(Homestay)
নানান বয়সিদের নিয়ে আমাদের ‘বুধবারের আড্ডা’য় সেদিন সিনিয়র আড্ডাবাজ অজয়দা শুরুতেই বললেন প্রকৃত ভ্রমণ বলতে তোরা কী বুঝিস? আর এখনকার হোমস্টে কনসেপ্ট নিয়েই বা তোদের কী মতামত? পাকা চুলওয়ালা চঞ্চলদা বললেন- একসময় ভ্রমণ বলতে তীর্থস্থান বা দেবস্থান দর্শনই মূল ছিল। আর এখন হোমস্টে বস্তুটা এমনই ব্যাপকতা নিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা মানে একটা জগঝম্প বিতর্কসভার আয়োজন করা! (Homestay)

প্রবীণ শিক্ষক অর্ধেন্দুদাকে বলা হল মাস্টারমশাই আপনি শুরু করুন। অর্ধেন্দুদা শুরু করলেন- আমার কাছে ভ্রমণের সংজ্ঞা মানে আট বছর বয়স থেকে, বত্রিশ বছর অব্দি অর্থাৎ কী না টানা ২৪ বছর সময়ের জীবনটা জুড়ে অখন্ড ভারতবর্ষের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ প্রান্ত পদব্রজে চষে বেড়ানোর মন্ত্র জপ। দক্ষিণের কালাডি থেকে নর্মদা তীর। বারাণসী-হরিদ্বার-নৈমিষারণ্য। শ্রীক্ষেত্র হয়ে বদ্রিক্ষেত্র। চরম শ্বাপদসংকুল চড়াই-উতরাই পথ ডিঙিয়ে অবিচল লক্ষ্যে চলা। আচার্য শংকর মাত্র ৩২ বছরের জীবনে যা করে গেছেন। পরবর্তীকালে অতীশ-দীপঙ্কর, চৈতন্যদেব কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের পরিব্রাজনও আমার পথ চলার প্রেরণা। পথে মাধুকরী করে চাল-ডাল ফুটিয়ে অন্ন গ্রহণ আর দেবালয় বা চটিতে রাত্রিযাপন। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: এসো আমার ঘরে এসো
চৈতন্য অনুগামীরা তাঁর পরিভ্রমণ পথে গড়ে ওঠা চটি, খড়ের চালার বিশ্রামস্থল কিংবা দেবালয়ের দালানে আশ্রয় নিয়ে, তার পাশেই কাঠকুটো জ্বালিয়ে দু-মুঠো ফুটিয়ে উদরপূর্তি করে আবার চৈতন্যপথে এগিয়ে চলতেন। এমন গমন-দর্শন-ভোজন-শয়নই আমার ভ্রমণ দর্শন। (Homestay)
এবার শক্তিব্রত বলতে শুরু করল- যুগ যুগ ধরে পথশ্রম ও পিপাসায় তৃষ্ণার্ত সাধু-সন্তদের এগিয়ে চলাটাই প্রকৃত ভ্রমণ ছিল, আর তাদের কষ্ট নিবারণে আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে ১৮৮০ সালে পরমহংস স্বামী বিশুদ্ধানন্দজীর উপলব্ধিতে গড়ে ওঠা ‘কালি কমলি’ ধর্মশালাই ছিল হোমস্টের আদিরূপ। সাধু-সন্ত মুনিঋষি বা ভক্তপ্রাণ মানুষজনের, পা দুটোই ছিল সম্বল। কী চরম কৃচ্ছ সাধনের মধ্যে দিয়ে ওঁরা পথ চলতেন। আজ তো ‘কালি কমলি’ ধর্মশালা এক কিংবদন্তি। ভালোবাসার দানে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে ওদের প্রায় ৯০ টির উপর ধর্মশালা। লঙ্গরখানার ভাত ডালেই অপরিসীম পুষ্টি।

আর এককালে সচ্ছল বাঙালির বার দুয়ার অর্থাৎ বৈঠকখানা ছিল মূল বাড়ির কিছুটা বাইরে, যেখানে অতিথি আশ্রয় চাইলে গৃহস্থ বিমুখ না করে তাকে সেই ঘরে স্থান দিত। সঙ্গে সরা ভরা সিধে সাজিয়ে আহারের বন্দোবস্ত করত। এটাই তো আমাদের সাবেকি সনাতন হোমস্টে। (Homestay)
চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মিন্টেদা উশখুশ করে বলে উঠল- এ তো পুরো ধর্মের পালে হাওয়া বইছে দেখছি! আমি কিছু বলি? পর্বতারোহী মিন্টেদার প্রায় ৫০ বছর পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা। সকলেই উৎসুক। মিন্টেদা শুরু করল- দেখো আজকের বেড়ানোটা বা বর্তমানের হোমস্টে ব্যবস্থাপনা আমরা ৪০-৪৫ বছর আগেও অন্য ধাঁচে পেয়েছি। একবার হর কি দুন ট্রেক করে ওসলা গ্রামে ফেরার পথে সারাদিন তুমুল বৃষ্টি। থামার কোনও লক্ষণ নেই। আমাদের দিশেহারা অবস্থা। এমন সময় আচমকা সাক্ষাৎ পেলাম দুই মেষপালকের। ওদের পাঁজা করে সাজানো পাথরে ঘেরা অস্থায়ী ছাউনিতে ঢুকে আমরা প্রাণে বাঁচলাম। আমাদের সঙ্গে থাকা সব খাবার নষ্ট। ওদের জমানো খাবার ভাগাভাগি করে খেয়ে একটা রাত ওই ছাউনিতে কাটিয়ে ওদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ওসলা গ্রাম পৌঁছে উঠলাম গাইডের বাড়িতে। (Homestay)
“পুলিশ কর্মীটি ধরাচূড়া দেখে সোজা গারদ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন- ‘আভি কোই ক্রিমিনাল নেহি হ্যায়, ইস লিয়ে ইঁহাই রহ যাইয়ে’। জাদরেল শ্বশুরও কি এমন খাতির করবে?”
বাড়ি মানে কাঠ দিয়ে ঘেরা টিনের ছাউনি, তাতেও পাথরের খাঁজ কাটা কাটা শোয়ার জায়গা। সেখানে ঠাসাঠাসি আমরা সব ম্যাট্রেস বিছিয়ে ফেললাম। গাইডের মা চমৎকার আলুর পরোটা আচার আর মোরব্বা খাওয়ালেন। আমাদের তখনও হাত-পা প্রায় অবশ। উনি আমাদের গরম কাপড় সেঁকে সেঁকে দিতে থাকলেন। প্রকৃতই শরীরে যেন বল ফিরে পেলাম। এমন হোমস্টের উদাহরণ আর পাই কোথায়?
আরেকবার ভারী মজার অভিজ্ঞতা, সিকিমের দিক থেকে ফালুট আসছি। চরম কুয়াশায় দিন না রাত বোঝাই দায়। কোনওমতে ডেনটামে পৌঁছে হাজির হলাম পুলিশ চৌকিতে, একটু যে থাকার ব্যবস্থা দরকার। পুলিশ কর্মীটি ধরাচূড়া দেখে সোজা গারদ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন- ‘আভি কোই ক্রিমিনাল নেহি হ্যায়, ইস লিয়ে ইঁহাই রহ যাইয়ে’। জাদরেল শ্বশুরও কি এমন খাতির করবে? কয়েদি দের যারা খাবার সাপ্লাই দেয় তারাই মূল্যের বিনিময়ে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। (Homestay)

সেদিনের কয়েদখানার ঘুমটা মনে হয়েছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘুম। আর এখন তো ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর যুগ। গিন্নি, ছানাপোনা নিয়ে বাবু পাহাড়ে চড়ছেন। পছন্দসই লোকেশনে টেন্ট খাটানো, বায়ো টয়লেটের ব্যবস্থা, প্রয়োজনে টেন্টে অক্সিজেন সাপ্লাই সব করে দেয় এজেন্সি। তিনজন টুরিস্টের জন্য চারজন মালবাহক। তোমার চোখ যেখানে আটকে যাবে সেখানেই ওরা তোমার জন্য হোমস্টে বানিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে দেবে। নে ভাস্কর এবার তুই বল- এই বলে বসে পড়ল মিন্টেদা। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: পর্যটনের নয়া ঠিকানা হেরিটেজ হোমস্টে
আমি বললাম- তাহলে আজ আমিই শেষ করব, অন্যরা ইচ্ছে হলে পরের দিন বলবে। দেখো আমার ঠাকুরদা হোল্ডঅলে সংসার বেঁধে প্রাক-স্বাধীনতা কালে রেললাইন পাতার সার্ভে করতেন। পরিবার নিয়ে তাঁবুতে বসবাস। লাইন আর সংসার দুটোই ছিল চলমান। সেটাই ছিল আমার বাবা-জ্যাঠার দেশ ভ্রমণ। স্বাধীনোত্তর কালে দেশজুড়ে কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করল। সরকারি ক্ষেত্রে এলটিসি ভাতা ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটা বাঁক আনল। রেল বিভাগ গ্রুপ ট্যুরের জন্য CTT কোচ বরাদ্দ করল, যার মধ্যেই থাকা-খাওয়া-রান্না-স্নানের ব্যবস্থা। নিজেদের নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ট্রেনের কামরা বড় স্টেশনে পৃথক(কাটা) হয়ে যেত। টিমের বাজার সরকার ব্যাগ হাতে ছুটত স্থানীয় বাজারে। পরিবারের মহিলারা স্নান সেরে প্ল্যাটফর্মের রোদে বসতেন চুল শুকোতে। (Homestay)

একথা অনস্বীকার্য রেল কামরায় থ্রি-টিয়ারের ব্যবস্থা মধ্যবিত্তের ভ্রমণ লিপ্সাকে ‘দশ কদম’ এগিয়ে দিয়েছিল। এককালের ঈর্ষা জাগানো পাঞ্জাব মেল কিংবা তুফান মেল আজ একদমই দুয়োরানি। ‘৯০ দশকের আর্থিক খোলা হওয়ার কারণে বর্তমানে ভুখ হরতাল বাসের বদলে গড়ে আড়াই জন যাত্রী পিছু শেভ্রলে কিংবা হুন্ডাই জাতীয় চারচাকা ছুটছে চারধাম দর্শনের নামে। কালি কমলি বা ঝুনঝুনওয়ালা ধর্মশালায় উঠে গঙ্গায় অবগাহনের বদলে রিসর্টের সুইমিং পুল বেটার চয়েস। আমি তো যুগের তালে ৩০/৩২ বছর আগে হলিডে হোমের ক্যাটালগই বানিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে বাজারের ব্যাগ নিয়ে শুধুমাত্র পুরীতেই মধ্যবিত্তকে অল্পবিস্তর খুঁজে পাবেন। (Homestay)
তবুও ওই এক ক্লিকেই অনলাইন পেমেন্ট আপনার পরিবারের থাকা-খাওয়া-গাড়ি নিশ্চিন্ত করে ভ্রমণপ্রেমীদের বড় অংশকেই ডাকছে- ‘আয় চলে আয়, আয় চলে আয় ঝড়ের পাখি, আমি যে তোর সঙ্গী হবার স্বপ্নে বিভোর পথের পানে চেয়ে থাকি….’
হোমস্টে কনসেপ্ট এখন তো আর নতুন নেই। বেনামে কালো টাকার যোগান, নব্য ধনী শ্রেণির হেরিটেজ প্রপার্টি বা জমিদার বাড়িতে রাত কাটাবার আসক্তি এসব বাজার গরম করে স্ট্যাটাস বাড়ায়। তবে এটা একদমই ঠিক কথা ছোট সংসারে কর্তা গিন্নি দু’জনেই চাকুরে হওয়ার দৌলতে অবসর কমেছে। টাইম ম্যাচিং হওয়াটা কঠিন শব্দজব্দের মতো। তবে এই হোমস্টের মার্কেটিং-কে কামাল করে দিতে মানুষের হাতে এসে গেছে মুঠোফোন। এক ক্লিকেই চলে আসছে নিত্য নতুন চোখ জুড়ানো ছবির মতো হোমস্টে। যেখানে পাহাড়ের অতি নির্জনে হোটেল করলে ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে চিন্তা থাকে সেখানে বাড়ির মালিক যদি দু’তিনটে ঘরকে হোমস্টে বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয় তাহলে সিজনে লক্ষী লাভ নিশ্চিত। (Homestay)

ভ্রামণিক ছোট পরিবারটি সঙ্গী না পেয়েও হোমস্টে মালিকের আতিথ্য, আন্তরিকতা ও সান্নিধ্যে কাটিয়ে খুশি মনে ঘরে ফেরে। আর হোমস্টে যদি পেট(পোষ্য) ফ্রেন্ডলি হয় তাহলে কেয়াবাত! আরামদায়ক সুসজ্জিত ঘর ও বিলাসী ব্যবস্থাপনার ক্যাটাগরি অনুসারে কাঞ্চনমূল্য নির্ধারিত হয়। আয়েশী মেজাজে দু-চার দিন কাটাতে হোমস্টে এখন অপরিহার্য বা অবিচ্ছেদ্য। সব ফাই ফরমাশ তামিল হয়ে যায়। তবে হোমস্টে নাম দিয়ে বারো-চোদ্দটা ঘরকে আমি হোটেলই বলব যেখানে তোমরা কেউ মালিকের দেখাই পাবে না। বাড়ির লোক রান্না করে দিচ্ছেন কি? (Homestay)
আরও পড়ুন: আলো: আলো: ফেলে আসা দেশের বাড়ি, হস্টেল, মেস জীবনের আলো
স্থানীয় সংস্কৃতি বা যাপনের নামগন্ধই নেই। তিন-চার বার চা-কফি, বন ফায়ারের ব্যবস্থা, কবজি ডুবিয়ে খানাপিনার ত্রুটি হবে না সেখানে। আর সন্ধ্যের পর ডাইনিং হলটা ডিস্কো ঠেক বলে ভ্রম হতেই পারে। নির্জনতাপ্রেমী পর্যটকের প্রাণ সেখানে ওষ্ঠাগত। (Homestay)
তবুও ওই এক ক্লিকেই অনলাইন পেমেন্ট আপনার পরিবারের থাকা-খাওয়া-গাড়ি নিশ্চিন্ত করে ভ্রমণপ্রেমীদের বড় অংশকেই ডাকছে- ‘আয় চলে আয়, আয় চলে আয় ঝড়ের পাখি, আমি যে তোর সঙ্গী হবার স্বপ্নে বিভোর পথের পানে চেয়ে থাকি….’ (Homestay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ভাস্কর রায় প্রায় আজন্ম বেড়ে উঠেছেন ভদ্রেশ্বরে। কর্মজীবন ছিল কলকাতার বেসরকারি বিদ্যুত সংস্থায়। খেলাধূলা, রাজনীতি এবং সংগীতে বরাবরের আকর্ষণ। গত চল্লিশ বছর মননের অনেকটা দখল করে রেখেছে ভ্রমণ। 'ভ্রমণ আড্ডা'র অন্যতম স্থপতি এবং ওই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম একজন। একজন ব্যতিক্রমী ধারার ভ্রমণ লেখক।
