Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

রাহুল পুরকায়স্থ: সময়, শূন্যতা ও দেহপাঠাগার

পঙ্কজ চক্রবর্তী

জুলাই ৩০, ২০২৫

Rahul Purakayastha
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Rahul Purakayastha)

২০২০ সাল। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম আয়োজিত তৃতীয় বর্ষের লিটিল ম্যাগাজিন মেলা।

স্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। আমরাও পত্রিকার স্টল নিয়েছি। সেখানে কবিতা পড়তে এলেন রাহুল পুরকায়স্থ। তখন এনআরসি নিয়ে হইচই চলছে। সেই আবহাওয়ায় নিজের কবিতা নয়, একজন তরুণ কবির সদ্য রচিত কবিতা পাঠ করলেন তিনি। আমি সেই প্রথম সামনাসামনি তাঁকে দেখি। সাধারণত কিংবদন্তীদের এড়িয়ে চলি। জনপ্রিয়কে সন্দেহ করি। অগ্রজকে বই উপহার দিতে অস্বস্তি হয়। তবুও সেসব কাটিয়ে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং সদ্য প্রকাশিত একটি গদ্যপুস্তিকা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। কথা বললেন। নেড়েচেড়ে দেখলেন এবং ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেন বইয়ের ভিতরে। ভাবলাম এখানেই হয়তো শেষ,সচরাচর যেমন হয়। (Rahul Purakayastha)

আরও পড়ুনঃ যেভাবে রচিত, ব্যর্থতার এলাহি আয়োজন

কিছুদিন পরই অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ফোনের ওপারে রাহুল পুরকায়স্থ। গলায় একরাশ উচ্ছ্বাস। এরকম লেখাই চাইছিলাম তোমাদের কাছে। প্রধানত গদ্যগ্রন্থটি নিয়েই বললেন। সঙ্গে উদার আহ্বান একদিন চলে এসো আমার বাড়িতে। যাওয়া হয়নি, আমারই আলস্যে। তারপরও একাধিকবার দেখা হয়েছে। ফোনে কথা হয়েছে। দেখলাম মনে রেখেছেন বেশ এবং কথা বলছেন এমন এক আত্মীয়তায় যা কেবল কথার কথা নয়। সত্যিই যেতে বলা। আড্ডায় সকাল সন্ধ্যা জড়িয়ে নেওয়ার আহ্বান। আটের একজন অগ্রজ কবির এই যে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রবণতা, তা উদাসীনতার অনেক মিথ ভেঙে দিল। শেষ কথা হয় যেদিন শ্যামনগর স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ কর আমার থেকে অনন্য রায়ের কবিতা সমগ্র নিলেন। উদ্দেশ্য রাহুলদাকে দিয়ে নির্বাচন করে একটি নির্বাচিত কবিতা প্রকাশ। সেই নিয়ে এবং আমার উপহার পাঠানো দুটি বই নিয়ে আবারও সামান্য কথা। আবারও একদিন এসো। আবারও আমারই পুনশ্চ অলসতা। এর আগেও অনেকবার খবর পেয়েছি তাঁর অসুখের। তারপর আবার দেখেছি শিরদাঁড়া সোজা রেখেই মেলা বা কবিসম্মেলনে হাজির। ভেবেছি এবারও সমস্ত উদ্বেগ মিথ্যে করে ফিরে আসবেন। কিন্তু আসেননি। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
কবি রাহুল পুরকায়স্থ

শোক অনেক বড় ব্যাপার। কিংবদন্তীর জন্য ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ কথাটিও বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমরা যে কষ্ট পেলাম, আমাদের যে হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগল, অজস্র তরুণ কবি যে রীতিমত অসহায় হয়ে পড়লেন, চোখের জল সামলাতে পারলেন না, এই দৃশ্য কতদিন দেখেনি বাংলা কবিতা! রাহুল পুরকায়স্থর মৃত্যু নক্ষত্রপতন নয়। নক্ষত্র পতনের ভিতর একটা দূরত্ব আছে। শ্যাওলা পিচ্ছিল অন্ধকার পথ আছে গত জন্মের, যা অপ্রকাশিত। (Rahul Purakayastha)

কিন্তু রাহুল পুরকায়স্থ যেমন তাঁর কবিতাও তেমন। এমনকি সারাজীবন একটা মফস্বলের কলোনি দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে রাহুলদা ছুলেন ছোট্ট ঘরে বসেই। তা বৈঠকখানা নয় কিন্তু বৈঠকখানা রোডের ফসল জোগায়। রাহুলদার মৃত্যু, আত্মীয় বিয়োগের মতো স্বাভাবি , বন্ধু বিচ্ছেদের মতো অনির্বাণ। তাই পরিবারের একজন বড় দাদা চলে যাওয়ার মতোই রাহুলদার মৃত্যু এক হাহাকার। আমি অন্তত মৃত্যু পরবর্তী তরুণ কবিদের প্রতিক্রিয়ায় কোনও ভণিতা দেখিনি। দেখেছি বুক নিংড়ে কিছু লেখা যা সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত। আর ব্যক্তিগত বলেই তার কোনও উপর চালাকি পর্দা নেই। এই অর্জন খুব কমই অগ্রজের। (Rahul Purakayastha)

অগ্রজকে ভালোবাসায় অনেক হিসেব-নিকেশ আছে, অন্তত বাংলা কবিতায় আছে। তাঁকে সম্পাদক হতে হয়, জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের দালাল হতে হয়। অনেক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে হয় তরুণদের। তবেই না তারা পিছন পিছন ঘুরবেন।

অগ্রজকে ভালোবাসায় অনেক হিসেব-নিকেশ আছে, অন্তত বাংলা কবিতায় আছে। তাঁকে সম্পাদক হতে হয়, জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের দালাল হতে হয়। অনেক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে হয় তরুণদের। তবেই না তারা পিছন পিছন ঘুরবেন। অথচ এই দু’হাজার পঁচিশে দাঁড়িয়ে দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো এক সম্পর্ক। তিনি কিছুই নন জেনেই তাঁকে ভালোবাসা। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট সতর্কতা। যেন তরুণদের পা পিছলে না যায়। এই দুর্মর অর্থহীন মঞ্চের দিনে এটুকু যে সরে গেল তার মূল্য আমাদের চোকাতে হবে। (Rahul Purakayastha)

রাহুল পুরকায়স্থ আশির কবি। আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় সবচেয়ে অস্পষ্ট একটি দশক আশি। কেন এ কথা বলছি তার কারণ আছে। পূর্ববর্তী চারটি দশক যদি লক্ষ্য করি খেয়াল করে দেখব সেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য আন্দোলন কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের অজস্র হৈচৈ আছে। দেশভাগ থেকে দাঙ্গা, খাদ্য আন্দোলন থেকে নকশাল, হাংরি থেকে শ্রুতি, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশ সব থেকেই নানা স্বর উঠে আসছে বিভিন্ন দশকে। তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের স্বেচ্ছাচার, মিথ ও মিথ্যা। আছে তখনও ব্যক্তিগত জীবন অদৃশ্য রাখবার কায়দা। আর তাই কিংবদন্তি তৈরির সহজ কারখানা ছিল সেই দশকগুলি। সত্য মিথ্যা বিচারের প্রয়োজন হয়নি। আশির দশক এসব কিছুই পায়নি। তবে খুব কাছ থেকে দেখেছে পূর্ববর্তী দশকের কবিদের নানা কান্ডকারখানা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন অসুখ এক উদাসীনতা। কথাটিকে কিছুটা ঘুরিয়ে বলতে ইচ্ছে করে উদাসীনতা এক কিংবদন্তী তৈরির অসুখ, ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলা কবিতায়। (Rahul Purakayastha)

আশির কবিতা এসব কিছুকে মান্যতা দেয়নি। আর তাই তাঁদের বড় করে দেখাবার কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাঁরা যতটুকু কেবল ততটুকুই। তার সামান্য বড় বা ছোট নন।

আশির কবিতা এসব কিছুকে মান্যতা দেয়নি। আর তাই তাঁদের বড় করে দেখাবার কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাঁরা যতটুকু কেবল ততটুকুই। তার সামান্য বড় বা ছোট নন। এর পাশাপাশি ছিল নিজের লেখাটাই নিজের শর্তে লিখব এমন এক প্রচারহীন আকাঙ্ক্ষা। তাই প্রয়োজন হয়নি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার গল্পের। প্রয়োজন হয়নি কোনও উচ্চ ঘোষণার। কিন্তু নিজের শর্তে কবিতার লেখায় আজীবন দায়বদ্ধ ছিলেন তাঁরা। প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহ করতেন। কোনও স্লোগান ছাড়াই, কোনও ইস্তেহার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করেছেন। প্রবল বিপ্লবী সেজে প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। আর ঠিক তাই রাহুল পুরকায়স্থর কবিতায় জনপ্রিয় মুগ্ধপন্থার পরিবর্তে আছে অতি চেনা শহরের পরিচিত বিরোধাভাস। যাকে আলাদা করে তিনি কবিতা করে তোলেননি। রাহুল পুরকায়স্থর কবিতা পড়লে একজন পাঠক দেখতে পাবেন প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত তিনি আগাগোড়া কবিতার কাছে সৎ ছিলেন। কিংবদন্তী সঙ্গ করেছেন কিন্তু সেসব ভাঙিয়ে পাতার পর পাতা স্মৃতিচারণ করেননি কোথাও। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
নির্বাচিত কবিতার প্রচ্ছদ

আমরা রাহুলের শক্তি সঙ্গের কথা জানি। আবার এটুকু জানি  এর জন্য কোনও অতিরিক্ত সুবিধা তাঁকে নিতে হয়নি। রাহুলদা কিংবদন্তী কবির জীবনের কাছে গিয়েছিলেন যে জীবন কবিতার সঙ্গে জড়িত, প্রতিষ্ঠার কাছে নয়। কিন্তু নীচু অভিমানের সঙ্গ করেননি। দূরত্ব রচনা করতে ভোলেননি। আমরা একথা মনে রাখব। আশির কবিকে ভালোবাসা যায়, সবচেয়ে বড় কথা উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু আশির কবিকে একবার ভালবাসলে সেই মিথ পরবর্তীতে ভেঙে যায় না। কেন না তা কবিতা দিয়ে গঠিত। কোনও হুল্লোড় দিয়ে নয়। রাহুলদা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলেন কোনও প্ররোচনা ছাড়াই, এই কথাগুলি। প্ররোচনা বলতেই মনে পড়ে রাহুলদার অনেক কবিতায় প্ররোচনা শব্দটি একটা গভীর ধাক্কার সঙ্গে জড়িত। যিনি দশ জনের বেশি পাঠক চান না কিন্তু একজন পাঠাক্রান্ত তো চান, যিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্ররোচনার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। এই প্ররোচনা রাহুলের কবিতার এক প্রাথমিক সন্ত্রাস, তাঁকে চেনার নগ্ন হাতিয়ার। (Rahul Purakayastha)

আসলে রাক্ষসমুখ, ছো-এর মুখোশ জেনে পুরুলিয়া থেকে আমি এনেছি তাহাকে
এখন সন্ধ্যায়, যখন বাতাসে হাঁটে
অন্ধ দেবতারা, এই মুখ স্মিত হাসে
আনন্দতন্ময়, মধুর মিলন শেষে
উঠে আসে ঘরের দেয়ালে
বাঁকানো মোমের আলো যেই তার
চোখে পড়ে, মনে হয় চেনা মুখ
বিষণ্ণ বিদ্রূপে এড়িয়ে গিয়েছি যাকে
সেও আজ প্ররোচনা চায়
            (মুখোশ/ আমার সামাজিক ভূমিকা)

কিংবা

নাস্তিক রক্তের গন্ধ তুমি বোঝো,
তাকে তুমি দাও ভালবাসা,
                               শুঁড়িপথে
কিছুটা এগিয়ে আমি স্পর্শে পাই,
বুনো চাঁদ দোলে,
ঈশ্বর শব্দের মধ্যে টের পাই
             জনপদ, সংলাপ ও আগুন।
আগুনে আহত তুমি,
               তুমি পুরাতনী,
আগুনের ধারে বসে তুমি আমি
                   কথা বুনে চলি,
কথা বুনি সম্পর্কের,
কথা বুনি সন্ত্রাসের,
আমার মায়ের ভাষা আমাকে জড়ায়
কাঠের গৌরাঙ্গ তুমি, আমি প্ররোচনা
                             (চার /সময় ও শূন্যতা)

একেবারে শুরুর দিকেও রাহুল এই প্ররোচনার কথা বলেছিলেন যা লগ্ন হয়ে আছে বৃহত্তর দেশের শিকড়ে, অথচ তা নিতান্তই ব্যক্তিগত উদাসীনতার এক আখ্যান। তাঁকে লিখতে হয় ‘প্রণয় বাসনা জুড়ে শুধু প্ররোচনা/ যেভাবে বলিনি তাকে/ ২৩ জুলাই কবরখানায় ফের/ পাখি ডেকেছিল।’ (Rahul Purakayastha)

রাহুল পুরকায়স্থর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার, প্রিয় স্বরলিপি'(১৯৮৮) যখন প্রকাশিত হয় তখন আমি রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, বন্দে আলি মিঞা থেকে জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়ছি পাঠ্যসূচিতে। আর তাঁকে জানতে পেরোতে হয়েছে আরও ১৫ বছর। তৃতীয় বই ‘শ্বাসাঘাত তাঁতকল পুরনো হরফ’ থেকে রাহুল পুরকায়স্থ বদলে ফেলছেন নিজের স্বর। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে ছন্দের যে তীব্র দোলা, বলবার যে ধরন, কিছুটা উচ্চকিত, আবেগপ্রবণ, তীব্র এবং মোহময় – তা বদলে যাচ্ছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে। এখানে রাহুলের স্বর সংযত, ছন্দের গতি রুদ্ধ এবং শান্ত। অজস্র যতিচিহ্নে সমধর্মী এবং বিপরীতধর্মী শব্দ পারস্পরিক সংঘাতে এক ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে। মনে হয় চুপ করে বসি। আগে যা ছিল প্রাণের আবেগে বলা, এখানে এসে তৈরি হচ্ছে ভাবনার বহু কৌণিক পরিসর। চিন্তার এক ধরনের দর্শন। (Rahul Purakayastha)

খেয়াল রাখি প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবিত ছিলেন। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বছর শক্তি চলে যাচ্ছেন। আমার ধারনা তীব্র ছন্দময় এই আবেগপ্রবণ ঘরানা রাহুলের শক্তিসঙ্গের ফল। অথচ তা অনুকরণকারীর নয়।

খেয়াল রাখি প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবিত ছিলেন। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বছর শক্তি চলে যাচ্ছেন। আমার ধারনা তীব্র ছন্দময় এই আবেগপ্রবণ ঘরানা রাহুলের শক্তিসঙ্গের ফল। অথচ তা অনুকরণকারীর নয়। উত্তরাধিকারও নয়। শুধু এক প্রাথমিক পাঠ। শক্তির জীবনবোধের এক নশ্বর উদযাপন। তারপর রাহুল ফিরে গেলেন নিজের কথা এবং কাহিনিতে। নিজের কলোনির ভেতর টেনে নিলেন গ্রামকে। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের নানাভঙ্গিকে চিহ্নিত করলেন। আদ্যোপান্ত শহর কলকাতার কবিতা লিখেও গ্রাম মফস্বল শহরের এক প্রতিমুহূর্তের যাতায়াত আছে তাঁর কবিতায়। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে কোনও ছদ্মবেশ নেই। একটি একা ধানক্ষেত চেয়েছিলেন রাহুল তাঁর কবিতায়, হয়তো আক্ষেপও ছিল। পাশাপাশি ছিল ট্রাকের আলোর নিচে প্রধান সড়কের ভূমিকাও। তাঁর কবিতার বিষয়, কীভাবে কবিতা লেখেন তিনি তারই এক বিশ্বাসযোগ্য রূপ একটি ছোট কবিতা (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
অন্ধের বর্ণনামতো-এর প্রচ্ছদ

‘যেভাবে তোমাকে চাই, যেভাবে তোমার কথা ভাবি যেভাবে বন্ধুভাষা আমাকেও খায়
যেভাবে পাখির ছায়া অতি সাবধানে
শহর পেরিয়ে একা গ্রামে উড়ে যায়’
                    (কীভাবে কবিতা লিখি /আমার সামাজিক ভূমিকা)

এই লেখাটির ২২ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’ (কবিতা আশ্রম)। সেখানে ভূমিকার বদলে আছে একটি বিভাব কবিতা। এই কবিতার সঙ্গে সেই বিভাব কবিতাটিকে মিলিয়ে পড়লে রাহুলের কবিতার জীবন এবং তাঁর কবিতার জগৎ কীভাবে নির্মিত, পাঠক তার আভাস পাবেন (Rahul Purakayastha)

‘অপঘাতে মরেছে সে,
             তার না-বলা কথার কাছে কান পেতে আছি
কথারা পিচ্ছিল অতি, অথবা জোনাক,
                 মাঠে ঘাটে ঘোরে ফেরে,
                                প্রধান সড়কে
                  ট্রাকের আলোর নীচে শুয়ে থাকে,
যেন পরী, ফিনফিনে ডানা দুটি আগুনে ঝলসানো
শব্দজন্ম দেখো হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে,
                                 তাকে ধরে আনো’

রাহুল পুরকায়স্থর কবিতায় কয়েকটি শব্দ ফিরে ফিরে আসে। আজীবন এসেছে। জল, সংকেত, সন্দেহ থেকে দেহ এসব জুড়ে আছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কলোনির কবিতায়, তাঁর শহরের কবিতায় অজস্র সংকেত তা সম্পর্কের এবং কখনও রাজনৈতিক। এসেছে জল আর অবগাহনের নিবিড় যৌনতা। আর বারবার এসেছে শ্রম এবং অন্নের কথা। রাহুলের বহু কবিতায় অন্নচিন্তা সুতীব্র। কীভাবে তাঁর কবিতায় সংকেত আসে বারবার, কিংবা আসে সুতীব্র যৌনতা, শ্রেণি, শ্রেণিপ্ররোচনা ও শ্বাসাঘাত পাঠক আজীবন পুনঃপাঠে টের পাবেন। এবার কয়েকটি কবিতা। প্রথমে খিদের কথা (Rahul Purakayastha)

‘ঘুমায় ঘুমায় ওরা, জাগরণে যায় বিভাবরী
মধুময় এই নিশি পোহাইলে জ্বলে অঙ্গ, পেট
কেমনে রচিব সখা জলবৎ এই উপবাস
ব্রজগীতি শুনি শুনি প্রাণবায়ু ছুটি বাহিরায়
জাগো জাগো মহাদেশ, জাগো জাগো দোকানির ছেলে’
                                (আলো /৯ই ভাদ্র ৯৫)

আবার,

দারিদ্র্যরেখার নীচে ঝুঁকে দেখি
মানুষের সংসার
আবহাওয়া ভালো নয়
সমস্ত নক্ষত্র আজ পৃথিবীর দিকে
যদি খসে পড়ে! উনুনে, হাঁড়িতে…
পৃথিবীর দিকে ঝুঁকে আছি
আজ হাটবার

                                  (ডানা /৯ই ভাদ্র ৯৫)

এবার আসি সংকেতের দিকে। রাহুলদা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন এই শব্দটি। এবং তাঁর কবিতার অভিপ্রায় বুঝতে তা সবচেয়ে জরুরি। (Rahul Purakayastha)

‘একটি দিনের স্মৃতি এভাবেও লিখে রাখা গেল
লেখা গেল বীতরাগ, আগুন উড়ছে চারপাশে তুমিও কি টের পাও, তুমিও কি বোঝো এই আলো-অপরাহ্ণ
মূলত পতঙ্গপ্রাণ, ফিরে যাচ্ছে শান্ত প্রতিরোধে
তাকে তুমি পথে পথে পোড়াও সংকেতে’
                   (১০ মার্চ /রাহুল পুরকায়স্থর কবিতা)

বা,

‘সতর্কে রেখেছি অগ্নি
পতঙ্গে রেখেছি প্রাণ, দূরে
প্রতিটি সম্পর্ক আজ
সংকেত সহায়
সম্বলহারানো এই
অবরোহণের বাঁকা পথে
কাহিনিরা মৃত, আর
মৃতেরা কাহিনি লিখে যায়’
                                   (প্রত্ন /অবাকজান)

এই রাহুলই ইতিপূর্বে লিখেছিলেন ‘কবিতা সংকেত শুধু, একা বাতাসের।’
একা মানুষের যৌনতা বারবার এসেছে রাহুল পুরকায়স্থর কবিতায়। কখনও জল ও যৌনতা এসেছে সমার্থক হয়ে। কখনও যৌনতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এক তুমি। কখনও তা একান্তই স্মৃতিধার্য নিরালম্ব এক সত্তা। রাহুলের কবিতায় উন্মাদ সঙ্গম চায় সংকেতের জলে। আবার এই যৌনতা কখনও দেহহীন। দেহহারা স্রোতে একটি প্রেমের দিন এভাবেই শেষ হয়ে যায়। তীব্র এক যৌনতার সংবেদনে রাহুলের কবিতা আচ্ছন্ন। শীতের রাতের বিপর্যয়ের মতো বিষণ্ণ এবং সন্দেহপ্রবণ। (Rahul Purakayastha)

আরও পড়ুনঃ দেশভাগ আর কৈশোরক স্মৃতির আখ্যান

‘কালো ঘোড়া লাফ দিল চাঁদের ভিতরে
যন্ত্রণা থেমে গেল, চরকায় সুতো
পেচিয়ে পেচিয়ে গেল অকস্মাৎ ছিঁড়ে
ভোর হল, শেষ ভোর, অবিবাহিতের’
      (প্রহর শেষের আলোয় ১ /শ্বাসাঘাত তাঁতঘর পুরনো হরফ)

বা,

‘অধুনা বিলুপ্তপ্রায়
লোহার ফলায় জাগে ভাষা
কাঁড়-বাঁশ হাতে ওই সূর্যের উদয়
আমারও দুহাত কাটা
মুখে শিঙা, দ্রুত ধাবমান
স্বরূপ নির্ণয়ে কাল বৃথা গেল
               (বৃথা আয়ুক্ষয়)

আরামুখী শিক্ষা শেষ
জ্বলন্ত ধ্বনির শিখা
ফুটে ওঠে, গুরুপত্নীগামী’
               (জলযন্ত্র /আমার সামাজিক ভূমিকা)

সংকেত ছাড়া রাহুলদার কবিতায় আর যা আছে তা হল, একজন তুমি। রাহুলদা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় লিখছেন, ‘এই তোমাকে নিয়েই আমার যাবতীয় বিপত্তি, ইহজীবনের। তোমাকে আর দেখে ওঠা হল না, সম্যক উপলব্ধিও করা গেল কি?… তুমি আমার প্লাবন, আমার ত্রাণশিবিরের রূপকথা।’ (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
সময় ও শূন্যতা-এর প্রচ্ছদ

এই তুমি অনেকভাবেই এসেছে রাহুল পুরকায়স্থর কবিতায়। সাধারণত তুমিকে প্রেমিকা বলে ভেবে নেওয়াই রীতি। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখব এই তুমি অনেকক্ষেত্রেই কবি নিজে। তাঁরই অলটার ইগো। এমনকি একই কবিতায় কয়েকটি তুমি পৃথক ব্যক্তিত্বের, এক কিংবা একক তুমি নয়। এই তুমি কি শেষপর্যন্ত কবিতা কাব্যদেবী? এই তুমি কি কবিতা আক্রান্ত মানুষের নাছোড় অসুখ? কবিতায় সারা জীবন এসেছে সে। ছটফটে দগ্ধ বাসনায়। আবার কখনও কখনও শান্ত প্রশ্রয়। এবং তাকে ভুলেও যেতে হয় কেন না তার যে যথাযথ পরম্পরা আছে তা নয়। এই তুমি আসলে রাহুল দার চোখের এক দূরবীণ। কাছের দূরের সম্পর্ক কিংবা নিসর্গের অজস্র পালাবদল। তাই এই তুমিকে  সম্যক উপলব্ধি করার নিশ্চিত বাধা আছে। অসম্পূর্ণতাও আছে। সাময়িক এক সম্পূর্ণতা দিয়ে মাঝে মাঝে একটি কবিতা রচিত হয় (Rahul Purakayastha)

এই তুমি কি কবিতা আক্রান্ত মানুষের নাছোড় অসুখ? কবিতায় সারা জীবন এসেছে সে। ছটফটে দগ্ধ বাসনায়। আবার কখনও কখনও শান্ত প্রশ্রয়। এবং তাকে ভুলেও যেতে হয় কেন না তার যে যথাযথ পরম্পরা আছে তা নয়।

১.
এখানেই ধুলো ওড়ে, এখানেই আঁধার জমাট
প্রাচীন পুকুর থেকে কার ছায়া উঠে আসে ঘরে
ঈষৎ আনত তুমি, চোখে জল, কেঁপে ওঠা হাত প্রতিটি মুহূর্ত আজ মনে হয় প্রথম-রঙিন
তোমার সহস্র মুখ
কোন মুখে মুখ রাখি বলো
             (বাগানবাড়ি/ একটি জটিল আয়ুরেখা)

২.
হাঁটু মুড়ে বসে আছি তোমার শরীরে
এ-শরীর বিষভাণ্ড, ও-শরীর ছাই
নিজেকে জ্বালাই আর তোমাকে জ্বালাই
অতঃপর অন্ধকার, অন্ধকার শব
নিজেকে প্রশ্ন করে, অরব অরব
কাঁপে নদী, কাঁপে সাঁকো, ঘন বন
তাও কম্পমান
তুমি আমি নিদারুণ, আমি তুমি সমান সমান
মূর্ছা যাই, মূর্ছা যাও, শরীরে শরীর, ঢালি প্রাণ কামনার প্রতি বাঁকে আমি আজও তোমারই সন্তান
                               (৯/ নেশা এক প্রিয় ফল)

সারাজীবন অজস্র স্মরণীয় কবিতা লিখেছেন রাহুল পুরকায়স্থ। প্রায় একটিও দুর্বল কবিতা লেখেননি। পাতার পর পাতা উল্টে একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতায় চোখ সরে না। মুগ্ধ হই। অনিশ্চিত এক মুগ্ধতা। অপ্রত্যাশিত এক সুর।

সারাজীবন অজস্র স্মরণীয় কবিতা লিখেছেন রাহুল পুরকায়স্থ। প্রায় একটিও দুর্বল কবিতা লেখেননি। পাতার পর পাতা উল্টে একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতায় চোখ সরে না। মুগ্ধ হই। অনিশ্চিত এক মুগ্ধতা। অপ্রত্যাশিত এক সুর। অনিবার্য এক মুহূর্ত। মনে হয় এভাবেই তো লিখতে চেয়েছিলাম আমি। আমার কথাগুলি কেবল চুরি হয়ে গেছে। শুধু পড়ার জন্যই, যদি না আপনার বই খোলার সময় হয়, এখানে কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করা হল। কিংবা আগেও যা উদ্ধৃত হয়েছে তা যেন আমার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারও পাঠভ্রমণ সারা হয়ে যায়  রাহুলময়, আরও দেরি হওয়ার আগে। আর মনে রাখতে হবে তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের বিভাব কবিতা এবং শেষ প্রচ্ছদের কবিতার কথা। আমার মনে হয় রাহুল পুরকায়স্থ সবচেয়ে অনিবার্য, সবচেয়ে তীব্র, সংকেতময় এই দুটি অংশে। এখানেই তাঁর কবিতায় প্রবেশের চাবিকাঠি আছে (Rahul Purakayastha)

১.
হিয়া, সন্দেহপ্রবণ
দেখো এই গ্রামগোধূলিকে পরিচিত মনে হয়
যেন সেকালের কথা
অনুতাপহেতু এক কল্পতোরণ
ঝুঁকে আছে
আবছা আলোয়
যাকে গৃহপথ ভাবি, আসলে তা ধূপশৃঙ্খল
                (নিসর্গ /আমার সামাজিক ভূমিকা)

২.
এক
একটি বায়স বসে দিগন্তমিনারে
শান্ত ও স্বাধীন এই সন্ধ্যা
দেহাতীত ধ্বংসেরে করেছে সংযত
একে তুমি ছন্দ বল, আমি বলি ত্রাণতহবিল

দুই
পড়ে ফেলি ভুল মৃত্যু এমন সন্ধ্যার
পুঁজির বিকাশ পড়ি, পড়ি রাষ্ট্র
অপদেবতার
মূলত বায়সবুদ্ধি
নাশকতা বলে ভুল বোঝাই তোমাকে
      (কবিতা পাঠের আসরে/ আমার সামাজিক ভূমিকা)

৩.
লেখা পড়ি, মনে ভাবি সীমানা পেরোই
স্মৃতি আসে, স্মৃতি পরম্পরা
জন্ম, মৃত্যু, যৌনতা ও জরা
কাক ডাকে
মনে হয়, এখনও কিছুটা পথ বাকি
লেখা রাখি, মনে রাখি, মনে মনে ডাকি
                    (নয় /অন্ধের বর্ণনামতো)

৪.
সমূহ স্মৃতির পাশে অন্ধকার, রচিত হয়েছে
কৃশ ও কৃপণ এই চৈত্ররথরূপ প্রহেলিকা
আমি তাকে ভালবাসি, এইমাত্র সম্পর্কদীপিকা স্বেদে ও শোণিতে, দিবা অবসানে, আমাকে চেয়েছে
ভ্রমণরেখার শেষে প্রতারণা, একা বসে আছে
           (একটি গোয়েন্দাজীবন/ আটটি জ্বলন্ত মুদ্রা)

তাই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় নিজের কবিতার পরিবর্তে কণ্ঠে তুলে নেন তরুণ কবির নতুন কবিতা। যেন তা নিজেরই, বাংলা ভাষার সম্পদ। তাই ডাক দেন। কখনও ফোনে। কখনও ছোটখাটো বার্তায়।

আজ তাকে সামগ্রিকভাবে দেখতে দেখতে কত কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে ছোট ছোট সংকেত, এতদিন যা বড় হয়ে দেখা দেয়নি। লক্ষ্য করে দেখছি রাহুলদা ‘বাকিটুকু’ লেখেননি কখনও, সর্বত্রই ‘আরটুকু’। যেন আরও অপেক্ষা। এক প্রবল ধনাত্মক শক্তি। যার নিঃশেষ নেই। নিঃশেষ নেই বলেই তার জয় কিংবা পরাজয় শেষপর্যন্ত তরুণ কবির জেগে থাকায়। তাই তরুণের লেখা পড়ে তিনি মনে মনে সীমানা পেরোন আর বলেন মনে মনে ডাকি। তাই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় নিজের কবিতার পরিবর্তে কণ্ঠে তুলে নেন তরুণ কবির নতুন কবিতা। যেন তা নিজেরই, বাংলা ভাষার সম্পদ। তাই ডাক দেন। কখনও ফোনে। কখনও ছোটখাটো বার্তায়। কখনও দেখা হলে তীব্র উল্লাসে। সর্বত্রই এক সংযোগ। সেই সংযোগ প্রচার সংযোগ নয়। প্রকাশের সংযোগ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাহুলদা দুর্বল কবিতা লিখলেন না। সঙ্গমের জলে সংকেতের জলে সুতীব্র হয়ে রইলেন। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
আমার সামাজিক ভূমিকা-এর প্রচ্ছদ

শেষপর্যন্ত নানামুখী সংকেত ছোট ছোট পরিসরে এক দিগন্তবিলীন ডাক। সারাজীবন ছোট কবিতাই লিখেছেন কিন্তু ছোট কবিতায় যে এত বড় সামাজিক পরিসর ধরা যায় তা তাঁর কবিতা না পড়লে আমরা বিশ্বাস করতাম না। ভাস্কর চক্রবর্তীর পর ছোট কবিতায় এমন সিদ্ধি কার্যত আর কারোর নেই। রাহুলদা কি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে? গুড়ি মেরে ওঁৎ পেতে বসে আছে থাবায় তুলে নেবে বলে? না হলে তার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘লেখাগুলি আমাকেই বলে’ গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, আর সেই কাব্যগ্রন্থের পাতার পর পাতা জুড়ে অনিশ্চিত জীবনের কথা। প্রবল মৃত্যুর কথা। বারবার বারবার এত তীব্র, এত বিশ্বাসযোগ্য। একজন ক্রান্তদর্শী কবি না হলে টের পাওয়া অসম্ভব। এই কাব্যগ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদেও তো অনিশ্চিত পথের কথা। গৃড়হীনতার কথা। আর শেষ লাইনে বলা ‘এভাবেই কবিতা মৃত্যুর দিকে যায়’। এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা পড়ুন আর কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা যদি রাহুলদার জীবনের শেষ প্রকাশিত কবিতা হয়, তবে তা মৃত্যুকে নিয়েই মৃত্যু উত্তীর্ণ জীবনধর্ম (Rahul Purakayastha)

১.
পড়ে আছে পাদটীকাটুকু
বাকি সব হারিয়ে ফেলেছি
ভয়বাতাসের পথে কতদূর এগিয়েছি আমি!
এই দেখ জলের বাগান
অবলুপ্ত পাখি ডাকে, মাছ ধরে, খায়
আমিও গাছের নিচে ছায়াকে রাঙাই
বলি, বর্ণ দাও, স্পর্শ, স্পর্শ দাও, ক্ষীণছন্দে
বেজে ওঠো রিপু, কাছিমগতির নিচে
ধুলোরক্ত, ঘরবাড়ি, কীটদষ্ট আকৃতি আমার
হারিয়ে গিয়েছি আমি, বাতাসের খুব কাছে
উড়ে যায় দেহপাঠাগার

২.
উনুনের কথা ভাবি, আগেও ভেবেছি বহুবার কোথায় হারিয়ে গেল তারা!
ওই যে জলের ঢেউ, ওইখানে ঘর ছিল আমাদের সুখী, আত্মহারা
তারাও তো ডুবে গেল একদিন, জল টেনে নিল গ্রাসে
আমার পায়ের নিচে মাটি কাঁপে
আমরাও ডুবে যাবো কোনো একদিন, এইরূপে অস্তনদীটির বাঁকে বাঁকে

৩.
এটাই শেষের পৃষ্ঠা, খাতাটাও শেষ হয়ে এল নবধারাপাতে যদি ভাসাই তোমাকে
তুমি কি রক্তিম হবে? আরেকটু না-চেনা রুধির! বহিবে কি চোখে, মুখে, বিপন্ন আশ্রয়ে!
এমন আশ্রয় আমি বয়ন করেছি দিনরাত
খাতাটা ফুরিয়ে এল, কোথায় বানাব ঘর,
কোথায় বসাব চাঁদ, কুয়োতলা, পিছল উঠানে
কোন মুদ্রাদোষে তুমি এসে বসিবে আবার!
যায় দিন, যায় নিদ্রা, যায় ক্ষুধা, যায় হাহাকার

২০২০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি, ফোনে কথা হওয়ার দু-তিনদিন পর রাহুলদার ছোট্ট একটি বার্তা ‘আরো গদ্য লেখো।’ তারপর মাঝে মাঝেই কখনও তুই বা তুমি সম্বোধনে কেমন আছিস, ভাল আছো তো, চলে আয়, এটা ছড়িয়ে দে। এমন কত আহবান।

২০২০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি, ফোনে কথা হওয়ার দু-তিনদিন পর রাহুলদার ছোট্ট একটি বার্তা ‘আরো গদ্য লেখো।’ তারপর মাঝে মাঝেই কখনও তুই বা তুমি সম্বোধনে কেমন আছিস, ভাল আছো তো, চলে আয়, এটা ছড়িয়ে দে। এমন কত আহবান। মাঝে মাঝে শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে নানা উদ্যোগের পাঠানো ইশতেহার। ব্যক্তিগত মানুষের সামাজিক কাজে যোগদানের ছোট ছোট আহ্বান আমাদের বিশ্বাস করে। সেসব একমুহূর্তে না হয়ে গেল। মৃত্যু কি কখনও বিচার করতে পারে জীবনের অমীমাংসিত সংলাপের? তবু স্মৃতির সূত্র ধরে কেউ কেউ শোকের উদযাপন করেন। মৃত্যু যে বিপুল শূন্যতা, মৃত্যু যে আমার আত্মা থেকে একটা বড় অংশ কেড়ে নিল, এই শোকের কোনও পরিচর্যা নেই। তাই শূন্য, তাকে মেনে নিয়ে আরও এক শূন্যতার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আমার কোনও কাজ নেই। কেউ কেউ বলেন এত বড় লেখকের কোনও মূল্যায়ন হল না। (Rahul Purakayastha)

Rahul Purakayastha
শেষ কবিতার বই, লেখাগুলি আমাকেই বলে-এর প্রচ্ছদ

নিশ্চয়ই পুরস্কারের কথা বলতে চান তাঁরা। কেউ কেউ বলেন মৃত্যুর পরেই একজন প্রকৃত কবি জীবিত হয়ে ওঠেন। এসব কোনও কিছুতেই আমার আস্থা নেই। আমি জানি একজন কবি জেগে থাকেন পাঠকের মধ্যদুপুরে বা গভীর রাতের ভালোবাসার সন্ত্রাসে। সেইমুহূর্তে তার মনে হয় লেখককে জড়িয়ে ধরি। লেখককে তার বড় প্রয়োজন। সে কথা কোনওদিন জানবেন না কোনও কবি বা প্রকাশক। কেবল বাতাসে ওড়ে সময়হীন এক চলাফেরা। সেটুকুই একজন কবির মূল্যায়ন। তার জন্য পুরস্কার নেই, কোনও লিটল ম্যাগাজিনের স্মরণসংখ্যা নেই। কেবল তিনি  প্রবল বিস্মরণের ভিতর হানা দেন অকারণে। এই অকারণটুকুই সাহিত্যে একমাত্র জরুরি। এটুকুই থাক। (Rahul Purakayastha)

আরও পড়ুনঃ স্মৃতি-বিস্মৃতির অনন্ত বিকেল: কবিতাসংগ্রহ: অঞ্জলি দাশ

কোনও কবি বা লেখক জীবিত বা মৃত অবস্থায় তার কোনও খবর পাবেন না জেনেও তার মৃত্যু নেই। এভাবেই বাতাসে তুলোর মতো ভেসে আছে অবিশ্বাস্য। কোনও এক অবশ্যম্ভাবী, অনিবার্য। রাহুলদার কবিতা আমাদের কাছে সেই অকারণের ফসল। তিনি যে অত্যন্ত বড় কবি, তা টের পাই যখন মনে মনে তাঁরই কোনও লেখাকে নিজের লেখা মনে করে মনে মনে পাঠকের কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া রচনা করি। আমি ভাবতে চেয়েছি এ তো আমারই কবিতা। রাহুলদা যেমন সেদিন একজন তরুণ কবির কবিতাকে নিজের কবিতা ভেবেছিলেন। একজন কবির সবচেয়ে বড় পরিচয়, বড় সামর্থ্যের পরিচয় সেটাই। যেভাবে প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠের গান আমারই গান হয়ে ওঠে স্মৃতিতে। এইসব কবিতাগুলো নিয়েই রাহুলদার নামটিকে মুছে দিয়ে আমার নাম কল্পনায় বসিয়ে আমি অনেকদিন পথ হেঁটেছি। রাহুলদা আপনার মতই আমি, আমরা জানি জীবন অনিশ্চিত, অপ্রত্যাশিত। লোকাল ট্রেনের জানালার পাশের সিটের মতো, বাপুজি কেকের অলৌকিক মোরব্বার মতো। (Rahul Purakayastha)

মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

Author Pankaj Chakraborty

জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা।  গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।

Picture of পঙ্কজ চক্রবর্তী

পঙ্কজ চক্রবর্তী

জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা।  গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।
Picture of পঙ্কজ চক্রবর্তী

পঙ্কজ চক্রবর্তী

জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা।  গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য
শমিতা হালদার

বিহার

রমেশ দাস
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

নির্মাল্য চ্যাটার্জি

উপন্যাস

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com