(Ruplal House)
“এই পৃথিবীতে যার আজ কোনও চিহ্ন নেই— যে ছিল অনেকদিন আগে
পোড়া ভিটের পোতায় তার দড়ির মতন শিরা, মরা চুল, আংটির কাচ
বিঁধে আছেঃ লোকাপবাদের স্মৃতি।”
-মণীন্দ্র গুপ্ত
২০২৫: ধুলোমাখা জামাল হাউসের করিডোর
বাংলাদেশের পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের গলির ভিতর ঢুকে ডানদিকে একটু হাঁটলেই বুড়িগঙ্গার পাড়ে রূপলাল হাউসের মূল ভবনটি, জরাজীর্ণ অবস্থা। দেওয়ালের গায়ে গাছের মোটা শিকড় জড়িয়ে আছে, ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলে পড়েছে শিকড়। ফাটল ধরা দেওয়ালের গায়ে লেগে আছে ভবন সংরক্ষণ-এর নোটিশ বোর্ডের ছেঁড়া টিন। নীচতলায় পেঁয়াজ, রসুন, আদার বস্তা ঠেলাঠেলি করে সাজানো। দোকানপাট আর আড়তের ভিড়ে বাড়িতে ঢোকার দরজা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই বাড়ির নাম বদলে এখন ‘জামাল হাউস’, কিন্তু একসময় যে এর নাম রূপলাল হাউস ছিল তা আজ অনেকেই ভুলতে বসেছেন। (Ruplal House)
বাড়ির সামনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দ্বিধা আর কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে এত বছরের যে ইতিহাস, যে গৌরব, আজ তা স্রেফ একটা বাজার— একটা জরাজীর্ণ ধাতব কাঠামো। ঝুলে পড়া তার আর পেঁয়াজের বস্তার নীচে চাপা পড়ে গেছে সবকিছু। (Ruplal House)
বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি দেখে আড়তের ভিতর থেকে এক লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন কিছু খুঁজছি কী না? রূপলাল হাউসের ভেতরে ঢোকার পথ কোনটা জানতে চাইলাম। একটা ভেঙে পড়া দরজা দেখিয়ে দিলেন। ভেতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছিল, যা খুঁজতে এসেছি তা কি এই বাড়ির ভেতর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে? নাকি সেসব অনেক আগে বিলীন হয়ে গেছে ইটের নিচে চাপা পড়ে। (Ruplal House)

১৮৮৮: বাড়ির দরজায় ব্রিটিশ অতিথি
১৮৮৮ সালের অক্টোবর মাস। তখন ঢাকা শহরটি এখনকার হাঁপানি রুগীর মতো শ্বাসকষ্টে আটকে থাকা ধুলোভরা নগর ছিল না। সেসময় ঢাকার গায়ে ভেসে বেড়াত বুড়িগঙ্গা নদীর ভিজে সুগন্ধ হাওয়া, বর্ষায় নদী তীরে থাকা সুরম্য ভবন গুলোকে ভেনিস নগরীর মতো মনে হত। এইরকম একটা সময়ে শহর জুড়ে উত্তেজনা, পূর্ব বাংলা ভ্রমনের শেষে ইংরেজ বড়লাট লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরে আসছেন। তাঁর সম্মানে ঢাকার ইংরেজ ক্লাব এক বলড্যান্স পার্টির আয়োজন করতে চায়। কিন্তু— সেই নাচ কোথায় হবে? সান্ধ্যকালীন সভায় জড়ো হয়েছে ক্লাবের সব সদস্য। (Ruplal House)
“ক্যাপ্টেন ব্রাউন গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের এমন একটি ভবন চাই, যা ভদ্রলোকদের প্রশংসা জাগাবে আর মহিলাদের স্বপ্নের মতো মনে হবে।”
ক্যাপ্টেন ব্রাউন গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের এমন একটি ভবন চাই, যা ভদ্রলোকদের প্রশংসা জাগাবে আর মহিলাদের স্বপ্নের মতো মনে হবে। (Ruplal House)
দুটি নাম উঠে এল সভায়। একদিকে নবাব পরিবারের ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল— গোলাপি দেয়ালে নরম রাজকীয়তা। অন্যদিকে নব্য ব্যবসায়ী শ্রেণির আভিজাত্যের প্রতীক— রূপলাল হাউস। রূপলাল হাউসে আধুনিক ইউরোপীয় নকশার সাথে মিশ্রণ ঘটেছে ভারতীয় স্থাপত্যের। (Ruplal House)

ব্রিটিশ অফিসাররা পরিদর্শনে এলেন। প্রথমে দেখলেন আহসান মঞ্জিল। ঝকঝকে, পরিচ্ছন্ন, তবে বলরুমটা বেশ ছোট— মাত্র একান্ন বাই চব্বিশ ফুট। এখানে ঘুড়ির মতো নাচা যাবে না, হেসে বললেন এক ব্রিটিশ লেডি, লেসে মোড়া ছাতা ঘুরিয়ে। (Ruplal House)
তারপর তাঁরা এলেন রূপলাল হাউসে। রূপলাল হাউস দেখতে অনেকটা ইংরেজি ‘E’ অক্ষরের মতো। পাথরের সিঁড়ির ওপরে দাঁড়ানো ৫০টি বিশাল কক্ষ আর বারান্দা জুড়ে অনেকগুলো সেমি-কোরিন্থীয় স্তম্ভ— মনে হয় যেন শত, শত প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে সারা বাড়ি জুড়ে। বুড়িগঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা পোর্টিকোতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর নিপুণ কারুকাজ। উত্তরে ও দক্ষিণে বিশাল বারান্দা আর পশ্চিম ব্লকের দোতলায় সেই বিশাল বলরুম—দেওয়ালে বেলজিয়াম আয়না, সিলিংয়ে খোদাই করা ফুলের নকশা আর মেঝেটা নিরেট কাঠের। কাঠের মেঝের উপর আলো পড়লে মনে হয় যেন ঝলমলে জলের ঢেউ। বল রুমের নিচে দাঁড়ানো একটি মর্মর-মূর্তি— ভেনাস, নিঃশব্দে চোখ তুলে চেয়ে আছে নদীর দিকে। (Ruplal House)
“বাড়ির ভেতরে ঢুকেই মনে হল, এখানে সময় থেমে গেছে। পুরো বাড়িটা যেন সময়ের চাপে সেঁধিয়ে গেছে— আলো ঢোকে না, বাতাস দাঁড়িয়ে থাকে।”
Bravo! ক্যাপ্টেন ব্রাউন চোখ তুলে বললেন, It breathes civilization!
২০২৫: ইদুরের কামড়ে ঝরে পড়ে প্লাস্টার
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই মনে হল, এখানে সময় থেমে গেছে। পুরো বাড়িটা যেন সময়ের চাপে সেঁধিয়ে গেছে— আলো ঢোকে না, বাতাস দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু মাঝের উঠোনে পড়ে থাকা রোদের টুকরোটা চোখে লাগে, পাশে একটা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে অন্ধকারে। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দু’পাশে দেখা যায়— পুরানো দেয়ালে কে কোথা থেকে ভাড়া নিয়েছে, কে কার কাছ থেকে গুদাম দিয়েছে এই ধরনের তথ্য লাগানো নোটিশ। নাচঘরের বারান্দা এখন কাপড় শুকানোর স্থান, ছাদে রেনেসাঁ পেডিমেন্টের নিচে কে যেন শুকাতে দিয়েছে কয়েকটি পুরানো জামা আর একটি শাড়ি। (Ruplal House)
বাড়ির ছাদে উঠে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, ড্রেনের উপরে লোহার জালি, তার ওপর ভেসে আছে কাঁচা ভাতের মাড়, মাছের কাঁটা, আমের পুরানো আঁটি। কাক ঠুকরাচ্ছে পলিপ্যাকে মোড়ানো চিংড়ির খোলস, তার পাশে দুটো বেড়াল বসে আছে চোখে ঘুম আর ক্ষুধার দৃষ্টি নিয়ে। (Ruplal House)
“শেষ বিকেলের আলোয় টের পাই— এই বাড়িটা এখন আর কোনও ভবন নয়, এটি এক জীবন্ত প্রেত।”
ডান দিকে যে মোটা থামওয়ালা ভবনটা, তার বারান্দায়ও কয়েকটি শাড়ি ঝুলছে, ভবনটার নীচে স্যাঁতসেঁতে ছোট উঠান, একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা গাছের চারপাশটা ইট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। শ্যাওলা ধরা ইটগুলোর পাশ ঘেঁষে এক বৃদ্ধা নারী বাসন মাজতে মাজতে, কথা বলছে ঘরের ভিতরে থাকা অন্য কারো সাথে। (Ruplal House)
শেষ বিকেলের আলোয় টের পাই— এই বাড়িটা এখন আর কোনও ভবন নয়, এটি এক জীবন্ত প্রেত। হঠাৎ দোতলার করিডোরে পুরানো দরজায় বসানো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠি, মনে হয়, এ আমি না—এ কারও পুরোনো সুরত, হয়তো সেই সময়কার এক ক্লার্ক বা উকিল, যিনি রোজ বিকেলে বারান্দায় বসে ইংরেজি সংবাদপত্র পড়তেন। (Ruplal House)

১৮৮৮: রূপলাল হাউস জাঁকজমকের শিল্পরূপ
ইংরেজ ক্লাব দুই দিনের জন্য ২০০ টাকায় বলরুম বুক করলেও রূপলাল ও রঘুনাথ জানতেন— এটা শুধুই বল ড্যান্স নয়। এটা এক সামাজিক উত্থান, জমিদারশ্রেণিকে পাশ কাটিয়ে ব্যবসায়ী শ্রেণির আত্মপ্রকাশ। (Ruplal House)
“বাড়ির প্রতিটি কোণ ধুয়ে-মুছে সেজে উঠল রাজকীয় সাজে। ঝাড়বাতিতে নতুন কাচ, ছাদে নতুন রঙ, সিঁড়িতে বসানো হল মখমলি রঙিন কার্পেট। সারা বাড়ি জুড়ে হাজার হাজার প্রদীপ।”
রূপলাল বললেন— এই ২০০ টাকায় কিছুই হবে না। আমরা এমন কিছু করব, যেন ইংরেজরা কখনও ভুলে না যায়।
রঘুনাথ হাসলেন, তিনি তাঁর এই ভাইকে চিনতেন, তাঁর এই ভাই সৌখিনতার চূড়ান্ত করতে পারে, আর এইজন্য দরাজ হাতে অর্থ ব্যায় করতে কার্পণ্য করে না। তার মনে আছে ১৮৪০ সালে আরাতুন নামে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এই বাড়ি কেনার পর অকাতরে অর্থ ব্যায় করা হয়েছে এই বাড়ির জন্য। (Ruplal House)

একরাতের বল ড্যান্সর জন্য রূপলাল খরচ করেছিলেন সেইসময়ে প্রায় ৪৫,০০০ টাকা— অবর্ণনীয় বিলাস। বাড়ির প্রতিটি কোণ ধুয়ে-মুছে সেজে উঠল রাজকীয় সাজে। ঝাড়বাতিতে নতুন কাচ, ছাদে নতুন রঙ, সিঁড়িতে বসানো হল মখমলি রঙিন কার্পেট। সারা বাড়ি জুড়ে হাজার হাজার প্রদীপ। হাজার হাজার প্রদীপ যখন জ্বলে উঠেছিল তার প্রতিবিম্বে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল দেয়ালে লাগানো আয়না, আলো, মানুষ আর ছায়া মিলেমিশে এক বিভ্রমের জগৎ সৃষ্টি করেছিল। (Ruplal House)
২০২৫: ছাদে অন্ধকার, নীচতলায় নিঃসঙ্গতা
ভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসি। নীচ তলায় অনেকগুলো ঘর, দু-একটি ছাড়া প্রায় সবগুলিই মানুষ বসবাসের অযোগ্য, কয়েকটির ভিতর বোধহয় কাকদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম। যে দু-একটি ঘরে মানুষ বসবাসের আলামত পেলাম, সব গুলিই তালা আটকানো শুধু একটি ছাড়া। এই ঘরটির দরজায় কাপড়ের পর্দার বদলে বাঁশের তৈরি জালির পর্দা লাগানো। এখন সেই পর্দা গুটানো, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সেই দরজার সামনে দাঁড়াই। প্রায় অন্ধকার ঘর, দেয়াল জুড়ে বিশাল ফাঁটল ছাদের কোনায় যেসব জাগয়ায় সুক্ষ্ম কারুকাজ ছিল সেসব ভেঙে ভেতরের সিমেন্ট দেখা যাচ্ছে।(Ruplal House)
আরও পড়ুন: অবগুণ্ঠিতা, নারী জাগরণের প্রতীক: অবলা বসু
ঘরটির আসবাবপত্র বলতে দেখলাম কাঠের টুলের ওপর রাখা পুরানো টিনের বাক্স। দেয়ালে জাপানি প্রকৃতির ছাপা একটি ক্যালেন্ডার, কয়েকটি ডেকচি উপুড় করে রাখা আর দুটি রঙ উঠা প্লাস্টিকের চেয়ার। একটা মিনমিনে টিউবলাইটের নিচে ঘাড় বাঁকিয়ে খাটে উপুড় হয়ে কিছু একটা পড়ছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী একটা ছেলে, শরীরে স্যান্ডো গেঞ্জি, মাথার চুল ঘেমে কপালে লেপ্টে আছে। (Ruplal House)
ঘরের কোণে এক তরুণী, গ্যাসের আগুনে পরোটা ভাজছে, পরোটা ভাজার গন্ধ ছাড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলার অনুমতি চাইলাম। তরুণীটি বিব্রত হল না, মনে হল এইরকম অনাহুত লোক মাঝে, মাঝে এই বাড়িতে আসে। (Ruplal House)

পরোটা ভাজার গন্ধ ছাড়িয়ে একটা বিদঘুটে গন্ধ নাকে লাগছিল, তাই জিজ্ঞেস করলাম- একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, এটা কীসের? ঘরের পেছনে নালাটা ভেঙে গেছে অনেকদিন, সেখান থেকে এই গন্ধটা আসছে। বর্ষাকালে উঠানের ময়লা জল ঘরে চলে আসে। হঠাৎ, হঠাৎ ছাদ থেকে পলেস্তার খসে পরে, বাড়িটা নিয়ে নানা অভিযোগ করছিলেন তিনি। (Ruplal House)
চলে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম, এই বাড়ি তো খুব বিখ্যাত, আপনি জানেন? উত্তরে শুনলাম, জানি, এটা এখন আর সেই বাড়ি নাই। এটা এখন জোড়াতালি দেওয়া একটা লাশ। (Ruplal House)
“নেমে আসছে ধীর পায়ে রূপলাল হাউসে, সিঁড়ির ধাপে ধাপে, করিডোরে, বারান্দায়, বাগানের পথে জ্বলে উঠছে মাটির প্রদীপ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে মোমের গন্ধ আর ঘুঙুরের নীরব শব্দ।”
১৮৮৮: বলরুমের ঝাড়বাতিতে ঝিকিমিকি আলো
নভেম্বর এর ২৭ তারিখ। বিকেলের শেষ আলো তখনও জানালায় লেগে আছে, বুড়িগঙ্গার বুকে ছড়িয়ে পড়েছে শেষ বিকেলের নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীর পায়ে রূপলাল হাউসে, সিঁড়ির ধাপে ধাপে, করিডোরে, বারান্দায়, বাগানের পথে জ্বলে উঠছে মাটির প্রদীপ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে মোমের গন্ধ আর ঘুঙুরের নীরব শব্দ। আজকের সন্ধ্যায় বল ড্যান্সের জন্য কলকাতা থেকে আনা হয়েছে সঙ্গীত দল, হেলেনা নামের এক ইউরোপীয় গায়িকা আর বেহালাবাদক ফ্রান্সিসকে। (Ruplal House)
রূপলাল হাউসের হলঘর তখন এক রূপকথার জগৎ, জাদুর দৃশ্যর মতো অলৌকিক। ইংরেজ ভদ্রলোকেরা সেজেছেন টেইলকোটে, তাদের সুন্দরী সঙ্গিনীরা পরেছেন লম্বা গাউন, গলায় পুঁতির গয়না আর ঠোঁটে হাসির মাদকতা। কাঠের মেঝেতে তাদের মৃদুমন্দ হাঁটা চলার সাথে সঙ্গত করছে ফিসফিস আওয়াজ। (Ruplal House)
“লর্ড ডাফরিন চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, One must not miss the poetry of motion. তিনি স্বয়ং নেমে পড়লেন নাচে।”
নদীর দিকে মুখ করে থাকা সব দরজা খোলা হয়েছে— সেখান দিয়ে ঢুকছে নদীর হাওয়া। হলঘর থেকে দেখা যাচ্ছিল চাঁদের আলো তিরতির করে নদীর বুক ছুঁয়ে কাঁপছে, দূরে আরও দূরে নৌকার বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে আর নিভছে। (Ruplal House)
হলঘরের মাঝখানে ঝুলছে একটি বিশাল ঝাড়বাতি— তাতে শত শত কাঁচের টুকরো— দেওয়ালে লাগানো আয়নার সাথে ঝাড়বাতির আলো মিলেমিশে নাচতে থাকা সাহেব আর ম্যামদের গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছিল সোনালি আলোর লতা। হেলেনার সঙ্গীতের ছন্দে জোড় বেঁধে তাঁরা নাচছিলেন প্রজাপতির মতো, বাতাসে ভেসে, ভেসে। তাদের পায়ের শব্দ কাঠের মেঝেতে পড়ে নদীর ঢেউয়ের মতো প্রতিধ্বনি তুলছিল। (Ruplal House)
“একটু কান পাতলেই শোনা যায়, এই বাড়ির শরীরে লেপ্টে থাকা সময়ের মরিচা, বুড়িগঙ্গার বাতাসের সাথে ফিসফাস করে বলে চলেছে বর্ণাঢ্য সেই সময় এর কথা।”
লর্ড ডাফরিন চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, One must not miss the poetry of motion. তিনি স্বয়ং নেমে পড়লেন নাচে। এক, এক করে দশ জন সুন্দরীর সাথে নাচে অংশ নিলেন। লেডি হ্যারিওট সুগন্ধ ছড়ানো বলঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে অন্য রমণীদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন কৌতূহলভরে। লেডি হ্যারিওট এই অপূৰ্ব সন্ধ্যার কথা Most exquisite silver programmes নামে উল্লেখ্য করেছিলেন তাঁর স্মৃতিকথায়। (Ruplal House)
রাত ঘন হয়, আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, আলো নিভে যাওয়া প্রদীপের ধোঁয়া। লর্ড ডাফরিন বিদায় নেন, কিন্তু উৎসব ফুরোয় না। ইংরেজ অতিথিরা রাতভর উদ্দাম উৎসবে মাতেন। চারপাশে হাসির শব্দ, হর্ষধ্বনি, নাচ আর মদের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরান ঢাকার বাতাসে। (Ruplal House)

রূপলাল দাস বলঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে তখন আলোর মতো কিছু একটা— যেন ক্লান্তির ওপরে বিজয়ের আলো। নবাবদের ছায়া পেরিয়ে এই শহরে যে বর্ণাঢ্য প্রাসাদ তিনি তৈরি করেছেন আজ যেন তারই জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। (Ruplal House)
২০২৫: বাতাসে মৃত পাতার গন্ধ
রূপলাল হাউস থেকে চলে আসার সময় নীচতলায় দেখলাম লোকজন চাপা শব্দে কাজ করে চলেছে— বস্তা সরাচ্ছে, হিসেব মিলাচ্ছে, তাদের ঘর্মাক্ত মুখগুলো কারুকাজহীন। মেঝেতে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে আছে পেঁয়াজের খোসা, গাদাগাদি করে রাখা বস্তা, বাতাসে মিশে আছে মশলার ঝাঁজ আর পুরনো কাঠের পঁচা গন্ধ। এখন এখানে কোন ইতিহাস নেই, আছে শুধু দৈনন্দিন কঠিন বাস্তবতা। (Ruplal House)
এই বাড়িটার বুকে যেটুকু ইতিহাস জমা ছিল, তা আজ অদৃশ্য কালির লেখার মতো মুছে গেছে কোলাহলের ভেতর। কিন্তু একটু কান পাতলেই শোনা যায়, এই বাড়ির শরীরে লেপ্টে থাকা সময়ের মরিচা, বুড়িগঙ্গার বাতাসের সাথে ফিসফাস করে বলে চলেছে বর্ণাঢ্য সেই সময় এর কথা। (Ruplal House)
তথ্য সূত্র:
1.Our Viceregal Life In India: Selections From My Journal, 1884-1888; Volume 2, Chapter XVI by Harriot Georgina 2.ঢাকা সমগ্র -৩, মুনতাসীর মামুন।
3.The Revitalization of Farashgonj as a Cultural and Heritage Town.
ছবি সৌজন্য- লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা ও বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক। তথ্য বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়।