(Arun Mukhopadhyay)
বহুরূপীর থেকে শুরু করে বাংলা চলচ্চিত্র। সেখানে সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ প্রমুখ প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতাদের ছবিতে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বইই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বই পড়তেন হাতে একটা পেনসিল নিয়ে, বইয়ের পাতার যে অংশটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন বা ভাল লাগত, সেখানে দাগ দিয়ে রাখতেন। (Arun Mukhopadhyay)
আজকে অরুণ মুখোপাধ্যায়কে স্মৃতির আকাশে ধরতে চেয়েছি। পাঠকদের প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে এই অরুণ মুখোপাধ্যায়কে নাট্যপরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায় ভেবে ভুল করবেন না। ইনি নাটক এবং বাংলা ছায়াছবির অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায় মানে রায়মশাইয়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র নায়ক। অরুণদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জী লেনে ওঁর কন্যার বাড়িতে। (Arun Mukhopadhyay)

আরেক অভিনেতা মৃণাল মুখোপাধ্যায়, অরুণদার ফোন নম্বরটা দিয়েছিলেন। যোগাযোগের উদ্দেশ্য ছিল আমার সম্পাদিত ‘অনুভবে তপন সিংহ’ গ্রন্থে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা। উনি তপনদার, ‘হারমোনিয়াম’ এবং ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ ছবি দুটিতে অভিনয় করেছিলেন। দূরাভাষে কথা বলে একদিন গেলাম ওঁর কাছে। তপনদার ছবিতে ওঁর কাজ করার কাহিনি তো শোনালেন কিন্তু সেদিনের পর থেকে অরুণ মুখোপাধ্যায় কীভাবে যে আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেলেন, বুঝতেই পারলাম না! অরুণদা যখনই আমাদের বাড়িতে আসতেন, অনেক গল্প এবং কথার মাঝে ডুবে যেতেন স্মৃতির অতলে! (Arun Mukhopadhyay)

ওঁর কাছে শোনা কিছু গল্পের মধ্যে কয়েকটি ভাগ জানাতে মন চাইছে। একটি গল্প অরুণদার মুখে শুনেছিলাম, তা হল একবার ট্যাক্সি করে শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রর সঙ্গে অরুণদা দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন এভিনিউ ধরে চলেছেন, তখন তৃপ্তি মিত্র হঠাৎ অরুণদাকে বললেন, ‘অরুণ, তুই যখন এই অঞ্চলে বাড়ি করবি, তখন আমরা মাঝে-মধ্যে তোর বাড়িতে বেড়াতে আসব।’ অরুণদা শুধুই হেসেছিলেন। সেই কথা শুনে শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, ‘অরুণ এখানে বাড়ি তৈরি করতে পারবে না।’ অনেকেই জানেন কলকাতার বিশেষ ওই অঞ্চলটি অভিজাত এবং সেখানকার জমির দাম ভীষণ বেশি। (Arun Mukhopadhyay)
“তরুণ মজুমদারের ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ওঁর একটা চরিত্র ছিল, সেটা ডাক্তারের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তনুজা অভিনীত, ‘অপর্ণা’ ছবিতেও অরুণদার অভিনয় ভাল লেগেছিল।”
সত্যজিৎ রায় যখন ওঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য অরুণদাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন উনি বহুরূপী আর নাটকের জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত তবুও অরুণদা এই বিষয়ে শম্ভু মিত্রর মতামত চেয়েছিলেন। সব শুনে শম্ভু মিত্র অরুণদাকে বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের মতো চলচ্চিত্র পরিচালক যখন তোমাকে ওঁর ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেবেন বলে ভেবেছেন, তখন অবশ্যই তোমার কাজটা করা উচিৎ।’ (Arun Mukhopadhyay)

শেষ পর্যন্ত ছবিতে অলোকনন্দা রায়ের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অরুণদা অভিনয় করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে উনি প্রায়ই বহুরূপী প্রযোজিত কিছু নাটক নিয়ে আলোচনা করতেন। মনে আছে বহুরূপী প্রযোজিত রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের সেট নিয়ে প্রশংসা করে অনেক গল্প করতেন। আমাদের পরিবারের প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অরুণদা আসতেন। আমার মামারবাড়িতে আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও গেছেন একাধিকবার। একবার আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে রক্তকরবীর, ‘ভালবাসি ভালবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন বইয়ের আদান-প্রদান চলত। নিজের পছন্দ অনুযায়ী বই পেলে পৃথিবীর আর সব বিষয় ভুলে যেতেন। নাটকের পাশাপাশি বাংলা ছবির জগতের নানা কথাও বলতেন। (Arun Mukhopadhyay)
“সেদিন ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল যে এমন যন্ত্রণার দিন যেন কোনও বাবাকেই জীবনে দেখতে না হয়!”
অরুণদা অভিনীত অনেক বাংলা ছবি রয়েছে কিন্তু সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘার কথাই বলেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব ভাল লাগে কালকুট রচিত এবং বিজয় বসু পরিচালিত ছবি, ‘স্বর্ণ শিখর প্রাঙ্গনে’। তরুণ মজুমদারের ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ওঁর একটা চরিত্র ছিল, সেটা ডাক্তারের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তনুজা অভিনীত, ‘অপর্ণা’ ছবিতেও অরুণদার অভিনয় ভাল লেগেছিল। আমার কন্যাকে ভীষণ স্নেহ করতেন, গিন্নি বলে ডাকতেন। (Arun Mukhopadhyay)
ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একদিন বলেছিলেন, ‘আমরা বকা খেয়ে কাজ শিখেছি, তপনদার ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে একটা ছোট্ট ভুল করার জন্য তপনদা বেশ বকা দিয়েছিলেন কারণ শটটা ছিল ফ্রেমইন-এর। শট শুরু হওয়ার পরে আমি হেটে গিয়ে একটা জায়গায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, তপনদা কাট বলে আমায় বকলেন, পরে বুঝিয়ে বলেছিলেন কেন আমি ওখানে না দাঁড়িয়ে সোজা হেঁটে যাব। আমিও ভেবে দেখলাম যে তপনদা বিষয়টা নিয়ে কী গভীরভাবে ভেবেছেন।’ (Arun Mukhopadhyay)

আর একদিন অরুণদার থেকে, ‘ছায়াসূর্য’ ছবিতে ওঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পরে মানিকদা ছবিটা দেখে বলেছিলেন, ”একি? তুমি কেন এমন একটা চরিত্রে কাজ করতে রাজি হলে, যেখানে তোমার মুখটাই একবারও দেখানো হল না! ক্যামেরা সবসময় তোমার পিঠের দিকে!” আমি বলেছিলাম আমার কিন্তু ওই চরিত্রে কাজটা করতে গিয়ে ভালই লেগেছিল। (Arun Mukhopadhyay)
“একদিন সকালে হঠাৎ অরুণদা ফোন করে জানালেন ছোট কন্যা কোনও অজানা কারণে আত্মহননের পথ বেচে নিয়েছে।”
একবার একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল। শপিং সেন্টার থেকে অলোকনন্দা মাসি একটা ভাল কোম্পানির জুতো কিনে অরুণদাকে উপহার দেন, সেইটা দেখিয়ে একটু গম্ভীরভাব নিয়ে অরুণদা আমাদের সকলকে মজা করে বললেন, ‘দেখ, আমার নায়িকা এত বছর পরে আমাকে জুতো উপহার দিল।’ উপস্থিত সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। প্রতি রবিবারই আমরা বাড়িতে বসে অরুণদার অপেক্ষায় থাকতাম আর উনিও নিরাশ করতেন না। পায়ে হেঁটেই ভবানীপুর থেকে মনোহরপুকুরে চলে আসতেন। (Arun Mukhopadhyay)
অরুণদার একটা অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন সকালে প্রাতঃরাশের আগে অল্প একটু জাফরান খাওযার। জিগ্যেস করলে বলতেন শরীরের প্রয়োজনে উনি এটা খেয়ে থাকেন। অরুণদার ছিল তিন কন্যা, একদিন সকালে হঠাৎ অরুণদা ফোন করে জানালেন ছোট কন্যা কোনও অজানা কারণে আত্মহননের পথ বেচে নিয়েছে। অনেক কষ্টে পুলিশ অরুণদার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছিল যে সোদপুরের কাছে রেললাইনে মেয়ের বিকৃত দেহ পাওয়া গেছে, অরুণদাকে ওঁরা ডেকেছেন দেহ শনাক্ত করতে। (Arun Mukhopadhyay)

সেদিন ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল যে এমন যন্ত্রণার দিন যেন কোনও বাবাকেই জীবনে দেখতে না হয়! আরও কিছু মাস পরে একদিন সকালে আলোকনন্দা মাসি ফোন করে জানাল যে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অরুণদাও চলে গেছেন, নাহ, খবরটা শুনে মন খারাপ হয়নি বরং আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে যে খুব বেশিদিন অরুণদাকে যন্ত্রণাময় নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হল না। (Arun Mukhopadhyay)
মাঝে-মধ্যে পুরোনো ছবির ভেতর থেকে অরুণদার কয়েকটি ছবি বেরিয়ে পড়ে আর অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।