If you’re in a bookshop browsing, then this book is for you, by definition. A beautiful little novel about books, history, ambition and the importance of literature to everyone, especially people who are trying to find a voice.
–Nick Hornby
কাউথার আদিমি আলজেরিয়ার একজন তরুণী উপন্যাসিক। এখন ফ্রান্সে থাকেন। ‘আ বুকশপ ইন আলজিয়ার্স’, মাত্র একশো চল্লিশ পাতার এই ছোট্ট উপন্যাসে দুটি থিম– একটা বইয়ের দোকানের গল্প আর আলজেরিয়ার ইতিহাস। একটি সাধারণ বইয়ের দোকানের অসাধারণ ইতিহাস। মনে রাখা ভালো এটি ঠিক গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, ইতিহাসের অনেক সত্যি ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে লেখা হয়েছে এই উপন্যাস। একে ফিকশন নয় বরং ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতে পারে।
এই উপন্যাসকে অনেকটা লম্বা চুলের বিনুনির সঙ্গে তুলনা করা যায়। গল্প এগিয়েছে প্রধানত দুটি সময়ের মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে এবং ২০১৭ সালে। ঠিক একই সঙ্গে চলছে একটি বইয়ের দোকানের নস্টালজিয়া আর আলজেরিয়ার না-বলা শোষণের ইতিহাস। আর এই দুই গল্পসূত্রকে বেঁধে রেখেছে বইপড়া, বই ভালবাসার এক সোনালি সুতো। ফ্রান্সের অধীনে আলজেরিয়ার রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা। বই ভালোবাসলে এ বই পড়তেই হবে। এ বইয়ের প্রতি পাতায় বইয়ের স্পর্শ, বইয়ের গন্ধ আর বইয়ের শব্দ। কে আসেননি সেই দোকানে? আলব্যের কামু লিখতেন সেই দোকানে বসে, আন্দ্রে জিদও। এ যেন সত্যি আর কল্পনার মাঝামাঝি এক উল্লম্ব অবস্থান।
আলজেরিয়ার অন্ধকারময় ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি যখন ফ্রান্সের অধীনে ছিল– কলোনি আর কি? ফ্রান্সের পতাকার সামনে আক্ষরিকভাবে নতজানু হতে হত। বলতে হত– “আমরা কুত্তা”। এই সব স্মৃতিগুলো নির্মিত এবং বিক্রি হত এই ছোট্ট বইয়ের দোকানটাতে। ফরাসি-আলজেরিয়ান প্রকাশক এডমন্ড শার্লট খুললেন এক ছোট বইয়ের দোকান এবং পরবর্তীকালে এক প্রকাশনা সংস্থা- লে ভ্রাইএস রিচেস (Les Vraies Richesses) –একেবারে সত্যি কথা। বইয়ের নানা লেখক আসতেন সেই দোকানে, বসতেন, লিখতেন সেখানে– এটাও সত্যি। এই বইয়ের মূল চরিত্র এই বইয়ের দোকান, শার্লট নন।

২০১৭ সালে রিয়াদ বলে একটি বছর কুড়ির ছেলের উপর দায়িত্ব পড়ে দোকানটা খালি করার। দোকান কিনে নিয়েছে একজন প্রোমোটার। সেখানে খাবার দোকান হবে। ফালতু বইয়ের দোকানে লাভ বড় কম। রিয়াদের বই পড়ার কোনও ইচ্ছেই নেই। কিন্তু গল্পের আরেক চরিত্র বুড়ো আবদাল্লা, বইয়ের দোকানের প্রাক্তন কর্মচারি, তাঁর চোখ খুলে দেয়। বইয়ের জগতের রোমান্স অনুভব করে রিয়াদ। শার্লটের আধা-সত্যি গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে রিয়াদের ২০১৭-র গল্প। এই ছোট উপন্যাসের পরিসরে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে আলজেরিয়ার বইপড়া ও গভীর ভাবনাচিন্তার জগতে সেই বইয়ের দোকানটা যেন একটা সংস্কৃতির মিলনস্থল হিসেবে কাজ করত। প্রতিটি পাতায় দেখতে পাই যে, যারা দোকানটির আশেপাশে থাকে– অর্থাৎ প্রতিবেশীরা, তাঁরা এই বইয়ের দোকান বিক্রি হয়ে যাওয়ায় কতটা ক্ষুব্ধ। সবাই যে বই পড়তেন তা নয়, কিন্তু যেকোনও বইয়ের দোকান বা গ্রন্থাগারের মতো এই ছোট্ট দোকানটাও গোটা কম্যুনিটির কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল।
বেশ কিছু পরিচ্ছেদ শুধু শার্লটের ডায়েরি– কীভাবে বইয়ের দোকানটা গড়ে উঠেছে, কীভাবে বইয়ের দোকান থেকে প্রকাশনা সংস্থা খুললেন শার্লট, যেখানে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আন্তয়া সোঁ এক্সুপেরি, আন্দ্রে জিদ থেকে আলব্যের কামু পর্যন্ত… এই প্রকাশনা সংস্থা যেন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংস্কৃতির স্থায়ী আবাসস্থল। বইয়ের দোকানের নাম জা জিওনোর এক উপন্যাস থেকে নিলেন শার্লট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাগজের আকাল, চরম অর্থাভাব– লেখকদের রয়্যালটি দিতে পারছেন না, এক এক করে নামকরা লেখকরা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য সংস্থায়– যেখানে অর্থাভাব তুলনামূলকভাবে কম। তারপর আছে মুক্তচিন্তার উপর নাৎসিবাহিনীর হস্তক্ষেপ। এই দুঃসময়ে শার্লট তাঁর ডায়েরীতে লিখছেন– “A distributor without books, it’s unheard of. Unimaginable. We’ve run out of everything, I’m desperate. The shelves are almost bare.”
রিয়াদের বই পড়ার কোনও ইচ্ছেই নেই। কিন্তু গল্পের আরেক চরিত্র বুড়ো আবদাল্লা, বইয়ের দোকানের প্রাক্তন কর্মচারি, তাঁর চোখ খুলে দেয়। বইয়ের জগতের রোমান্স অনুভব করে রিয়াদ। শার্লটের আধা-সত্যি গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে রিয়াদের ২০১৭-র গল্প।
গল্প বিচরণ করেছে অনায়াসে ১৯৩০ থেকে ২০১৭। মাঝে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম, আবার ২০১৭ সালে রিয়াদের দুনিয়ায় এসেছে আবদাল্লা, যার এই বইয়ের দোকানের প্রতি ভালোবাসা সে প্রথমে বুঝতেই পারে না। আবদাল্লা এই দোকানে কাজ করেছিল কিছুদিন। সমস্ত চরিত্রগুলোই কাউথার লুকিয়ে রেখেছেন আবছায়াতে, কোনও চরিত্রই সরলরৈখিক নয়।

উপন্যাসের শেষে পাঠকের আকাঙ্ক্ষা ধাক্কা খায় আবার। যা সাধারণ বইয়ে হয়ে থাকে, এবং যা প্রত্যাশিত তা হয় না। যে উষ্ণতা এতক্ষণ ধরে চলছিল, তা আশ্চর্যজনকভাবে শীতল হয়ে যায়। এই বই আমাদের মনে পড়ায়, পৃথিবীতে, সাহিত্যে বা জীবনে আমাদের ভালো লাগা বা প্রয়োজন বড় ক্ষণস্থায়ী। কেবল আমাদের স্মৃতিতে তা রয়ে যায় অনেকদিন। এই বই আলিঙ্গন করে বইপড়াকে, আমাদের নিয়ে যায় সেই এক পুরনো বইয়ের দোকানে, পুরনো বইয়ের গন্ধ পাই পড়তে পড়তে, স্পর্শ পাই পেপার-ব্যাকের। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয় যখন পড়ি কামু দোতলায় বসে তাঁর নতুন বইয়ের খসড়া করছেন। শার্লটের মতো আমরাও দুঃখে ভেঙে পড়ি পথ দুর্ঘটনায় কামুর মারা যাবার খবরে।
ফ্রান্স কলোনি তৈরি করে ১৮৩০ সালে। কিন্তু আলজেরিয়ার তীব্র জাতীয়তাবাদ জন্ম দেয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হন, রাসায়নিক বোমা ব্যবহার হয় যথেচ্ছ। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প– কী হয়নি সেখানে! স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়া হয়, সম্পত্তিও। সঙ্গে ধীরে ধীরে ইউরোপিয়ান কালচার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আলজেরিয়ার মুসলমান-প্রধান সংস্কৃতিতে। ১৮৫৬ সালে তাঁদের ফ্রান্সের প্রজার স্বীকৃতি(!) দেওয়া হয়। ১৮৬৫ সালে নেপোলিয়ন দয়া করে তাঁদের পুরোদস্তুর ফ্রান্সের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলত শরিয়া আইন বদলে তাঁদের ফ্রান্সের আইন মান্য করতে বাধ্য করা হল। স্বকীয়তা বর্জন করার বিনিময়ে যা লাভ হল, তা হল ফ্রান্সের সঙ্গে সুসম্পর্ক– প্রভুর সঙ্গে ভৃত্যের সম্পর্ক। ফ্রান্সের নৈকট্যের সুফল হিসেবে বলতে পারি চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকতা বা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিন্তু বারবার দাবি ওঠে স্বাধীনতার এবং প্রতিবারই ফ্রান্সের দিক থেকে আসে একটু একটু ছাড় (কনসেশন)। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের ইতিহাসের কথা মনে পড়ে যায়।
প্রকৃত স্বাধীনতার লড়াই চলে ১৯৫৪ থেকে। আট বছর পর ১৯৬২তে স্বাধীন হয় আলজেরিয়া। সাড়ে তিন থেকে দশ লক্ষ মুসলমান অধিবাসীকে হত্যা করার পর ফ্রান্স পাততাড়ি গোটায়। আরও কুড়ি লক্ষের মতো লোক গৃহচ্যুত হন। মনে রাখতে হবে, আলজেরিয়ার জনসংখ্যা মাত্র এক কোটির একটু বেশি। এই সময় এমন কোনও যুদ্ধাপরাধ নেই যা সংঘটিত হয়নি, অর্থাৎ দুপক্ষই করেনি– নারী, শিশু, সাধারণ লোককে মারতে, ধর্ষণ করতে দুপক্ষেরই যথেষ্ট কালি লেগে আছে হাতে। সুতরাং বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যখন যুদ্ধাপরাধের কথা তোলে তখন তা বাস্তবরহিত মনে হতে বাধ্য।

বইয়ের দোকান খুললেন শার্লট, কিন্তু শুধু বইয়ের দোকান করে রাখলেন না। লাইব্রেরি, পুরনো বইয়ের দোকান, নতুন বই আর প্রকাশনা– অর্থাৎ বইয়ের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কিছু। তাঁর উদ্দেশ্য পরিষ্কার “be a library, a bookstore, a publishing house, but above all a place for friends who love the literature of the Mediterranean”। লোকে যখন শুধু নাম করা লোকেদের বেস্টসেলার খুঁজবে, যখন প্রাইজ পাওয়া বই খুঁজবে, তখন শার্লট তাদের পরিচিত করাবেন নতুন লেখকদের সঙ্গে। নতুন একজন উঠতি লেখক ভালো লিখছেন– তাঁর নাম আলব্যের কামু, যিনি পরে নোবেল প্রাইজটিও পাবেন এবং আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে পরিগণিত হবেন। এই বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা পড়েছে শার্লটের একক প্রচেষ্টা এবং ব্যর্থতা। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দুটির একাত্মীকরণ ঘটিয়েছেন, এবং গল্পের মধ্যে এই ব্যর্থতা এত নিপুণ হাতে বুনেছেন যে কামুর মতো লেখকও একজন পার্শ্বচরিত্রের বেশি কিছু হতে পারেননি।
বইয়ের দোকানে রিয়াদের কাজ ছিল শুধু সাফ করে দিতে হবে, বই– চাই না, মান্যাস্ক্রিপ্ট– ফেলে দাও। রসিদ, বই– ডাস্টবিন। কামু, আন্তোয়া সন এক্সুপেরি– বাদ… বাদ। পেপারব্যাক, হার্ড বাউন্ড– সব বেকার। কিছু বই সে দান করে দিল অন্যত্র। সেই মতো একটা লিস্ট করে দেওয়া হয় তাকে। ফুলের পাপড়ি ছেঁড়ার মতো লিস্ট করে এক এক করে সমস্ত ফেলে দিতে হবে। যারা বইকে ভালবাসেন তাঁদের কাছে এ বড় যন্ত্রণার বিবরণ। কিন্তু রিয়াদের সঙ্গে বইয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। সে বই ভালবাসে না। তার কাছে এ শুধু একটা কাজ, একটা দায়িত্ব। তার কাছে বাস্তব হল, এই সব বই-ই এখন ইন্টারনেটের যুগে সহজে পাওয়া যায়, ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ নয় তার কাছে।
এই বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা পড়েছে শার্লটের একক প্রচেষ্টা এবং ব্যর্থতা। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দুটির একাত্মীকরণ ঘটিয়েছেন, এবং গল্পের মধ্যে এই ব্যর্থতা এত নিপুণ হাতে বুনেছেন যে কামুর মতো লেখকও একজন পার্শ্বচরিত্রের বেশি কিছু হতে পারেননি।
এই ছোট্ট বইটির অসাধারণ গল্প একে এনে দিয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। বইটি পেয়েছে প্রিক্স রেনদত, প্রিক্স দু স্তাইল, প্রিক্স বয়ের মেদিতেরানি এবং গণকোর দে ইতালিয়া পুরস্কার। এই ছোট্ট বইটা কাউথার আদিমির তৃতীয় উপন্যাস। এই বই কিন্তু তবুও ইতিহাসের বই নয়, ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতে পারে বড়জোর। এই বই শুধু বইপড়া নিয়ে। বইকে ভালবাসলে এই বই পড়তেই হবে। এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেগে রয়েছে আলজেরিয়ার সেই রাস্তার ধারের ছোট্ট বইয়ের দোকানের গন্ধ, পুরনো বইয়ের স্পর্শ, এক বইয়ের দোকানদার থেকে প্রকাশক হয়ে ওঠার গল্প। নতুন জিনিয়াস লেখকদের খুঁজে বার করার উচ্চাশার গল্প।
বই: A Bookshop in Algiers
লেখক: কাউথার আদিমি
প্রকাশক: Serpent’s Tail
প্রকাশকাল: ৩১ মে, ২০২১
পাতাসংখ্যা: ১৬০
বিনিময়: ১১২৫ টাকা (হার্ডকভার)
৩২৪ টাকা (পেপারব্যাক)
ছবি সৌজন্য: Flickr, Jenikirbyhistory,
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।