‘বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি’, বহুদিন আগে করা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই উক্তি আজও কতখানি সঠিক, তাই যেন প্রমাণ হল রণেন আয়ন দত্তের আকস্মিক চলে যাওয়ায়। আমরা, বিদেশি সংস্কৃতির হালহকিকত নিয়ে যতটা চিন্তিত, ঠিক ততটাই উদাসীন স্বজাতির মানুষগুলোকে নিয়ে। তাই মহীরুহ পতনের মতো রণেন আয়ন দত্তের (Ranen Ayan Dutt) মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা গেল কই!
৯৬ বছরের দীর্ঘ, কর্মময় জীবনের অনেকখানি সময় জুড়ে তিনি ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে। ৮০-৯০ এর দশকের বিজ্ঞাপনের ভাষাকে প্রায় নিজের হাতে গড়েপিটে নিয়েছিলেন রণেন আয়ন। বাংলা বিজ্ঞাপনের ভাষাকে করে তুলেছিলেন একাধারে সাবালক ও জনপ্রিয়। বোরোলীন, জবাকুসুম তেল বা শালিমার নারকেল তেল— এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি।
অবশ্য শুধু বিজ্ঞাপন নয়, বিচিত্রকর্মা এই মানুষটির কাজকর্ম প্রসারিত হয়েছিল আরও নানা ক্ষেত্রে। ম্যুরাল, গ্রাফিক্স, বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে সিনেমার পোস্টার— সব ক্ষেত্রেই তাঁর দক্ষতা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হলেও সাধারণ বাঙালির অনেকেই আজও জানেন না এই মানুষটির নাম। (Ranen Ayan Dutt)

রণেন আয়ন দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ২৪ নভেম্বর, অধুনা বাংলাদেশের সিলেটে। খুব অল্প বয়স থেকেই তাঁকে টানত রেখা আর রঙের জগত। তরুণ বয়সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের ছবির ভাষা ও আঙ্গিক প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মনে। সেই সুবাদেই ভর্তি হলেন সরকারি আর্ট কলেজে। ফাইন আর্টসের পরীক্ষায় পাশ করলেন প্রথম বিভাগে একেবারে ডিস্টিংশন নিয়ে। এই সময়েই খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অন্নদা মুন্সির সঙ্গে আলাপ, এবং একরকম তাঁর হাত ধরেই বিজ্ঞাপন জগতে পা রাখেন রণেন আয়ন।
অন্নদা মুন্সির বিজ্ঞাপন সংস্থাতেই প্রথম ইলাস্ট্রেটর হিসাবে যোগ দেন রণেন আয়ন দত্ত। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে) ‘স্টোনঅ্যাকস’ থেকে কলকাতার জে ওয়াল্টার থমসন— একের পর এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আর্ট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন রণেন আয়ন, বসেছেন প্রধান আর্ট ডিরেক্টরের চেয়ারেও।

এদেশের বিজ্ঞাপন জগতে রণেন আয়ন দত্ত নিঃসন্দেহে মহীরুহপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। তাঁর কুড়ি বছরের সুদীর্ঘ কর্মজীবন অসংখ্য মাইলস্টোনে ভরা। পরের প্রজন্মের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘ডিজাইন গুরু’। হ্যাঁ, গুরুই বটে— টাটা স্টিল, টিবোর্ড, ফিলিপস, ‘জিকেডব্লিউ, এয়ার ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেনে তাঁর আঁকা ইলাস্ট্রেশনগুলো আজও তাকিয়ে দেখার মতো, শিক্ষণীয়ও বটে।
এক জায়গায় থেমে থাকার মানুষ ছিলেন না রণেন আয়ন। ফলে ক্যানভাস ছাড়িয়ে খুব দ্রুতই শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরেন। মণ্ডপসজ্জাতেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেসময় আলোচনায় উঠে এসেছে তাঁর হাতে তৈরি একাধিক মণ্ডপ। ১৯৭২ সালে দিল্লিতে এশিয়া-৭২ এর মেলায় তাঁর তৈরি মণ্ডপসজ্জা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। টাটা স্টিল, টি বোর্ড এবং স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার প্যাভিলিয়ন এবং মণ্ডপগুলিও বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে সেসময়।

১৯৭৪ সালে, RAD Associates নামে তাঁর নিজস্ব সংস্থার জন্ম দেন তিনি। এর পাশাপাশি এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কোল ম্যানেজমেন্টের মতো ল্যান্ডমার্কগুলিও সেজে উঠেছিল তাঁর স্থাপত্যভাবনায়। কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের সংগ্রহশালা এবং রামমোহন সংগ্রহশালা গড়ে ওঠার পিছনেও নেপথ্যে ছিলেন রণেন আয়ন দত্ত। ইলাস্ট্রেটর তথা শিল্পনির্দেশকের কাজও করেছেন সুভো ঠাকুরের সুন্দরম্ এবং চতুরঙ্গ পত্রিকাতে।
বাংলা সিনেমার পোস্টারের ভাষাকে বদলে দিয়েছিলেন রণেন আয়ন দত্ত। তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’, অরুন্ধতী দেবীর ‘ছুটি’, অজয় করের ‘হারানো সুর’-এর মতো ছবিতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে তাঁর আঁকা জনপ্রিয় পোস্টারগুলি। এঁকেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মতো অসংখ্য বিখ্যাত বইয়ের প্রচ্ছদ।

প্রকৃত অর্থেই বিচিত্রকর্মা পুরুষ ছিলেন রণেন আয়ন দত্ত। শিল্পক্ষেত্রে বিপুল অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে তাঁকে ডি. লিট প্রদান করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিপুল কর্মময় মানুষটির জীবন ঠিক যেন পলকাটা হিরে, নানা ভূমিকার আলোয় যা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বারবার। তাঁর মৃত্যু যে বাংলার শিল্পজগতের বিরাট ক্ষতি সে কথা মেনে নিতে দ্বিধা নেই।
ছবি সৌজন্য- Wikipedia
বিশেষ ধন্যবাদ- সঞ্জিৎ চৌধুরী।
একের দশকের বাংলা কবিতার পরিচিত নাম। পেশায় সাংবাদিক। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা সহ একাধিক পুরস্কার। আগ্রহ আছে থিয়েটার ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে।