(David Hare)
রাজ্যের আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, এমন একজন ব্যক্তির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যিনি ভিনদেশী এবং পেশায় ব্যবসায়ী হয়েও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, বঙ্গের শিক্ষার উন্নতিতে সর্বস্ব ব্যয় করে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় এই শহরেই দেহ রেখেছিলেন। তিনি ডেভিড হেয়ার। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ দেশীয় সজ্জনেরা ডেভিডের এই কাজে অংশীদার ছিলেন। (David Hare)
১৮১৪ সালে রাজা রামমোহনের সঙ্গে ডেভিডের পরিচয় হয়। ডেভিড হেয়ার ছিলেন একজন ঘড়ি ব্যবসায়ী। তাঁর জন্ম স্কটল্যান্ডে ১৭৭৫ সালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে আনুমানিক ১৮০১ সালে তিনি কলকাতায় পদার্পণ করেছিলেন এদেশে লক্ষ্মীলাভের উদ্দেশ্যে। (David Hare)
আরও পড়ুন: সন্জীদা খাতুন (১৯৩৩-২০২৫): সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে
কলকাতায় এসে ডেভিড বাসা বাঁধলেন ব্যাঙ্কশাল এলাকায় আর লার্কিন্স লেনে খুলে ফেললেন একটি ঘড়ি তৈরি ও মেরামতের দোকান। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ঘড়ি মেরামতকারী এবং ঘড়ি প্রস্তুতকারী হিসেবে তিনি প্রচুর বিত্তের অধিকারী হন। ডেভিড ছিলেন অকৃতদার এবং সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বর্যবিমুখ। তিনি স্থানীয় মানুষদের শোচনীয় অবস্থা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর দেশের মানুষদের থেকে ছিলেন অনেকাংশে আলাদা। যাঁরা এদেশে এসে ভাগ্য ফিরিয়ে প্রচুর বিত্ত নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতেন। ডেভিড মনস্থ করলেন এই দেশে থেকে, তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের উন্নতিতে জীবন উৎসর্গ করবেন। (David Hare)

ঔপনিবেশিক শাসনে নিষ্পেষিত মানুষদের সার্বিক উন্নতির কথা তিনি ভেবেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল কলকাতার মানুষ শিক্ষিত হলে, তাঁদের কর্মসংস্থান হবে। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনই হবে তার পক্ষে এই কাজে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। (David Hare)
ডেভিড হেয়ার ছিলেন এক অন্য প্রকৃতির মানুষ। তিনি ধনী, দরিদ্র সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন। ভাল বাংলা শিখেছিলেন। বাংলাতে কথা বলতেন, দেশি খাবার খেতেন এবং কখনও কখনও তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। (David Hare)
আরও পড়ুন: শ্রদ্ধাভরে শেষকৃত্য করান ‘শ্মশান বন্ধু’ টুম্পা দাস
রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে ডেভিড হেয়ার বন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভার সঙ্গে যুক্ত হন। শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি তাঁর ব্যবসার ক্ষতি করে অর্থ, সময় এবং নিরলস শ্রম দান করতে থাকেন। ১৮১৫ সাল থেকেই ইংরেজি শিক্ষা এবং উন্নততর শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তারে ডেভিড, রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ কলকাতার হিন্দু সমাজের বিশিষ্টদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করেছিলেন। ১৮১৬ সালে এই কাজ ত্বরান্বিত করতে একটি সভা আহ্বান করা হয় এবং এরই ফলশ্রুতিতে ১৮১৭ সালে গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে, ৩০৪ চিৎপুর রোডে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। কথিত আছে অর্থ সংগ্রহের জন্য ডেভিডকে বাড়ি বাড়ি চাঁদার বই নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল। (David Hare)
ব্যবসা করে প্রচুর ভূসম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন ডেভিড। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজের নিজস্ব ভবন তৈরির সময়ে তাঁর ভূসম্পত্তির বেশ কিছু অংশ তিনি হিন্দু কলেজকে দান করেন এবং বাকিটা সংস্কৃত কলেজের কাছে নামমাত্র দামে বিক্রি করেন। সমাজ এবং শিক্ষার উন্নয়নের কাজে ডেভিড এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে ব্যবসার কাজে সময় দিতে পারছিলেন না। ১৮২০ সালে তিনি তাঁর সহকারী ঈ গ্রের কাছে তাঁর সমস্ত ব্যবসা বেচে দিয়ে শিক্ষা এবং জনহিতকর কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিলেন। (David Hare)
কবি, চিন্তাবিদ ও শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিওর সঙ্গেও ডেভিড হেয়ারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল। ডিরোজিওর ‘ইয়ং বেঙ্গল’এর একজন হিতৈষী ছিলেন তিনি। বাংলার সমাজজীবনে হেয়ার কর্তৃক হিন্দু কলেজ স্থাপনের ফলাফল হয়েছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
কবি, চিন্তাবিদ ও শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিওর সঙ্গেও ডেভিড হেয়ারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল। ডিরোজিওর ‘ইয়ং বেঙ্গল’এর একজন হিতৈষী ছিলেন তিনি। বাংলার সমাজজীবনে হেয়ার কর্তৃক হিন্দু কলেজ স্থাপনের ফলাফল হয়েছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বাংলার মুক্তিবুদ্ধি ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এই কলেজকে কেন্দ্র করেই। (David Hare)
১৮১৭ সালে যে কলকাতা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ডেভিড ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা এবং অন্যতম কর্মকর্তা। এই সোসাইটির মাধ্যমে স্কুলপাঠ্য বই ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হত এবং সুলভ মূল্যে তা বিতরণ করা হত। ১৮১৮ সালে ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির উল্টোদিকে আরপুলিতে কলকাতা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত একটি পাঠশালার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ডেভিড নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে নিকটবর্তী একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপনেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে দুটি স্কুলে দুটি বিভাগ খোলা হল-ইংরেজি ও বাংলা। ১৮৩৪ সালে আরপুলি পাঠশালা এবং পটলডাঙা পাঠশালা সংযুক্ত হয়ে নাম হল স্কুল সোসাইটির স্কুল। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে এর পরিচিতি ছিল ‘হেয়ারের স্কুল’ নামে। (David Hare)
স্ত্রীশিক্ষার জন্য রাধাকান্ত দেবের উদ্যোগে যে তরুণ সমিতি গঠিত হয়েছিল, ডেভিড তার কর্মসূচীতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
স্ত্রীশিক্ষার জন্য রাধাকান্ত দেবের উদ্যোগে যে তরুণ সমিতি গঠিত হয়েছিল, ডেভিড তার কর্মসূচীতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সংস্থার উদ্যোগে শ্যামবাজার, জানবাজার এবং এন্টালিতে যে সব মেয়েদের স্কুল খোলা হয়েছিল সেখানে ডেভিড অকাতরে সময় এবং অর্থ ব্যয় করেছিলেন। (David Hare)
হিন্দু কলেজের প্রসঙ্গে গেলে দেখা যায় যে দীর্ঘদিন এক অস্থায়ী জায়গায় কলেজটি চলেছিল। ১৮২৯ সালে ডেভিড হেয়ার এই কলেজের পরিদর্শক নিযুক্ত হন। তিনি তাঁর পটলডাঙার কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে কলেজের নিজস্ব ভবন তৈরির কাজে সেই অর্থ ব্যয় করেন। ভবন তৈরি হলে জনসাধারণের কাছে ওটির নাম হল পটলডাঙা স্কুল ঘর। (David Hare)
প্রতিদিন তিনি স্কুল এবং হিন্দু কলেজ পরিদর্শনে যেতেন এবং প্রায় প্রতিটি ছাত্রের সঙ্গে দেখা করতেন। এই ছাত্রদের জন্য অনুরাগ এবং নিষ্ঠা এতটাই ছিল যে তিনি ছাত্রদের কাছে এক মহান প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৫৫ সাল থেকে হিন্দু কলেজের নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। (David Hare)

সংস্কৃত কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ডেভিডের অবদান কিছু কম নয়। মনুষ্যদেহ ব্যবচ্ছেদের পক্ষেও তিনি প্রচার চালিয়েছিলেন। মধুসূদন গুপ্ত, দেশীয় চিকিৎসা বিদ্যায়তনের এক প্রাক্তন অধ্যাপক, ১৮৩৬ সালের ১০ই জানুয়ারি, যেদিন প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করলেন, সেইদিন থেকে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন হল। ১৮৩৭ সালে ডেভিড ঐ কলেজের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। দু’বছর পরে সেই পদে ইস্তফা দিলে তিনি কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু সেই পদে আসীন ছিলেন। (David Hare)
ডেভিড হেয়ার, শুধু যে শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে কাজ করেছেন তাই নয়, তিনি সমাজের যে স্তরে অবিচার, অত্যাচার লক্ষ্য করেছেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
ডেভিড হেয়ার, শুধু যে শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে কাজ করেছেন তাই নয়, তিনি সমাজের যে স্তরে অবিচার, অত্যাচার লক্ষ্য করেছেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিদেশি শাসক আরোপিত বিভিন্ন অমানবিক এবং নিষ্ঠুর আইনের বিরুদ্ধেও তিনি জনমত গড়ে তুলেছিলেন। (David Hare)
জীবনের শেষদিকে ডেভিডের স্বচ্ছলতার অভাব দেখা গিয়েছিল। যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর সমস্ত সঞ্চয় জমা ছিল, সেটি দেউলিয়া ঘোষিত হলে তিনি কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য ডেভিডকে তাঁর সদ্য নির্মিত ভবন ও যাবতীয় সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়। গৃহহীন, প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় বাধ্য হয়ে ডেভিড হেয়ার বহু দিনের বন্ধু গ্রের সঙ্গে বাস করতে শুরু করেন। এই অবস্থাতেও তাঁর উদার হস্তে দান-বিশেষ করে স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য, অব্যাহত ছিল। এর ফলে তিনি শেষ বয়সে এত দুর্দশায় পড়েন যে ১৮৪০ সালে কোর্টের রিকোয়েস্ট (অনুরোধী আদালত)-এ তাঁর একটি কমিশনারের পদ গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। আমৃত্যু তিনি সেই পদে বহাল ছিলেন। (David Hare)

দূর দেশে ডেভিড হেয়ার স্বেচ্ছায় যেভাবে সাধারণ মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুতেও তিনি যেন সেভাবেই জীবন বিসর্জন দিলেন। কলেরা আক্রান্ত ছাত্রদের সেবা করতে গিয়ে তিনি এই রোগে আক্রান্ত হলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একজন ডাঃপ্রসন্নকুমার মিত্র তাঁকে সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ১৮৪২ সালে ১লা জুন ডেভিড হেয়ারের জীবনের অবসান ঘটে। ডেভিড হেয়ারের প্রয়াণের পরে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, “কুড়ায়ে পথের রোগী সংক্রামকে দিলে তুমি প্রাণ/ তবুও নাস্তিক তুমি-ও অস্থি নেবে না গোরস্থান”। (David Hare)
হেয়ারের মৃত্যু সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লে, বন্ধু গ্রের বাড়ি থেকে গোলদিঘি পর্যন্ত ছাত্র, শিক্ষক সমেত হাজার হাজার জনতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শবানুগমন করেছিলেন।
হেয়ারের মৃত্যু সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লে, বন্ধু গ্রের বাড়ি থেকে গোলদিঘি পর্যন্ত ছাত্র, শিক্ষক সমেত হাজার হাজার জনতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শবানুগমন করেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী একথা তাঁর লেখায় উল্লেখ করে গেছেন। খ্রিস্টান মিশনারিরা ডেভিডকে যেহেতু মনে করত, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, তারা তাঁদের সমাধিস্থলে তাঁকে সমাহিত করতে দিল না। তাঁরই দান করা জায়গা, হেয়ার স্কুল-প্রেসিডেন্সির প্রাঙ্গণেই ডেভিড হেয়ারকে সমাহিত করা হয়। কলকাতাবাসী ডেভিডের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মারক ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ করেছিল ১৮৪৭ সালে। (David Hare)
Hare “having acquired an ample competence cheerfully relinquished the prospect of returning to enjoy it in his native land in order to promote the welfare of that of his adoption.” (David Hare)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
তথ্যসূত্র: ‘আমি আপনি কলকাতা’- শিবপ্রসাদ সমাদ্দার
উইকিপিডিয়া: বাংলাপিডিয়া।
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।