১০/০২/২০২০, নীস, রাত ১১:২০
৩রা জানুয়ারি কলকাতা থেকে ফিরেছি। প্রায় দেড় বছর পর মাসখানেকের বেশি সময় হাতে নিয়েই বাড়ি গিয়েছিলাম। সুতরাং কাজের চাপ থাকলেও, মন বেশ ফুরফুরেই রয়েছে। তার মাঝেই আর্য এসেছিল গত সপ্তাহের শেষে। আর্যর সাথে বহুদিনের আলাপ, আমার এক বন্ধুর ভাই। আলাপ সেভাবেই তবে আমরা কলকাতায় একসাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। সাহা ইন্সটিটিউটের দিনগুলোও বেশ ছিল। বিগত নয় বছরে কলকাতায় একবার, আর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে— যাওয়া -আসার পথে একবার, এই দু’বার বাদ দিয়ে আমাদের দেখাও হয়নি। সে কারণেই ঠিক হয় ও ফেব্রুয়ারির প্রথম উইকেণ্ডেই আসবে। দিন কয়েক জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, আর তার সাথে যদি টুক করে একটা গাড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে আসা যায় তবে তো কোনো কথাই নেই। সে গল্পটাই লিখে রাখব বলে এতদিন বাদে বেশ জোর করেই ডায়েরিটা নিয়ে বসা।
[the_ad id=”270088″]
চাকরির একটা যুৎসই হিল্লে হওয়ায় বেশ তাড়াহুড়ো করেই ড্রেসডেনের পাঠ চুকিয়ে বছর খানেক হল দক্ষিণ ফ্রান্সের মধ্যমণি নীস শহরে এসে বাসা বেঁধেছি। এদেশের এই অঞ্চলটাকে “ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা” বা “কোট ডি আজুর” নামে ডাকা হয়। ভূমধ্যসাগরের তীরে মেনটন, মোন্যাকো, নীস, অন্টিবস, কান, ইত্যাদি একের পর এক চোখ ধাঁধানো ছোট ছোট শহর। নীসের উত্তরে অবস্থিত মোন্যাকো ফর্মুলা ওয়ান রেসিং এবং মন্টে কার্লো ক্যাসিনোর জন্য বিশ্বখ্যাত। এই ক্যাসিনোর পাশেই “কাফে পারি”। মোন্যাকো ছাড়িয়ে মিনিট ত্রিশেক উত্তরে ড্রাইভ করলেই মেনটন এবং তারপরই ফ্রান্স-ইটালি সীমান্ত। অন্যদিকে নীস ছাড়িয়ে মিনিট কুড়ির রেলপথেই অন্টিবস পৌছে যাওয়া যায় এবং আরো মিনিট ত্রিশেক গাড়ি নিয়ে এগোলেই সিনেমা জগতের স্বপ্নশহর কান। এই সমস্ত শহরগুলোর যেমন মন কাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তেমনই সুন্দর এখানকার মানুষ। কাজেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে আর্য যখন আসছে তিনজনে মিলে বেশ কয়েকটা জায়গা চষে ফেলা যাবে। তার উপর ওর গাড়ি চালানোর লাইসেন্স থাকায় একটু কম চেনা কম জানা এক আধটা জায়গাও ঘুরে দেখা যাবে।
আর্য এল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেবেলা। শুক্রবারটা আমরা নীসের অলিগলিতেই কাটিয়ে দিলাম। একটা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া হয়েছে। পরের দিন গাড়িটা নিয়ে মোন্যাকোয় খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা মেনটনে যাব। তা ছাড়া মোন্যাকো যাওয়ার পথে মধ্যযুগীয় একটা গ্রাম পড়ে, ফরাসিতে তার নাম “এজে ভিলাজ”। সেদিকটাতেও একটু ঢু মারার ইচ্ছে রয়েছে।
শুতে যাওয়ার আগে দু’জনে অল্প দু-পাত্তর নিয়ে বসেছি। নানান ব্যাপারে কথা হতে হতে এজে নিয়েও কথা উঠল।

আসলে নীস থেকে মোন্যাকো যাওয়ার রাস্তায় পড়লেও, এজে গ্রামটি, প্রায় ৪২৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এই গ্রাম এখন এজে কমিউনের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলের প্রথম স্থাপত্যের বয়স প্রায় ৪০০০ বছরের বেশি। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে বাস্টিড পাহাড়ে প্রথম বাস্তু ব্যবহারের নিদর্শন মেলে। এরপর লৌহযুগে সেল্টো-লিগুরিয়ান যাযাবর জনগোষ্ঠী অঞ্চলটিতে বহু ক্যাসটেলার (উঁচু পাথরের থাম দিয়ে নির্মিত ঘেরা জায়গা) উত্থাপন করেছিলেন। এই পাথরের ঘেরগুলি সাধারণত গ্রাম অঞ্চলে বা প্রভাবশালী মাউন্ট বাসটিডের মতো উচ্চতায় (৫৬৭ মিটার) বানানো হত। এজের নামকরণের পেছনে প্রচলিত গল্পগুলিও বেশ চিত্তাকর্ষক। কিছু তথ্যে বলা হয় নামটির জন্ম হয় আন্তোনিন সামুদ্রিক ভ্রমণ-ইতিহাসে উল্লিখিত সেন্ট-লরেন্ট ডি’এজে উপসাগরে অবস্থিত অ্যাভিসিও বন্দরের থেকে। আবার অন্যদিকে ফোনিশিয়ানদের মৌখিক ঐতিহ্য অনুযায়ী পাথরের উপর পূজ্য দেবী আইসিসের নাম থেকে এজে নামের উৎপত্তি। আইসিস ছিলেন প্রাচীনত্বের দেবী, নারীত্ব এবং মাতৃত্বের মিশরীয় আদর্শ। তিনি সমগ্র দাস ও নিপীড়িত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষক, তবে ধনী, অভিজাত এবং শাসকদের প্রার্থনাও শুনতেন, এমনই বিশ্বাস। পাহাড়ের উপর ফিনিক্স পাখির বাসার মতন এজের গঠন হওয়ায়, এ গ্রামের “কোট অফ আর্মস”-এও এই পৌরাণিক পাখির মূর্তি রয়েছে, এবং লেখা রয়েছে “আইসিস মরিয়েন্দো রেনাসকর” যার অর্থ “মৃত্যুর সময়, আমার পুনর্জন্ম হয়”।
নীসের উত্তরে অবস্থিত মোন্যাকো ফর্মুলা ওয়ান রেসিং এবং মন্টে কার্লো ক্যাসিনোর জন্য বিশ্বখ্যাত। এই ক্যাসিনোর পাশেই “কাফে পারি”। মোন্যাকো ছাড়িয়ে মিনিট ত্রিশেক উত্তরে ড্রাইভ করলেই মেনটন এবং তারপরই ফ্রান্স-ইটালি সীমান্ত। অন্যদিকে নীস ছাড়িয়ে মিনিট কুড়ির রেলপথেই অন্টিবস পৌছে যাওয়া যায় এবং আরো মিনিট ত্রিশেক গাড়ি নিয়ে এগোলেই সিনেমা জগতের স্বপ্নশহর কান।
যাই হয়ে থাকুক, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পর বারবারিয়ান আগ্রাসনের একাধিক সংঘর্ষের মুখে পড়ে এই অঞ্চল। ফলত একটা সময় প্রায় বাধ্য হয়েই এখানকার আদি-বাসিন্দারা গ্রামটিকে পুনরুদ্ধার করেন এবং এজে একটি প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চল হিসাবে স্থাপিত হয়। এ অঞ্চলের মানুষ “এজাসক” নামে পরিচিত হন। গ্রাম স্থাপনের পরপরই ১০ম শতাব্দীতে মুর আগ্রাসনের কবলে আসে এজে। অবশেষে ৯৭৩ সালে “উইলিয়াম দে প্রভেন্স” মুর রাজাদের অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে এজাসকদের মুক্তি এনে দেন।
১৩৮৩ সাল নাগাদ, এজে সাওয় রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে আসে, যারা এ গ্রামে একটি নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গের ফলে সুরক্ষার বৃদ্ধি হওয়ায় এজে শহর গড়ে ওঠে । এক সময়ে, হাউস অফ সাভয়ের শক্তি ওয়াউদ শহর সহ অন্যান্য অঞ্চলগুলিতেও প্রসারিত হয়েছিল। হ্যারেডদিন বারবারোসার নির্দেশে ১৫৪৩ সালে ফরাসি এবং তূর্কি সৈন্যরা এজে দখল করে এবং তারপর স্পেনের উত্তরাধিকার সূত্রে চতুর্দশ লুই ১৭০০ সালে শহর অধিগ্রহণ করতে এসে দুর্গের প্রাচীর পুরোপুরি ধ্বংস করে দেন। এর ফলস্বরূপ পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে বেশ অশান্ত হয়ে পড়ে এজের ইতিহাস। অবশেষে ১৮৬0 সালে আঞ্চলিক বাসিন্দাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এজে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের অংশ হয়।
[the_ad id=”270085″]
শনিবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া গেল। প্রথমে আর্য আর আমি আমাদের ফ্ল্যাটের কাছেই কিছু ক্রোয়াসঁ সহযোগে এক কাপ করে কফি খেয়ে এয়ারপোর্ট ছুটলাম। আসলে আমাদের গাড়ি ভাড়ার কোম্পানিটি এয়ারপোর্টেই অবস্থিত। নীস এয়ারপোর্ট বাড়ি থেকে বিশেষ দূরে না হওয়ায় পৌঁছে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই গাড়ি পাওয়া গেল। শারদীয়ার আরো একটু সময় লাগবে জানতে পেরে আমরা ঠিক করলাম চট করে অন্টিবসের সমুদ্র সৈকতটা একবার ঘুরে আসা যাক। সকাল সকাল ফাঁকা রাস্তায় সময়ও বেশি লাগার কথা নয়। অন্টিবসের পালা শেষ করে ফ্ল্যাটে পৌছলাম যখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। এবার আমদের গাড়ি রওনা দবে এজের উদ্দেশে।
নীস থেকে মোন্যাকোর দূরত্ব বিশেষ কিছু নয়। নীস বন্দরের কাছ থেকে ১০০ নম্বর বাস পনেরো মিনিট পরপর দিব্যি পাওয়া যায়। কাজেই আগেও দু- একবার আমাদের মোন্যাকো যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এজের অবস্থানটা বেশ বেয়াড়া। গাড়ি না থাকলে পৌঁছনো দুরূহ। তাই আর্যর লাইসেন্স ভরসা। মোন্যাকোর রাস্তা এমনিতেই ভীষণ মনোরম। দু’ভাবে যাওয়া যেতে পারে। প্রথম রাস্তাটি পাহাড়ি টানেলের ভিতর দিয়ে, সৈকত থেকে দূরে। তবে দ্বিতীয়টি আমার বিশেষ পছন্দের। নীস থে্কে সেন্ট ট্রোপেজ যাওয়ার এই রাস্তা পাহাড়ের খাদের গায়ে। বাঁ হাতে পাহাড়, আর গোটা রাস্তাটাতেই ডান হাতে ভূমধ্যসাগরের অপরূপ নীলিমা। শুধু এই দৃশ্যের জন্যেই বার বার আমি এ রাস্তায় ফিরে যাই।
আমাদের গাড়ি নীস ছাড়িয়ে পাহাড়ে উঠতেই ডান হাতে সমুদ্রসৈকতের পাশে রেললাইন ও নীস পোর্টের অপরূপ প্যানোরামা দেখে আর্য উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠেছে। আমি বিশেষ কিছু বলিনি। এজে যেমন ভুবনমোহিনী এক একটি প্যানোরামা নিয়ে অপেক্ষায় আছে বলে শুনেছি তাতে উত্তেজনা জমিয়ে রাখাই ভাল।
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।