Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ভারতের প্রথম আধুনিক মহিলা চিকিৎসক আনন্দী যোশি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মার্চ ৮, ২০২৩

Anandibai Gopalrao Joshi
Anandibai Gopalrao Joshi
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি রাজ্যের ছোট্ট শহর রসেলের এক দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করতে করতে সময় কাটানোর জন্য পুরনো পত্রিকার পাতা উল্টোচ্ছিলেন থিওডোসিয়া কার্পেন্টার। হঠাৎ একটা চিঠি আর তার উত্তরে তাঁর চোখ আটকে গেল। পত্রিকাটির নাম মিশনারি রিভিউ, সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কথাই থাকে। এই চিঠিটা একটু আলাদা, সুদূর ভারত থেকে গোপালরাও যোশি নামের একজন লিখেছেন তাঁর খুব ইচ্ছা যে তাঁর স্ত্রী উচ্চশিক্ষা পায়, কিন্তু ভারতে সে সুযোগ নেই। আমেরিকাতে কি কেউ গোপালরাওদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে, যাতে করে তাঁর স্ত্রী পড়াশোনা করতে পারে? চিঠির উত্তর লিখেছেন পত্রিকার সম্পাদক খ্রিস্টান মিশনারি; তিনি একটু রূঢ়ভাবেই বলেছেন যে ভারতে মিশনারিদের স্থাপিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, গোপালরাওয়ের স্ত্রী সেখানেই পড়তে পারবে। তিনি আশা করেন যে স্বামী স্ত্রী দুজনেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে। 

গোপালরাওয়ের চিঠিটি থিওডোসিয়ার মনে দাগ কাটল। তিনি স্থানীয়ভাবে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ভেবেচিন্তে তিনি গোপালরাওয়ের ঠিকানাতে তাঁর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক চিঠি লিখলেন, তিনি ও তাঁর স্বামী বেঞ্জামিন তাঁদের যথাসাধ্য সাহায্য করতে চান। 

পত্রিকাটির নাম মিশনারি রিভিউ, সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কথাই থাকে। এই চিঠিটা একটু আলাদা, সুদূর ভারত থেকে গোপালরাও যোশি নামের একজন লিখেছেন তাঁর খুব ইচ্ছা যে তাঁর স্ত্রী উচ্চশিক্ষা পায়, কিন্তু ভারতে সে সুযোগ নেই। আমেরিকাতে কি কেউ গোপালরাওদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে, যাতে করে তাঁর স্ত্রী পড়াশোনা করতে পারে?  

কে এই আনন্দীবাই? ১৮৬৫ সালের ৩১ মার্চ বম্বে প্রেসিডেন্সি বা বর্তমান মহারাষ্ট্রের কল্যাণে এক মারাঠি চিতপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় এক কন্যার, নাম রাখা হয় যমুনা। তাঁর বাবার নাম গণপতরাও যোশি, মায়ের নাম গঙ্গাবাই। ‘রাও’ ও ‘বাই’ হল পুরুষ ও মহিলাদের সম্মানসূচক সম্ভাষণ। যুগের রীতি মেনে মাত্র ন’বছর বয়সেই যমুনার বিয়ে দেওয়া হল তার থেকে কুড়ি বছরের বড় গোপালরাওয়ের সঙ্গে। তিনি যমুনাদের বাড়িতে থেকে ডাকবিভাগে চাকরি করতেন, যমুনাকে সংস্কৃত পড়াতেন। প্রথম স্ত্রী আগেই মারা গেছেন, এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। মারাঠাদের প্রথা অনুসারে বিয়ের পরে যমুনার নাম পালটে রাখা হল আনন্দী। 

Anandibai
আনন্দী বাই

গোপালরাও ছিলেন প্রগতিশীল, নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহের সমর্থক। তাঁর মা ও পরিবারের অন্যদের আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী সাবিত্রীর পড়াশোনা শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাবিত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি কোনও বিধবাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু তা বিশেষ এগোয়নি। তাঁর ইচ্ছা ছিল আনন্দী পড়াশোনা চালিয়ে যাক, মেয়েরাও যে উচ্চশিক্ষা অর্জনে সক্ষম, তার উদাহরণ হিসাবে তিনি তাকে তুলে ধরবেন। আনন্দীর বাবাও সহমত ছিলেন, কিন্তু বাদ সেধেছিলেন আনন্দীর মা ও ঠাকুমা। মেয়েকে পড়াশোনা শেখালে অধর্ম হবে ভেবে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে শিশু আনন্দী গোপালকে ভয় পেতে শুরু করে, তাঁর কাছে যেতে চায় না। গোপালরাও সমস্যাটা বুঝে আনন্দীকে বকাবকি করেননি, কিন্তু আনন্দীর ঠাকুমা গোপালকে বলেন যে এত লাই দিলে পরে বৌকে আর সামলানো যাবে না। এই সমস্ত গোপালের উপরেও প্রভাব ফেলছিল। একদিন আনন্দী পড়তে না চাওয়ায় গোপাল ধৈর্য হারিয়ে আনন্দীকে চেলাকাঠ দিয়ে এমন মেরেছিলেন যে সারা গায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। পরে আরও একবার রেগে গিয়ে আনন্দীর দিকে চেয়ার ছুড়েছিলেন। আনন্দী সারা জীবন সে সব কথা ভোলেননি। 

আরও পড়ুন: ‘বাংলার কিটস’: বিস্মৃতপ্রায় তরু দত্ত

গোপাল বুঝলেন যে বাপের বাড়িতে আনন্দীর পড়াশোনা হবে না। তিনি আলিবাগে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করলেন এবং ঠিক করলেন আনন্দীকেও নিয়ে যাবেন। কিন্তু আনন্দী তখনও শিশু, রীতি অনুযায়ী তার স্বামীর সঙ্গে থাকার বয়স তখনও হয়নি। তাই আনন্দীর ঠাকুমা সঙ্গে গেলেন, ফলে সমস্যাটার পুরোপুরি সমাধান হল না। তবে গোপাল চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। আনন্দীকে তিনি জুতো কিনে দিয়েছিলেন, যা তখন মেয়েদের পায়ে ভাবাই যেত না। সন্ধেবেলা আনন্দী ও গোপাল সমুদ্রের ধারে পায়চারি করতেন, সেটাও ছিল প্রচলিত রীতির বিপরীত। এই সব লোভের পাশাপাশি ছিল ভয় দেখানো, আনন্দী পড়াশোনা না করলে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয়। সেসময় স্বামী ছেড়ে গেলে মেয়েদের একমাত্র জায়গা ছিল বাপের বাড়ি, সঙ্গে জুটত সামাজিক অসম্মান ও বাড়ির গঞ্জনা। 

একদিন আনন্দী পড়তে না চাওয়ায় গোপাল ধৈর্য হারিয়ে আনন্দীকে চেলাকাঠ দিয়ে এমন মেরেছিলেন যে সারা গায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। পরে আরও একবার রেগে গিয়ে আনন্দীর দিকে চেয়ার ছুড়েছিলেন। আনন্দী সারা জীবন সে সব কথা ভোলেননি। 

তেরো বছর বয়সে আনন্দীর এক ছেলে হল, কিন্তু সে বেঁচেছিল মাত্র দশ দিন। সে যুগে অন্যরা একে কর্মফল বলেই মেনে নিত, কিন্তু আনন্দীর মনে হয়েছিল যে সঠিক চিকিৎসা পেলে হয়তো তাঁর ছেলেকে এমন অকালে চলে যেতে হত না। ছেলের মৃত্যু বদলে দিল আনন্দীকে। তাঁর পড়াশোনা আর শুধু স্বামীর মন রাখতে নয়, এক উদ্দেশ্য খুঁজে পেল; ঠিক করলেন তিনি ডাক্তার হবেন। ইতিমধ্যে আনন্দী মারাঠি ভালোই শিখে গেছে, ইংরাজিও শিখতে শুরু করেছেন। 

গোপালরাও বুঝলেন কোনও বড় শহরে যাওয়া দরকার, যেখানে সামাজিক বাধানিষেধ আনন্দীর পড়াশোনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, একই সঙ্গে তাঁর ইংরাজি শেখারও সুযোগ থাকবে। তিনি কোলহাপুরে ট্রান্সফার নিলেন। এই সময়েই এক মিশনারির পরামর্শে তিনি আমেরিকার পত্রিকাতে চিঠি লিখেছিলেন যা মিসেস কার্পেন্টারের চোখে পড়েছিল। কোলহাপুরেও কিছু সমস্যা হল, শেষ পর্যন্ত গোপাল বম্বেতে ট্রান্সফার নিলেন। সেখানে এক মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেন আনন্দী। একসময় বাইবেল পড়তে অস্বীকার করে স্কুল ছাড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু গোপাল তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ফেরত পাঠান। 

Anandibai & Gopalrao Joshi
আনন্দীবাই ও স্বামী গোপালরাও

বম্বের স্কুলে পড়তে যাওয়া আনন্দীর কাছে ছিল এক বিভীষিকা। জুতো-মোজা পরা, হাতে বই তরুণীটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল পথচারী ও দোকানদারদের বিদ্রূপ, এমনকি অশালীন অঙ্গভঙ্গির লক্ষ্যবস্তু। গোপালের বাবা বিনায়ক রাও গোপালের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। শেষপর্যন্ত গোপালরাও আবার ট্রান্সফার নিলেন, এবার ভুজে। বম্বের মতো বড় শহর থেকে আসা আনন্দীর ভুজের কোনও স্কুলে নতুন কিছু শেখার ছিল না। কিন্তু ভুজের দেওয়ানের সঙ্গে গোপালরাওয়ের আলাপ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর মারফত ভুজের ব্রিটিশ রেসিডেন্টের স্ত্রী মিসেস ব্যাটাই আনন্দীর পড়াশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন। থিওডোসিয়ার চিঠি কোলহাপুরেই গিয়েছিল, ন’মাস পরে সেই চিঠি ভুজে গোপালরাওয়ের কাছে পৌঁছল। 

পনেরো বছরের আনন্দী ও চল্লিশোর্ধ্ব থিওডোসিয়ার মধ্যে পত্রবিনিময় শুরু হল। থিওডোসিয়া পাঠাতেন খবরের কাগজ ও বই। দুজনে দুজনের সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে শিখলেন। আনন্দী মাত্র এক বছর কোনও স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর চিঠিগুলোতে ইংরাজি ভাষার উপর দখল দেখলে অবাক হতে হয়। আর খুঁজে পাওয়া যায় এক প্রতিবাদী নারীকে। সেকালের রীতিনীতি উড়িয়ে তিনি স্বামীর নাম চিঠিতে লিখে পাঠাচ্ছেন, মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন। কিছুদিন পর থেকেই থিওডোসিয়া হলেন আনন্দীর মাসি, ‘আন্ট’। 

বম্বের স্কুলে পড়তে যাওয়া আনন্দীর কাছে ছিল এক বিভীষিকা। জুতো-মোজা পরা, হাতে বই তরুণীটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল পথচারী ও দোকানদারদের বিদ্রূপ, এমনকি অশালীন অঙ্গভঙ্গির লক্ষ্যবস্তু। গোপালের বাবা বিনায়ক রাও গোপালের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। শেষপর্যন্ত গোপালরাও আবার ট্রান্সফার নিলেন, এবার ভুজে।

ইতিমধ্যে গোপাল বদলি হয়েছেন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতাতে। সেখানে আনন্দীরা খুবই সমস্যায় পড়েছিলেন। মারাঠি মেয়েদের অনেক বাধানিষেধ থাকলেও পর্দাপ্রথা ছিল না। এখানে দুজনে একসঙ্গে বেরোলে তাঁদের পিছনে লোক জড়ো হয়ে যেত। আনন্দী থিওডোসিয়াকে লিখেছেন এমনকি যে সমস্ত বাবুরা ইউরোপ আমেরিকাতে অনেকদিন থেকেছেন, তাঁরাও তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে খোলা গাড়িতে বেরোন না। বম্বে ও কলকাতার সমাজের পার্থক্য দেখে গোপালরাও হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবতেই পারেননি সুদূর বিদেশের রীতিনীতি এতই অন্যরকম হবে যে তাঁরা কিছুতেই সেখানে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবেন না। এবার কিন্তু আনন্দী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি ডাক্তারি পড়বেনই। 

Anandibai Joshi
আনন্দী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি ডাক্তারি পড়বেনই

থিওডোসিয়া আনন্দীদের তাঁর বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানালেন, কিন্তু গোপালরাও ও আনন্দী অনেক আলোচনা করে ঠিক করলেন আনন্দী একাই যাবেন, কারণ দুজনের আমেরিকা যাত্রা ও থাকার খরচ তাঁদের ক্ষমতাতীত। সে যুগের বিচারে এ এক অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত সন্দেহ নেই। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এক উচ্চবর্ণের মহিলার একা কালাপানি পার হয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্তকে কী চোখে দেখেছিল আমরা অনুমান করতে পারি। ইতিমধ্যে গোপালরাও ব্যারাকপুর হয়ে শ্রীরামপুর পোস্ট অফিসে বদলি হয়েছেন। সেখানে প্রতিদিন তাঁদের দেখার জন্য ভিড় জমে যেত, নানারকম টিটকিরি ভেসে আসত। শেষ পর্যন্ত আনন্দী ও গোপাল ঠিক করলেন প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে আনন্দীর আমেরিকা যাত্রার উদ্দেশ্য সবাইকে জানানো হবে। বক্তৃতা হবে শ্রীরামপুর কলেজে।

এতদিনে ছাত্রী শিক্ষককে ছাড়িয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন, তাই প্রথমে গোপালরাওয়ের বলার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভিড় ঠাসা সভায় বক্তব্য রাখেন আনন্দী নিজেই। সভাতে ভারতীয়দের সঙ্গে কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন। প্রথম প্রকাশ্য সভাতে উপস্থিত হওয়া, সেখানে বক্তৃতা এবং তাও ইংরাজিতে! আনন্দী লিখিত বক্তৃতা পড়েননি বা কোনও নোট ব্যবহার করেননি। সৌভাগ্যক্রমে সেই বক্তৃতা কোনও এক অজ্ঞাত সংবাদদাতা বম্বের নেটিভ ওপিনিয়ন সংবাদপত্রে ছাপানোর সুবাদে সেটি আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। 

আনন্দীর সেই বক্তৃতাটি এক অসাধারণ দলিল, কিন্তু এই লেখার পরিসরে তার ক্ষুদ্র অংশও উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। একটি কথাই শুধু বলি, আনন্দী স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, তিনি আমেরিকায় ডাক্তারি পড়তে চান, কারণ দেশের নারীরা পুরুষ ডাক্তার স্পর্শ করতে দেন না, তাই প্রয়োজন মহিলা ডাক্তার। রক্ষণশীলদের মতের পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু বক্তৃতাটি শ্রোতাদের মনে দাগ কেটেছিল। বাংলার পোস্টমাস্টার জেনারেল এইচ ই এম জেমস গোপালরাওকে অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দীর পড়াশোনার খরচ হিসাবে একশো টাকা পাঠান। তিনি এই উদ্দেশ্যে একটা ফান্ডও খুলেছিলেন, সেখানে ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিপন, বাংলার গভর্নর টম্পসন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহায্য করেছিলেন, জেমস নিজেও আরও একশো টাকা দিয়েছিলেন। চাঁদার মোট সাড়ে সাতশো টাকা আনন্দীর উপকারে লেগেছিল। অবশ্য টিকিটের জন্য এরপরও আনন্দী বাবা-মায়ের দেওয়া সোনার গয়নাগুলি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আনন্দীর সেই বক্তৃতাটি এক অসাধারণ দলিল, কিন্তু এই লেখার পরিসরে তার ক্ষুদ্র অংশও উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। একটি কথাই শুধু বলি, আনন্দী স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, তিনি আমেরিকায় ডাক্তারি পড়তে চান, কারণ দেশের নারীরা পুরুষ ডাক্তার স্পর্শ করতে দেন না, তাই প্রয়োজন মহিলা ডাক্তার। রক্ষণশীলদের মতের পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু বক্তৃতাটি শ্রোতাদের মনে দাগ কেটেছিল। বাংলার পোস্টমাস্টার জেনারেল এইচ ই এম জেমস গোপালরাওকে অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দীর পড়াশোনার খরচ হিসাবে একশো টাকা পাঠান।

জেমস কলকাতার কাগজে আনন্দীকে সাহায্যের আবেদন ছাপিয়েছিলেন, কিন্তু দাতাদের মধ্যে কোনও ভারতীয়ের নাম পাইনি। কলকাতার শিক্ষিত সমাজে আনন্দীর খবর কোনও আলোড়ন তোলেনি। গোপালরাও এতদিন পর্যন্ত যেখানেই গেছেন, নিজেদের জাতের অর্থাৎ মারাঠি চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের সাহায্য পেয়েছেন। এবার কিন্তু কলকাতায় তাঁর সমাজও মুখ ফিরিয়ে নিল। তবে আনন্দীকে তা দমাতে পারেনি, কিছু সমস্যার পরে শেষ পর্যন্ত ১৮৮৩ সালের ৭ এপ্রিল আনন্দী কলকাতা থেকে কয়েকজন মিশনারি মহিলার সঙ্গে লন্ডন রওনা হলেন। জাহাজে নিরামিষাশী আনন্দীর খুবই সমস্যা হয়েছিল, খাবারের মধ্যে ছিল দু’তিনটি করে আলু। লন্ডন থেকে জাহাজ পাল্টে আনন্দী নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছিলেন ৪ জুন। সেখানে কার্পেন্টার দম্পতি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ও তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যান। 

মাত্র কয়েক বছর হল এক গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয়েছে। ভারতীয় আমেরিকাতে তখন বিশেষ ছিল না, ব্রাহ্মণ মহিলার তো প্রশ্নই ওঠে না। সহজেই বোঝা যায়, ভারতীয় আনন্দী সেখানে কৌতূহলের বস্তু হয়ে উঠেছিলেন, অনেক কাগজে তাঁকে নিয়ে খবরও বেরিয়েছিল। বিদ্রূপও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। এসব কোনওকিছুই আনন্দীকে বিচলিত করতে পারেনি। যাঁরা তাকে ভালো করে জেনেছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কার্পেন্টাররা সব সময় আনন্দীর পাশে ছিলেন। আমেরিকা থেকে আসা আনন্দীর চিঠিগুলি সেসময় গোপাল খবরের কাগজে প্রকাশ করতেন, আনন্দীর মানসিক অবস্থা ও আমেরিকাতে তাঁর অভিজ্ঞতা বুঝতে সাহায্য করে এইসব চিঠি। 

Anandibai Joshee,, Kei Okami, and Tabat M. Islambooly

আনন্দীকে নেওয়ার ব্যাপারে একাধিক কলেজ উৎসাহী ছিল। তার মধ্যে ছিল এক হোমিওপ্যাথি কলেজ, কিন্তু আনন্দী রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত পেনসিলভেনিয়ার ওমেন’স মেডিক্যাল কলেজ তাঁকে ছ’শ ডলার ছাত্রবৃত্তি দিয়ে তিন বছরের কোর্সে ভর্তি করে। কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের মেয়েরাই বৃত্তি পাওয়ার অধিকারী ছিল, আঠারো বছরের আনন্দীর জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম করা হয়।

আনন্দী কলেজের কাছেই এক ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। তিন বছর পরে এমডি পাস করলেন আনন্দী, ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার। এমডি-তে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘হিন্দুদের মধ্যে প্রসূতিবিদ্যা’, আয়ুর্বেদ ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা দুইয়েরই সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১১ মার্চ ১৮৮৬, এক অনুষ্ঠানে নতুন স্নাতকদের হাতে ডিপ্লোমা তুলে দেওয়া হল, সেই অনুষ্ঠানে গোপালরাও উপস্থিত ছিলেন। পাশ করার পর আনন্দী নিউ ইংল্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসা শুরু করেন। ইতিমধ্যে দেশিয় রাজ্য কোলহাপুর তাঁকে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগের চিঠি পাঠায়। এই কোলহাপুর থেকেই আনন্দীর চিকিৎসক হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এতদিনে বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। 

কিন্তু এই ছিল আনন্দীর জীবনের শীর্ষবিন্দু, এর পরেই তা খাদের দিকে মোড় নিল। গোপালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের আগে থেকেই অবনতি ঘটছিল, চিঠিপত্র থেকে বোঝা যায় প্রাথমিভাবে প্রগতিশীল গোপাল উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার স্ত্রীর সাফল্যকে আর মেনে নিতে পারছেন না। আমেরিকাতে সেখানকার সামাজিক রীতিনীতিতে অনভ্যস্ত গোপালের সমস্ত রোষের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর স্ত্রী। স্বামীর এই পরিবর্তন আনন্দীর মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিমধ্যে আমেরিকার প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতে অনভ্যস্ত আনন্দীকে ধরল যক্ষারোগ। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে যক্ষা প্রায়শই প্রাণঘাতী হত। অসুস্থতার মধ্যেই আনন্দী স্বামীর সঙ্গে দেশে রওনা হন। ১৮৮৬ সালের ১৬ নভেম্বর তাঁরা বম্বে পৌছান। আনন্দীর ডাক্তার হয়ে ফিরে আসার ঘটনা বেশ সাড়া ফেলেছিল, এত বছর আমেরিকাতে থেকেও হিন্দু ধর্ম না ছাড়ার জন্য খবরের কাগজের প্রশংসা পেলেন তিনি। সারা দেশ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে টেলিগ্রাম এল। কিন্তু শরীর ক্রমশই খারাপ হতে থাকল, কোনো চিকিৎসাই কাজ করল না। পুনের আবহাওয়াতে শরীর ভাল হতে পারে ভেবে আনন্দী ও গোপাল সেখানে গেলেন, কিন্তু কোনো উপকার হল না। যে রক্ষণশীল সমাজপতিরা আনন্দীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা এই সময় তাঁর মঙ্গলকামনা করে দেখা করেন, এমনকি যজ্ঞও করেন। চিকিৎসা বা প্রার্থনা, কোনো কিছুতেই কাজ হল না; ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭ আনন্দীর মৃত্যু হল, উপস্থিত ছিলেন তাঁর মা ও স্বামী। থিওডোসিয়ার অনুরোধে চিতাভস্মের এক অংশ তাঁকে পাঠানো হয়েছিল, কার্পেন্টারদের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে তা রক্ষিত আছে। আনন্দীর মৃত্যুর পরে তাঁর আমেরিকার বান্ধবী ক্যারোলিন ডাল তাঁর এক জীবনী প্রকাশ করেছিলেন। 

এমডি-তে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘হিন্দুদের মধ্যে প্রসূতিবিদ্যা’, আয়ুর্বেদ ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা দুইয়েরই সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১১ মার্চ ১৮৮৬, এক অনুষ্ঠানে নতুন স্নাতকদের হাতে ডিপ্লোমা তুলে দেওয়া হল, সেই অনুষ্ঠানে গোপালরাও উপস্থিত ছিলেন। পাশ করার পর আনন্দী নিউ ইংল্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসা শুরু করেন।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষা, সমুদ্রযাত্রা এবং একা বিদেশবাস – রক্ষণশীল সমাজের কতগুলি বাধানিষেধ ভেঙেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আনন্দী! মেডিক্যাল কলেজে আবেদনের সময় তিনি লিখেছিলেন, “… that determination which has brought me to your country against the combined opposition of my friends & caste ought to go along way towards helping me to carry out the purpose for which I came i.e. is to render to my poor suffering country women the true medical aid they so sadly stand in need of, and which they would rather die for than accept at the hands of a male physician. The voice of humanity is with me and I must not fail.” আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হল না। মৃত্যুর আগে আনন্দীর শেষ কথা ছিল, ‘আমার যথাসাধ্য আমি করেছি।’ সত্যিই আর কীই বা করতে পারতেন আনন্দী! 

তথ্যসূত্র:
Radical Spirits: India’s First Woman Doctor and Her American Champions, Nandini Patwardhan, Story Artisan Press, 2020
The Life of Dr. Anandabai Joshi, Caroline Healey Dall, Roberts Brothers, Boston, 1888
Anandi Gopal, Pooja Thakar, in Lilavati’s Daughters, Ed. Rohini Godbole and Ram Ramswami, Indian Academy of Sciences, 2008

 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia Commons,

Gautam Gangopadhyay Author

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সত্যেন্দ্রনাথের একটি ছোট জীবনী।

Picture of গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সত্যেন্দ্রনাথের একটি ছোট জীবনী।
Picture of গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সত্যেন্দ্রনাথের একটি ছোট জীবনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com