এ এক গুপ্তচরের গল্প। গল্প, কিন্তু আসলে তো গল্প নয়। গুপ্তচরও তো আসলে গুপ্তচর নয়।
গল্পের থেকে অনেক বড় এই গল্প। আর সেই যে গুপ্তচর, নাকি গুপ্তচর হয়েও গুপ্তচর নয়, তাঁর নাম শরৎচন্দ্র দাশ। তাঁর কাহিনির প্রতি মোড়ে লুকিয়ে আছে একাধারে ধর্মজিজ্ঞাসা, রাজনীতি ও ভূপর্যটকের আখ্যান। যতবার প্রদক্ষিণ করব এই ঘটনাবহুল পাকদণ্ডী, ততবারই ঘুরে-ফিরে আসবে একটাই প্রশ্ন— আমরা শরৎচন্দ্র দাশের কথা মনে রাখিনি কেন? তাঁর সেই গল্প, দেশের জন্য অসমসাহসী পদক্ষেপ আমরা ভুলে গেলাম কী করে?
শরৎচন্দ্র দাশের জন্ম ১৮৪৯ সালে। এই সময়বিন্দু মনে করিয়ে দেয়, সময়টা সিপাহী বিদ্রোহেরও কয়েক বছর আগে। মনে করে নিই, বাংলার নবজাগরণের জন্মসময়ও উনবিংশ শতাব্দীর এই সোনার সময়ের আশেপাশে। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত, বাংলা নবজাগরণের সূচনা ১৭৯০-এর দশকে, কিছুটা এই সময়ই মহারাষ্ট্রে শিক্ষার এক ভিন্নধারার শিক্ষা-আন্দোলনের সূচনা করেছেন জ্যোতিবা ফুলে। সমাজ শিক্ষার দ্বিস্তরীয় এই প্রেক্ষাপটের মাঝে কোথায় জায়গা করে নিচ্ছে রাজনীতি? এ কথা জানা আমাদের একান্তই প্রয়োজন, কারণ আমাদের শরৎচন্দ্র দাশ যে বৃহত্তর চিত্রনাট্যের অংশ হয়ে উঠবেন, তার নিয়ন্তা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি।

সকালবেলার সূর্য ও পরবর্তী দিনের সম্পর্কিত প্রবাদকে সত্যি করে, জীবনের শুরু থেকেই উজ্জ্বল ছাত্রজীবন শরৎচন্দ্র দাশের। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ভূগোল ও নির্মাণবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হন ১৮৭৪ সালে। সেই বছরই দার্জিলিং-এ ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। মনে রাখা ভালো, সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেয়নি গোর্খা রেজিমেন্ট, তাই পাহাড়ি এলাকা দার্জিলিং বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ে ইংরেজ শাসকদের বিশ্বস্ত জায়গা হয়ে ওঠে।
এই সময়, ১৮৭৪ সালে, দার্জিলিং-এর ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন শরৎচন্দ্র দাশ। এখানেই তাঁর আলাপ হয় সহ-প্রধানশিক্ষক উগিয়েন গ্যাটসোর সঙ্গে, যিনি রিঞ্চেংপং মনাস্ট্রির ভিক্ষু। গ্যাটসোর সূত্রেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন শরৎচন্দ্র, শুরু করেন গভীর অধ্যয়ন। এই বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন অদূর ভবিষ্যতে যে বিশেষ ভূমিকা নিতে চলেছে, শুরুর সেই দিনগুলিতেই কি তার কোনও দিকনির্দেশ পেয়েছিলে শরৎচন্দ্র?
এই ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলেই আরও একজন ব্যক্তির স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র— তিনি বোর্ডিং স্কুলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক অ্যালফ্রেড ক্রোফট। রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে ক্রোফটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের উচ্চস্তরীয় মহলে। ক্রোফট সাহেবের এই অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছিল শরৎচন্দ্রের জীবনে।

সময়টা ১৮৭৯। সে সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়া একটু খেয়াল করে নেওয়া যাক। সিপাহী বিদ্রোহের ২২ বছর হয়েছে, ভারতবর্ষে রানির শাসন প্রতিষ্ঠিত। সেই সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো—- ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং রাশিয়া চেষ্টা করছে এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ অধিগ্রহণ করার। প্রকৃতপক্ষে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগকে চিহ্নিত করা হয় ঔপনিবেশিকতার প্রতিযোগিতার যুগ হিসেবে।
এই ঔপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তিব্বতের অবস্থান। তিব্বত তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এক অদ্ভূত বিচ্ছিন্নতা উপভোগ করত। সহজে সে দেশে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না, একমাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই পারত সেই কষ্ট সহ্য করতে। কিন্তু চিন এবং রাশিয়া থেকে তিব্বতে পৌঁছানো ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ, তাই রাশিয়ার পক্ষে তিব্বত অধিগ্রহণ করা ছিল ব্রিটিশদের অনুপাতে অনেকটাই সুলভ।
আরও পড়ুন: কালাজ্বরের প্রতিষেধক এসেছিল তাঁর হাতেই
তিব্বতের এই ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ব্রিটিশ শাসনের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল না। রাজনৈতিক দৌত্য পাঠানো সম্ভব নয়। অথচ খুবই প্রয়োজন তিব্বত সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য, ভৌগোলিক রূপরেখ পাওয়া।
এমতাবস্থায় ব্রিটিশ শাসকদের কানে পৌঁছয় শরৎচন্দ্র দাসের কথা। মধ্যস্থতা করেন পৃষ্ঠপোষক ক্রোফট। শরৎচন্দ্র দাশকে প্রস্তাব দেওয়া হয় সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে তিব্বতে যাত্রা করার। অচেনা দুর্গম পথ চেনানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় সহ-প্রধানশিক্ষক গ্যাটসোকে, কারণ অতীতে তিব্বত যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর। আইনি কাগজপত্র সইসাবুদ করে দিতে হয় শরৎচন্দ্রকে, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী হবে না এই মর্মে। তাঁর মাসিক আয় ধার্য হয় ৩০০ টাকা। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্বনামা পর্যন্ত সইসাবুদ করা থাকে। এমন গোপনীয়, এমন গুরুত্বপূর্ণ, এমন ঐতিহাসিক ছিল শরৎচন্দ্রের এই তিব্বতযাত্রা।

১৮৭৯ সালে বরফাবৃত, পার্বত্য পথে যাত্রা করেন শরৎচন্দ্র দাশ। তিব্বতে পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগে যায় বেশ কয়েক মাস। শরৎন্দ্রকে তিব্বতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেন গ্যাটসো, তবে বেশিদিন থাকেন না। শরৎচন্দ্রকে একাই থেকে যেতে হয়। প্রায় ২ বছর দীর্ঘ হয় তাঁর তিব্বত প্রবাস।
শোনা যায় তিব্বত দেখার খুব শখ ছিল শরৎচন্দ্রের। বিধাতাপুরুষ বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। শুধু সুদীর্ঘকাল তিব্বতে থাকাই নয়, সম্পূর্ণ তিব্বতভূমিকেই নখদর্পণে আনতে হয় তাঁকে। অচেনা দুর্গম সেই তিব্বতভূমি। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ, নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করতে হবে।
তৈরি হয় সেই মানচিত্র। ছাত্রাবস্থার ভূগোল ও জ্যামিতির জ্ঞান কাজে লেগে যায়। সেই মানচিত্র কিন্তু তৈরি হয় সম্পূর্ণ গোপনে, যেমন অন্তরালে থেকে যায় শরৎচন্দ্রের পরিচয় দীর্ঘ বসবাসের পরেও।
মানচিত্র, স্থানীয় রাজনীতি ও ইতিহাসের জ্ঞান ও বহু দুর্লভ পুথি সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসেন শরৎচন্দ্র। যেহেতু সম্পূর্ণ গোপনীয় ছিল, তাই রাজউদ্দেশ্যে যাওয়া এই বিপুল সাহসিকতার তিব্বত যাত্রার জন্য কোনও সম্বর্ধনা পান না শরৎচন্দ্র। যদিও পরবর্তীকালে তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব দেওয়া হয় এবং রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটির পক্ষ থেকে স্বর্ণপদক।
১৮৮২ সালে আবারও একইরকম উদ্দেশ্যে চিনে পাঠানো হয় শরৎচন্দ্রকে, একই রকম সফলও হন তিনি।

ঘটনা পরম্পরায়, ১৯০২ সালে ব্রিটিশ সরকার তিব্বত অধিগ্রহণ করে। অনায়াসে, এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ করায়ত্তও করে। যে ভৌগোলিক দুর্ভেদ্যতা বর্ম হয়ে কাজ করেছিল, তা ভেঙে যায়— তার কারণ সহজেই অনুমেয়।
এইভাবে, শরৎচন্দ্র দাশ নায়ক ও প্রতিনায়কের মাঝামাঝি কোথাও থেকে যান, একাধারে উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত হয়ে, প্রণম্য ও সন্দেহভাজন হয়ে।
অমূল্য কিছু বৌদ্ধশাস্ত্রের জ্ঞান আকর রচনা করেন শরৎচন্দ্র। পাঠাগারে, প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সেইসব পুঁথিপত্র। রচনা করেন প্রথম তিব্বতি ভাষার শব্দকোষও।
নিঃসন্দেহে, এক ঐতিহাসিক গাথার সৃষ্টিকর্তা ছিলেন শরৎচন্দ্র। আমরা তাঁকে মনে রাখিনি। তাঁর ঐতিহাসিক অবশিষ্টাংশদের প্রতি আমরা যদি সম্মান দেখানে পারি, পাপস্খালন হবে শরৎচন্দ্রের প্রতি, বাংলার ইতিহাসের প্রতিও।
তাই, এ শুধু এক বাঙালি গুপ্তচরের গল্প নয়। আরও অনেক বড়, সময়ের দিগন্তরেখাকে ছুঁয়ে ফেলা অনেক বড় এক সত্য কাহিনি।
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
One Response
শরৎচন্দ্রের তিব্বত গিয়েছিলেন একাধিকবার। পরিচয় গোপন রেখে কাজ করার জন্য তিনি স্থানীয় অনেকের সাহায্য পান। পরবর্তীকালে পরিচয় প্রকাশ হবার ফলে সেই সাহায্যকারীদের প্রভূত দুর্দশায় পড়তে হয়।