(Refugee Day)
১
“জঙ্গল-জমি যখন আমাদের, শাসন (সরকার) আমাদের দিক।
জঙ্গলকে আমরা বাঁচাব
নদীকে আমরা বাঁচাব
জংলি জন্তুদের আমরা বাঁচাব
গাছ আমরা লাগাব
জঙ্গলের আগুন আমরা নেভাব
জঙ্গল-জমি তো আমাদের। শাসন আমাদের দিক।”

অচানক মার টাইগার রিজার্ভের কোর জোনে বৈরাহা গ্রাম। তিনদিকে জঙ্গল। সামান্য দূরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে মণিহারি নদী। নিরঞ্জন, নিরঞ্জন বয়গা বলছিলেন, বর্ষা এলে অন্তত তিনমাস জঙ্গলে আটকে থাকতে হবে। নদী তখন ফুলে-ফেঁপে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই সময়ে কেউ পোয়াতি হলে বা অসুস্থ হলেও কিছু করার নেই। পশ্চিমে, খানিক দূরে, দেওয়ালের মতো উঁচু পাহাড়। নিরঞ্জনের বাড়ির উঠোনে বেশ ভিড় জমেছে। ধীর লয়ে সন্ধে নামছে আর ইনিয়েবিনিয়ে চলা একটা সুর, তাল বদলাচ্ছে দ্রুত। মাথায় পালক, হাতে-হাত ধরে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে নাচছেন বয়গা যুবতীর দল। আর একসারি মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ মহিলা মাঝে স্থির দাঁড়িয়ে গাইছেন করমা গান। গলায় রুপোর মোটা হাঁসুলি। এসব গয়না তাঁদের দাদুর দাদুরা দিয়েছিল দিদিমার দিদিমাকে। (Refugee Day)
ছবি বদলের ছবি: সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
গানের ভিতর বইতে থাকে প্রজন্মবাহিত অধিকারের কথা। জঙ্গলকে ঘিরে সমর্পণের কথা। মুগ্ধতার কথা। ভালবাসার কথা। এই জঙ্গল তাঁদের সব দিয়েছে। যা চাওয়া যায়, তার চাইতেও বেশি। এবং সেই সব পাওয়ার দেশেও কত না-পাওয়ার ক্ষোভ। করমা আসলে দাবির গান। হকের গান। (Refugee Day)
“কোঁদো-কুটকি, জোয়ার-বাজরা হাম খাব
কাঁন্দা কুশা, হাম খাব
দাদা-পুরখা খাতে আয়ে হ্যায়, হামু খাব
বাবুরা ধান দিল, ধান আমাদের নয়।
আমরা খাব জোয়ার।”
রাত আরেকটু ঘন হলে চারপাশটা যখন নিস্তব্ধ হয়ে পড়বে, নিরঞ্জন তখন ভাঙা হিন্দি আর ছত্তিশগড়হিতে আমাদের শোনাবেন বয়গাদের আত্মা ও আত্মাভিমানের গল্প, নানাবিধ অভিযোগের আখ্যান। বয়গারা ভাত খেতে পছন্দ করেন না, কিন্তু সরকার নাকি জোর করে তাঁদের ধান চাষ করতে বলছে।
রাত আরেকটু ঘন হলে চারপাশটা যখন নিস্তব্ধ হয়ে পড়বে, নিরঞ্জন তখন ভাঙা হিন্দি আর ছত্তিশগড়হিতে আমাদের শোনাবেন বয়গাদের আত্মা ও আত্মাভিমানের গল্প, নানাবিধ অভিযোগের আখ্যান। বয়গারা ভাত খেতে পছন্দ করেন না, কিন্তু সরকার নাকি জোর করে তাঁদের ধান চাষ করতে বলছে। নিরঞ্জন বারো ক্লাস অবধি পড়েছেন। গ্রামে তাঁর মতো পড়াশোনা আর কেউ করেনি। মাঝে লোরমি টাউনে একটা কাজ জুটিয়েছিলেন, কিন্তু পোষায়নি। জঙ্গলে ফিরে এসেছেন। নিরঞ্জন বলছিলেন, শহর বয়গাদের জায়গা নয়। বাঘ যেমন এক জঙ্গল থেকে নিশ্চিন্তে চলে আসে অন্য জঙ্গলে, বয়গারাও এককালে তেমন বাসা বদলাত। এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গল। পাহাড়ের ওপর থেকে নদীর পাড়। তাঁরা জঙ্গলের পশুপতি। বাসা আর গ্রাম বারবার বদলায়, কিন্তু জীবন থেকে জঙ্গল মোছে না। (Refugee Day)

জঙ্গলটাই বয়গাদের সব। সেই কবে এক মায়ের দুই ছেলে হয়েছিল। বড় হয়ে এক ছেলে কাঁধে তুলে নিল লাঙল। নেমে পড়ল সামনের মাঠে। আরেক ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেল জঙ্গলে। তার কাঁধে লাঙল নেই, ছোট্ট একটা কুঠার। সেই কুঠার দিয়ে সে কন্দ খুঁড়ে গেল। জঙ্গল তাকে কত ফল-মূল-পাতা চেনাল। জড়িবুটি চেনাল। মাটি কুপিয়ে চাষ করে খেতে হল না তাকে। জঙ্গলই তাকে খাওয়াল। জঙ্গলের পশুপাখিরা তাকে আপন করে নিল। কেউ কারো ক্ষতি করল না। (Refugee Day)
জানলা আমার মানে না আজ ধর্মের বিভেদ: আত্রেয়ী চক্রবর্তী
লাঙল হাতে মাটিতে নামা ছেলেটি যে বংশের জন্ম দিল, তাঁরা হল গোঁড়। আর, বনে যাওয়া ছেলেটির উত্তরপ্রজন্ম বয়গা। এই গল্প ছোটোনাগপুর মালভূমির জঙ্গলে-জঙ্গলে কতকাল ধরে লাট খাচ্ছে। নিরঞ্জন বলছিলেন, তবে, এই গল্পের নানা বৈচিত্র্য আছে। রকমফের আছে। কোনও বয়গা বিশ্বাস করেন এই গল্প, কেউ বলেন, “আদিতে ছিল জল আর জল। তারপর ডাঙা হল। জঙ্গল হল। ডাঙা থেকে বেরোল এক ব্রাহ্মণ আর একজন নগ্ন বয়গা। ভগবান নগ্ন বয়গাকে বললে, তুমি কোঁদো আর কুঁটকি ছাড়া আর কিছু চাষ করবে না। এক জায়গায় বারবার চাষ করবে না। প্রয়োজন না পড়লে চাষ করবে না। “সেই থেকে বয়গারা লাঙল হাতে চাষ করাকে ঘৃণা করে। কিন্তু লালমুখো সাহেবরা এসে আমাদের পূর্বপুরুষদের চাষে বাধ্য করল। নিজেদের জঙ্গল থেকে তাড়িয়েও দিল। আমাদের নিজের বলতে আর কিছুই নেই। আমরা নিজেদের জঙ্গলেই উদ্বাস্তু।” (Refugee Day)
একটানা এতগুলো কথা বলে নিরঞ্জন একটু দম নেন। আর, ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটা আন্দাজ করার পর ছ্যাঁত করে কানে এসে লাগে আমাদের। আমি আর শৌনক মুখ চাওয়াচাওয়ি করি।
একটানা এতগুলো কথা বলে নিরঞ্জন একটু দম নেন। আর, ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটা আন্দাজ করার পর ছ্যাঁত করে কানে এসে লাগে আমাদের। আমি আর শৌনক মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। সরকারি খাতায় বৈরাহা বনগ্রাম। ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন মোতাবেক জঙ্গলের ওপর হকও স্বীকৃত হয়েছে বন ও বন-সংলগ্ন ভূমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী মানুষদের। তারপরেও নিরঞ্জন নিজেকে ছিন্নমূল মনে করেন! বয়গাদের মনে হয়, তাঁদের সব গেছে! শাসন থুড়ি সরকার তাঁদের থেকে জঙ্গলটাই কেড়ে নিল! অবশ্য, এই মনে হওয়াটা খুব নতুন নয়। (Refugee Day)
ভারতের যে-যে বনাঞ্চলে গেছি, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি, দেখেছি এই হাহাকার কমবেশি সকলের ধ্রুবপদ। জঙ্গলটা চলে যাচ্ছে। জঙ্গলের ওপর অধিকার নেই। নিজের জঙ্গলে, নিজের বদলাতে থাকা বাস্তুতে, নিজের ভূখণ্ডেই চির-ছিন্নমূল হয়ে থাকার ইতিহাস। যে ইতিহাস কোথাও পড়ানো হয় না। সম্ভবত হবেও না। (Refugee Day)

নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এল্যুইন দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন ভারতের নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে। বিশেষ করে বয়গাদের সঙ্গে। তাঁর লেখা ‘দ্য বয়গা’ কিংবা আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রাইবাল ওয়র্ল্ড অফ ভেরিয়ায় এল্যুইন’-এ সেই যাপনের কথা আছে। তাঁর দেখাতে ধরা পড়েছে বয়গাদের রূপকথাসম আত্মজগৎ। ডব্লু বি থমসন কিংবা এইচ সি ই ওয়ার্ডের মতো ব্রিটিশ কর্নেলরা ল্যান্ড রেভেনিউ সেটলমেন্টে বয়গাদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, তাঁরা ততটাই বন্য, যতটা এই অরণ্যভূমি। তাঁরা স্বাধীন, ক্ষিপ্র। চোখের নিমেষে পাহাড় চড়ে, বন বদলায়। শ্বাপদের সঙ্গে মোকাবিলায়, বাঘকে বশ মানাতে তাঁরা সদা-প্রস্তুত অথচ স্বভাবে নরম, বিনয়ী। আর এল্যুইন লিখেছেন, বয়গাদের সাহসের উৎস তাঁদের আদিম কর্তব্যবোধ। (Refugee Day)
তাঁরা জানে, এই দায় জঙ্গলের সৃষ্টিকাল থেকেই তাঁদের ওপরে। গোঁড়দের হয়ে তাঁরা জাদুক্রিয়া করে, চাষের মন্ত্র পড়ে, জড়ি-বুটি দেয়। অত্যন্ত গর্বিত স্বভাবের বয়গারা লাঙল-চাষ পছন্দ করে না। এককালে তাঁরা জুম করত। জঙ্গলের ছোটোখাটো একটা অংশ সাফ করে, পুড়িয়ে দিয়ে ছড়িয়ে দিত ফসলের বীজ। সেই ফসল থেকেই খাওয়া-দাওয়া। তারপর ক্রমে সরে যেত বনের অন্যপ্রান্তে। আগের কাটা অংশে ফের বন জন্ম নিত। এল্যুইন জানাচ্ছেন, মাগুলা ও বালাঘাটে কয়েক শতাব্দী ধরে এভাবেই তাঁরা চাষবাদ করে আসছে। (Refugee Day)
আসল কথা হল, জঙ্গলটা দখল করতে গেলে পরিযায়িতাকে শেকল পরাতে হয়। বয়গাদের তাই শাসন করার প্রয়োজন পড়েছিল। তাঁদের খাদ্যের প্রয়োজনে যৎসামান্য শিকার বন্ধ করে দেওয়া হল। তিরধনুক কেড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হল।
অথচ, ১৮৬৭ থেকে ব্রিটিশ বনদপ্তর তাঁদের বাধ্য করল লাঙল চাষে অভ্যস্ত হতে। কারণ, বন পুড়িয়ে চাষ করলে নাকি বনের ক্ষতি হয়। আসল কথা হল, জঙ্গলটা দখল করতে গেলে পরিযায়িতাকে শেকল পরাতে হয়। বয়গাদের তাই শাসন করার প্রয়োজন পড়েছিল। তাঁদের খাদ্যের প্রয়োজনে যৎসামান্য শিকার বন্ধ করে দেওয়া হল। তিরধনুক কেড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হল। প্রয়োজন বুঝে নানা জায়গায় জঙ্গল থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হল। স্বভূমি থেকে তাড়িয়ে সাহেবরা কখনও কখনও তাঁদের অন্যত্র পুনর্বাসন দিত। মধ্যপ্রদেশের ডিন্দোরি জেলার ‘বয়গা চক’ যেমন। ১৮৯০ সালে সাতটা গ্রাম নিয়ে তৈরি হওয়া বয়গাদের নতুন বাসস্থান। এখন সেখানে সাকুল্যে বাহান্নটা গ্রাম। নামে ‘বয়গা চক’ হলেও সেটা আর নিজভূম হল কই! অন্যের নিয়মে স্থায়ী হয়ে গেঁড়ে বসা তো পরিযায়ী বয়গাদের রক্তে নেই। (Refugee Day)
বদলের বিভিন্ন মাত্রা: রবীন্দ্রনাথ: শুভেন্দু দাশমুন্সী
এ তো পরাধীনতার আপোষ। ভেরিয়ার এল্যুইন লিখছেন, এই উচ্ছেদের এবং বলপূর্বক চাষে বাধ্য করার ফলে তাঁরা হয়ে উঠল নিঃস্বতর, অবসন্ন, ব্যর্থ চাষি। যে অপবিত্র চাষকে তাঁরা ঘৃণা করে এসেছে, সেই চাষে বাধ্য হয়ে তাঁদের আত্মগৌরব মাটিতে মিশে গেল। নিজেদের পৌরাণিক বিশ্বাসের জগৎ থেকে ছিটকে পড়ে তাঁরা বুঝতে শিখল, তাঁরা আর পশুপতি নয়, জঙ্গলের রাজা নয়, এই জঙ্গলটাও সম্ভবত তাঁদের নয়। সেই থেকে এই ক্রমবহমান হাহাকার বয়গাদের চৈতন্যে থইথই করছে। অথচ, জঙ্গলটা মুছেও মোছে না। শরীরের উল্কির মতোই নানা শিরা-উপশিরায় সেই ফেলে আসা স্মৃতি বইতে থাকে। এক নাছোড় কষ্ট। ফলে, কোনও এক অসম্ভব স্বপ্নে তাঁরা ভাবেন, এই জঙ্গল তাঁদের, সরকার সেই অধিকার ফিরিয়ে দিক। (Refugee Day)
আর সরকার! ব্রিটিশদের একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁরা তো জঙ্গলকে দেখেছিল সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে। বন মানে কাঠ। কাঠ মানে রেললাইন, রেলের বগি, টেলিগ্রামের পোত, নৌবহর, বাংলোবাড়ি, আসবাব আরও কত কী! অতএব, বন কাটতে হল।
আর সরকার! ব্রিটিশদের একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁরা তো জঙ্গলকে দেখেছিল সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে। বন মানে কাঠ। কাঠ মানে রেললাইন, রেলের বগি, টেলিগ্রামের পোত, নৌবহর, বাংলোবাড়ি, আসবাব আরও কত কী! অতএব, বন কাটতে হল। ঔপনিবেশিক উন্নয়নের সেই পর্বে ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে কত লক্ষ আদিবাসী ছিন্নমূল হয়েছিলেন তার হিসেব নেই। কত বন্যপ্রাণ উজাড় হয়েছিল, সে তো কহতব্যই নয়। সাহেবরা মজার ছলে, খেলার ছলে শিকার করতেন। দেশি বাবুরাও করতেন। সে যাহোক, ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে স্বাধীন দেশেও বনের ওপর দখলদারি বন্ধ হল না। বন রাষ্ট্রের সম্পত্তি৷ কাঠের থেকে প্রয়োজনের অভিমুখটা ঘুরল খনিতে। খনি ব্রিটিশ আমলেও হয়েছে, কিন্তু পরিমাণে কম। ফলে, স্বাধীন দেশেও ‘উন্নয়নের’ প্রয়োজনে বয়গা তথা বিভিন্ন আদিবাসী-বননিবাসী মানুষদের উচ্ছেদ হতে হয়েছে বারবার। (Refugee Day)
কিন্তু ছয়ের দশকের শেষ থেকে সেই উচ্ছেদে একটা নতুন মাত্রা যোগ হল— টাইগার রিজার্ভ। দেশে বাঘের সংখ্যা ভয়াবহ হারে কমে যাচ্ছে, তাই টাইগার রিজার্ভ ঘোষণা না করলেই নয়। অতএব, সেই জঙ্গল থেকে মানুষ সরাতে হবে। সেই মানুষ বলতে কারা, তাঁরা কত হাজার বছর ধরে ওই জঙ্গলে আছেন, বাঘের সঙ্গে সহাবস্থান করেই বাঁচেন কী না— এসব কথার অর্থ নেই। জঙ্গলকে বিপন্মুক্ত করতে হবে। (Refugee Day)

অতএব, বয়গারা স্বাধীন দেশেও উদ্বাস্তু হলেন। বারবার। কানহা টাইগার রিজার্ভে ১৯৬৮-৭৮-এ শুরু হল উচ্ছেদ ও ‘পুনর্বাসন’। তারপর, নয়ের দশক থেকে নানা সময়ে ওমরাই, ভারি, বেন্দার মতো গ্রাম থেকে কমপক্ষে বত্রিশটা বয়গা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। এর কিছুদিন পরে, ২০১০-১৫ পর্যন্ত সময়কালে, ধাপে-ধাপে, কানহা-র কোর জোন থেকে প্রায় হাজার দু’য়েক বয়গা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিছু বয়গা পরিবার বন ছেড়ে উঠতে রাজি হচ্ছিলেন না বলে নাকি নানারকম চাপ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি হাতি ছেড়ে দিয়ে গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখানো হয়। ভুল বুঝিয়ে, জোর করে জমি ছেড়ে উঠে যাওয়ার কাগজে সই করিয়ে নেওয়ার মতো অভিযোগও উঠেছিল। সেসব খবর অবশ্য আমাদের কান অবধি পৌঁছয়নি। কিংবা কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করেনি। কোথাকার ওই জংলি চার-পাঁচ হাজার বয়গার দল, টাইগার রিজার্ভের জমি দখল করে বসেছিল। উচ্ছেদ হয়ে ভালই হয়েছে। (Refugee Day)
কেউ প্রশ্ন তোলেনি, যাঁরা এতকাল জঙ্গলের একটা অংশ হয়েই বেঁচে ছিল, তাঁদের জন্য বাঘেদের কী ক্ষতি হবে? তাঁরা কি গণ্ডায়-গণ্ডায় বাঘ মেরে নিকেশ করলেন? সে যাহোক, কানহার কোর জোনে এখন কোনও গ্রাম নেই। মসৃণ টাইগার সাফারি হয়। ট্যুরিস্টরা যান, ছবি তোলেন। বনদপ্তরের সাজানো বাগান আলো করে বাঘ বসে থাকে। (Refugee Day)
বয়গাদের পাশাপাশি কিছু গোঁড় পরিবারকেও উচ্ছেদ করা হয়েছিল কানহায়। ঠিক যেমনটা ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল অচানক মার টাইগার রিজার্ভে। দেশের নানাপ্রান্তের টাইগার রিজার্ভেও যেমনটা ঘটে চলেছে। অচানক মারে বামনি গ্রামের দিলহরণ টাকাম বলেছিল, হুট করে এখানে ‘টাইগার রিজার্ভ’ ঘোষণা করে দেওয়া হল। অথচ, বাঘ তো নেই আর। থাকলেও হাতেগোনা। এই বনদপ্তর আর শিকারিরা তো বাঘ মেরে মেরে শেষ করে দিল। এদিকে একদিন অফিসারবাবুরা এসে ঘোষণা করলেন, এই জঙ্গলের পঁচিশটা গ্রাম নাকি কোর জোনের মধ্যে পড়েছে। বাঘ আর মানুষ একসঙ্গে থাকা যাবে না, অতএব অন্যত্র উঠে যেতে হবে। যে জঙ্গল ঘিরে এত এত বছর বেঁচে থাকা, বাঘ-বুনো মহিষ-চিতার সঙ্গে ওঠাবসা, সেই জঙ্গল ছেড়ে উঠে যেতে হবে কেন! বাঘের কোনও ক্ষতি তো তাঁরা করেননি, বাঘও তাঁদের কোনও ক্ষতি করেনি কখনও। (Refugee Day)

জঙ্গলের মাঝে বসে দিলহরণ বলছিল, “দাদু বলত, বাঘ গর্জন করলে বৃষ্টি নামে। তখন ফসল বুনতে হয়। বাঘ ছাড়া জঙ্গল হয় না। জঙ্গল ছাড়া আমরাও থাকব কীভাবে! আর, আমরা না থাকলে কি জঙ্গলটাও থাকবে!” (Refugee Day)
দিলহরণ জাতিতে গোণ্ড বা গোঁড়। ডোঙ্গর, মানে জঙ্গলের পাহাড় থেকে দিলহরণের পূর্বপুরুষরা নেমে এসেছিল মণিহারী নদীর পাশে। এই মণিহারী গোটা জঙ্গলকেই এঁকেবেঁকে ঘিরে রেখেছে। নদীতে মাছ ভাল পাওয়া যায়। জলটাও সারাবছর থাকে। ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে অন্য গোঁড় পরিবাররাও নেমে এল। গ্রামের নাম হল বামনি। দিলহরণ ছত্তিশগড়হিতে কথা বলে। আনন্দও তাই। আনন্দ এক্কা। ওঁরাও। মহামাঈ গ্রামে প্রায় সব ঘরই ওঁরাওদের। বামনি থেকে মহামাঈ পাক্কা দশ কিলোমিটারের বুনো পথ। আনন্দের মাতৃভাষা কুরুক। এদিকে সে কথা বলে ভাঙা ছত্তিশগড়হিতে। (Refugee Day)
কিন্তু, অচানক মার টাইগার রিজার্ভের আশপাশে গ্রামের সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ছত্তিশগড়হিতেই স্বচ্ছন্দ। সাদ্রি তাঁরা সকলেই জানেন। দিলহরণ যেমন দিব্বি বোঝে কুরুক।
সারগুজাতে ওঁরাও, গোঁড়, সাঁওতাল, মুণ্ডা সকলে নিজেদের মধ্যে সাদ্রিতে কথা বলেন। কিন্তু, অচানক মার টাইগার রিজার্ভের আশপাশে গ্রামের সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ছত্তিশগড়হিতেই স্বচ্ছন্দ। সাদ্রি তাঁরা সকলেই জানেন। দিলহরণ যেমন দিব্বি বোঝে কুরুক। কিন্তু নিজেরা কথা বলেন ছত্তিশগড়হিতে। ঠিক মূল ছত্তিশগড়হিও নয়। একজাতের মিশ্রভাষা। সে ভারি অদ্ভুত। বাংলা-ঠেসা কানেও দিব্বি চমৎকার ঠেকে। (Refugee Day)
দিলহরণের সঙ্গে আনন্দের বন্ধুত্ব জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সময়। টাইগার রিজার্ভ ঘোষণার পরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুম্বা, সম্বরধাসান, বাঙ্কাল, জালদা, বাহৌর, বোখরাখাচারের মতো বনগ্রামকে জঙ্গলের বাইরে ‘বিস্থাপিত’ তথা উচ্ছেদ করে দেওয়া হল। নতুন গ্রামে সব বাড়িই একধাঁচের দেখতে। সারিবদ্ধ। সেখানে জঙ্গল নেই। কাজ খুঁজতে শহরে যেতে হয়। বেঁচে থাকাটা জটিল। বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হওয়ার পর অচানক মারের বাদবাকি সব গ্রাম মিলে এর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ায়। ‘অচানক মার টাইগার রিজার্ভ সংঘর্ষ সমিতি’ তৈরি হয়। ফলে, বাকি গ্রামগুলোকে এখনও অবধি উচ্ছেদ করে দেওয়া যায়নি। বরং, বনাধিকার আইন অনুযায়ী প্রাপ্য বনাধিকারের অনেকটাই আদায় করা গেছে। (Refugee Day)

বনদপ্তরের আঁটোসাটো পাহারায় জঙ্গলে তেঁন্দুপাতা তোলার কাজ শুরু হয়েছিল একসময়। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। সেখানে গ্রামবাসীদের হক ছিল না। তাতে জঙ্গলে জঙ্গলে আগুন লাগত। এখন গ্রামবাসীরা নিজেই জঙ্গলের দেখভাল করা শুরু করেছেন। আগুন লাগলে নিভিয়েও দেওয়া হয় দ্রুত। মহোলাইন পাতা আর মধু সংগ্রহের কাজও চলছে। বনদপ্তর আজও এসে চোখ রাঙায়। উঠে যেতে চাপ দেয়। তির-ধনুক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে একসঙ্গে ছবি তোলে। তারপর রিপোর্টার ডেকে বলে, শিকার করার সময় গ্রামবাসীরা বাকি অস্ত্র-সমেত হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের তিরধনুক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাই নিয়েও অরণ্যভূমির গ্রাম উত্তাল হয়। বনদপ্তর কখনও ক্ষমা চায়, কখনও চায় না। (Refugee Day)
দুপুরে দিলহরণের ঘরেই ক্ষেত থেকে ওঠা উরদ ডাল, জিরাফুলের ভাত আর শুকনো পিঢ়ির সবজি দিয়ে পেটপুজোর পরে আমরা হাঁটতে বেরোই। আলো পড়ে আসছে। কাটামি হয়ে বৃন্দাবল ঘুরে আরও খানিকটা জায়গায় যাওয়া বাকি। দিলহরণ বলেই চলে জঙ্গলের গল্প। (Refugee Day)

“অব দেখাথ হস বড়ে বড়ে রুখরাই হবে। অও নদীয়া, নরওয়া, ঝোরখা হবে। অউ এইসনে জাগামাহ হামান রথন, তিঁহাতে ঘুমেলা আয়হঁস। অউ হামান বচপন লে রাহাথান। হামারা মানখে দাদামানহা ইঁহি জন্মেরেইনে। ও ঘনি মা অতি বঘুয়া, ভলুয়া রহেঁ। তেন ঘনি এদে-ওদে ভেঁট হো যায় বাঘ-ভালু সন। ত দেখকে রুখুয়া ম চড় যান। ডোংগর-মা ভাঁইসা চড়ায়লা যাত রঁহন। তা গওয়ঁর (বাইসন) সন মিল যাওয়ে ভাইসঁমন।” আরে, একবার আমার দাদু বাঘ দেখে গাছের টঙে চড়ে বসেছিল। কত ভাল্লুক ছিল এখানে কদিন আগেও। মোষ চড়াতে যেতাম জঙ্গলে৷ সে কী কাণ্ড, কয়েকটা বাইসন দেখি আমার মোষেদের দলে ভিড়ে চলে এসেছে। (Refugee Day)
গল্প মানে স্মৃতি। যা নেই তার কথা। যা আর আসবেও না। অনেক লড়াই করে এই নামমাত্র জায়গায় বাসা ধরে রাখা গেছে এখনও। সেও কবে উড়ে যাবে, জানা নেই।
গল্প মানে স্মৃতি। যা নেই তার কথা। যা আর আসবেও না। অনেক লড়াই করে এই নামমাত্র জায়গায় বাসা ধরে রাখা গেছে এখনও। সেও কবে উড়ে যাবে, জানা নেই। শেষ দেড়শো-দুশো বছরের ইতিহাসটাই তো শিকড় উপড়ে ফেলা আর নতুন করে গাঁথার ইতিহাস। যেভাবে নিরঞ্জন বলছিলেন, তাঁরা নিজেদের জঙ্গলেই উদ্বাস্তু। ছিন্নমূল। স্বদেশ বলে যদি কিছু থাকেও, সেখানে তাঁরা চিরপ্রবাসী। (Refugee Day)
এই এক কথা, এক হাহাকার পাক খেতে থাকে ভারতের নানা প্রান্তের জঙ্গলে। শিকড় গুলিয়ে যায়। বয়গাদের মতোই উত্তরবঙ্গের জুমিয়ারাও ছিন্নমূল হন নিজেদের জঙ্গল থেকে। কখনও উন্নয়ন, কখনও টাইগার রিজার্ভ, কখনও সংরক্ষিত অরণ্যের প্রয়োজনে। পুরনো জঙ্গলটাও হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় হাজার-হাজার বন্যপ্রাণী, নদী, নিসর্গ। পুরনো জঙ্গল, নিসর্গ, পুরনো যাপনের স্মৃতিগুলো লোপাট করে একটা নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। ছিন্নমূলের ইতিহাস। (Refugee Day)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
তথ্যসূত্র:
1. The Tribal World of Verrier Elwin, Verrier Elwin
2. The Baiga, Verrier Elwin
3. W. B. Thomson: Report of the Land Revenue Settlement of the Seonee District, 1867
4. H. C. E. Ward: Report of the Land Revenue Settlement of the Umdlah District, 1868-69
5. Article Published in ‘Survival International’ dated July 22, 2015.
6. Article Published in ‘Down To Earth’ dated January 16, 2015.
7. Article Published in ‘Down To Earth dated July 13, 2012.
ছবি সৌজন্য- লেখক
অনিতেশ চক্রবর্তী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। গবেষক। পড়ানো ছেড়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ। অত:পর আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজস্ব সংস্থা। ভালোবাসেন তথ্যচিত্র বানাতে। বনগ্রাম ও বনাধিকার নিয়ে কাজের সূত্রে উত্তরবঙ্গ তথা ভারতের নানা বনাঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক দুটি বই। কবিতার বইও আছে একটি।