(Kerry Packer)
১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট চালু করে অস্ট্রেলিয়ান ধনকুবের কেরি প্যাকার, ক্রিকেটের খোলনলচে বদলে দেন। প্যাকারের আগে ক্রিকেট যা ছিল, আর ১৯৭৭-৭৯— মাত্র দু’বছরের মধ্যেই ক্রিকেট যেখানে এসে দাঁড়ায়, সেই পরিবর্তন অভূতপূর্ব। শতাধিক বছর ধরে ব্যবহৃত চিরাচরিত ‘ভদ্রলোকোচিত’ সাদা পোশাকের পরিবর্তে ‘পাজামা ক্রিকেট’-এর উজ্জ্বল রঙিন পোশাক, লাল বলের জায়গায় সাদা বল, ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হওয়া দিবাকালীন ক্রিকেটের পরিবর্তে ফুটবল স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটের আলোয় আয়োজিত নৈশকালীন ক্রিকেট; শুধু তা-ই নয়, ক্রিকেটে সর্বপ্রথম হেলমেটের ব্যবহার, টিভির পর্দায় প্রচলিত ক্রিকেট-কমেন্ট্রির ঘরানা বদল, ড্রপ-ইন পিচের আমদানি— সব-ই কেরি প্যাকারের কৃতিত্বে। (Kerry Packer)
১৯৭৬-এ প্যাকার অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কাছে হাজির হন, পরবর্তী তিন বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সম্প্রচারের একচেটিয়া অধিকার ১.৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাঁর চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্কের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু এসিবি সেই প্রস্তাব বিবেচনা না করে প্যাকারের প্রস্তাবিত অর্থের তুলনায় আট ভাগের এক ভাগ অর্থে ক্রিকেট সম্প্রচার-স্বত্ব তুলে দেয় এতদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের হাতে। (Kerry Packer)

অপমানিত-ক্ষিপ্ত প্যাকার শুরু করেন নিজস্ব খেলা। তিনি যোগাযোগ করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক রিচি বেনোর সঙ্গে। তারপর পরামর্শদাতা বেনোর সঙ্গে বসে ছকে ফেলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মডেল। ১৯৭৭ সালের মধ্যেই বিশ্বক্রিকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ ৩৫ জন খেলোয়াড় চুক্তিবদ্ধ হন প্যাকার আয়োজিত ‘বিদ্রোহী’ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের জন্য। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, এমনকি সেই সময় বর্ণবিদ্বেষের কারণে বহিষ্কৃত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা মোটা অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়ে প্যাকার-ক্রিকেটে খেলতে সম্মত হন। (Kerry Packer)

অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল, ইয়ান চ্যাপেল, ডেনিস লিলি, রডনি মার্শ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড, অ্যান্ডি রবার্টস, পাকিস্তানের ইমরান খান, ইংল্যান্ড-অধিনায়ক টনি গ্রেগ কে না ছিলেন সেই দলে! তখন ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক এবং প্রথম শ্রেণির খেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল নামমাত্র; শুধু তা-ই নয় জাতীয় দলের হয়ে প্রতিটি টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশগ্রহণ করাটা ছিল একপ্রকার বাধ্যতামূলক। এতে ক্রিকেটাররা খুশি ছিলেন না। ক্রিকেটারদের সেই অসন্তোষকে হাতিয়ার করে দাঁও মারতে চেয়েছিলেন প্যাকার এবং তাতে তিনি সফলকামও হন। (Kerry Packer)
“প্যাকারও তাঁর ‘চ্যালেঞ্জ’ থেকে সরে এসে ১৯৭৯ সালের মে মাসে এসিবির সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে তাঁর চ্যানেল নাইনের জন্য বহু আকাঙ্ক্ষিত টেলিভিশন-সম্প্রচার-স্বত্ব লাভ করেন।”
পরবর্তী দু’বছর ক্রিকেটবিশ্ব স্পষ্টত দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে ওঠায় দর্শককুল মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে; অন্যদিকে তারকাদের ঔজ্জ্বল্যে এবং সম্প্রচারের দীপ্তিতে ঝলমলিয়ে উঠতে থাকে প্যাকারের ‘সুপার টেস্ট’ এবং দিন-রাতের সীমিত ওভারের ক্রিকেট। তৎকালীন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স প্যাকার-ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করে। যদিও প্যাকার আদালতে গিয়ে আইসিসির এই দণ্ড রোধ করেছিলেন। (Kerry Packer)

অল্প দিনের মধ্যেই প্যাকারের দেখানো পথ থেকে ক্রিকেট প্রশাসকরা বুঝতে পারেন পণ্য হিসেবে ক্রিকেটের মূল্যমান। মিডিয়া-স্বত্ব বিক্রয়ের মাধ্যমে বিপুল অর্থাগমের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট প্রশাসকরা প্যাকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। প্যাকারও তাঁর ‘চ্যালেঞ্জ’ থেকে সরে এসে ১৯৭৯ সালের মে মাসে এসিবির সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে তাঁর চ্যানেল নাইনের জন্য বহু আকাঙ্ক্ষিত টেলিভিশন-সম্প্রচার-স্বত্ব লাভ করেন। ক্রিকেট হয়ে ওঠে আধুনিক এবং পেশাদার। ২০০৫ সালে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে প্যাকার এটা দেখে যেতে পেরেছিলেন— ঐতিহ্য ও বিশুদ্ধতার ধ্বজাবাহক এমসিসি তাঁকে সদস্যপদ দিয়েছে। (Kerry Packer)
আরও পড়ুন:স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা: রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পারস্পরিক মূল্যায়ন
২০০৮ সালের এপ্রিলে আবির্ভাব আইপিএল— ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের। আইপিএলের সূচনা কিন্তু সুভাষ চন্দ্রের মিডিয়া কোম্পানি জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস এবং এসেল গ্রুপের ২০০৭ সালে প্রবর্তিত আইসিএল— ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে। সদ্যসমাপ্ত প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় কুড়ি ওভারের ক্রিকেট যে ভারতে ভাল বাজার পাবে সেটা অনুধাবন করে আইসিএলের কর্মকর্তারা ভারতীয় ক্রিকেটে ধুন্ধুমার ফেলে দেন। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান-বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকেও প্রশাসনিক কর্তা-কোচ-মেন্টর-ক্রিকেটাররা আইসিএলে যোগদান করেন। জয়ী ক্লাব-দলের জন্য পুরস্কার মূল্য ঘোষিত হয় এক মিলিয়ন ইউএস ডলার। সঙ্কট অনুধাবন করে বিসিসিআই এবং আইসিসি আইসিএলের সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক কর্তা এবং খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। (Kerry Packer)

কিন্তু আইসিএলের বিরোধী হলেও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বুঝতে দেরি হয়নি, যে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক কুড়ি ওভারের ক্রিকেট হয়ে উঠতে পারে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তা-ই এতদিন যা ছিল বিদ্রোহী— সে প্যাকার-ক্রিকেট বা আইপিএল, যা-ই হোক না কেন— বিসিসিআইয়ের হাত ধরে তা এই প্রথম হয়ে ওঠে মূলধারার অফিসিয়াল ক্রিকেট। ((Kerry Packer)
“বিশ্বক্রিকেটের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগ আইপিএল ২০১৪ সালেই লিগ হিসেবে আয়োজিত সমস্ত খেলার মধ্যে গড়পড়তা দর্শক উপস্থিতির বিচারে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে।”
প্যাকার-ক্রিকেট যতই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনুক না কেন, বিদ্রোহী ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বিভাজন আনে, তা মাত্র সতেরো মাস স্থায়ী হয়েছিল। আইসিএল প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে শুরু করেও বিসিসিআইয়ের তীব্র বিরোধিতার কারণে দু’মরসুমের বেশি টিকতে পারেনি। আমোদে-উত্তেজনায়-বিনোদনে মোড়া আইপিএল সেখানে রমরমিয়ে সতেরো মরসুম কাটিয়ে ফেলল! শক্তি হ্রাস তো দূরের কথা, তার শক্তি ক্রমবর্ধমান। (Kerry Packer)

বিসিসিআই একদম আটঘাট বেঁধে নেমেছিল। ধনী এবং প্রভাবশালী ক্রিকেট সংস্থা বিসিসিআইয়ের ইচ্ছানুসারে প্রথম থেকেই আইসিসির ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম নির্ধারিত হয় আইপিএলের জন্য খালি সময় ফেলে রেখে, যাতে সব দেশের খেলোয়াড়দের এই প্রতিযোগিতায় পাওয়া যায়। আইপিএলের নিলামের দিকে এখন তাকিয়ে থাকে বিশ্বক্রিকেটের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়, এমনকি অন্য ক্রিকেট বোর্ডগুলোও। কারণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডও নির্দিষ্ট দশ শতাংশ অর্থ পাওয়ার অধিকারী যে! ২০১০ সালে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে সর্বপ্রথম আইপিএল ইউ টিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। (Kerry Packer)
আরও পড়ুন: পারস্যে রবীন্দ্রনাথ, জন্মদিনে
বিশ্বক্রিকেটের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগ আইপিএল ২০১৪ সালেই লিগ হিসেবে আয়োজিত সমস্ত খেলার মধ্যে গড়পড়তা দর্শক উপস্থিতির বিচারে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে। আইপিএল-অনুপ্রাণিত ভারতে হকি-কবাডি-ব্যাডমিন্টন এবং অন্যান্য খেলার পেশাদার লিগ চালু হয়। বিসিসিআইয়ের হিসেব অনুযায়ী ২০১৫ সালের আইপিএল ভারতের জিডিপিতে ১১৫০ কোটি টাকা যোগায়। ২০২২ সালে আইপিএলের ব্র্যান্ড ভ্যালু দাঁড়ায় ৯০০৩৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে আইপিএল ফাইনাল ইন্টারনেটে দেখেন প্রায় তিন কোটি কুড়ি লক্ষ দর্শক। ২০২৩ সালে আইপিএলের মিডিয়া-স্বত্ব পরবর্তী চারটি মরসুমের জন্য ভায়াকম১৮ এবং স্টার স্পোর্টস কিনে নেয় ৬.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বিনিময়ে। কেরি প্যাকার কি তাঁর ক্রিকেট-কফিনের মধ্যে পাশ ফিরে শুলেন! (Kerry Packer)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
পেশায় শিক্ষক দিলীপকুমার ঘোষের জন্ম হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজের স্নাতক, রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'সুখপাঠ' এবং 'উদ্ভাস' পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক 'থার্ড লেন'-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে।
