(Kitchen Garden)
সেবার বেড়াতে গিয়েছি ডুয়ার্সের মূর্তি। গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছি। নদী-পাহাড় তো আছেই, সেখানকার মানুষজন দেখতে গ্রামে যেতে হবে। সেখানকার এক বাড়ির আওতায় অল্প কিছু সবজি লাগানো, লঙ্কা, বেগুন আর একী, এ তো বিছুটি গাছ। গাছের আশপাশ বেশ পরিপাটি, যত্ন করে লাগানো। গৃহস্থ বধুর কাছ থেকে জানা গেল, এটা ওরা রান্না করে খায়। কাঞ্চন বলে উঠল, “এও তাহলে জঙ্গল সেদ্ধর মধ্যে থাকত।” (Kitchen Garden)
আরও পড়ুন: গোলাপ- যেভাবেই দেখো
গৃহ বধুর কাছ থেকে জানা গেল বিছুটি রন্ধন প্রণালী। পাতার গায়ের রোঁয়া চুল্কানির কারণ সেটা জানি। তাই পলিথিনের প্যাকেটে হাত গলিয়ে গ্লাভসের মতো করে পাতা ছিঁড়ে উনুনের তাপে পোড়ানো হয়। তারপর ভাপিয়ে নিয়ে বেটে তেল অথবা ঘি মিশিয়ে শুকনো লঙ্কা, সর্ষে, রসুন ফোড়ন আর স্বাদমতো নুন দিয়ে শাক ভেজে নিলেই তৈরি। (Kitchen Garden)
আমরা যখন হিমালয়ে, ট্রেকিং করতে যাই, ভারতে অথবা নেপালে, তখন দুপুরের খাবার খাই রাস্তার পাশের ঝুপরি দোকানে। ডাল, ভাত, সবজি। সবজিটা বেশিরভাগ সময় থাকত শাকের। দোকান লাগোয়া ক্ষেত থেকে তুলে আনা আলু শাক, রাই শাক, এ সব থাকত। বন্ধু মানব, মজা করে বলত জঙ্গল সেদ্ধ। ফিরে এলাম আমাদের রেসর্টে, সেখানেও এক ফালি জমিতে চাষ হয়েছে বাঁধা কপি। (Kitchen Garden)

কাঞ্চনের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু। “আচ্ছা এই যে ইচ্ছা হল, ক্ষেত থেকে তুলে এনে রান্না করছে, এটি বেশ মজার। আমাদের তো তা হবে না, কলকাতায় জায়গা কোথায়!” (Kitchen Garden)
তা কেনো? তুমি চাইলে তোমার ছাদে, বা বারান্দায় অল্প পরিমাণে সবজি চাষ করতেও পার। মজা পাবে। নিজের হাতে করা সবজি, তাও টাটকা…
বাবুদা, তুমি বল কীভাবে ছাদে সবজি চাষ করব।
ও সব পরে হবে, আগে চল, চান করে খেয়ে নিই আগে, পরে…
দুপুরের খাবার পরে বিশ্রামের সময়, কাঞ্চন ছাড়তে চায় না। অগত্যা শুরু করতেই হল, “তোমার ছাদে ভালই রোদ আসে, সবজি চাষ হবে। ওইটা খুবই দরকারি। মাটি তৈরি হবে হাল্কা, তুমি এই অনুপাতে করতে পারো, বেলে দোআঁশলা মাটি ২ ভাগ, কোকোপিট (মাটি হাল্কা করার জন্যে, যাতে ছাদে বেশি ওজন না পড়ে) ১ ভাগ, গোবর সার/ ভার্মি কম্পোস্ট ১ ভাগ। (Kitchen Garden)
“তোমার ছাদে ভালই রোদ আসে, সবজি চাষ হবে। ওইটা খুবই দরকারি।”
প্রতি ১০ লিটার এই মিশ্রণের সাথে মেশাতে হবে নিম খোল ১৫০ গ্রাম, হাড় গুঁড়ো ২০০ গ্রাম, ট্রেসেল ৫ গ্রাম, ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ২ গ্রাম। এই কম্পোস্টটা ভালভাবে মিশিয়ে অল্প জল ছিটিয়ে অন্তত ১৫ দিন রাখতে হবে গাছ লাগাবার আগে।” (Kitchen Garden)
অনেকে যে বলে সুপার ফসফেট, মিউরেট অফ পতাশ, এসব দিতে হয়।

বুঝতে হবে, তুমি সবজি ব্যবসা করছ না, করছ বাড়ির জন্য। কেমিকাল সার দরকার কী? অর্গানিক সবজি খাবে।
কিন্তু সার তো দিতে হবে।
তা তো দিতেই হবে, গাছের বয়স ২০- ২৫ দিন হলে টব প্রতি ৭-১০ দিন অন্তর সরষের খোল পচানো জল হাল্কা করে দিতে হবে। চাল ধোয়া জল, মাছ ধোয়া জলও দেওয়া যায়। সার দেওয়ার আগে ও পরে যথেষ্ট পরিমাণ জল গাছে দেওয়া দরকার। শাক সব্জির খোসা, ফলের খোসা, ফলনের পরে গাছের অবশিষ্টাংশ যদি একটা পাত্রে পচিয়ে রাখা সম্ভব হয়, তবে সেটা মাটির সাথে মেশালে ভাল জৈব সারের কাজ করবে। (Kitchen Garden)
গাছ লাগাব কীভাবে?
এখানে একটা কথা বলা দরকার, কিছু সবজি, যেমন শাক সরাসরি বীজ বপন করে লাগাতে হবে। আর তুমি যেহেতু অল্প কিছু সবজি করবে, তাই বীজ থেকে না করে চারা কেনাই ভাল। মাটিতে রস আছে এমন অবস্থায়, চারা লাগাতে হবে। বীজের ক্ষেত্রে ৪-৫ টা বীজ লাগাতে হবে। চারা ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা হলে একটা সবচেয়ে সতেজ চারা রেখে বাকিগুলো তুলে দেওয়া উচিত। (Kitchen Garden)
আরও পড়ুন: ঘর সাজাতে গাছের যত্ন নেবেন কীভাবে?
আর আমি যদি নিজেই বীজ থেকে চারা করতে চাই। মানে সব ধরনের চারা আমি বাজারে নাও পেতে পারি। তোমার বাড়িতে দেখেছিলাম গোল বীটের মতো গোল গাজর, সেটা কি বাজারে পাব? বা ধরো ব্রুসসেলস স্প্রাউট? (Kitchen Garden)
সেক্ষেত্রে নিজেকেই চারা তৈরি করতে হবে। করলা, উচ্ছে, সিম, ঢ্যাঁড়স, লাউ, বরবটি ইত্যাদির বীজ এক রাত জলে ভিজিয়ে, কাপড়ে জড়িয়ে, জল ঝরিয়ে, খড়ের মধ্যে ২-৩ দিন রাখলেই অঙ্কুরোদ্গম হবে। খড়ের অভাবে তুমি ক্যাসারোলের মধ্যেও রাখতে পারো। (Kitchen Garden)

কী ধরনের পাত্রে গাছ করব?
ব্যবহার করতে পার অর্ধেক করা ড্রাম, ফলের ক্রেট, গ্রো ব্যাগ, মাটির টব। শাকের জন্যে ট্রে টব অথবা ফলের ক্রেট ভালোই। মাটি ভরবার আগে পাত্রের নিচে ১ ইঞ্চি পরিমাণ ইটের টুকরো, খোলামকুচি/ সিন্ডার দিয়ে ফিল্টার লেয়ার করতে হবে যাতে জল না জমে। প্রয়োজনে খোলামকুচি আর কম্পোস্টের মাঝে জাল ব্যাবহার করতে পার। (Kitchen Garden)
জল কতটা দেব?
তুমি অন্যান্য গাছ করছ, তুমি জানই। তবুও বলি, মাটি শুকিয়ে গেলে তবেই জল দিতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা, মানে বিশেষ দেখ-ভাল কি করতে হবে?
আগাছা পরিষ্কার না করলে, সেই সব খাবার খেয়ে নেবে। সুতরাং সেটাও লক্ষ করতে হবে।
সবজি চাষের জন্য রৌদ্রালোকিত জায়গা অতি প্রয়োজন, এটা আগেই বলেছি। গাছ ৪-৫ ইঞ্চি হওয়ার পর মাটি খুঁচিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আগাছা পরিষ্কার না করলে, সেই সব খাবার খেয়ে নেবে। সুতরাং সেটাও লক্ষ করতে হবে। নিয়মিত গাছকে স্প্রে করে চান করালে ভাল হয়। লতানে গাছের ক্ষেত্রে মাচা প্রয়োজন। এটা তৈরি করা যেতে পারে কঞ্চি/ সরু পাইপ (জলের লাইন করতে যেগুলো ব্যবহার করা হয়) দিয়ে/ জাল ব্যবহার করে। (Kitchen Garden)

কী কী ওষুধ লাগবে?
বাড়িতে ব্যাবহারের সব্জির জন্যে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করাই ভাল। প্রয়োজনে নিম তেল/ ট্রাইকোডারমা ভিরিডি, পাতার ওপরে নিচে স্প্রে করা যায়। নীম তেল ১ মিলি, জল ৫০০ মিলি, গুঁড়ো সাবান ১/২ চা চামচ। এই মিশ্রণ স্প্রে করা যেতে পারে। তবে নিয়মিত জল স্প্রে করলে পোকা মাকড় গাছে বাসা বাঁধতে পারে না। (Kitchen Garden)
শুনেছি প্ল্যানওফিক্স স্প্রে করলে ফলন ভাল হয়।
ফসল ধরার পর ৫০০ মিলি জলে প্ল্যানোফিক্স ২ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করলে ফসল ঝরা কমে।
আর কিছু করার আছে?
আছে তো। গাছ লাগানো হয়ে গেল। এবার ফুল আসবে, ফল ধরবে। সময়মতো টপাটপ তুলবে আর রান্না করবে। নির্বিষ টাটকা সবজির স্বাদই আলাদা আর এর মধ্যে যেহেতু তোমার যত্ন ও ভালোবাসার ছোঁয়া আছে, তাই বাড়তি স্বাদ পাবে। আর হ্যাঁ, একটা ঘটনার কথা বলি। আমার খাবার টেবিলে বাহারী টবে লঙ্কা গাছ ছিল, বাহারও হয়েছে, ইন্টিরিয়র ডেকরেশন আর কী। অমরনাথদা এসেছে গলদা চিংড়ির মালাইকারির গন্ধ পেয়ে। ঝাল খাওয়ার ইচ্ছে মনে হতেই, গাছ থেকে লঙ্কা ছিঁড়ে মুখে চালান। এমন টাটকা তাজা লঙ্কা পাবে? (Kitchen Garden)
নির্বিষ টাটকা সবজির স্বাদই আলাদা আর এর মধ্যে যেহেতু তোমার যত্ন ও ভালোবাসার ছোঁয়া আছে, তাই বাড়তি স্বাদ পাবে।
দারুণ তো। এবার কবে কী সবজি লাগাব তার একটা লিস্ট দাও।
ঠিক আছে। আমাকে যে লিস্টটা অরবিন্দদা আর বিশ্বজিত বানিয়ে দিয়েছিল, যেটা আমি মেনে চলি সেটাই তোমাকে দেব। ওদেরকে তুমি চেন, আগে আলাপ হয়েছে। এখন চল বোরলি মাছের খোঁজ করি কালকের জন্য। পাহাড়ী নদীর বোরলি মাছ। আহা। আর বিছুটি পাতার ছেঁচকি খাবে নাকি! (Kitchen Garden)

মাস | ঋতু | সবজির নাম (বীজ ফেলা ও চারা লাগানো) |
বৈশাখ + জৈষ্ঠঃ | গ্রীষ্ম | চাঁপা নটে, বরবটি, উচ্ছে, করলা, ঝিঙ্গে, লাউ, ঢ্যাঁড়স। |
আষাঢ় + শ্রাবণঃ | বর্ষা | |
ভাদ্র + আশ্বিনঃ | শরৎ | পালং, ধনে, ক্যাপসিকাম, মেথি শাক, গাজর |
কার্ত্তিক + অগ্রহায়ণঃ | হেমন্ত | পালং, ফ্রেঞ্চ বিন, কপি (সব ধরনের, ব্রকোলি), টমেটো, ক্যাপসিকাম, পালং, ধনে, মুলো |
পৌষ + মাঘঃ | শীত | |
ফাল্গুন + চৈত্রঃ | বসন্ত | ঢ্যাঁড়স |
সারা বছর চাষ করা যায় | বেগুন, লঙ্কা, পুঁই শাক, কলমি শাক, লাল শাক, শসা, লাউ, কুমরো |
এই লিস্ট নমুনা মাত্র, সুবিধের জন্যে। আগু পিছু মাসেও করা যায়।
ছবি সৌজন্য: লেখক
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।