(Depression)
(Depression) নতুন বছর পড়তে না পড়তেই আরও একটি মৃত্যুসংবাদ! বস্তুত, আত্মহত্যার খবর। বছর আটচল্লিশের এক সঙ্গীত শিল্পী, যিনি একদা জনপ্রিয় এক বাংলা ব্যান্ডের বেস-গিটারিস্ট ছিলেন, বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। বেশ কয়েক বছর আগে জনপ্রিয় ব্যান্ডটি থেকে তিনি বিযুক্ত করেছিলেন নিজেকে। যোগ দিয়েছিলেন অন্য দুটি স্বল্পখ্যাত ব্যান্ডের সঙ্গে। তাঁর নিকট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। ডিসেম্বর মাসেও নাকি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন সেই শিল্পী। প্রাথমিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের অভিঘাত সামলে নিলেও, শিল্পীজীবনের অপ্রাপ্তির বোধ তাঁকে গ্রাস করছিল ক্রমশ। (Depression)
আরও পড়ুন: আজ আবার বেঁচে থাকবার হল সাধ…
প্রশ্ন জাগে, একজন শিল্পীর কেন নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়ার এই অভিপ্রায়? কেন শিল্প মানুষকে জীবনের পথে নিয়ে যেতে যেতে বিপরীত অভিমুখে ঠেলে দেয়? সারা পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্পীদের আত্মহত্যা প্রবণতা অত্যন্ত পরিচিত ঘটনা। তবে কি কোথাও শিল্পের সঙ্গে বিষাদের কোনও কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত যোগ রয়েছে? আমেরিকায় প্রকাশিত মনোবিজ্ঞান বিষয়ক একটি প্রবন্ধে (সায়েন্টিফিক আমেরিকান) প্রকাশিত হয়, সৃজনশীল মানুষদের মধ্যে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের প্রবণতা, সাধারণ মানুষের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি, এবং ডিপ্রেশনের প্রবণতা ১০ শতাংশ বেশি। সেখানে এও বলা হচ্ছে যে, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ মেজর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। দার্শনিক প্লেটো পাগলামি (madness) ও সৃষ্টিশীলতাকে যমজ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই— আধুনিক বিজ্ঞান যে অবসাদকে ‘ডিপ্রেশন’ হিসাবে, ও যে উতরোলকে ‘ম্যানিয়া’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে, সেসব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৃষ্টির অনুপ্রেরণা হিসাবেও কাজ করে। (Depression)
আরও পড়ুন: সুভাষের কবিতায় নারীবাদ
(Depression) ২৮ মার্চ ১৯৪১, ভার্জিনিয়া উল্ফ পকেটে বড় বড় পাথর নিয়ে হেঁটে চলে গেলেন বাড়ির পিছনের নদীতে। আর ফিরলেন না। তাঁর দেহ উদ্ধার করা হল ১৮ এপ্রিল। নদীতে ডুবে যাওয়ার আগে তিনি একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছিলেন তাঁর দাম্পত্যসঙ্গী লিওনার্ড উল্ফের উদ্দেশে। তাঁর প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল,
“Dearest,
I feel certain that I am going mad again. I feel we can’t go through another of those terrible times. And I shan’t recover this time. I begin to hear voices, and I can’t concentrate. So I am doing what seems the best thing to do…” (Depression)
ভার্জিনিয়ার একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা ও জীবনের বিভিন্ন সময়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা, বহুবিধ ওষুধ খেয়ে চলা, তাঁর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবসাদকে নির্দিষ্ট করে।
ভার্জিনিয়ার একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা ও জীবনের বিভিন্ন সময়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা, বহুবিধ ওষুধ খেয়ে চলা, তাঁর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবসাদকে নির্দিষ্ট করে। এসবের মধ্যেও তিনি লিখে গেছেন একের পর এক কালজয়ী গ্রন্থ। এমনকি আত্মহত্যার আগেই তিনি শেষ করেছিলেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘Between the Acts’ -এর পাণ্ডুলিপি। ১৯৪১-এ তাঁর অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার পিছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল সময়ও একটা অন্যতম কারণ ছিল বলে মনে করা হয়। (Depression)
সমাজের কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ধরা যাক একটি নৃশংস গণধর্ষণ ও হত্যা, কিংবা অতর্কিতে এসে পড়া অতিমারীর মতো ঘটনা অন্যান্য মানুষজনের মস্তিষ্কে যেভাবে রেখাপাত করে, একজন শিল্পী বা সাহিত্যিকের মস্তিষ্কে ঠিক সেভাবে করে না৷ কখনও তার প্রাবল্য হয় অন্যান্যদের তুলনায় বহুগুণ বেশি, কখনও তা ভিন্ন দৃষ্টিকোণে ধরা দেয়। যা যেরকম আছে, হুবহু সেরকমভাবেই দেখতে পাওয়া একজন সৃষ্টিশীল মানুষের স্বভাবোচিত নয়। মেঘকে সে সর্বদা বৃষ্টির কারণ হিসাবেই দ্যাখে না। ইউনিকর্নের বসতবাড়িও ভাবতে পারে। এই অ্যাবস্ট্রাকশন একাধারে যেমন তাকে সৃষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তেমনই মানসিক অস্থিরতাগুলোকেও অসুস্থতায় রূপান্তরিত করে বহুক্ষেত্রে। উনষাট বছর বয়সী ভার্জিনিয়ার অবসাদের ক্ষেত্রে স্বভাবতই বিশ্বযুদ্ধ একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আত্মহত্যার তিন-চার সপ্তাহ আগে তিনি আবার ডুবে যান গভীর অবসাদে, এবার যা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। (Depression)
আরও পড়ুন: শব্দ তুমি চিত্রকল্প বিধি
২৭ জুলাই ১৮৯০ — সাঁইত্রিশ বছর বয়সী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ নিজের বুকে নিজে গুলি করেন। আত্মহত্যার জন্য তিনি বেছে নেন বাড়ির অদূরে একটি গমের ক্ষেত, যেখানে তিনি প্রায়শ ছবি আঁকতে যেতেন। গুলিটি আশ্চর্যজনকভাবে পাঁজরের মধ্যে দিয়ে মেরুদণ্ড অবধি চলে যায়, কিন্তু শরীরের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গগুলির ক্ষতি করে না৷ ফলে কিছুক্ষণ পর ভিনসেন্ট হেঁটে বাড়ির দিকে যেতে পারেন। দু’জন দক্ষ চিকিৎসক তাঁর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেন। সেই মুহূর্তে তিনি প্রাণে বেঁচেও যান। কিন্তু দুদিন পর গুলির ক্ষতের জায়গায় সংক্রমণ দেখা দেয়। ভিনসেন্টের ভাই থিও তাঁকে দেখতে আসেন। ২৯ জুলাই ভিনসেন্টের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার আগে থিওকে তিনি শেষ বাক্যটি বলেছিলেন, “The saddness will last forever.” (Depression)
ভিনসেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষণা হয়েছে। কেউ বাইপোলার ডিজঅর্ডার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কেউ ফ্রন্টাল লোব এপিলেপ্সি।
(Depression) ভিনসেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষণা হয়েছে। কেউ বাইপোলার ডিজঅর্ডার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কেউ ফ্রন্টাল লোব এপিলেপ্সি। তবে ডিপ্রেশন যে ছিলই, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। সেই অবসাদকে বাড়িয়ে তুলছিল অনিয়মিত খাদ্যাভাস, রাতের পর রাত জেগে কাজ করা, এবং মদ্যপান। শিল্পীদের ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্ততাকে, অবসাদ বাড়িয়ে তোলার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। মদ-গাঁজা তো বটেই, ড্রাগ অ্যাবিউজ-ও পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্পীদের মধ্যে বিরল নয়। এসব মাদকদ্রব্য দ্রুত ঘোরের মধ্যে পৌঁছে দেয় বলে বস্তুগত ঘটনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করা যায়। এবং পরিপার্শ্ব থেকে এই বিযুক্তি ছাড়া ছবি আঁকা হোক বা উপন্যাস লেখা, সিনেমা বানানো হোক কিংবা গানে সুর দেওয়া, কোনওটাই সফলভাবে সম্ভব হয় না। এই নেশার দ্রব্যগুলো মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারকে নানাভাবে ব্যাহত করে। ফলে যে ব্যক্তি এমনিতেই অবসাদের মধ্যে দিনযাপন করছে, তার ক্ষেত্রে আত্মহত্যাপ্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। সকলেই যে আত্মহত্যায় সচেষ্ট হন এমন নয়। কিন্তু কল্পনা করেন, নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ভাবনায় বিষাদজনিত তৃপ্তি অনুভব করেন। মনস্তত্ত্ব এর নাম দেয় ‘সুইসাইডাল আইডিয়েশন’। (Depression)
আরও পড়ুন: হেলাল-তর্পণ: জনপ্রিয়তা, জিজ্ঞাসা ও সংশয়
৮ এপ্রিল ১৯৯৪, বিখ্যাত আমেরিকান ব্যান্ড ‘নির্ভানা’-র সাতাশ বছর বয়সী লিড ভোকালিস্ট কার্ট কোবেনের দেহ উদ্ধার হয়। অনুমান করা হয়, ৫ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। কার্ট একটি শটগান দিয়ে নিজেকে গুলি করেন। পাশে রাখা ফুলদানির ওপর থেকে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া যায়। কার্ট চিঠিটি লিখেছিলেন তাঁর বাল্যকালের কল্পনার বন্ধু ‘বোড্ডা’-কে। কার্ট বহুদিন ধরে ড্রাগ অ্যাডিকশন থেকে বেরোনোর জন্য রিহ্যাব সেন্টারে যাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রীয়ের বয়ান অনুযায়ী তিনি এর আগেও বেশ কয়েকবার ঘরের দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কার্ট কোবেনের মৃত্যুকে হত্যা বলে মনে করেন অনেকে, কিন্তু তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি শেষমেশ। (Depression)
এমন বহু সঙ্গীতশিল্পী আছেন, যাঁরা এই আশঙ্কায় ভোগেন যে, আগামীকাল সকালে উঠে যদি দেখি আর গান গাইতে পারছি না!
“I don’t have the passion anymore. Its better to burn out than to fade away”— কার্ট কোবেনের সুইসাইড নোটে লেখা ছিল এই বাক্য। মুছে যাওয়ার থেকে পুড়ে যাওয়া ভালো। প্যাশন বলতে কার্ট সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন সম্ভবত, যা ফুরিয়ে আসছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর সাংগীতিক সত্তা ক্রমশ মুছে যেতে পারে। তার চেয়ে নিজেকে হত্যা করা শ্রেয়। একজন শিল্পী নিজের সৃষ্টিশীলতাকে ফুরিয়ে যেতে দেখতে ভয় পায়। এমন বহু সঙ্গীতশিল্পী আছেন, যাঁরা এই আশঙ্কায় ভোগেন যে, আগামীকাল সকালে উঠে যদি দেখি আর গান গাইতে পারছি না! যে সত্তা তাঁকে পৃথিবীর অন্যান্যদের থেকে আলাদা করেছে, তা ফুরিয়ে যাওয়া মানে জীবন ফুরিয়ে যাওয়া, এমন একটা ধারণা তাঁদের মধ্যে কাজ করে। এও এক অহম্-এর (ego) বহিঃপ্রকাশ। যেমনটা থাকে শিল্পীদের আত্মহত্যায়। থাকে নিজের শরীর ও মনের ওপর কেবলমাত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বোধ। শিল্পী মনে করেন, তাঁর জীবন এতটাই তাঁর নিজের, যে মৃত্যুকেও তিনি নিজে নিয়ন্ত্রণ করবেন। (Depression)
আরও পড়ুন: হাওয়ারা যেভাবে আসে, হাওয়ারা যেভাবে যায়
অবসাদ যেমন অসহায়তার বোধ, আত্মহত্যা তেমনই সেই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তির উপায়। মনোসমীক্ষক কার্ল ইয়ুং লিখেছিলেন, “Art is a kind of innate drive that seizes a human and makes him its instrument.” মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময় আর্ট থেরাপির কথা উল্লেখ করা হয়। যে সাধারণ মানুষটি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে, শিল্প তাকে ভাষা দিতে পারে। কিন্তু যেসব সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্র শিল্প নিজেই একটা আচ্ছন্ন করে দেওয়া ঘোরের মতো, তার ক্ষেত্রে আর্ট আর থেরাপির কাজ করে না। বরং সে-ই শিল্পের দ্বারা পরিচালিত হয়। এমনকি চিকিৎসক কিংবা ওষুধ থেকেও তারা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে৷ তারা বিশ্বাস করে, চিকিৎসা তাদের ভাবনার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। বস্তুত, সিডেটিভ কিংবা ট্রাংকুইলাইজারের মতো ওষুধ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সুস্থ করতে চায়। সেই সুস্থতা আদতে কতখানি সুস্থতা, উত্তরাধুনিক তত্ত্ব তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান ওষুধ নির্ভর চিকিৎসা সত্যিই সৃষ্টিশীল মানুষকে তার প্রকৃত-আমিতে ফিরিয়ে দিতে পারে কী না, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। (Depression)
জন্ম ১৭ জুন ১৯৮৬। জে.বি.রায় স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। মানসিক স্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর। কবিতা, সংগীত ও নাট্যচর্চার সঙ্গে নৈকট্য আশৈশব। জনস্বাস্থ্য, সমাজবিজ্ঞান, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধচর্চা করেন নিয়মিতভাবে৷ তাঁর 'অরুণা শানবাগ নিষ্কৃতিমৃত্যু ও ভারত' (২০১৭) বইটি এদ্যবধি ইউথেনেসিয়া প্রসঙ্গে লেখা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বাংলা বই যা মনোজ্ঞ পাঠকমহলে প্রশংসিত। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর সর্বজনবিদিত 'হম দেখেঙ্গে' (দেখে নেবো আমরাই) কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে অবন্তিকা জাতীয় স্তরেও জায়গা করে নিয়েছেন।