(Late Autumn)
হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় হাঁটতে বেড়িয়েছি, আকাশে তখন কনে-দেখা আলো লেগে আছে। ক্যালগেরিতে এই সময়টাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। গ্রীষ্মের শেষে হালকা শীতের আভাস, অথচ ঠান্ডাও পড়েনি। তাপমাত্রা আপাতত ২০-এর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আজ আকাশ রূপকথার গল্পের রাজকন্যের মতন কূঁচবরণ নীলাম্বরী শাড়ি পরেছে। পায়ের নীচে ঘাস এখনও ঘন সবুজ। বাতাসে মন ভালো-করা গন্ধে শীতের কলকাতা-কলকাতা ভাব। উদাস মন বারবার কলকাতার স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। কানাডায় হেমন্ত ঋতু, যেন সাত সূর্যের রথে চড়ে এক দিব্যকান্তি পুরুষ হয়ে দেখা দেয়। হেমন্ত এদেশে গ্রীষ্ম আর দীর্ঘ-শীতের মাঝে একটা ছোট্ট হাইফেন চিহ্নের মতন। তার মেয়াদ বড় জোড় এক বা দেড় মাসের (সেপ্টেম্বার থেকে মাঝ-অক্টোবার)। (Late Autumn)
“ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে, আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে। রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস, যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।” (Late Autumn)

হেমন্তের সন্ধ্যায় ব্যস্ত জনপথে একা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতে খুব ভাল লাগে। আজ আমি হাঁটছি, আর দু’চারটে লোক আমার আগে-পিছে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। রাস্তায় একটার পর একটা গাড়ি সাঁই সাঁই শব্দে চলে যাচ্ছে। পথের দু’ধারে গাছে গাছে সোনালি পাতা ফুলের মতন ফুটে আছে। দূরে বাদামি পাহাড়ের বুকে ঘন কালচে সবুজ পাইন বনে সোনালি পত্রমোচি গাছেরা জ্বলছে। পশ্চিম কানাডায় হেমন্তে গাছের রঙ হলদে-সোনালি, আর পুবে কমলা-লাল। (Late Autumn)

আমাদের এদিকে কানাডার বিখ্যাত ম্যাপল গাছ নেই বলে, লাল রং হয় না। পশ্চিমে লার্চ, এস্পেন গাছেরা পাতা ঝরার আগে হলুদ রং-এ সাজে। হেমন্তের ছোট হতে থাকা দিনগুলো আর মৃদু তাপমাত্রা, গাছেদের কাছে শীতের আভাস বয়ে আনে। পাতার সবুজ ক্লোরোফিল সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। সেই ফাঁকে কমলা-লাল-হলুদ রঙ আত্মপ্রকাশ করে। গাছেরা এবার পুরোপুরি খাবার তৈরি করা বন্ধ করে দেবে। শীতকাল নেমে আসবার আগেই পর্ণমোচী গাছেরা পাতা ঝরিয়ে একেবারে ন্যাড়া হয়ে যায়। এইভাবে পত্রবিহীন গাছেরা হেমন্তের শেষে শীতঘুমে যায়। এটা ওদের কানাডার মারাত্মক শীতে টিকে থাকবার একমাত্র কৌশল! (Late Autumn)

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় হলুদ পাতার নাচন দেখতে খুব ভাল লাগছে। দমকা হাওয়ায় গাছ থেকে একটা দু’টো করে পাতা খসে, প্রজাপতির মতন উড়ছে। পাড়ায়, পার্কে ঘুরে অনেক ফটো তুলেছি। আমি সব সময় ভাললাগার মুহূর্তগুলোকে মুঠোফোনে ধরে রাখবার চেষ্টা করি। প্রকৃতির ফটো তোলা আমার অন্যতম নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ফোন ঘাঁটলেই এক গোছা হলুদ গাছের ছবি পাওয়া যাবে! (Late Autumn)

প্রকৃতির কী অদ্ভুত নিয়ম। এরপর দু’একদিন টানা ঝরের মতন দমকা হাওয়ায় পাতা “খসানো শুরু” হয়ে যাবে। অর্থাৎ হেমন্ত খুব শিগগিরি চলে যাবে। (Late Autumn)

গত রবিবার হেমন্তের রং দেখতে পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন বেশ গরম। কানাডাতে এই সময় পাহাড়ের অপূর্ব রূপ! ক্যালগেরিতে এত তাড়াতাড়ি বরফ এসে যায়, যে হেমন্তকে ধরতে না ধরতেই তিনি বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যান। তাই আমাদের মতন পাহাড়প্রেমীরা, একটু ফাঁক পেতেই পাহাড়ে দৌড় দেয়। মাত্র ৪৫ মিনিটেই Kananaskis-এ চলে এসেছিলাম। পাহাড়ে ঢুকে দেখি কালচে-সবুজ বনে রং লেগেছে। পর্ণমোচী গাছেরা হালকা-হলুদ, কমলা, সোনালি-হলুদ রঙে সেজেছে। যাক, পাহাড়ে এখনও রং আছে। একবার শুধু ন্যাড়া গাছ দেখে মন খারাপ করে ফিরেছিলাম। তখন বিকেল ৫টা বাজে। পাহাড়ি পথে সূর্য একবার বাঁ দিকে, একটু পরেই বাঁকের শেষে ডানদিকে চলে যাচ্ছে। (Late Autumn)

হেমন্তের পথে ঘন সবুজ পাইন গাছের সামনে কমলাভ-হলুদ পর্ণমোচী গাছের সারি। পিছনে নীল পাহাড়। দু’পাশে ক্রমশ আবছা হতে থাকা বনের মধ্যে একটা কোণায় ঝকঝকে রোদ্দুর। সূর্য যেন spotlight এ আলো ফেলেছে। মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগে কলকাতায় মুক্তাঙ্গন মঞ্চে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। স্টেজে মুখ্য চরিত্রদের মুখে ঘুরেফিরে spotlight ফেলা হচ্ছিল। সেদিন প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে সূর্যদেবও যেন হলুদ গাছের মাথায় spotlight ফেলেছিলেন। কি অসাধারণ সুন্দর! তাঁর চেয়ে বড় শিল্পী আর কে আছে! (Late Autumn)

এবার আজকের কথায় ফিরি। এই যে অলসভাবে হাঁটছি তার একটা আলাদা আনন্দ আছে। প্রাচীন গাছে ঢাকা রাস্তাটা আমার খুব প্রিয়। গ্রীষ্মে প্রায়ই হাঁটতে আসি। আজকাল দিন ছোট হয়ে, সাতটার মধ্যে সন্ধ্যে নামছে। দিন আর রাত্তিরের সন্ধিক্ষণটা ভারি মনোরম। চারপাশ, স্বভাবত শান্ত-নম্র। রাস্তার দু’পাশে বাড়িগুলোকে ভিতরের আবছা আলোয় আর্টিস্টের স্টুডিওর মতন লাগছে। ভিতর থেকে রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। কোথাও নিশ্চই একটা ভারতীয় পরিবার থাকে। পরোটা ভাজার গন্ধ পাচ্ছি। কলকাতাকে খুব মনে পড়ে গেল। (Late Autumn)

এইরকম শীতের হালকা ঠান্ডায়, এগরোল চাউমিনের গন্ধ মেখে উপচে পড়া ভিড় ঠেলে গড়িয়াহাটে যাচ্ছি। হাতে ঝাল মুড়ির ঠোঙা। রাস্তায় বাস, মিনিবাস, গাড়ির হর্ণ, জানজট। এই সময়ে মা সন্ধ্যে দিয়ে, টিভিতে সিরিয়াল দেখে। ধূপের চেনা চেনা গন্ধটাও যেন ভেসে আসছে। বাবা ঘরে বসে পুরানো বই পড়ছে –বিভূতিভূষণের আরণ্যক? লেক কালিবাড়িতে পুজো দিয়ে মায়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছি। শীতের ফুটপাথে মানুষ গুটিসুটি আগুন পোহাচ্ছে। দু’জনে ভাঁড়ে চা খেলাম, কিছুদূরে গিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে জলপাই সন্দেশ। হেমন্তের মায়াবি সন্ধ্যায় কলকাতা কাছে চলে এল। মনটা খুশি খুশি লাগছে। বাইরের হাওয়াও খুব রিফ্রেশিং, নতুন এনার্জি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। (Late Autumn)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি ঋণ: লেখক
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
