(The Voice of Hind Rajab)
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ক্লোজিং ছবি ‘ভয়েস অফ হিন্দ রাজাব‘ দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি আজকের সময়ের এক তীব্র আর্তি, ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা এক জীবন্ত দলিল। ঠিক যেমন ১৯২৫ সালের ‘ব্যাটলশীপ পোটেমকিন’-এর মতোই এই ছবি সমসাময়িক রাজনীতির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মানুষের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তবে এটি কেবল প্রতিবাদের স্বর নয়— এ যেন অসহায় মানবতার শেষ আর্তি, যা আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি। (The Voice of Hind Rajab)
এক শিশুর কণ্ঠস্বর, যুদ্ধের বিরুদ্ধে বার্তা
ছয় বছরের ফিলিস্তিনি বালিকা হিন্দ রাজাব। একটি ফোনকল, গাড়ির অন্ধকারে আটকে থাকা এক ছোট্ট শিশু, যার চারপাশে কেবল মৃত্যু। গোটা ছবি জুড়ে ভেসে আসা তার কচি কণ্ঠস্বর— একদিকে যুদ্ধের হিংস্র ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে জীবন আর মৃত্যুর দোলাচল। হিন্দ কোনও রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়নি, কোনও বড় কথা বলেনি। তার আর্তি ছিল মাত্র দুটি শব্দ— “আমি ভয় পাচ্ছি… আমাকে নিয়ে যাবেন?” এই ভয় কি শুধু হিন্দের? এই ভয় পৃথিবীর সমস্ত শান্তিকামী মানুষের, যারা ক্ষমতার নির্মম খেলায় বারবার নিষ্পাপ বলি দেখে। (The Voice of Hind Rajab)
“হিন্দের ভয়েস কলটি লম্বা, বাস্তব, এবং কাটা-ছেঁড়া ছাড়া চলে। এতে তৈরি হয় এক রিয়েল-টাইম অনুভূতি, ইমারজেন্সি রুমের উদ্বেগ, এবং ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’— এই তীব্র চাপ। প্রতিটি সেকেন্ড যেন জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর দোলাচল।”
যুদ্ধ ইতিহাস জুড়ে মানুষের নির্মমতা ও ক্ষমতালিপ্সার সাক্ষী হলেও, সবচেয়ে দগ্ধ, সবচেয়ে অবহেলিত, অথচ সবচেয়ে নিষ্পাপ ভুক্তভোগীরা হল শিশুরা। তারা যুদ্ধের কারণ বোঝে না, উদ্দেশ্য বোঝে না— বোঝে শুধু ভয়, ক্ষতি, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর ছায়া। হিন্দের সেই ভয়, সেই অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার আকুতি— এই চলচ্চিত্রকে এক সার্থক ‘ওয়ার ফ্রন্ট ডকুমেন্টারি’-র মর্যাদা দিয়েছে। (The Voice of Hind Rajab)
রিয়েল-টাইম টেনশন: ইমাজিনেশন সিনেমা

পরিচালক কাওথার বেন হানিয়া (Kaouther Ben Hania) এই চলচ্চিত্রে এক অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। সম্পূর্ণ ছবিটি তিনটি উপাদানের ওপর দাঁড়িয়ে:
১. একটি সিঙ্গেল জোন: রেড ক্রিসেন্ট অপারেশন রুম।
২. একটি ফোন কল: হিন্দ রাজাবের আসল ভয়েস রেকর্ডিং।
৩. কয়েকজন উদ্বিগ্ন উদ্ধারকর্মী। (The Voice of Hind Rajab)
“হিন্দ বলেছিল— “আমি আর পারছি না…”। কিছুক্ষণ পর সিগন্যাল সম্পূর্ণ কেটে যায়। উদ্ধারকারী অ্যাম্বুলেন্সও গুলিবিদ্ধ ও ধ্বংস হয়েছে— এই সংবাদ অপারেশন রুমকে নিস্তব্ধ করে দেয়।”
এই সীমাবদ্ধতা দুর্বলতা নয়— এটাই ছবির সবচেয়ে বড় শক্তি। দর্শক গাড়ির ভিতর হিন্দকে দেখে না, দেখে না যুদ্ধক্ষেত্র, দেখে না ধ্বংসস্তূপে। কিন্তু তার কণ্ঠে ভেসে আসা শব্দ— কম্পিত নিঃশ্বাস, কান্না, অন্ধকারের বর্ণনা— দর্শকের মস্তিষ্কে দৃশ্য তৈরি করে। চলচ্চিত্রের ভাষায়, এই প্রক্রিয়ার নাম: “Imagination Cinema.” যে দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, তা কল্পনায় আরও ভয়ঙ্কর, আরও মর্মান্তিকভাবে ফুটে ওঠে। (The Voice of Hind Rajab)
হিন্দের ভয়েস কলটি লম্বা, বাস্তব, এবং কাটা-ছেঁড়া ছাড়া চলে। এতে তৈরি হয় এক রিয়েল-টাইম অনুভূতি, ইমারজেন্সি রুমের উদ্বেগ, এবং ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’— এই তীব্র চাপ। প্রতিটি সেকেন্ড যেন জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর দোলাচল। উদ্ধারকর্মী ওমর আলকামের (Omar Alqam) প্রতিটি শব্দ, “বাবা ভয় পেও না, আমরা আসছি…”, আর হিন্দের বারবার প্রশ্ন, “আপনারা কোথায়? এখানে খুব অন্ধকার…”— এই কথোপকথন যেন অসহায় মানবতার এক করুণ মহাকাব্য। রানা নামের অপর এক কর্মীর কথাটি দর্শকের বুকে বাজে: “লাইন কাটবে না। তাকে কথা বলতে দাও। যতক্ষণ সে কথা বলছে, সে বেঁচে আছে।” (The Voice of Hind Rajab)
আরও পড়ুন: বন্দিত্বের ছবি, এবং মুক্তির ছবিও
মানবতা ও আমলাতন্ত্রের দ্বন্দ্ব
রেড ক্রিসেন্ট–এর অপারেশন রুমে আলো কম, বাইরে বিস্ফোরণের শব্দ মাঝে মাঝে দেয়াল কাঁপিয়ে দিলেও, সবচেয়ে বেশি কাঁপছিল মনিটরের সামনে বসে থাকা কর্মীরা— কারণ তাঁরা ফোনের ওপাশে শুনছিল এক ছ’বছরের শিশুর কণ্ঠস্বর। তাঁরা মানচিত্রে হিসেব করে, জিপিএস মেলায়, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে— তাদের চোখে আতঙ্ক, তাড়াহুড়া, ব্যর্থতা, এবং জেদ ফুটে ওঠে। এই অভিনয় অত্যন্ত ‘আন্ডারস্টেটেড’ হলেও সবচেয়ে কার্যকর। (The Voice of Hind Rajab)
“আমাদের দেশে এই ধরনের ‘ওয়ার ফ্রন্ট ডকুমেন্টারি’-র জন্য এগিয়ে আসার লোক কম, তাই এই ছবিটি কলকাতায় প্রদর্শিত হওয়া এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
কিন্তু তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা আটকে যায় আমলাতান্ত্রিকতার এক কঠিন জালে। যারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে তাকে উদ্ধার করতে চায়, তারা নিরুপায়। বারবার সামরিক আগ্রাসনের কারণে থমকে যেতে হয়। তাদের অসহায়তা কেবল হিন্দের জন্য নয়, সেই বর্বর সিস্টেমের বিরুদ্ধে, যেখানে মানুষের জীবনের চেয়ে প্রোটোকল বড় হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত যখন অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিল, নানা পথ পেরিয়ে পৌঁছাল বটে, কিন্তু তাকেও গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেওয়া হল— এক চরম অনৈতিক, অপরাধপ্রবণ, বর্বর সেনার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কারের জন্ম দেয় এই ঘটনা। (The Voice of Hind Rajab)
হিন্দ বলেছিল— “আমি আর পারছি না…”। কিছুক্ষণ পর সিগন্যাল সম্পূর্ণ কেটে যায়। উদ্ধারকারী অ্যাম্বুলেন্সও গুলিবিদ্ধ ও ধ্বংস হয়েছে— এই সংবাদ অপারেশন রুমকে নিস্তব্ধ করে দেয়।
“হিন্দের শেষ কণ্ঠস্বর ছিল— “ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসছে… অন্ধকারে আমার ভয় করে।” তারপর ফোন থেমে যায়। তার কথা থেমে গেল— কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমাদের বুকে প্রবলভাবে ধাক্কা মেরে গেল।”
একটি নীরবতা, এক প্রবল ধাক্কা
হিন্দের শেষ কণ্ঠস্বর ছিল— “ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসছে… অন্ধকারে আমার ভয় করে।” তারপর ফোন থেমে যায়। তার কথা থেমে গেল— কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমাদের বুকে প্রবলভাবে ধাক্কা মেরে গেল। এই চলচ্চিত্র শুধু একটি বালিকাকে হারানোর বেদনা নয়, এটি আজকের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি এক তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। ব্র্যাড পিট-এর মতো উচ্চ-প্রোফাইল প্রযোজকের যুক্ত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফান্ডিং পাওয়া প্রমাণ করে, এই কাহিনি বিশ্ব বিবেকের কাছে এক জরুরি বার্তা। (The Voice of Hind Rajab)

আমাদের দেশে এই ধরনের ‘ওয়ার ফ্রন্ট ডকুমেন্টারি’-র জন্য এগিয়ে আসার লোক কম, তাই এই ছবিটি কলকাতায় প্রদর্শিত হওয়া এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ছবিটি দেখতে বসে মুহূর্তের মধ্যে সিনেমা হলের আরামদায়ক পরিবেশ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। পর্দায় যুদ্ধক্ষেত্রের কোনও বীভৎস দৃশ্য নেই, নেই কোনও রক্তপাত; আছে কেবল একটি ফোন কলের শব্দ, রেড ক্রিসেন্ট অপারেশন রুমের চাপা উত্তেজনা, আর ছ’বছরের হিন্দ রাজাবের কম্পিত কণ্ঠস্বর। কিন্তু ঠিক এই ‘না-দেখা’-র মাধ্যমেই পরিচালক আমাদের এমন এক মানসিক যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে নিয়ে যান, যা চোখে দেখা দৃশ্যের চেয়েও বহুগুণ বেশি ভয়ঙ্কর। (The Voice of Hind Rajab)
আরও পড়ুন: খসে পড়া তারা অথবা পুনর্জন্মের গল্প
এই অস্বস্তি শারীরিক নয়, এটি ছিল নৈতিক অস্বস্তি। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, কীভাবে মানবতা যন্ত্রের কাছে, আমলাতন্ত্রের কাছে, এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামরিক আগ্রাসনের কাছে অসহায়। আমরা দর্শক হিসেবে সম্পূর্ণ নিরাপদ আসনে বসে ছিলাম, অথচ আমাদের সামনেই জীবনের শেষ কয়েকটি মিনিট পার করছিল একটি নিষ্পাপ শিশু। আমরা জানি এরপর কী হবে, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অলৌকিক আশার জন্ম হচ্ছিল— ‘এই বুঝি উদ্ধারকারীরা পৌঁছে গেল!’ কিন্তু এই আশা বারবার গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল বাইরের বিস্ফোরণের শব্দ। (The Voice of Hind Rajab)
এই অস্বস্তিই ছবির সবচেয়ে বড় জয়; কারণ এই অস্বস্তি প্রমাণ করে যে আমাদের মধ্যে মানবতা এখনও সম্পূর্ণ মরে যায়নি। হিন্দের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই নীরবতা লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে এক প্রবল ধাক্কা দিয়ে গেল। (The Voice of Hind Rajab)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
কবি, সমালোচক
