(Little Magazine)
অক্ষম শব্দের অনুবাদক
কবিতা এবং পাঠক— এই দুইয়ের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক হওয়া সত্ত্বেও কবিতা কিছুতেই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না ৷ তার দায় যেমন পাঠকের, তেমনি কবিরও ৷ সহজবোধ্য কবিতা খুঁজতে গিয়ে পাঠক যখন দুর্বোধ্যতার পাথরে ঠোক্কর খায় তখন তাঁর কবিতাপ্রীতির মোহ শুকিয়ে আসে ৷ কবিতার রস খুঁজতে গিয়ে ফিরে আসেন ঠোক্কর খাওয়া ব্যথা নিয়ে ৷ কিন্তু বাঙালির কাব্যচর্চা তো চিরকালীন স্বভাব৷ ঋতু পরিবর্তনে তার কবিতা পায়, আকাশে মেঘ উঠলে কবিতা পায়, প্রেম পেলে কবিতা পায়, হাগা পেলে কবিতা পায়, কবিতা পায় হোঁচট খেলেও ৷ আসলে কবিতা পাওয়া আর সাধনায় কবিতাকে ধরা— দুটো জিনিস এক নয় ৷ প্রথমটায়, কবিরা তাৎক্ষণিক সমসাময়িক অভিঘাতের সঙ্গে নিজের আবেগ আর মূল্যায়ন মিশিয়ে কিছু একটা লিখতে চান, আর অন্যটা দীর্ঘ সাধনায় নিজের ভেতর কুলকুণ্ডলিনী শক্তির মতো জাগিয়ে তুলতে হয় ৷ (Little Magazine)
সে অনেক সাধনা, আত্মত্যাগ, মেধা, নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ও পরিশ্রমের ফসল৷ কিন্তু বাঙালি মুদিকেরানী থেকে বিজ্ঞানী, খেলোয়াড় থেকে কবি, পড়ুয়া থেকে দালাল সকলের একটাই পলিসি— ‘মিনিমাম ইনভেস্ট ম্যাক্সিমাম প্রফিট’৷ ফলে সঙ্গতকারণেই তাঁর চর্চা হয়ে উঠতে পারে না তাদের প্যাশন, হয়ে উঠতে পারে না সৎ ও আন্তরিক৷ বিনিময়ে হয়ে ওঠে গুছিয়ে নেওয়ার মঞ্চ, গুছিয়ে নেওয়ার মাধ্যম৷ কবিতা সেই ভুলভুলাইয়ায় পথ হারাইয়াছে৷ তাই কবিতা লেখা এখন জল ভাত৷ কয়েকটি শব্দ জানলেই, শব্দগুলোকে একটু ছড়িয়ে দিতে জানলেই একটা বাঁধাধরা ছক এসে যায়৷ সেই ছকে শব্দ ফেললেই বাঁধানো ছাঁচে বেরিয়ে আসে টাটকা টাটকা কবিতা৷ ফলে বিনা-সাধনায় যেমন কবিরা কবিতা লিখতে বসেন, কবিযশ প্রার্থনা করেন, তেমনি বিনা-সাধনায় পাঠকও আসেন কবিতা পড়তে, কবিতার রস খুঁজতে৷ ফলে কেউ কারোর দেখা পান না৷ দু-পক্ষই দু-পক্ষকে দোষারোপ করতে থাকেন৷ একপক্ষ যদি বলে—
—বেরসিক পাঠকই বোকার হদ্দমুদ্দ!
তো অন্যপক্ষ তীর ছোঁড়ে—
—আঁতেল কবি, ভড়ং আছে কবিতা নাই ৷ (Little Magazine)

এই যাঁতাকলে ফাঁসিয়া গিয়া বাংলা কবিতা আগাইতে পারিতেছে না৷ কবিও কবিতায় শব্দের পাথুরে খোলস পেরিয়ে ঝরনার প্রাণধ্বনি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না৷ আর পাঠকেরাও সন্তুষ্ট হচ্ছে না তার ঝরে পড়া অবিরাম জলধারায় অবগাহন করে৷ কারণ পাঠক তো পুকুরে নাইতে অভ্যস্ত, বাথরুমে শাওয়ার খুলে স্নান করতে অভ্যস্ত— সেখানে পাথরের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জলধারার প্রাণবন্ত উচ্ছলতা সইবেন কেমন করে? ছন্দ না জানলে কি করে জানবেন শ্যাওলা ধরা পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে কীভাবে ঝরনার জল মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়? স্নান করতে করতে কি করে তার মনের ভেতর জেগে উঠবে বনভূমির প্রাণস্পন্দন? তির তির কেঁপে উঠবে নির্জন বাঁশি? (Little Magazine)
কী করে জানবেন ওই জলে আশীর্বাদ মিশিয়ে দেন পাহাড়ি জঙ্গলের দেবতা? জানবেন না, জানতে হলে, বুঝতে হলে, সত্তার ভেতর উপলব্ধি করতে হলে পাঠককেও তার রস আহরণের মন্ত্র জানতে হবে৷ জাগাতে হবে পাঠকসত্তার কুলকুণ্ডলিনী শক্তি৷ তবেই তো তার মধ্যে সঞ্চারিত হবে সৃষ্টির স্পন্দন, তবেই তো তার ভেতরে ধ্বনিত হবে রহস্যময় প্রতিধ্বনি৷ তবেই তো তার ভেতরে আলোড়ন তুলবে খরোস্রোতা নদী৷ তা নইলে মরা, শুকিয়ে আসা মজা নদীর স্থবির ন্যুব্জ স্রোত তাকে বিষিয়ে দেবে৷ ব্যর্থ প্রতীক্ষায় দুদিন তার কিনারায় দাঁড়িয়ে থেকে বিবমিষা নিয়ে ফিরিয়ে নেবে মুখ৷ বাংলা কবিতায় কবি ও পাঠক এখন পরস্পর পরস্পরের থেকে সেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পথে৷ দু-পক্ষই আত্মাভিমানে কাঁদা ছুঁড়ছেন৷ আর এই দড়ি টানাটানিতে অধরা থেকে যাচ্ছে কবিতার সত্য৷ (Little Magazine)
—কেমন সেই কবিতার সত্য?
—সেই সত্য কি আক্ষরিক?
—সেই সত্য কি আপেক্ষিক?
—কাকে বলব সেই সত্য? (Little Magazine)
আসলে কাকে বলা হবে সেই সত্য; তার আভিধানিক একটা ব্যাখ্যা তৈরি করা গেলেও কবিতা যে আসলে কি— তা নির্দিষ্ট করে পাঠকও জানেন না, কবিও না৷ সমালোচক কিঞ্চিৎ বুঝতে চেষ্টা করেন, বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনে বুঝতে চান বটে অথচ তিনিও পৌঁছতে পারেন না তার কাছে৷ কারণ তিনি কবিতা ব্যাখ্যা করতে পারেন কিন্তু কবিতার অন্তরের কাছে পৌঁছানোর চাবি তার হাতে নেই৷
—তবে কে পৌঁছান? (Little Magazine)
কেউই না৷ পৌঁছাতে পারবে না কোনদিনও— এই সত্য বুঝেও তাকে পেতে, তাকে ছুঁতে যে তীব্র অভিপ্সা নিয়ে কেউ কেউ ধাবমান হন, কেউ কেউ অক্ষরের খোলস সরিয়ে পরম ‘ওম’ মেখে নিতে চান গায়ে, তিনি, কেবল তিনি অধিকারী হয়ে ওঠেন কবিতার কাছে পৌঁছাতে৷ তবে শেষপর্যন্ত তিনিও পৌঁছাতে পারেন না৷ তবুও পৌঁছানোর নেশা তার ছাড়ে না৷ তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয় সেই নেশা৷ আর নেশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবিতা, প্রাণপ্রতিষ্ঠিত কবিতা নিরন্তর রূপ বদলাতে থাকে৷ এক রহস্য থেকে পৌঁছায় আর এক রহস্যে৷ বার বার পাঠকের কাছে ধরা দেয় বহু বর্ণে, গন্ধে, স্পর্শে, সমারোহে৷ তখন তার সঙ্গে কথা বলা যায়, দু-দণ্ড সময় কাটানো যায়, তার চুলের হলুদ জ্যোৎস্নায় গুঁজে দেওয়া যায় দু-মুঠো বুনোফুল৷ তা সত্ত্বেও কিছুতেই তাকে ধরা যায় না, বাঁধা যায় না৷ তবে বাঁধা না গেলেও পাঠকের কাছে তার আবেদন কমে না এতটুকুও—বরং হয়ে ওঠে আরও বেশি মোহানীকাঞ্চন৷ পাঠক ভেদে, সময় ভেদেও আবহ পাল্টে হয়ে ওঠে নতুন নতুন৷ এই বহুমুখী প্রবহমানতই বড়ো কবিতার প্রধান মাপকাঠি৷ যেখানে কেউ চিনিয়ে দেবে না, কেউ শিখিয়ে দেবে না, কেবল কবিতাই পাঠককে পৌঁছে দেবে আত্মানুসন্ধানের সিঁড়িতে৷ সেই সিঁড়ি বেয়ে পাঠক উঠে যাবে সহজানন্দে ৷ যে কবিতা অজস্রবার পড়লেও তার রহস্য শেষ হয় না, সময় কেটে গেলে নেশা ছুটবে না, পালিশ উঠবে না ৷ (Little Magazine)
যে কবিতার শব্দ, পঙ্ক্তি, স্তবকের দাগ ক্ষয়ে এলেও যার আহবমান ছাপ থেকে যায়৷ যে কবিতার গায়ে জড়োয়ার ভারী কৃত্রিম গহণা নেই, শরীর পাথুরে, নিস্তেজ, প্রাণহীন নয়৷ যে কবিতা জলের মতো— সৃষ্টির শুরু থেকে সহজ প্রবাহ নিয়ে ভেসে চলেছে কিন্তু মানুষ তার অপার রহস্য উন্মোচন করে উঠতে পারেনি৷ এই রহস্য অক্সিজেন কিংবা হাইড্রোজেন পরমাণুর নয়— এই রহস্য বিপুল বিশ্বের৷ এই রহস্য বিস্ময়ের৷ এই রহস্য আনন্দের৷ সেই প্রকীর্ণ সম্ভারের ভেতর ঐশ্বর্য নিয়ে বসে থাকে কবিতা৷ এছাড়া, মহাবিশ্বের সঙ্গে মিলে যায় কবিতাও৷ সৃষ্টির, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মূল সুর তার ছন্দ৷ কোটি কোটি প্রাণ, গ্রহ, নক্ষত্রের নিজস্ব নিয়ম-কানুন থাকলেও মূলগতভাবে লয় বাঁধা আছে অবিস্মরণীয় ছন্দে৷ সেই লয়ে ছন্দপতন ঘটলেই ধ্বসে যাবে ব্রহ্মাণ্ডের ভিত৷ বিরাট আয়োজন, বিশাল ব্যাপ্তি, বৈচিত্র ও বৈপরীত্যে কল্পনাতীত তবুও কিছুতেই সেই ছন্দ চ্যুত হয় না৷ ব্রহ্মাণ্ডের এই ছন্দই তো কবিতার প্রাণ৷ দলবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, কলাবৃত্ত, গদ্য ছন্দের যতি ছেদের বাহ্যিক বিন্যাস নয়৷ বরং তা অতিক্রম করে যে ছন্দে কবি, কবিতা এবং পাঠকের হৃদয়ে একসঙ্গে বেজে ওঠে অদৃশ্য মাদল, সেই সুরের অনুরণন অনুভব করা যায়— মন দিয়ে, শরীর দিয়ে, ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়াতীত স্পর্শ দিয়ে৷ সেই ছন্দের দৃশ্যমানতা নেই— কিন্তু মন্ত্রে আগুন জ্বালানোর মতো মানুষের অন্তর জাগাতে পারে৷ সহস্রমুখী প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা করতে পারে৷ সেই ছন্দের ব্যাকরণ নেই, ইহকাল পরকাল নেই, সময় অসময়ের দ্বন্দ্ব বিধান নেই ৷ (Little Magazine)

কবি যদি সেই ছন্দে শব্দের বীজ বুনতে পারেন৷ কবি যদি সেই ছন্দে মেঘ ফাটিয়ে বৃষ্টি আনতে পারেন তাহলে তিনি কবি৷ তাহলে তিনি সিদ্ধ মেঘমল্লারে৷ তাহলে তার মাথা উঠে গেছে পাহাড়ের মতো আকাশে৷ তাহলে তিনি শিবের মতো ত্রিকালদর্শী সাধক৷ তাহলে তিনি স্রষ্টার মতো পরম৷ তার কবিতা তখন আর পাঠক ভিখিরি নয়৷ তখন সে গাছ-পাহাড়-নদীর মতো সবুজ, উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত৷ তা নইলে আমরা সকলে অক্ষম শব্দের অনুবাদক, তা নইলে আমরা সবাই মৃত শবের বিছানায় আঁকিবুঁকি কাটি; আর শতাব্দীর ভাঁড়ের মতো নিজেরা নিজেদের পিঠ চাপড়ে বাহ্বা দেই৷ এর বেশি কী? (Little Magazine)
দুই
‘তাবিক’ প্রকাশের সময়ের দিক থেকে আট বছর পেরিয়ে গেল ৷ এই আট বছরে খুব বেশি সংখ্যা যে প্রকাশ করা গেছে এমন নয় ৷ সর্বমোট এগারোটি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে ৷ কিন্তু তাবিক প্রথম থেকে যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল তা এখনও মূল সুর বিচ্যুত হয়নি ৷ তাবিক কবির নাম নয়— কবিতায় বিশ্বাস করে ৷ কি কবিতা আমরা চাই, কেন চাই পত্রিকার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা ইতোমধ্যেই জানেন৷ আর আমরাও পাঠকদের বারে বারে মনে করাতে চাই যে কবিদের আত্মবিস্মৃত আত্মদংশনের আঁচড়ের দাগ নিয়ে আমাদের যাবতীয় আয়োজন৷ তাই আমরা বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কতকগুলি কবিতা ছেপে নিছকই একটা সংকলন প্রকাশে আগ্রহী নই৷ আমাদের পাঠকপ্রত্যাশাও নেই৷ কেবল আমরা আমাদের প্রয়াসটুকু জানি৷ সাধনার আশ্রয় জানি৷ জানি অন্বেষণ ও আবিষ্কারের আনন্দ৷ তাই আমরা কবিদের ভেতরকার গভীরতম উচ্চারণের অনুরণন ধরে রাখতে চাই৷ তার সার্থকতা, বিফলতা নিয়ে ভাবতে চাই না৷ প্রথাগত বিন্যাস, নির্মাণ, শব্দ, ছন্দ, বোধ, শৈলী ছাড়িয়ে পৌঁছাতে চাই আশ্চর্য সংকেত ও ইশারার কাছে৷ আমাদের অভিযাত্রা দ্রুত পায়ে নয়, ধীর লয়ে৷ তাই অযথা পৃষ্ঠা বাড়িয়ে ঢাউস মোটা সংখ্যা করার অভিপ্রায় আমাদের নেই৷ বরং আট পাতা থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রয়োজনবোধে পুনরায় সেই আটপাতায় ফিরে যেতেও আমাদের দ্বিধা নেই ৷ (Little Magazine)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
