(Natai Puja)
‘ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে- জীবনেরে জেনেছে সে- কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়- খেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে- খেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন- ঝ’রে পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ণ সোনালি…’
বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন সন্ধ্যা নেমে আসত। আমরা যারা মাঠ ভালবাসতাম, খেলাধূলা ছাড়া আর কিছু বুঝতাম না, তাদের জন্য এই সময়টা ছিল খুব দুঃখের। বাড়ির লোক ঘড়িতে ক’টা বাজে তা দেখত না। অন্ধকার হল মানে ঘরে চলে এসো। ঘরে ফিরে ধূপধুনোর গন্ধ নাকে নিয়ে আমরা হাত-মুখ-পা ধুতাম। বাইরের ঘাসে জড়ানো, ধুলোয় খেলা জামাকাপড় ছাড়তাম। (Natai Puja)
আরও পড়ুন: সারমেয়গণ ও ন্যায়ালয়ের আদেশ
হালকা খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম। অন্য ঘরে হয়তো তখন সাতটার খবর আরম্ভ হত টিভিতে- ‘আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল…’ বলে উঠতেন একজন মহিলাকণ্ঠ। কিন্তু অগ্রহায়ণ মাসের রবিবারগুলো আমাদের মন এতটা খারাপ হত না। এই মাসটার নামের উচ্চারণ এক আর বানান আরেক। মুখে আমরা বলতাম অঘ্রাণ আর লিখতাম অগ্রহায়ণ! এই মাসের চারটে রবিবার আমাদের এ-কারণে পছন্দ ছিল যে সেই সন্ধ্যাবেলাগুলোয় বাড়িতে নাটাইচণ্ডীর পুজো হত। (Natai Puja)
আমার ছোটবেলা কেটেছে মাসি-মেসো আর তাঁদের ছ’টি ছেলেমেয়ের মধ্যে। আমার দাদা-দিদিরা আমাকে খুব ভালবাসত। টালিগঞ্জের যে-কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম সেখানকার লোকেরাও আমাকে স্নেহ করত অনেক। কারণ, সবাই বলত ‘আহা রে! ছেলেটার মা-বাবা নেই!’ কিন্তু মা-বাবা তো আমার ছিল। মা থাকত কোয়ার্টার থেকে দূরে রাজা রামমোহন রায় রোডে। বাবাও সেখানেই থাকত। আমাকে নিয়ে যাওয়া হত ওবাড়ি। বড়দি নিয়ে যেত। (Natai Puja)

সারাটা দিন মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতাম। আসলে মা-বাবা যেখানে থাকত সেই এলাকাটা ছিল অনুন্নত। আমার স্কুলও সেখান থেকে ছিল দূরে। তাই মাসির বাড়ি থাকতাম আমি। একদিন শুনলাম বাবা আর আসবে না। বাবা আমাদের সঙ্গে থাকবে না। মা, আমি আর বাবা- তিনজন তিন দিকে ছিটকে গেলাম। সারাটা জীবন আমাদের আর একসঙ্গে থাকা হয়নি। (Natai Puja)
নাটাইচণ্ডী পুজোর গল্পে ধনপতি সদাগরের বড়পক্ষের ছেলেমেয়ে দু’টির জীবন ছিল অনেকটা আমার মতো। ওদেরও মা ছিল না। আর বাবা বাণিজ্য করতে অনেক দূর গিয়েছিল সপ্তডিঙা নিয়ে। মেজদি নাটাইচণ্ডী পুজোর সময় সেই গল্প বলত আর আমি খুব মন দিয়ে শুনতাম। তবে কিছু ঘটনা ভিন্ন ছিল। ওই ছেলেমেয়ে দু’টিকে ওদের বিমাতা খুব অত্যাচার করত। কিন্তু আমাকে কেউ অযত্ন করত না মাসির বাড়িতে। আর ধনপতি সদাগর যেহেতু জানতেন দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়ে দু’টি স্নেহ পাবে না তাই তিনি ফলওয়ালা, গোয়ালাদের বলে গিয়েছিলেন তারা যেন ফল-পাকুড়, দুধ, বাচ্চা দু’টিকে দেয়। (Natai Puja)
“মনাদের বাগান থেকে কলাপাতা আর কচুপাতা কেটে আনতাম সকালেই। বিকেলের পর থেকে চিতইপিঠে বানানো শুরু হত। কিছু পিঠে করতে হত নোনতা আর কিছু পিঠে মিষ্টি।”
তিনি এসে সব দাম মিটিয়ে দেবেন। আমার বাবা কোনওদিন আমার সঙ্গে আর যোগাযোগই করেননি, তিনি আমাকে কিছু কিনে দেবেন, ভালবাসবেন, খাওয়াতে নিয়ে যাবেন এমন আশা আমি যখন ত্যাগ করেছি তখন আমার বয়স আট কিংবা নয়। (Natai Puja)
নাটাইচণ্ডীর ব্রত এক্কেবারে পূর্ব বঙ্গের সংস্কার। কায়স্থ, নমঃশূদ্র এবং আরও নানা বাঙালি সম্প্রদায়ের ব্রতধর্মী এই সংস্কৃতি দেশভাগের সময় ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল নিশ্চয়ই। নাটাইচণ্ডী মূলত মা ষষ্ঠী। ইনি হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেন। অগ্রহায়ণ মাসের চারটে রোববার বিকেল থেকে নাটাইচণ্ডী পুজোর তোড়জোড় আরম্ভ হত আমাদের বাড়িতে। (Natai Puja)
মনাদের বাগান থেকে কলাপাতা আর কচুপাতা কেটে আনতাম সকালেই। বিকেলের পর থেকে চিতইপিঠে বানানো শুরু হত। কিছু পিঠে করতে হত নোনতা আর কিছু পিঠে মিষ্টি। দু’রকম পিঠেই আমরা নতুন গুড় দিয়ে খেতাম। সঙ্গে কিছু কাটাফল। নাটাইচণ্ডীর কোনও মূর্তি বা আলেখ্য ছিল না। আমাদের ছোট ঠাকুরের তাকে শুধু মাটি দিয়ে একটা ছোট্ট পুকুর তৈরি করা হত। হাতে ফুল নিয়ে আমরা শুনতাম নাটাইচণ্ডীর মাহাত্ম্য। (Natai Puja)
মেজদি শুরু করত একটা সুন্দর মন্ত্র দিয়ে- ‘জয় মা নাটাইচন্ডী/স্মরি মা তোমায়/তোমার পূজার কথা কহি মা হেথায়/তুমি যারে দয়া কর সেই ধন্য হয়/ সরল ভক্তিতে প্রিয় হও মা সদয়/পূজাবিধি জানিনা মা, প্রাণভরা ডাকে/পূজাখেলা খেলিমা তুষিতে তোমাকে।’ (Natai Puja)

ধনপতি সদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়ে দু’টিকে পান্তা ভাত ছাড়া কিচ্ছু তেমন খেতে দিত না। মাঠে গরু চড়াতে পাঠিয়ে দিত ওদের। এদিকে সে লক্ষ্য করত ছেলেমেয়ে দু’টো এত অযত্নে রোগা তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন সুন্দর স্বাস্থ্য তৈরি হচ্ছে তাদের। পেছনের রহস্যটা জানতে নিজের ছেলেমেয়ে দু’টিকে সে প্রথম পক্ষের দু’টির সঙ্গে মাঠে পাঠাল। (Natai Puja)
বেলা হল যখন ফলওয়ালা আর গোয়ালা এসে চারটি বাচ্চাকেই ফল-দুধ-মিষ্টান্ন খাইয়ে দিয়ে গেল। বাচ্চা দু’টি বাড়ি ফিরে সরলতায় সে-কথা জানাল তাদের মা-কে। ধনপতি সদাগরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ফলওয়ালা আর গোয়ালাকে বলে সব বন্ধ করল। (Natai Puja)
“গরু হারানোর কথা বলতে তিনি জানালেন যে-দেবীর পুজো হল উনি হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেন। ছেলেমেয়ে দু’টি গরু ফিরিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা করল।”
এরপর বড়পক্ষের দু’টি ছেলেমেয়ের দুঃখে দিন কাটে। একদিন আরও বিপদ। হঠাৎ তারা দেখে দু’টি গরু হারিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরলে সৎমা খুব বকবে, মারবে ভেবে তারা পাগলের মতো মাঠ ছেড়ে গ্রামে সেই গরু দু’টি খুঁজতে বেরল। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এক গৃহস্থের বাড়ির সামনে এসে তারা দেখল মহিলারা অপূর্ব করে একটি পুজো করছেন। বাড়ির গিন্নি তাদের প্রসাদ দিলেন আর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। (Natai Puja)
গরু হারানোর কথা বলতে তিনি জানালেন যে-দেবীর পুজো হল উনি হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেন। ছেলেমেয়ে দু’টি গরু ফিরিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা করল।
গিন্নি হেসে বললেন তারা যেন বাবার জন্যেও প্রার্থনা করে। তারা তাই-ই করল। (Natai Puja)

বাড়ি ফিরে আসতে মার-বকা খেল ঠিকই কিন্তু পরদিন ভোরে দেখা গেল গরু দু’টি ফিরে এসেছে। তারা পুনরায় মাঠে গরু চড়াতে বেরল। এদিকে ধনপতি সদাগরের সপ্তডিঙা ঘাটে এসে ভিড়ল। সদাগর বাড়িতে খবর পাঠালেন ছোটবউ যেন চার ছেলেমেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, তিনি বাড়ি ফিরে সকলকে দেখতে চান। ছোটবউয়ের মাথায় হাত। তিনি দৌড়লেন মাঠের দিকে বড় পক্ষের ছেলেমেয়েদের আনতে। কিন্তু তাদের পাওয়া গেল না। পাওয়া যাবে কী করে? ওদের বাবা যে আগেই ওদের দেখে ছোটবউকে জব্দ করবে বলে এমন খবর পাঠিয়েছেন।
ছোটবউ পাগলের মতো নানা দিকে ছুটতে ছুটতে একটি পুকুরে পড়ে ডুবে মারা গেল। আর সেই পুকুর দুধে ভরে উঠল। (Natai Puja)
গল্পের ঠিক এই সময় মেজদি ঠাকুরের তাকে বানানো মাটির পুকুরে কাঁচা দুধ ঢেলে দিত। নাটাইচণ্ডী ব্রত শেষ হত তারপর। আমরা প্রসাদ নিয়ে খাটের তলায় ঢুকে যেতাম! হ্যাঁ, তাই করতাম কারণ নাটাইচণ্ডীর প্রসাদ যে খেতে হত অন্ধকারে! সেই অন্ধকারে প্রসাদ মুখে দিয়ে মাসির বাড়ি থাকা ছেলেটা অনেক সময় কেঁদে ফেলত শব্দহীন। সে ভাবত ধনপতি সদাগর তো ফিরে এলো, তার বাবা কেন ফিরল না? তারও কি তবে ছোটমা হল কেউ? বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ছেলেটি বড় হয়ে গেল। বড় হলে মানুষ আর কাঁদে না। বড় হলে মানুষ কষ্ট চেপে রাখতে শিখে যায়। (Natai Puja)
নাটাইচণ্ডী পুজোও ক্রমে বন্ধ হল তাদের বাড়ি। কিন্তু অগ্রহায়ণ মাসের সেই রবিবারগুলো যে মুক্তির স্বাদ এনে আমাদের ছোটবেলাটা ভরিয়ে রাখত সেই স্মৃতি আজও অমলিন। শীত এলে, বিকেলের সঙ্গে সন্ধ্যা নামলে, বাদামি রঙের প্রজাপতি ইতিউতি ঘুরে-বেরালে এখনও মনে হয় এই শঙ্খ বেজে উঠল, মেজদি পুজোয় বসবে নাটাইচণ্ডীর, ধনপতি সদাগরের গল্প শুরু হবে আর আমরা অপেক্ষা করব কচুপাতায় কখন গুড় আর চিতইপিঠে খাব। (Natai Puja)
লেখার শুরুতে ব্যবহৃত কবিতাটি, জীবনানন্দ দাশের ‘অঘ্রাণ’ কবিতার অংশ।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ভাস্কর মজুমদার লেখেন মূলত প্রবন্ধ, উত্তরসম্পাদকীয় নিবন্ধ, কলাম ও ছোটগল্প। যৌনসংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক মানুষ, স্কুলশিক্ষা, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, নৃত্য ও সিনেমা তাঁর বেশিরভাগ লেখার বিষয়। অনুবাদকর্মের সঙ্গেও তিনি বহু বছর যুক্ত। সম্প্রতি কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে।
