(Rannabati)
চলচ্চিত্র: রান্নাবাটি
মুখ্য ভূমিকায়: ঋত্বিক চক্রবর্তী, সোহিনী সরকার, সোলাঙ্কি রায়, ইদারা দাশগুপ্ত, অনির্বাণ চক্রবর্তী, বরুণ চন্দ প্রমুখ।
পরিচালক: প্রতীম দাশগুপ্ত
প্রযোজক: প্রদীপ কুমার নন্দী
সঙ্গীত পরিচালনা: রণজয় ভট্টাচার্য
সিনেমাটোগ্রাফি: তূর্য ঘোষ
এডিটর: সংলাপ ভৌমিক
যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। ভীষণ পরিচিত এই কথা, জড়িয়ে আছে প্রায় প্রতিটি বাঙালি পরিবারের ঘরে ঘরে। বাংলার রন্ধন কারিগরি মানেই হেঁশেল ঠেলা, এমন বহুজনবিদিত ধারণা আজও সমানভাবে কার্যকরী। বঙ্গরমণী, বিশেষ করে গৃহবধূ, তাঁর প্রধান কাজ রান্নাঘর সামলানো। এর বাইরে তাঁর আর কিছু কাজ আছে বা থাকতে পারে, এমন বোধ ও ভাবনার জগতে প্রবেশ করতে বাঙালি এখনও দ্বিধান্বিত। তাই ওই পরিচিত কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় বৈকি! (Rannabati)
আরও পড়ুন: চলচ্চিত্রের কলকাতা, কলকাতার উৎসব
কিন্তু বিষয়টা যদি উল্টে যায়? অর্থাৎ যিনি চুল বাঁধেন, তিনি রাঁধেনও! মানে রন্ধনশিল্পই বলি বা রন্ধনকর্ম, রান্না একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজ। ভোজনরসিক ব্যক্তি ভাবেন রসনা পরিতৃপ্তির কথা, সেই রান্না প্রস্তুত হয় কীভাবে? তার পিছনের প্রতিটি শ্রম আমাদের কাছে অজানাই থেকে যায়। নিত্যনতুন রকমারি পদ জিভে জল আনে, কিন্তু সেই পদকর্তার কাছে কাজটা একঘেয়ে বা ক্লান্তিকরও তো মনে হতে পারে! অবশ্য মনে হলেও উপায় নেই বিশেষ, স্বাদের এদিক ওদিক হলেই সেই রান্নার যাবতীয় রেপুটেশন রসাতলে! তাই রন্ধনশিল্প বাস্তবিক ভীষণ ধৈর্যসাপেক্ষ। সামান্য পান থেকে চুন খসার জো নেই। যেমন ধৈর্যসাপেক্ষ তেমনই সূক্ষ্মতার দাবিদারও বটে। সুতরাং রান্না যাঁরা করেন তাঁদের কৃতিত্ব কিছু পরিমাণ বেশি বৈ কম নয়। (Rannabati)
রান্নাঘর তাই হতে পারে কোনও মানুষের ক্রিয়েটিভিটির জায়গা। কেউ আনন্দে রান্না করতে পারেন, কেউ বা রান্না করতে পারেন দুঃখ ভুলতে। কেউ রান্না করতে পারেন নিজেদের জন্য, কেউ রান্নার স্কুল তৈরি করতে পারেন। বাহারি পদের সমন্বয়ে ডাইনিং টেবিল হয়ে উঠতে পারে কারও সমস্ত ডিপ্রেশন রিলিজের জায়গা। কিন্তু প্রশ্ন হল, হঠাৎই রান্না বিষয়ক এত ভণিতার প্রয়োজন কেন? যে চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে আসব তার ভিতরে এই সমস্ত খুঁটিনাটি মিশে আছে গভীরভাবে। চলচ্চিত্রের নাম ‘রান্নাবাটি’, পরিচালক প্রতীম দাশগুপ্ত। ‘মাছের ঝোল’ যাঁরা দেখেছেন তাঁদের সিনেমার নাম দেখে রিপিটেটিভ মনে হতে পারে কিন্তু বাঙালি পরিবারের অন্দরমহলকে এমন নির্মেদভঙ্গিতে উপস্থাপিত হতে দেখে মনখারাপের অনেক কারণ হয়তো চলে যাবে নিমেষেই! (Rannabati)

বাংলায় একটা কথা বারবার শোনা যায়, মাতৃত্ব হল সহজাত আর পিতৃত্ব অর্জিত। যে বয়সে কথাটা প্রথম শুনি, উপলব্ধি হয়নি। পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উপলব্ধির পরিসর বেড়েছে। এই সিনেমায় যেন গল্পের ভিত তৈরি হয়েছে সম্পর্কের ওই গভীর তত্ত্বকথাটাকে নিয়েই। মোহর এক বছর চোদ্দোর কিশোরী, যে মাকে হারিয়েছে। তার মা অর্থাৎ সুপ্রিয়ার চলে যাওয়াটাও ক্যান্সারের আকস্মিকতায়। বাবা শান্তনুর কর্মসূত্রে বাইরে থাকা মোহরের যে জীবন ও জগৎ তৈরি করে, সেখানে কেবল তার মা-র অধিষ্ঠান। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বাবাসুলভ কোনও আচরণ পায় না মোহর, বরং ‘পিতৃত্ব’ বিষয়টাই যেন গড়ে ওঠে না তার ছোটোবেলায়। শান্তনুও মেয়েকে সময় দিতে পারে না, স্ত্রী সুপ্রিয়ার জগৎই কার্যত হয়ে ওঠে মোহরের জগৎ। (Rannabati)
“অভিনয় প্রসঙ্গে বেশি কথা বললে লেখা শেষ করা মুশকিল। এই সিনেমায় সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি নজর কেড়েছে, তা অভিনয়।”
এই জগতে হঠাৎই ছেদ পড়ে। সুপ্রিয়ার চলে যাওয়া যেমন শান্তনুকে বিপর্যস্ত করে, তার থেকে অনেক বেশি ছন্নছাড়া হয়ে যায় মোহরের জীবন। বাবা এবং মেয়ের এই আপাত অসম সমীকরণ থেকে গল্পের যাত্রা শুরু, এবং চলচ্চিত্রে গতিবিধির যাপনপর্ব। শান্তনু, বারবার অর্জিত পিতৃত্বকে বুঝতে চায় কিন্তু তা যেন বোঝার মতন হয়ে দাঁড়ায়। কিছুতেই সে মোহরের জীবন বা জগতে প্রবেশ করতে পারে না। নানান চেষ্টা, বন্ধুদের পরামর্শ সবই চলে, তবে বয়ঃসন্ধির যে পর্বে সংসারে মায়ের প্রয়োজন, সেই পর্বে একজন বাবা ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ে। নিজের সঙ্গে প্রতিদিন যুঝতে যুঝতে অসম লড়াইয়ে যেন হেরে যেতে থাকে শান্তনু। আর এখানেই সামান্য আশার আলো হয়ে আসে একটি রান্নার খাতা, ‘রান্নাবাটি’। (Rannabati)
মোহরের জগতে ছিল তার মা এবং হরেকরকম রেসিপি। মেয়েকে রকমারি পদ বানিয়ে দিয়ে কাটত তাদের সময়, আর সেইসব পদের বিবরণ লেখা থাকত খাতায়। সেই খাতার প্রতিটি পাতায় আছে মোহরের ভাল থাকার রসদ। কিন্তু শান্তনু রান্নার সামান্যটুকুও জানে না। তাই সেই খাতা হাতে পেয়েও শান্তনু যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যায়। বাবা ও মেয়ের মধ্যেকার দূরত্ব কমে না বরং বাড়তে থাকে। নানান প্রচেষ্টার পর অবশেষে একদিন রান্না শেখানোর বিজ্ঞাপন দেখে শান্তনু, ঋতা রায়ের ক্লাসে চমৎকার সব রান্না শিখে ফেলা যায় সহজেই! তারপর কী হয় সেই ক্লাসে? এরপরের গল্প তোলা থাক দর্শকের জন্য নাহলে সিনেমার মজাটাই মাটি। তবে বাবা-মেয়ের সমীকরণে ‘রান্নাবাটি’ অবশ্যই নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। (Rannabati)
আরও পড়ুন: খসে পড়া তারা অথবা পুনর্জন্মের গল্প
ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম আমরা। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সেই খেলার নাম ছিল রান্নাবাটি। ছোট আকারের হাতা, খুন্তি, কড়াই, গ্যাস, ওভেন, প্রেসার কুকার, চামচ, বাটি সবমিলিয়ে ছিল খেলার সরঞ্জাম। রান্নার উপকরণে ঘাসপাতা থেকে কাগজ, থাকত নানান সামগ্রী। এই রান্নাবাটি খেলায় কোনও ছেলে-মেয়ের বিভাজন দেখিনি। ক্রমে যদিও ইতিউতি শুনেছি এসব নাকি ‘মেয়েদের খেলা’ কিন্তু ছেলেদের শৈশবেও ছিল এই খেলার ভরপুর অস্তিত্ব। (Rannabati)
চলচ্চিত্র ‘রান্নাবাটি’ সেই ফেলে আসা শৈশবের কথাও মনে করিয়ে দেবে। বাবা অর্থাৎ একজন পুরুষ তার মেয়ের কাছে মায়ের ভূমিকা পালন করতে চাইছে, যেখানে যোগাযোগের একমাত্র সূত্র রান্না। সেখানে কোনও তথাকথিত ‘জেন্ডার’ বা লিঙ্গ পরিচয় কার্যকর হয়ে উঠছে না। একইসঙ্গে সমাজ-পরিবারের একাধিক স্তর উঠে আসছে এই সিনেমায়। সমাজ নির্ধারিত প্রচলিত মেয়ে ও ছেলের বাইনারির বিরুদ্ধে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনই রান্না মানেই তা কেবল মেয়েদের কাজ বা মেয়েরাই করবে, এর বিপরীত ভাবনার সূক্ষ্মতাগুলিকেও ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। পাশাপাশি রান্না করার মতো বিষয়টি যে দৈনন্দিন আর পাঁচটা কাজ বা চাকরির মতন সমান গুরুত্বপূর্ণ, এমন ভাবনার পরিসর নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু দিক ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। রান্নাবাটি আদতে খেলা হয়, তা যেন বিরাট জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ! (Rannabati)

অভিনয় প্রসঙ্গে বেশি কথা বললে লেখা শেষ করা মুশকিল। এই সিনেমায় সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি নজর কেড়েছে, তা অভিনয়। একবারের জন্যও মনে হয়নি কেউ অভিনয় করছেন। মনে হয়েছে যেন একের পর এক দৃশ্য স্বাভাবিকভাবেই হয়ে চলেছে, যেমন বাস্তবে হয়ে থাকে। শান্তনুর ভূমিকায় ঋত্বিক চক্রবর্তীকে দেখে মনে হয়েছে, এই চরিত্রটি যেন ঋত্বিককে ভেবে নির্মাণ করা! সুপ্রিয়া অর্থাৎ সোলাঙ্কি রায়ের অভিনয়ের পরিসর কম কিন্তু সেই পরিসরেও যে অদ্ভুত মায়াবী বাতাবরণ তৈরি করেছেন সোলাঙ্কি তা প্রশংসনীয়। মোহরের ভূমিকায় ইদারা দাশগুপ্ত অনবদ্য। একটি চোদ্দো বছর বয়সী মা-হারা মেয়ে ঠিক কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে, তা অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ইদারা। রাগ-ক্ষোভ-অভিমান থেকে আনন্দ, হাসি, মজার সবরকম অনুভূতি প্রকাশে ইদারা ছিলেন ভীষণ সাবলীল। (Rannabati)
“সঙ্গীত প্রয়োগ এবং ব্যবহারে সিনেমাটিকে পাঁচে অবশ্যই তিন দেওয়া যায় এবং সামগ্রিকভাবে সিনেমাটিকে পাঁচে সাড়ে তিন দেওয়া যায়।”
এরপর ঋতা রায় ওরফে সোহিনী সরকার। এইমুহূর্তে বাংলা সিনেমাজগতে সোহিনী নিজেই বোধহয় নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যে কোনও চরিত্র এমন অনায়াসেই সোহিণী সহজ করে তুলতে পারেন যে একবারের জন্যও মনে হয় না, তিনি অভিনয় করছেন। যতক্ষণ এই সিনেমায় সোহিনী উপস্থিত থেকেছেন, সিনেমার ঘটনাপ্রবাহকে সহজ-সাবলীল করে তুলেছেন। অন্যান্য চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী, বরুণ চন্দ, পুষ্পরাগ (টোটা) রায়চৌধুরীসহ অন্যান্যরাও একেবারে যথাযথ। (Rannabati)

সিনেমায় আবহ এবং গানের ব্যবহার বাড়াবাড়ি মনে হয়নি। কোথাও অতিরিক্ত গানের প্রয়োগ সিনেমার গতিকে স্লথ করেনি। রণজয় ভট্টাচার্য তাই সঙ্গীত নির্মাণে প্রশংসার দাবিদার। সিনেমার ভিতরে বহু দৃশ্য এবং ফ্রেম আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে। ক্যামেরার কাজে সেই কৃতিত্ব অবশ্যই তূর্য ঘোষের। শান্তনু ও মোহরের কথোপকথন বা ঋতা-শান্তনুর কথোপকথনের কিছু দৃশ্য যেমন মনে থেকে যাবে, তেমনই সুপ্রিয়ার এই রান্নাবাটি পর্বের অতিক্রান্ত সময়ের কোলাজগুলিকে নিজের মুন্সিয়ানায় ধরেছেন তূর্য। (Rannabati)
আরও পড়ুন: স্বপ্নের চারাগাছে জল দেওয়ার গল্প ‘অঙ্ক কি কঠিন’
১২২ মিনিটের চলচ্চিত্র ‘রান্নাবাটি’। রুদ্ধশ্বাস ক্রাইম বা থ্রিলিং এলিমেন্টের বাইরে বেরিয়ে এই চলচ্চিত্র সেন্টিমেন্টাল কিন্তু ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। রক্তারক্তি বা অবাধ যৌনতার বাইরে বেরিয়েও যে সমসাময়িক প্লটকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা যায়, তা প্রমাণ করলেন প্রতীম দাশগুপ্ত। ‘চালচিত্র’-র মতন ক্রাইম-থ্রিলার যিনি তৈরি করেছিলেন তিনিই তৈরি করলেন ‘রান্নাবাটি’; এমন ভিন্নমাত্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণে অবশ্যই প্রতীম দাশগুপ্তকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। জমজমাটি স্বাদের সন্ধানে, হারানো ছেলেবেলা আর হেঁশেলের ভিতর অনেক না পাওয়াগুলোকে ফিরে পাওয়ার হদিশ দেবে ‘রান্নাবাটি’। পরিচালক বলছেন চ্যাপ্টার ১, তাহলে আমাদের মতন দর্শক অপেক্ষায় থাকবে পরের চ্যাপ্টারের। রেসিপি থেকে রিলেশন খুঁজে পাওয়া গেলে মন্দ কী? (Rannabati)
সঙ্গীত প্রয়োগ এবং ব্যবহারে সিনেমাটিকে পাঁচে অবশ্যই তিন দেওয়া যায় এবং সামগ্রিকভাবে সিনেমাটিকে পাঁচে সাড়ে তিন দেওয়া যায়। (Rannabati)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।
