায় থাকেন?
-নর্থে। আপনি?
-বাইপাসে। কীভাবে অফিসে আসেন?
-মেট্রোতে। আপনি?
-আমি পুলকার।
-এক সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে? যদি আপনার আপত্তি না থাকে। মোহনার প্রস্তাব শুনে প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়েছিল সে।
-ঘাবড়ে গেলেন? আরে এখানেই খাব। বাইরে যেতে বলছি না। আসলে আজ একটা লং মিটিং করে ক্লান্ত লাগছে। তাই ভাবলাম একটু রিল্যাক্সড হই নীচে নেমে। চা তো রুমেই দিয়ে যায়। ওই একটু অক্সিজেন নেওয়া বাইরের বাতাস থেকে।(Bengali Novel)

এরপর আর আপত্তি করেনি রূপাঞ্জন। ক্রমশ অসম বয়সী দু’জন মানুষের মধ্যে এক অজানা ভালবাসা ভাল-লাগা তৈরি হয়ে গেল। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে দ্রুত নেমে এসেছিল সম্পর্ক।
মোহনাই বলেছিল- আমি না আপনি বলতে পারি না বেশিক্ষণ। যদি তুমি বলি আপনি প্লিজ মাইন্ড করবেন না। আসলে আপনি মাইন্ড করলেও আমি তুমিই বলব। আপনি-টা আমার আসে না।
রূপাঞ্জন এতদিনের অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে এটুকু বুঝেছিল তুমি বললেও এ মেয়ে গায়ে পড়া নয়। ফলে নিশ্চিন্তে আপনি থেকে তুমির যাত্রা শুরু হয়ে গেল।
এরপর মোহনার দ্রুত পদোন্নতি, হেড কোয়ার্টারে যোগ দান, মেট্রোর বদলে গাড়ি… (Bengali Novel)
“মোহনা যখন এই অফিস থেকে চলে গেল মোবাইল নাম্বার নিলেও তার মনে দ্বিধা তৈরি হয়েছিল আদৌ কী তার সঙ্গে আর যোগাযোগ থাকবে? নাকি আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাকে ভুলে যাবে নতুন কাজের চাপে!”
রূপাঞ্জন একেবারেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত। মফস্বল থেকে শহরে এসেছিল চাকরি করতে। তারপর অফিসেরই এক কলিগের বোনকে বিয়ে করে কলকাতায় থিতু। স্ত্রী মিতুল আর ছেলে অনির্বাণকে নিয়ে তার সংসার। অসুখী বলা যায় না তাদের। যদিও তার নাটকের ও বইপত্রের প্রতি অসম্ভব টান, প্রতি সপ্তাহেই এই দু’টোর জন্য শয়ে শয়ে টাকা খরচ নিয়ে মিতুলের সঙ্গে ঝামেলা লাগে, তবুও দু’জনেই রোজগার করে বলে, সংসারে অভাব নেই। মিতুল বকাবকি করলেও মোটের উপর মেনেই নিয়েছে তার এই শখকে। সেও মিতুলের দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবার শখকে মেনে নিয়েছে। বছরে নিয়ম করে যেকোনও সুখী মানুষের মতোই তারা তিনজনে ঘুরতে চলে যায়। অবশ্য কোথায় যাওয়া হবে, থাকা হবে- এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মিতুলই নেয়। সে খালি সহমত পোষণ করে সঙ্গী হয় তাদের। (Bengali Novel)

এই নিয়ে তার খেদও বিশেষ নেই। সব যে এক জীবনে মনের মতো হবে না এই তত্ত্বে সে বিশ্বাস করে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। তার মধ্যেই মোহনার সঙ্গে পরিচয় হল। মেয়েটার সবচেয়ে বড় গুণ কারোর নিন্দে, সমালোচনা করে না। এমনকি, যদি মিতুলের কোনও বিষয় নিয়ে তার মনে রাগ অভিমান জন্মায়, সে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, মিতুলদি ঠিকই বলেছেন, বা করেছেন। তোমারই বরং ভুল। (Bengali Novel)
মোহনার এই আচরণগুলো ক্রমশই তার প্রতি শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালবাসার জন্ম দিয়েছে। মোহনা যখন এই অফিস থেকে চলে গেল মোবাইল নাম্বার নিলেও তার মনে দ্বিধা তৈরি হয়েছিল আদৌ কী তার সঙ্গে আর যোগাযোগ থাকবে? নাকি আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাকে ভুলে যাবে নতুন কাজের চাপে! (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: পঞ্চম পর্ব
বেশ কয়েক মাস সত্যি আর যোগাযোগ ছিল না। তারপর একদিন হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। সেদিন সে অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের জন্য কিছু জিনিস কিনছিল মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে গায়ে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখে মোহনা। (Bengali Novel)
-বাপরে বাপ! গাড়ি থেকে হর্ণ দিচ্ছে কত আমার ড্রাইভার। আমি ডাকছি। শুনতে পাচ্ছ না? আজব মানুষ তো তুমি!
-আমি বুঝব কী করে তুমি আমাকে ডাকছ? আমাকে যে তোমার মনে আছে এখনও এটাই তো আশ্চর্যের!
-কী রে ভাই! মনে থাকবে না কেন? আমি কী পালটে গেছি! নাকি মোহনা চৌধুরী থেকে নায়িকা মোহনা হয়ে গেছি?
-তা হয়তো হওনি। কিন্তু এত বড় চাকরি, গাড়ি… আমি তো খুবই সামান্য। তাই ভাবলাম।
-সে তো আমিও ভেবেছি। আমাকে তোমার আর মনেই নেই। একটা ফোনও করোনি, খোঁজও নাওনি। যাহোক এখন অভিযোগ পর্ব থাক, গাড়িতে উঠে এসো।
-কোথায় যাব এখন? আমি তো বাড়ি ফিরব ভাবছিলাম। (Bengali Novel)

-আমি তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব না নিশ্চয়ই। একটা ভাল নাটক এসেছে আকাদেমিতে। পাস পেয়েছি। তাই ভাবলাম তোমার অফিসে গিয়ে কার্ডটা দিয়ে আসি। নাটক আমি বুঝি না, এসব তুমি ভালবাসো।
-আমার জন্য তুমি কার্ড দিতে আসছিলে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
-এই দেখো এতে অবিশ্বাসের কী হল? আরে ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় একটা নাটক, দাঁড়াও বলছি, আগে গাড়িতে ওঠো। বলে প্রায় জোর করেই গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিল মোহনা। (Bengali Novel)
“তবু মাঝে মাঝে ভয় লাগে তার। এত দ্রুত লাইম লাইটে এসে যাচ্ছে মোহনা, শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে তো!”
-আসলে এই নাটকের একটা স্পন্সর আমাদের কোম্পানি। ফলে অনেকগুলোই পাস পেয়েছি। হাতে পেয়েই আগে তোমার কথা মনে হল। তুমি নাট্যপ্রেমী। বলে ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে রূপাঞ্জনের হাতে দিল মোহনা। দিদি বা ছেলে কেউ যাবে? তাহলে আরও একটা আছে। দিতে পারি।
সেই প্রথম রূপাঞ্জন সাহস করে বলল- যদি কিছু মনে না করো, তুমি গেলেই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগবে।
-আমাকে তো একবার যেতেই হবে। তবে নাটক বসে দেখব এমন ভাবনা নেই। একটু চুপ করে বলল- তিনি তো খুব নামী নাট্যকার, অভিনেতা। বেশ চলো, তার নাটক দিয়েই আমার নাটক দেখা শুরু হোক। তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ সময়ও কাটানো যাবে, আবার নাটক দেখাও হবে। বলেই হেসে উঠল- একে বলে এক সাথে রথ দেখা কলা বেচা- ঠিক বললাম? (Bengali Novel)

দুজনেই হেসে উঠেছিল। সেই থেকে প্রতিদিন টেলিফোনে যোগাযোগটা থেকে গেল। এর মধ্যেই মোহনা চাকরি ছেড়ে শ্বশুরের পারিবারিক প্রকাশনা সংস্থায় যোগ দিল। সেদিন মোহনার অন্য পরিচিতদের কতটা আনন্দ বা কতটা ঈর্ষা হয়েছিল, তা তার জানা নেই। তবে তার খুব আনন্দ ছিল সীমাহীন। মনে হয়েছিল একশো বছরের বেশি একটা সংস্থাকে পুনঃর্জ্জীবিত করার জন্য যা যা গুণ দরকার, তার সবটাই মোহনার আছে। যেটা নেই, সাহিত্য জগত সম্পর্কে বিস্তৃত পড়াশোনা! কিন্তু সে নিজের চেষ্টায় সেই বাধাও কাটিয়ে ফেলবে– এই বিষয়ে কোনও সংশয় ছিল না। (Bengali Novel)
তার অনুমান যে কতটা নির্ভুল ছিল, তার প্রমাণ সে এই কয়েক বছরেই উপলব্ধি করেছে। বাংলার সব কটি ইউনিভার্সিটি, কলেজ, বড় বড় প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া হাউজ সব জায়গায় মোহনা এক আলোচিত নাম। সাহিত্য বা কলেজস্ট্রিট বইপাড়া নিয়ে যেকোনও আলোচনায় তার বক্তব্য সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। (Bengali Novel)
সব মিলিয়েই মোহনা আলোচিত। তবু মাঝে মাঝে ভয় লাগে তার। এত দ্রুত লাইম লাইটে এসে যাচ্ছে মোহনা, শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে তো! স্লো বাট স্টেডি- এই মন্ত্রে বিশ্বাস করে না মোহনা। তার মূল মন্ত্র–নাও অর নেভার। এখনই করতে হলে করো, নইলে তা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। কালকের জন্য, আগামীর জন্য ফেলে রাখা যাবে না। এই আছি, এই নেই জীবনে এই মুহূর্তটাই একমাত্র সত্যি রূপাঞ্জন- মোহনার এই কথাগুলো কতটা সত্যি ও স্থায়ী হবে তা ভবিষ্যৎ-ই জানে! ভেবে টেবিলে রাখা একটা বই তুলে নিল রূপাঞ্জন। বইটার নাম- জীবনের ঝড়া পাতা। (Bengali Novel)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিতস্তা ঘোষাল ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি', 'সারস্বত সম্মান', 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার', 'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, 'দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান', 'বিজয়া সর্বজয়া', 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে?
