(Aparna Sen)
বাড়ির মেয়ে, মিঠুর দিল্লি থেকে একটা টেলিফোন-কল আসবে। ওপরের ফোনটায় কিছু শোনা যাচ্ছে না। সে নিচে এসে ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে। এখানে তার মা বসে রয়েছেন এবং মায়ের বন্ধু সোমনাথবাবু। ফোন এল। দিল্লি থেকেই। কিন্তু মিঠুকে সে-ফোন চাইছে না। মিঠুর মা, ‘ন্যাশনালি ফেমাস ডান্সার’ সরোজিনী গুপ্তকে চাইছে। সরোজিনী ফোন ধরলেন। চার-পাঁচটা কথা হওয়ার পর তিনি ফোন রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। মিঠু আর সোমনাথবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে সরোজিনীকে এসবের কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি মিঠুকে লাঞ্চে তার প্রিয় চাইনিজ় আনাবেন কি না জানতে চাইলেন। (Aparna Sen)
কিন্তু কেন? সরোজিনী তখন সোজাসুজি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। কয়েক সেকেন্ডে তাঁর চোখের কোল অশ্রুরেখায় ভরে উঠল। তিনি বললেন, ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমি আমায় অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছে এবার। পুণায় মিটিং ছিল, কাল ফাইনালাইজড হয়েছে, সেখান থেকে টেলিগ্রাম করেছে।’ এই হঠাৎ করে চোখে জল নিয়ে আসা খুব বড় অভিনেতা ছাড়া সম্ভব নয়। (Aparna Sen)
কোনও এডিটিং-এর কারসাজি নেই অথচ চোখে এমন জল আনা আমরা ‘আ স্পেশাল ডে’ (১৯৭৭) ছবিতে সোফিয়া লোরেনকে দেখেছি, ‘সিক্রেটস অ্যান্ড লাইজ়’ (১৯৯৬) সিনেমায় ব্লেন্ডা ব্লিদিনকে দেখেছি, ‘হ্যাপি টুগেদার’ (১৯৯৭)-এ দেখেছি টনি লিউংকে, ‘ক্যারল’ (২০১৫) ছবিতে রুনি মারাকে, ‘মিস্টিক রিভার’ (২০০৩)-এ শঁ পেনকে কিংবা ‘সিক্রেট সানশাইন’ (২০০৭) সিনেমায় জোন দো য়োনকে করতে। অবাক লাগে সত্যজিত রায় অপর্ণা সেনের অভিনয়দক্ষতার ঠিক এদিকটা নিয়ে একবার বলেছিলেন যে অপর্ণার চোখে জল আনতে সময় লাগে অথচ কয়েক বছরেই সত্যজিতবাবুর রিনা এ-বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। (Aparna Sen)
জাত অভিনেত্রী বোধহয় একেই বলে! তবে পৃথিবীর বহু অভিনেতার সঙ্গে যা ঘটেনি তা অপর্ণা সেনের সঙ্গে হয়েছে। তাঁর কেরিয়ারের একেকটি ছবি কখনও স্টাইল স্টেটমেন্ট আবার কখনও গুঢ় সামাজিক বক্তব্য তৈরি করেছে। তিনি যখন ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১) করেছেন তখন মৃন্ময়ী বাঙালি মেয়ের অদ্ভুত উদাহরণ হয়েছে- যে খেলাধূলা করে, গাছে চড়ে আবার শুক্তোনিতে যে সর্ষে ফোড়ন দেয়, তাও জানে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০)-তে হরির বান্ধবী হয়ে অপর্ণা দেখিয়েছেন যে পরচুলা পরাই যায় আর বেশি পৌরুষ দেখিয়ে বয়ফ্রেন্ড যদি চুল ধরে টানে তবে কষিয়ে সেই বয়ফ্রেন্ডকে চড়ও মারা যায়। (Aparna Sen)

‘জয়জয়ন্তী’ (১৯৭১)-এ অপর্ণা গভার্নেসের-চাকরি-করা মেয়ে, যার পারিবারিক স্বাচ্ছল্য থাকলেও সে স্বরোজগার করতে পিছপা নয়। একইরকম সুর ‘বসন্ত বিলাপ’ (১৯৭৩) ছবির অনুরাধা সিংহ বা রাধা চরিত্রের মধ্যেও। রাধা চাকরি করে, মেয়েদের মেসে থাকে যেখানে একটা সংগঠন তৈরি করেছে সে। সেই সংগঠন সরস্বতী পুজো করে এবং ছেলেদের বাঁদরামো, বশ্যতা- কিছুই স্বীকার করে না। আধুনিক বাঙালি মেয়ের আদর্শ শুধু যে অপর্ণা ছবি-পরিচালনা বা পত্রিকা-সম্পাদনার পর হয়ে উঠেছেন, তা নয়। কেরিয়ারের প্রথম থেকে তাঁর সিনেমা-নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তা বাঙ্ময় হয়েছে। সব থেকে বড় কথা এমন অভিনেতা ভারতে বিরল যিনি একাধারে এক বিরাট জাতির মেয়েদের আদর্শ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার পরাকাষ্ঠা, পরিচালকের নয়নমণি, ফ্যাশন-আইকন আবার উচ্চশ্রেণীর কুইয়র মানুষদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। (Aparna Sen)
“অপর্ণা সেনের নারী জানে সে পুরুষের থেকে আলাদা। কিন্তু সে এও জানে যে পুরুষের থেকে কোনও অংশে তার কোনও খামতি নেই।”
অপর্ণা সেনের পাণ্ডিত্য নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন। মেয়েদের জন্য যে-পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন সেখানে একেকটি সম্পাদকীয় তাঁর কলমের জোর আমাদের মালুম করিয়েছে। তিনি একসময় কবিতা-আবৃত্তি করতেন। জয়শ্রী দাশগুপ্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর আবৃত্তির ক্যাসেট-সিডি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কলকাতায় ইংরেজি থিয়েটার-চর্চায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। আবার বাঙালি যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ইংরেজি সিনেমা বানিয়ে জাতীয় পুরস্কার আনতে পারে, তারও পথ বাতলেছেন অপর্ণা সেন। (Aparna Sen)
এমনকি তিনি ছাড়া আর কোনও মহিলা-পরিচালক এতগুলো বছরের ইতিহাসে আজ অবধি ফিল্মপরিচালনার জন্য কখনও জাতীয় পুরস্কারই পাননি, তাঁর মতো দু’বার পাওয়া তো দূরের কথা! পূর্ব ভারতের মেয়েদের একটি বিশেষ পরিচয় যেন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা থেকে এক সময় গড়ে উঠেছিল, বিশেষত মধ্যবিত্ত মহিলাদের। সেখানে একটি অন্য ধরনের নারীবাদ চোখে পড়ত। অপর্ণা সেনের নারী জানে সে পুরুষের থেকে আলাদা। কিন্তু সে এও জানে যে পুরুষের থেকে কোনও অংশে তার কোনও খামতি নেই। তার মানে আবার এটা নয় যে সে পুরুষের নকল করবে! সে বরং তার আলাদত্ব দিয়ে পুরুষতন্ত্রের মুখে ঝামা ঘষে দেবে। (Aparna Sen)
আরও পড়ুন: দীপাবলিতে পুতুল শ্রমজীবি মানুষের কথা বলে
অপর্ণা সেনের নারী শাড়ি পরে, ঘর-গেরস্থালি সজ্জিত করে, রান্নায় পারদর্শী, বাচ্চাদের যত্ন নেয়, রূপচর্চা করে আবার সে চাকুরীজীবিও। সে তার বাড়িতে লোক নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। অন্যের পার্টিতে তার হাতে পানীয়ের গ্লাস থাকে কিংবা কখনও ঠোঁটে সিগারেটও ঝুলতে পারে। কিন্তু সে নারী। নারীই। পুরুষের মতো মোটে নয়। অপর্ণা সেন তাঁর জীবন-যাপনেও সেই আদর্শ ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁকে খুব কম আমরা জনসমক্ষে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে দেখেছি। এমনকি তাঁকে বেশিরভাগ সময় দেখেছি শাড়ির সঙ্গে এয়ারহস্টেস-ব্লাউজ় পরতে। (Aparna Sen)

সিমি গারেওয়ালের ‘রদেঁভু’ অনুষ্ঠান হোক বা অন্য কোনও সর্ব ভারতীয় চ্যানেল- সব জায়গাতেই তিনি গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলছেন কিন্তু পরনে শাড়ি। এর অর্থ এই নয় যে অন্য পোশাকে নারীর আধুনিকতা কম। অপর্ণা সেনের আধুনিকতা খানিকটা ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থেকে, উপড়ে ফেলে নয়- এটাই বক্তব্য। এই শাড়ির সঙ্গে অপর্ণা বাঙালি নারীর চিরাচরিত সোনার গয়না বেশিরভাগ সময়ই পরেননি। কম দামি ধাতুর নতুন সব ডিজাইন হয়ে উঠেছিল তাঁর সাজসজ্জার অঙ্গ যা বাঙালি নারীকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমনকি ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিভুবনের সব নারীচরিত্রই নাকি প্রকৃতপক্ষে অপর্ণা সেনের আদলে গড়া। বহু অভিনেত্রী ঋতুপর্ণকে চরিত্রের মেকআপ বিষয়ে ঠাট্টা করে বলতেন, ‘রিনাদি সাজতে হবে তো? জানি’। (Aparna Sen)
সমসাময়িক পরিচালকদের এমন শ্রদ্ধা আদায় করে নেওয়া সহজ কাজ নয় কিন্তু অপর্ণা সেন তা পেরেছেন। অপর্ণা সেন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কথাও (যে-সময় সমগ্র ভারতে এ-বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনাই হত না) তুলে ধরেছিলেন খুব স্পষ্টভাবে। (Aparna Sen)
“তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষ্য বা অবস্থান সকলের পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু তাঁর রাজনীতির যে-চেতনা তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ কখনও ছিল না।”
অভিনীত সিনেমা দিয়ে কেবল নয় অপর্ণা সেন তাঁর পরিচালিত ছবি দিয়েও বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গড্ডলিকা প্রবাহকে বহু সময় অন্য খাতে বইতে বাধ্য করেছেন। ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গী লেন’ (১৯৮১) অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজের কাহিনি। বাঙালি সে-জীবনের সঙ্গে একাত্ব হতে না পারলেও ‘পরমা’ (১৯৮৫) বাঙালি নারীর জীবন ও তার স্বাধীনতার প্রশ্নে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। আজ যে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক কিংবা বিবাহিত মানুষের প্রেম করার অধিকার নিয়ে নানা আলোচনা হয় অপর্ণা সেই আশির দশকে আমাদের সামনে গভীর প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন যে নিজের সবটুকু ভুলে সংসারে উজাড় হয়ে যাওয়া মেয়েটির জীবনে যদি কখনও প্রেম আসে তার সঙ্গে কী আমরা দেহপসার কিংবা চরিত্রহীনতাকে গুলিয়ে দিতে পারি? (Aparna Sen)

কিংবা যদি কোনও মেয়ে মনেপ্রাণে শিল্পী হতে চায় ‘যুগান্ত’ (১৯৯৫)-এর অনসূয়ার মতো তবে কেবল তথাকথিত সংসারের ঘেরাটোপে তাকে বেঁধে তার শিল্পের পথ রুদ্ধ করবার ষড়যন্ত্র কতটা যুক্তিযুক্ত? সংসারে শাশুড়ি-বউয়ের চিরাচরিত মনোমালিন্যের যে সম্পর্ক বাঙালি দেখে এসেছে ‘পারমিতার একদিন’ (২০০০)-এ এসে থমকে যেতে হয় যে এ-সম্পর্কের পরত অনেক সময় আলাদা হতে পারে। শাশুড়ি বউমার স্বাধীনতাকে সমর্থন করতে পারে আর শাশুড়ির পুরনো প্রেম বউমার চোখে এতটুকু অস্বাভাবিক ঠেকে না! ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ (২০০২) থেকে শুরু করে হালের ‘দ্য রেপিস্ট’ (২০২১) অবধি সব ছবিতেই অপর্ণা নারীজীবনের বিভিন্ন জিজ্ঞাসা রেখেছেন। (Aparna Sen)
আরও পড়ুন: বৃহৎ বঙ্গে বাংলা ভাষা শিখেছিল পর্তুগিজরা
কিন্তু সবকিছুর পরেও অস্বীকার করা যায় না অভিনেত্রী অপর্ণা সেনকে। তিনি নিজে অনেক সময় তাঁর পরিচালক-সত্ত্বাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু বাংলা ছবির বিশেষত বানিজ্যিক ছবিকে তিনি অনেকগুলো দশক ঋদ্ধ করেছেন। বিশেষত যে-সময়টা সুচিত্রা সেন আর অভিনয় করছেন না, মহুয়া রায় চৌধুরী মারা গেছেন এবং দেবশ্রী-শতাব্দী-ঋতুপর্ণাদের জায়গা আসতে আসতে দৃঢ় হচ্ছে। তিনি পর পর বছরে ‘একান্ত আপন’ (১৯৮৭), ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ (১৯৮৯)), ‘অনন্যা’ (১৯৯২), ‘শ্বেত পাথরের থালা’ (১৯৯২) ইত্যাদি ছবি দিয়ে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির মঞ্চ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। (Aparna Sen)
এবং কী আশ্চর্য সব কটি ছবিই সমাজের নানা সমস্যা তুলে ধরেছিল বিশেষ করে মেয়েদের। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৪) কিংবা ‘তিতলি’ (২০১৪)-তে অভিনয়ের বহু আগেই তিনি প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী, কখনও নিজেও একটা প্রতিষ্ঠান। ‘খেলব হোলি রং দেব না’ গানের দৃশ্যকল্পই হোক কিংবা ‘ফুটেছে গো একটি গোলাপ যৌবন বাগানে’- অপর্ণা সেনের ‘স্ক্রিন-প্রেজেন্স’-এর জুড়ি মেলা ভার ছিল। নিজের অভিনেত্রী সত্ত্বাকে তেমন গুরুত্ব কখনও দেননি বলেই অপর্ণা সেলিব্রিটি-সুলভ কাচের ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। বহু সময়ই মানুষের প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষ্য বা অবস্থান সকলের পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু তাঁর রাজনীতির যে-চেতনা তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ কখনও ছিল না। ২৫শে অক্টোবর অপর্ণা সেন ৮০ বছরে পা দিলেন। তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি। তাঁর শিল্পসাধনার শতফুল বিকশিত হোক। (Aparna Sen)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ভাস্কর মজুমদার লেখেন মূলত প্রবন্ধ, উত্তরসম্পাদকীয় নিবন্ধ, কলাম ও ছোটগল্প। যৌনসংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক মানুষ, স্কুলশিক্ষা, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, নৃত্য ও সিনেমা তাঁর বেশিরভাগ লেখার বিষয়। অনুবাদকর্মের সঙ্গেও তিনি বহু বছর যুক্ত। সম্প্রতি কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে।
