(Eli Cohen)
কেমন ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর মিশর? কেমন ছিল বন্দরনগরী আলেকজান্দ্রিয়া, যেখানে শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রথম দিনগুলো কাটিয়েছিলেন এলি কোহন? আদতে তিনি যে ভূ-রাজনৈতিক আর্বতে পড়েছিলেন তা বুঝতে গেলে মিশরীয় ইতিহাসের অনেক গভীরে যেতে হবে। (Eli Cohen)
শুরু হল এলি কোহেন সপ্তম পর্ব
আগেই বলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স কারুর পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব হয়নি। ফলে ১৯১৮ এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজিত অটোমানদের কাছ থেকে লুঠের বখরা হিসাবে পাওয়া পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক রাশ ১৯৪৫ সালের পরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। (Eli Cohen)
আরও পড়ুন: পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- বিদ্রোহ, ধ্বংস ও আগামীর স্বপ্ন
এই রাশ হারানোর ক্ষেত্রটা আসলে বিংশ শতকের গোড়া থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিল। পুরো আরব বিশ্ব জুড়েই ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্যের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছিল। অটোমানদের অধীনস্ত পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠছিল। জাতীয়তাবোধ জেগে উঠছিল। ফলে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল তখন ইস্তানবুল আবিষ্কার করল আরব দুনিয়ায় তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে। দুই পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক পিটার ম্যান্সফিল্ড ও নিকোলাস পেলহাম তাদের ‘আ হিস্টরি অফ দ্য মিডল ইস্ট’ এ বলছেন, যে মূহূর্তে ইস্তানবুল অক্ষশক্তির হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নামল সেই ক্ষণেই অটোমান সাম্রাজ্যের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। (Eli Cohen)
তাইই হল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের হার ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্তাইন, ট্রান্সজর্ডন সহ পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল অটোমান মুক্ত করে দিল। ফলে এইসব এলাকায় স্বাধীনতা যোদ্ধারা নতুন করে লড়ার অক্সিজেন পেয়ে গেল। এবার তাদের লড়াইয়ের অভিমুখ ঘুরে গেল ব্রিটিশ ও ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে পড়ায় এরা সাময়িকভাবে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে মদত দিয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হতেই ফের স্থানীয় প্রতিরোধ বাহিনীগুলো তাদের যুদ্ধের আগের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়। এদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা অসম্ভব ছিল ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের পক্ষে। যার ফলে রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমী শক্তিদের সরাতে সফল হল পশ্চিম এশিয়া। (Eli Cohen)
এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুনামির মধ্যে মিশর একা অনেকটা স্বাধীন ছিল। আদতে এই স্বাধীনতা কিন্ত একদিনে হঠাৎ করে উদ্ভুত হয়নি। হয়তো এই স্বাধীনতার সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টিয়ে গিয়েছে কিন্তু ভিনদেশিদের প্রভুত্ব না স্বীকার করাটা মিশরীয়দের রক্তে বহু শতক ধরেই রয়েছে। আর এই স্বকীয়তা বোঝার জন্যই এক ঝলকে মিশরের ইতিহাসটা বলা দরকার। (Eli Cohen)
“অনুগামীদের বিশ্বাসঘাতকতায় মামলুক সুলতান অটোমানদের হাতে ধরা পড়েন। তুমান বে কে খাঁচায় বন্দী করে কায়রো আনা হয়।”
মিশরীয় শক্তির উত্থান
জানার জন্য ইতিহাসের পাতা ছয় শতক পিছিয়ে খুলতে হবে। ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে পশ্চিম এশিয়ায় মূলত মামলুক ও অটোমান সাম্রাজ্য রাজ করত। বর্তমান তুরস্ক আর পূর্ব ইউরোপ মূলত ছিল অটোমানদের দখলে। অন্যদিকে মিশরের মামলুক সুলতানের অধীনে ছিল পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়া, প্যালেস্তাইন আর মক্কা-মদিনা সহ বর্তমান সৌদি আরবের বিশাল অঞ্চল। (Eli Cohen)
এই পরিস্থিতিতে প্রথমে ইস্তানবুলের অটোমান সুলতান পশ্চিম এশিয়ায় তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াতে অগ্রসর হন। তখন মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের হাতে লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথ আর ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মক্কা মদিনা ছিল। পশ্চিম এশিয়ার কর্তৃত্ব নিতে হলে যে এই দুই জায়গা কব্জায় থাকা দরকার তা অটোমানদের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। তাই সিরিয়া থেকে মামলুকদের নাম ও নিশান মেটাতে ইস্তানবুল উদ্যোগী হল। এমনিতেই কামানবাহিনী সজ্জিত অটোমান বাহিনী মূলত অশ্বারোহী মামলুক তীরন্দাজ বাহিনীর চেয়ে সামরিক দিক থেকে অনেকটাই শক্তিশালী ছিল। তাই ১৫১৬ সালে ২৪ অগস্ট সিরিয়ার আলেপ্পোর কাছে মার্জ দাবিকে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের সঙ্গে মামলুক সুলতান কুনশা অল ঘাউরির যুদ্ধ হল। (Eli Cohen)

যুদ্ধে অটোমানদের কামানের গোলায় মামলুকদের অশ্বারোহী বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, মামলুক সুলতান অল ঘাউরি প্রাণ হারান। ফলে প্রাথমিকভাবে সিরিয়ায় পা রাখতে পারল অটোমান সেনা।
কিন্তু মিশরের মূল মামলুক সেনা তখনও অক্ষত। অল ঘাউরির মৃত্যুর পরে তাঁর প্রধানমন্ত্রী অল আশরফ আবু অল নসর তুমান বে ওরফে দ্বিতীয় তুমান বে নামে কায়রোর তখতে আসীন হল। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমও জানতেন মামলুকদের মূল শক্তি নিহিত আছে কায়রোতে আর কায়রোতে যতদিন কোনও মামলুক সুলতান ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন লোহিত সাগরের বানিজ্যপথ কব্জা করা সম্ভব নয়। তাই অটোমান-মামলুক যুদ্ধ অবশাম্ভাবী হয়ে পড়ল। ১৫১৭ সালের ২২ জানুয়ারি কায়রোর অনতিদূরে রিদানিয়েতে দু’পক্ষে যুদ্ধ হয়। মামলুক বাহিনী ছত্রভঙ্গ হলে সুলতান তুমান বে, নীল নদ পেরিয়ে অনুগত বেদুইন সর্দারের আশ্রয়ে আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেই আশ্রয়ও বেশিদিন রইল না। (Eli Cohen)
আরও পড়ুন: গণহত্যার অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো
অনুগামীদের বিশ্বাসঘাতকতায় মামলুক সুলতান অটোমানদের হাতে ধরা পড়েন। তুমান বে কে খাঁচায় বন্দী করে কায়রো আনা হয়। ১৫১৭ সালের ১৫ এপ্রিল কায়রোর বাব জুলিয়া ফটকে মামলুক সুলতানকে ফাঁসিতে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। মিশরের ইতিহাসে মামলুক শাসনের অবসান হয়। (Eli Cohen)
তবে সে অর্থে কোনওকালেও মিশরকে ইস্তানবুল দমিয়ে রাখতে পারেনি। সুলতানি তখত চলে গেলেও মামলুক প্রভাব কিন্তু মিশরে রয়েই গেল। মামলুক শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য ও অন্য কয়েকটি মুসলিম রাজ্য যারা পূর্ব ইউরোপ দখল করেছিল তারা মূলত ককেশাস ও জর্জিয়ার খ্রিশ্চান তরুণদের বন্দী করে ক্রীতদাস বানাত। এরাই ওইসব মুসলিম রাজ্যগুলির হয়ে যুদ্ধ করত। অর্থাৎ এক অর্থে এরা ভাড়াটে সেনাও ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সমরাঙ্গনে ক্রমাগত সাফল্য, ধীরে ধীরে এদের ক্ষমতাবান করে তোলে এবং এই ক্রীতদাসদেরই এক শ্রেণী ক্ষমতার শীর্ষস্তরে পৌঁছে যান। ‘কিংমেকার’ থেকে ক্রমে তারা মসনদ দখল করে। (Eli Cohen)
ফলে শেষ মামলুক সুলতানকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলালেও, মিশর সরকারিভাবে ইস্তানবুলের অধীনে গেলেও মিশরীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে মামলুক প্রভাব বিন্দুমাত্র খর্ব হল না। খাতায় কলমে মিশর হল অটোমান সাম্রাজ্যের এক প্রদেশ বা আয়ালেত যার শাসনভার ন্যস্ত ছিল ইস্তানবুল নিয়োজিত এক পাশার হাতে। কিন্তু এই পাশার কথামতো কায়রো চলত না। মিশরের বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তা, প্রশাসনিক কর্তা, কর আদায়কারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর উঁচু সব পদে ছিল মামলুকরা। ফলে তাঁদের সঙ্গে কার্যত আপোস করে ইস্তানবুল নিয়োজিত পাশাদের শাসন চালাতে হত। (Eli Cohen)
ক্রমে মামলুকরা এক সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলে যা প্রায় তিনশো বছর স্থায়ী হয়। ১৮১১ সালে মামলুক প্রধানদের নির্মমভাবে হত্যা করে এই ব্যবস্থার অবসান করেন মহম্মদ আলি পাশা এবং নতুন এক রাজবংশের সূচনা করেন। অর্থ্যাৎ মামলুক প্রভাব শেষ হওয়ার সঙ্গেই মিশরও সব অর্থেই স্বাধীন হয়ে যায়। (Eli Cohen)
“উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে এসে ফের মিশর উত্তাল হল। বস্তুত মিশরীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানও হল বলা যায়। মিশরের ভাগ্যাকাশে দেখা দিলেন আহমেদ উরাবি।”
মহম্মদ আলি পাশা আর মিশরীয় স্বাধীনতা
কারণ মহম্মদ আলি পাশাও মোটেই ইস্তানবুলের আজ্ঞাবহ ছিলেন না। জন্মসূত্রে আলবানীয় মহম্মদ আলি ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে অধুনা গ্রিসের কাভালা বন্দরনগরীতে চলে আসেন। পরবর্তীকালে নিজ দক্ষতায় তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের আলবানীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে দাঁড়ান। এরপরই তাঁর রণাঙ্গণ আর রাজনীতিতে সমান দক্ষতা দেখা যায়। (Eli Cohen)
১৮০১ সালে ফরাসি দখলদারি সেনা হঠাতে আলবানীয় সেনার প্রধান হয়ে কায়রো এসে দেখলেন মিশরে চরম অস্থিরতা চলছে। অটোমান সুলতান আর মামলুক দু’পক্ষের অত্যাচারে জনগন বীতশ্রদ্ধ। জনগনের কাছে বিকল্প শক্তি হয়ে ওঠার এই সুযোগ হেলায় হঠাতে চাননি মহম্মদ আলি। তাঁর এই উচ্চাকাঙ্খা পূরণে সাথী হিসাবে পেয়ে গেলেন কায়রোয় উলেমাদের নেতা উমর আক্রম আর অল আজহার মসজিদের গ্র্যান্ড ইমামকে তারপর পরিস্থিতি বুঝে কোনও সময় অটোমান, কোনওসময় মামলুকদের সঙ্গে দোস্তি করে কার্যত কায়রো শাসন শুরু করলেন। (Eli Cohen)

জনগনের কর কমালেন। বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রিত করলেন। ফলে জনগনের একটা বড় অংশ মহম্মদ আলিকে সমর্থন করল। অরাজকতা থেকে স্থিতীশীলতার পথে মিশর হাঁটতে লাগল। ক্রমে ইস্তানবুলও দেখল কায়রোর পরিস্থিতি রাখতে গেলে মহম্মদ আলির মতোই লোক দরকার। ১৮০৫ সালে তাই মহম্মদ আলিকে অটোমানদের মিশর প্রদেশের ওয়ালি বা শাসক মনোনীত করল ইস্তানবুল। (Eli Cohen)
এরপর মহম্মদ আলি আর ফিরে তাকাননি। দক্ষিনে সুদান জয় করে উত্তরে প্যালেস্তাইন আর গ্রিসের কিছু অংশ দখল করে মিশর। তারপর সরাসরি ইস্তানবুলের সঙ্গেই যুদ্ধ, যার সুবাদে সিরিয়া জয় মহম্মদ আলির। ঐতিহাসিকরা বলেন, মিশরীয় জাতীয়তাবাদের দীপ তিনিই জ্বেলেছিলেন। (Eli Cohen)
আরও পড়ুন: ম্যান ইটার্স অফ সাভো থেকে প্যালেস্তাইন ক্যাম্পেন
আহমেদ উরাবি আর মিশরীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে এসে ফের মিশর উত্তাল হল। বস্তুত মিশরীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানও হল বলা যায়। মিশরের ভাগ্যাকাশে দেখা দিলেন আহমেদ উরাবি। (Eli Cohen)
সম্পন্ন কৃষক পুত্র উরাবি মাত্র বিশ বছর বয়সে মিশরীয় সেনাবাহিনীর লেফটানেন্ট কর্ণেল হন। কিন্তু ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত দু’বছর ধরে চলা ইথিওপিয়া যুদ্ধে মিশরের হার উরাবিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে তুর্কি প্রভাব না কমালে মিশর উন্নতি করতে পারবে না। তাই প্রয়োজন ইস্তানবুলের মুখাপেক্ষি মহম্মদ আলি রাজবংশের ষষ্ঠ খেডিভ (মিশরীয় সুলতানের উপাধি) তেওফিক পাশার গদীচ্যুতিও দরকার। (Eli Cohen)
“১৮৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কায়রোর অনতিদূরে তেল এল কেবিরে ব্রিটিশরা এই ব্রিদ্রোহ দমন করে। কায়রোতে উরাবি সহ বিদ্রোহের সব নেতা আত্মসমর্পণ করেন। উরাবিকে শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত করা হয়।”
কৃষক তনয় উরাবি ছিলেন সুবক্তাও। একদম মেঠো ভাষায় মিশরীয়দের মাঝে দিন বদলের আহ্বান জানাতে লাগলেন। জনগন এতদিন তুর্কিদের কথা, ভিনদেশি মামলুকদের কথা শুনে এসেছে। এবারই প্রথম কেউ মিশরীয় তাদের ভাষায় তাদের দাবির কথা বলল। হুহু করে জনপ্রিয়তা বাড়ল উরাবির। ভক্তরা তাঁর নাম দিল ‘এল ওয়াহিদ’ বা ‘একা একমাত্র’। ১৮৭৯ সালে সেনাবাহিনী থাকাকালীন উরাবি ‘মিশর জাতীয়তাবাদী পার্টি’ গঠন করলেন। শোনা যায় এইসময় তেওফিক পাশা বাধ্য হন উরাবির নেতৃত্বাধীন এক জাতীয় মন্ত্রীসভা গঠন করতে দিতে। ১৮৮২ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর এই মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন উরাবি। (Eli Cohen)
এদিকে উরাবির জনপ্রিয়তায় ভীত তেওফিক পাশা ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। ব্রিটিশরাও মিশর আক্রমনের এই সুযোগটাই খুঁজছিল। ইউরোপ থেকে ভারতে নৌবাণিজ্য চালানোর জন্য সুয়েজ খালের কর্তৃত্ব কব্জা করতে চাইছিল ব্রিটিশরা। এদিকে সুয়েজ খাল খনন ও অন্য পরিকাঠামো করতে গিয়ে পাশা ইউরোপীয় ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে ১০ কোটি পাউণ্ড দেনা করে বসে আছেন। এদিকে মিশরের বার্ষিক আয় মাত্র ৯০ লক্ষ পাউন্ড। ফলে কায়রো যাতে ঠিকমতো ঋণ শোধ দেয় তা দেখার জন্য পাবলিক ডেট কমিশন গঠন করে ব্রিটিশরা যা ছিল মিশরীয়দের কাছে ছিল চক্ষুশূল। এইসব নানা কারণে সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ বিদ্রোহ করে যা ‘উরাবি বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। ১৮৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কায়রোর অনতিদূরে তেল এল কেবিরে ব্রিটিশরা এই ব্রিদ্রোহ দমন করে। কায়রোতে উরাবি সহ বিদ্রোহের সব নেতা আত্মসমর্পণ করেন। উরাবিকে শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত করা হয়। শেষ জীবনে অবশ্য উরাবি মিশর ফিরে আসতে পেরেছিলেন। (Eli Cohen)

উরাবির প্রভাব
তবে উরাবির মূল্যায়ণ কিন্তু এই যুদ্ধ হারার মধ্যে নিহিত নেই। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অণুপ্রেরণা রূপে উরাবিকে দেখা হয়। ভোটাধিকারের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সবার জন্য সমান আইনের বিচার পাওয়া, মিশরীয় সুলতান তথা খেদিভের ক্ষমতা সীমিত করার মতো যেসব দাবিতে উরাবি তাঁর আন্দোলন গড়ে তোলেন তাই পরবর্তীকালে মিশরীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে। কারণ মহম্মদ আলির বংশধর সুলতান ফারুক উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৫২ সাল অবধি তখতে ছিলেন। কায়রোর হৃদপিণ্ড যাকে বলা হয় সেই তাহরির স্কোয়ারের নামকরণই করা হয় উরাবি আন্দোলনের সম্মানার্থে। (Eli Cohen)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইস্তানবুলের শোচনীয় হার মিশরের জন্য স্বাধীনতার দরজা খুলে দেয়। মিশরের মসনদে তখনও মহম্মদ আলির বংশধর। কিন্তু নীলনদের দেশ তখন পুরোপুরি ব্রিটিশদের কব্জায়। মিশরীয় বিপ্লবী সাদ জগলুল কয়েক দশক আগের উরাবির মতাদর্শকে সামনে রেখে দেশকে ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত করে সংসদীয় রাজতন্ত্র দাবি করলেন। (Eli Cohen)
“১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর আর ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দু’দফায় ভোট হয়। ফলাফল বেরোলে দেখা যায় নয়া সংসদের ২১৪টা আসনের মধ্যে ১৭৯টা জিতেছে সাদ জগলুল নেতৃত্বাধীন ওয়াফ্ড দল।”
১৯১৮ সালের নভেম্বরে জগলুল ও তাঁর অনুগামীরা এরজন্য দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করলেন। ১৯১৯ সালে জগলুলের নেতৃত্বে ওয়াফ্ড দল গঠিত হল। ১৯১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনকে কোনওরকমে ব্রিটিশরা দমাতে পারলেও দেশজুড়ে অসন্তোষের আঁচের আভাস তারা পেয়ে গিয়েছিল। ফলে সমঝোতায় রাস্তায় হাঁটল তারা। (Eli Cohen)
১৯২২ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মিশর আংশিক স্বাধীনতা লাভ করে। জগলুলের দাবি মতোই দেশে সুলতানকে রাষ্ট্রপ্রধান রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত দিল ব্রিটেন। তবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, যোগাযোগ আর সুয়েজ খালের কর্তৃত্ব রাখল নিজের কাছে যা নিয়ে পরবর্তী সময়ে দু’দেশের মধ্যে সমস্যা দেখা দেবে। সুলতান প্রথম ফাউদকে মাথায় রেখে মিশর হল সংসদীয় রাজতন্ত্র। (Eli Cohen)
আরও পড়ুন: পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপট
১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর আর ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দু’দফায় ভোট হয়। ফলাফল বেরোলে দেখা যায় নয়া সংসদের ২১৪টা আসনের মধ্যে ১৭৯টা জিতেছে সাদ জগলুল নেতৃত্বাধীন ওয়াফ্ড দল। স্বাভাবিকভাবেই জগলুল প্রধানমন্ত্রীও হন। মিশরের আংশিক স্বাধীনতার সঙ্গে কোথাও আহমেদ উরাবির স্বপ্ন কিয়দাংশে পূরণ হল। (Eli Cohen)
এদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদি মহল্লায় তখন এলি কোহেনের শৈশব শুরু হচ্ছে।
তথ্যসূত্র- পিটার ম্যান্সফিল্ড ও নিকোলাস পেলহাম-‘আ হিস্টরি অফ দ্য মিডল ইস্ট’
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে
