ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় শৈলেন মান্নার (Sailen Manna) ফুটবল জীবন, পরাধীন ভারত থেকে শুরু করে, স্বাধীন ভারতের বেশ কিছুটা সময় অবধি প্রবাহিত। যে সময়কালের প্রায় পুরোটাই ছিল সমাজ-রাজনীতিগত দিক থেকে বর্ণময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। গোটা ১৯৪০ দশক জুড়ে অশান্তি আর গণ্ডগোলে ছেয়ে ছিল কলকাতা তথা বাংলা। আর ঠিক এইসময়েই কলকাতা ময়দানে পা রাখছেন শৈলেন মান্না। ফলে, শুরু থেকেই এক জটিল বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে ও তাঁর সমসাময়িক খেলোয়াড়দের। ঐ উত্তাল চল্লিশ দশকে খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নিজেকে। সুতরাং, তাঁর ক্রীড়া-সংগ্রামের পথটা বেশ কঠিনই ছিল।

১৯২৪-এর ১ সেপ্টেম্বর হাওড়ার ব্যাঁটরায় মামারবাড়িতে জন্ম শৈলেন মান্নার। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। ফুটবলে আকর্ষণ শুরু থেকেই। বাড়ি ও এলাকা মোহনবাগানময়। হাওড়ার বিশিষ্ট ফুটবল কর্মকর্তা হেমন্ত দে, তাঁর ক্লাব হাওড়া ইউনিয়নে মান্নাকে নিয়ে আসেন ১৯৪০ সালে। পরে প্রথম ডিভিশনে খেললেও, সেইসময় কলকাতা লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনে থাকা এই ক্লাবের হয়েই প্রথমবার ময়দানে ফুটবল-অভিষেক হল শৈলেন মান্নার। পড়তেন রিপন কলেজে(এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। সেখানেও কলেজ-টিমে শুরু থেকেই জায়গা পাকা। আবার ১৯৪১ সালে আই.এ পড়ার সময়েই কলকাতা ইউনিভার্সিটির হয়ে প্রথমবার মাঠে নেমে ২–১ ব্যবধানে পরাজিত করলেন পঞ্জাব ইউনিভার্সিটিকে। কলকাতা তখন দারুণ দল। শৈলেন মান্না ছাড়াও রয়েছেন শরৎ দাস, চঞ্চল ব্যানার্জি, সোমানার মতো চৌখস ফুটবলারেরা। যাঁরা প্রত্যেকেই পরে কলকাতা ময়দান কাঁপিয়েছেন। প্রসঙ্গত, শরৎ দাস রিপন কলেজেই মান্নার চেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়তেন এবং তখনই খেলছেন মোহনবাগানে। এঁরই সহযোগী হয়ে মোহনবাগানের জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন শৈলেন মান্না। আর ইউনিভার্সিটি দলের গোলকিপার চঞ্চল ব্যানার্জিও তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েক বছর খেলেছিলেন মোহনবাগানে।
সেকালের ভোট ও দাদাঠাকুরের রঙ্গব্যঙ্গ : অভীক চট্টোপাধ্যায়
সেদিন ইউনিভার্সিটির খেলায় মাঠে ছিলেন গ্রেট গোষ্ঠ পাল। যিনি সম্ভাবনাময় ফুটবলারের সন্ধানে মাঠে মাঠে ঘুরতেন। মান্নার খেলা নজর কাড়লো তাঁর। শৈলেন মান্নার মামা ইন্দুভূষণ সামন্ত ছিলেন মোহনবাগানের একজন কর্মকর্তা। গোষ্ঠবাবু তাঁকেই বললেন, ভাগ্নেকে ক্লাবে নিয়ে আসার জন্যে। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাঁটরার বাড়িতে এ ব্যাপারে পাকা কথা বলতে এলেন বিখ্যাত ফুটবলার অনিল দে। মোহনবাগানে প্রবেশ ঘটল শৈলেন মান্নার। এভাবেই সূচনা হল একটা যুগেরও। সেটি ১৯৪২ সাল।
তখন খেলা হত ২–৩–৫ সিস্টেমে। শৈলেন মান্না মোহনবাগানে খেলা শুরু করলেন শরৎ দাসের মতো অভিজ্ঞ ও অসামান্য ব্যাকের পাশে। তিনিই মান্নাকে গাইড করেছিলেন শুরুতে। এ-ব্যাপারে চিরকাল, ‘শরৎদার’ প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন শৈলেন মান্না। তখন আলাদা করে ফুটবল-কোচ রাখার চল ছিল না। ক্লাবের সিনিয়র আর প্রাক্তন ফুটবলারদের পরামর্শেই দল চলত। যাই হোক, অল্প দিনের মধ্যেই মোহনবাগান ডিফেন্সে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন শৈলেন মান্না। প্রায় তিন দশক ধরে খেললেন পাশে একের পর এক নতুন নতুন ফুটবলার নিয়ে। গোটা দল, বিশেষ করে ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড়েরা উদ্বুদ্ধ ও নিশ্চিন্ত হতেন, ডিফেন্সে শৈলেন মান্না থাকার জন্যে।

মান্নার খেলোয়াড়ি জীবনের সময়টা ছিল সব দিক থেকেই অন্যরকম। একদিকে ছিল সমাজ-রাজনীতিগত অশান্ত আবহাওয়া, আর অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলে আসা নানা ক্রীড়াগত পরিবর্তন। এসবের সঙ্গে মানিয়ে, অভ্যস্থ হয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে সাফল্যের লক্ষ্যে। যেমন, তাঁকে শুরু করতে হয়েছিল খালি পায়ে, শেষ করতে হল বুট পরে খেলে। অবশ্য, যতদিন খালি পায়ে খেলেছেন, তখন কখনওই বুট পরেননি, এমনটা নয়। কারণ, বৃষ্টিভেজা মাঠ হলে বুট পরতেই হত। কিন্তু নিয়মিত নয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ অবধি তিনি যে ভারতীয় দলের হয়ে প্রায় ১৪/১৫ টি ম্যাচ খেলেছিলেন, তার মধ্যে ১৯৫২-র হেলসিঙ্কি অলিম্পিক অবধি খেলতে হয়েছিল খালি পায়ে। তার পর থেকে সবুট। কাজটা খুব সহজ নয়। কারণ, একজন খেলোয়াড় খালি পায়ে খেলে উচ্চ মানে পৌঁছবার পর, হঠাৎ নিয়মিত বুট পরে খেলা বেশ কঠিন। পাশাপাশি তাঁকে মাথায় রাখতে হয় যেন তাঁর দক্ষতার এতটুকু পতন না ঘটে। সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শৈলেন মান্নার ক্ষেত্রে যে সেটা হয়নি, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে মোহনবাগানের হয়ে খেলা তাঁর দুটি স্মরণীয় ম্যাচের উদাহরণ দেওয়া যায়। অব্যর্থ নিশানায় গোলার মতো বিশ্বমানের শট নিতে পারার জন্যে শৈলেন মান্নাকে বলা হত ‘ফ্রি-কিকের জাদুকর’। মোহনবাগানের হয়ে দুটি স্মরণীয় ম্যাচে তাঁর মারা দুটি অসামান্য ফ্রি-কিক থেকেই বিষয়টা অনেকটাই স্পষ্ট হয়। প্রথমটি তাঁকে মারতে হয়েছিল খালি পায়ে। আর দ্বিতীয়বারে বুট পরে।
১৯৪৪ সাল। লীগ চ্যাম্পিয়নের নির্ধারক ম্যাচে মোহনবাগানের মুখোমুখি মহামেডান। খেলার আগে লীগ টেবিলে মোহনবাগানের চেয়ে এক পয়েন্টে এগিয়ে মহামেডান। তখন(অনেক পর অবধিও) নিয়ম ছিল, জিতলে দুই আর ড্র করলে এক পয়েন্ট। সেই হিসেবে এই ম্যাচ অমীমাংসিত থাকলে, দুটি দলের পয়েন্টের ব্যবধান একই থাকবে। ফলে, মহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। অতএব, লীগ-চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে মোহনবাগানকে জিততেই হবে। এই অবস্থায় খেলা শুরু হল। দুটি দলই দুরন্ত। একদিকে ইসমাইল(গোলকিপার), জুম্মা খাঁ, হাফিজ রসিদদের মতো ডাকসাইটে ফুটবলার দিয়ে সজ্জিত মহামেডান, অন্যদিকে চঞ্চল ব্যানার্জি(গোলকিপার), টি. আও, শরৎ দাস, শৈলেন মান্না, অনিল দে(অধিনায়ক), নির্মল চ্যাটার্জিদের মতো অসামান্যদের নিয়ে গঠিত মোহনবাগান। খেলায় কী হল, তা দেখা যাক স্বয়ং শৈলেন মান্নারই বয়ানে, “… ১৯৪৪ সালে আমার জীবনে এল এক শুভক্ষণ। লিগের দৌড়ে তখন এগিয়ে আছে মহমেডান। ওরা ২৩টা খেলে ৩৯। আর আমরা ৩৮। লিগের শেষ খেলা ওদের সঙ্গে। সেই খেলায় আমাদের জিততেই হবে যদি লিগ পেতে চাই। জিতলাম এক গোলে। এবং সেটা আমারই ফ্রি-কিক থেকে। ভাবতেও পারিনি ওদের ইসমাইলের মতো গোলকিপার কিংবা জুম্মা খাঁর মতো ব্যাককে পরাজিত করে, ওদের জালে বল পাঠাব। সেই ম্যাচই জনসমক্ষে আমাকে ‘মান্না’ বলে পরিচিত করল। জীবনে প্রথম সাফল্য। তাই তার আনন্দও অসীম…”। এই শটটি তিনি মেরেছিলেন খালি পায়ে এবং খেলোয়াড়ি জীবনের গোড়ার দিকে। যাতে শুধু ম্যাচের নয়, লিগের ফলাফলও নির্ধারিত হয়েছিল।
হেমন্ত-র স্বর্ণকণ্ঠ : কিছু ভাবনা : অভীক চট্টোপাধ্যায়
এবার পরের খেলাটির কথা। ১৯৫২ সালের আই.এফ.এ শীল্ড ফাইনালে মোহনবাগান বনাম রাজস্থানের ম্যাচ। তখন রাজস্থান মারকাটারি দল। রয়েছেন ডোরাইলিঙ্গম, মহাবীর, কানাইয়ান, রমন, ডব্লু পাল, স্টুয়ার্ডদের মতো দুর্ধর্ষ ফুটবলারেরা। অন্যদিকে, মোহনবাগানে অধিনায়ক শৈলেন মান্নার সঙ্গে আছেন টি আও, বাবু, রুণু গুহ ঠাকুরতা, বদ্রু ব্যানার্জি, জে অ্যান্টনির মতো খেলোয়াড়েরা। সেদিন মোহনবাগানের সেইসময়ের সেরা ফরোয়ার্ড সাত্তার চোটের জন্যে মাঠে নামতে না পারায় শুরু থেকেই একটু চিন্তায় ছিল সবুজ মেরুণ। খেলা আরম্ভ হতেই রাজস্থান দাপটের সঙ্গে খেলতে লাগল। প্রথমার্ধেই ডব্লু পাল ও রমনের গোলে তারা ২–০ করে ফেলল। হাফটাইমের পর মাঠে নেমে মরীয়া হয়ে খেলেও গোল আসছে না মোহনবাগানের। মাঠভর্তি সমর্থকরা হতাশ। খেলা শেষ হতে তখন মিনিট দশেক বাকি। বিপক্ষের হাফ লাইন থেকে একটু এগিয়ে একটা ফ্রি-কিক পেল মোহনবাগান। বলটা মাথায় ঠেকিয়ে স্পটে বসিয়ে দিলেন সঙ্গী ব্যাক পূর্ণেন্দু বড়ুয়া। শট নিলেন শৈলেন মান্না। নেট নড়ে উঠল রাজস্থানের। ২–১। মোহনবাগানিদের গর্জনে কান পাতা দায়। এরপর, শেষের পাঁচ মিনিট আগে হেডে বশিথ বাকারের গোলশোধ এবং দুমিনিট আগে বদ্রু ব্যানার্জির শট রাজস্থান গোলের ক্রসবার ছুঁয়ে চলে এল। যা না এলে, সেদিন শীল্ড-চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত মোহনবাগান। মান্নার দুরন্ত ফ্রি-কিকই যে মোহনবাগানের দিকে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, তা তো বলতেই হয়। সেবার শীল্ড অবশ্য পরিত্যক্ত হয়েছিল। তার কারণ, এখানে আলোচ্য নয়।

আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে, একবার শৈলেন মান্নার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁকে তখন এই খালি পা আর বুট পরে খেলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে, তিনি বলেছিলেন, “এটা তুমি ঠিকই বলেছ। ভাবতে তো হয়েইছিল। তখন তো আমাদের কোনও কোচ ছিল না। ক্লাবের সিনিয়রদের পরামর্শ নেওয়া, আর বাকিটা নিজের থেকেই অনুশীলন করা, এভাবেই অভ্যেস করতে হয়েছিল।” আমরা জানি, ভারতীয় ফুটবল দলে খেলা ও নেতৃত্ব দেওয়ার এক উজ্জ্বল অধ্যায় আছে শৈলেন মান্নার ফুটবল-জীবনে। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে, লন্ডন অলিম্পিকে মোহনবাগানের সেন্টার-হাফ টি. আওয়ের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিল ভারতীয় ফুটবল দল, যে দলের অপরিহার্য ব্যাক ছিলেন শৈলেন মান্না। তাঁর খেলায় সেবার আপ্লুত হয়েছিলেন বিদেশিরা। একজন ডিফেন্সে খেলা ফুটবলারের ক্ষেত্রে যা কমই চোখে পড়ে। সাধারণ ভাবে দেখা যায়, ফুটবলে ফরোয়ার্ড বা অফেন্সের খেলোয়াড়েরা তুলনামূলক ভাবে বেশি জনপ্রিয় হন। হয়তো গোল আটকানোর চেয়ে, গোল দেওয়া বেশি আকর্ষণ করে মানুষকে। লন্ডন অলিম্পিকে এক এবং একমাত্র খেলায় ফ্রান্সের সঙ্গে ভারত পরাজিত হয়েছিল ২–১ গোলে। কিন্তু, পৃথিবীর অন্যতম সেরা দলের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সেদিনের লড়াই প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিল বিদেশিদের কাছ থেকে। খেলায় ভারত দুটি পেনাল্টি পেয়েও তা গোলে পর্যবসিত করতে পারেনি। পারলে সেদিন হয়তো ফরাসীরা হেরেও যেতে পারত। অব্যর্থ নিশানায় দুরন্ত শট করার ব্যাপারে যাঁর দারুণ সুনাম, সেই শৈলেন মান্না প্রথম পেনাল্টিটি ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন! পরেরটা মিস্ করেছিলেন মহাবীর প্রসাদ। এ ব্যাপারে মান্নাদার বক্তব্য ছিল, “আর বলো কেন! যে আমি অনায়াসে পেনাল্টি তো বটেই, অত ফ্রি-কিক থেকে গোল করেছি, সেই আমি কী না এরকম একটা খেলায় পেনাল্টিটা দিলাম বারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে! এর কারণ আজও আমার কাছে অজানা। তবে একটা কথা মনে হয়, ওর পরে ভারত আরও একটা পেনাল্টি পায়, সেটা অবশ্যই আবার আমারই মারা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি গেলাম না। মহাবীর মারল এবং সেও মিস্ করল। আমার যেটা মনে হয়, আমার আগের মিসের চিন্তাটা আমার পক্ষে কাটিয়ে উঠে দ্বিতীয়বার নতুন উদ্যমে মারাটা অনেক সহজ ছিল, কিন্তু মহাবীরের মাথায় আমার মিস্ করাটা খেলছিল, যেটা কাটানো তার পক্ষে ছিল অসম্ভব। এ ব্যাপারে মহাবীর আমায় পরে বলেছিল। আসলে, বুঝতেই পারছো, সবে স্বাধীন হওয়া একটা দেশের নাগরিক হিসেবে প্রথমবার অলিম্পিকের মতো আসরে সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহাওয়ায়, অচেনা পরিবেশে খেলতে নেমেছি। তার ওপর তাদের দেশেই গেছি, কয়েক মাস আগেও যাদের হাতে আমরা পরাধীন ছিলাম। ভেবো না এগুলো আমি পেনাল্টি মিসের অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছি, তবে এরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়লে মনেপ্রাণে তো একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়ই। তাই না?” অবশ্যই হয় তো বটেই, পাশাপাশি কথাগুলোর একটা অন্য তাৎপর্যও আছে।
চেনা মহানায়কের অন্তরালে অন্য উত্তম : অভীক চট্টোপাধ্যায়
স্বাধীন দেশে ভারতীয় ফুটবলের নিরিখে প্রথম একজন শ্রদ্ধেয় ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে অবশ্যই আসবে শৈলেন মান্নার নাম। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল-শিল্পী, যিনি পারিপার্শ্বিকতাকে খুব একটা আমল দিতেন না, সেই আমেদ খাঁ-ও শৈলেন মান্নাকে বরাবর ‘ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন করে, নেতার মর্যাদা দিয়েছেন। অথচ, ক্লাব ফুটবলে আমেদ খাঁ ছিলেন শৈলেন মান্নার মোহনবাগানের প্রধান প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার (শেষের দিকে কিছুদিন খেলেছিলেন মহামেডানে)। তবে, ভারতীয় দলে একসঙ্গে দুজনে খেলেছেন অনেক ম্যাচ।
১৯৪৮ অলিম্পিকে ভাল খেলার জন্যে, ১৯৫০-এ ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে আমন্ত্রণ পেয়েছিল ভারতীয় দল। নানা কারণে, তাতে অংশ নেওয়া হয়নি। যার সবটা হয়তো অভিপ্রেত ছিল না। নিলে বোধহয় ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসটা অন্যরকম হতে পারত। যাই হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু, একটা কথা, যদি সেই বিশ্বকাপে খেলত ভারত, তাহলে ধরেই নেওয়া যায়, অধিনায়ক হতেন শৈলেন মান্না। যা হত তাঁর ফুটবল-জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। ১৯৫১-য় দিল্লিতে হওয়া প্রথম এশিয়ান গেমসে ভারত ফুটবলে সোনা জেতে শৈলেন মান্নার নেতৃত্বে। এরপর, ১৯৫২ হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেও তিনি অধিনায়ক। সেখানে যুগোস্লাভিয়ার কাছে ১০–১ ব্যবধানে পর্যুদস্ত হয় ভারত। এই শোচনীয় ফলাফলের অব্যবহিত পর থেকেই ভারতীয় ফুটবল নিয়ামক সংস্থা দেশে বুট পরে ফুটবল খেলা বাধ্যতামূলক করল। ১৯৫২ সালের আই.এফ.এ শীল্ড থেকে এটি প্রথম কার্যকরী হয়, যাতে হেলসিঙ্কি থেকে ফিরে অংশ নেন মান্নাদারা। তাঁর নেতৃত্বে এরপর আরও বেশ কয়েকবছর খেলেছে ভারতীয় দল। ১৯৪৪ সাল থেকে বাংলার হয়ে প্রথম সন্তোষ ট্রফি খেলেন শৈলেন মান্না। ১৯৫৪ পর্যন্ত একটানা ১১ বার বাংলার হয়ে মাঠে নেমে, ৯ বার ফাইনালে উঠে ৬ বার চ্যাম্পিয়ন হন। যার মধ্যে তিনি অধিনায়ক ছিলেন চারবার। শৈলেন মান্নাই একমাত্র বাঙালি ফুটবলার যিনি একনাগাড়ে ৬ বছর (১৯৪৯–১৯৫৪) বাংলার অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৬০ অবধি, ১৯ বছর মোহনবাগানের হয়ে মাঠে নেমেছেন। যদিও ১৯৫৮ অবধি একটানা খেলে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৫৯-এ মাঠে নামেননি। কিন্তু, ১৯৬০ সালে মোহনবাগান থেকে চুনী গোস্বামী, জার্নেল সিং, কেম্পিয়ার মতো প্রথমসারির কয়েকজন ফুটবলার রোম অলিম্পিকে ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে যাওয়ার কারণে, লিগের খেলায় অবসর ভেঙে মাঠে নামতে হয়েছিল শৈলেন মান্নাকে। প্রসঙ্গত, ১৯৫৮ সাল অবধি তিনি খেলেছিলেন ২–৩–৫ সিস্টেমে। কিন্তু, ১৯৬০-এ তা পালটে হয়ে গেছে, ৩–২–৫। ফুটবল-জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও অনায়াসে নতুন সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, দুদিকে দুজন সাইডব্যাক নিয়ে দাপটে খেলে গিয়েছিলেন শৈলেন মান্না এবং ঐ ভাঙাচোরা মোহনবাগান সেবার লিগ চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল।

ভারতীয় ক্রীড়াজগতে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল-ব্যক্তিত্ব হলেন অদ্বিতীয় শৈলেন মান্না। ডিফেন্সে ছিলেন দুর্ভেদ্য। লম্বা, ঋজু চেহারার এই মানুষটি চিরকাল মাথা উঁচু করে খেলে গেছেন। একজন ডিফেন্ডার হয়েও খেলতেন ফাউলবিহীন এক পরিচ্ছন্ন ফুটবল। তাঁর ঠাণ্ডা মাথায় খেলা বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মবিশ্বাসী শৈল্পিক ফুটবল, ডিফেন্সের খেলায় নতুন দিশা দেখিয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে, শৈলেন মান্নার বিকশিত হয়ে ওঠার সময়টা ছিল উত্তাল ১৯৪০ দশক। ফলে, ঐ সময় ধরে চলা দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে কাপড়-কয়লা সংকট, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, দেশভাগ ইত্যাদি দারুণ সংকটময় অবস্থা পেরোতে হয়েছে তাঁকে এবং একইসঙ্গে ভাবতে হয়েছে দলের সাফল্য ও নিজেকে খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে। কাজটা কতটা কঠিন ছিল, তা বলাই বাহুল্য। এর মধ্যেই এসেছে স্বাধীনতা। দেশভাগের জন্যে আগমন ঘটেছে কাতারে কাতারে শরণার্থীর। ১৯৪৬ ও ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণে, পর পর দুবছর, ময়দানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যথাক্রমে আই.এফ.এ শীল্ড ও কলকাতা লিগ। ১৯৫৩-য় ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনের ফলে, মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় কলকাতা লিগের খেলা। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, কী চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে শৈলেন মান্নার সময়ের মানুষদের এগোতে হয়েছে। এইসব বাধাবিপত্তিই হয়তো তাঁর শিরদাঁড়াকে সোজা ও শক্ত করে গড়েছিল। তাই হয়তো ঠাণ্ডা মাথায় নিপাট ভদ্র ব্যবহার দিয়ে তিনি সামলাতে পারতেন যেকোনও প্রতিকূল অবস্থা। এই কারণে, অল্পবিস্তর কিছু বিতর্কিত ক্ষেত্র ছাড়া, কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। কিংবদন্তি গোষ্ঠ পালের পরে, ১৯৭১ সালে দ্বিতীয় ফুটবলার হলেন শৈলেন মান্না, যাঁকে “পদ্মশ্রী” সম্মানে সম্মানিত করেছিল ভারত সরকার। ২০০০ সালে, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের বিচারে তিনি “শতাব্দীর সেরা ফুটবলার” নির্বাচিত হন।
প্লেব্যাক থেকে অভিনয়: বহুমুখী অনুভার দীপ্তি : অভীক চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে একমাত্র ভারতের ফুটবলাররাই (২/৩ জন বাদে) খেলেছিলেন খালি পায়ে। ফ্রান্সের মতো ডাকসাইটে দলের বিরুদ্ধে খালি পায়ে ভারতীয়দের অনবদ্য লড়াই চমকে দিয়েছিল সবাইকে। যে সব ভারতীয় ফুটবলার আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন, তার মধ্যে যে জনপ্রিয়তায় সেরা হয়ে উঠেছিলেন শৈলেন মান্না, তার স্বপক্ষে দুটি ঘটনার কথা বলা যায়।

অলিম্পিক-ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পরেও সেবার কয়েকদিন লন্ডনে ছিলেন ভারতীয় খেলোয়াড়েরা। সেইসময় একবার কোচ বলাই চ্যাটার্জির সঙ্গে কোনও একটা মাঠে বসে টটেনহ্যাম হটসপারের খেলা দেখছিলেন শৈলেন মান্না। হঠাৎ কয়েকজন ইংরেজ ছেলেছোকরার দল তাঁর কাছে এসে, পা টিপে টিপে দেখতে শুরু করল। তাঁদের বিস্ময়, কী এমন আছে পায়ে, যা দিয়ে বুটের বিরুদ্ধে টক্কর নেওয়া যায়? দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল বাকিংহাম প্যালেসে। সেখানে ইংলন্ডের রাজপরিবারের আমন্ত্রণে অলিম্পিক খেলোয়াড়দের ভোজসভায় ভারতীয় ফুটবল দল থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শৈলেন মান্না। অন্যান্য খেলার ভারতীয় খেলোয়াড়ও দুজন ছিলেন। এভাবেই ছিলেন তিন-চারজন করে সব দেশ থেকে। ডিফেন্ডার হিসেবে খালি পায়ে, বুটপরা ফরোয়ার্ডদের বিরুদ্ধে শৈলেন মান্নার অসামান্য খেলা, একলাফে সবার কাছে বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তা এবং এই কারণেই তিনি রাজবাড়ির খাওয়াদাওয়ার আসরে পেয়েছিলেন বিশেষ আমন্ত্রণ। সেদিন ঐ প্রাসাদে দুই রাজকুমারী এলিজাবেথ (পরে রানী) ও তাঁর বোন মার্গারেট চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে শৈলেন মান্নার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, পায়ে কী এমন আছে, যা দিয়ে বুটের বিরুদ্ধে এমন অনায়াসে খেলা যায়! কী অদ্ভুত! তাই না? একবছর আগে অবধিও যাদের পায়ের তলায় থাকতে হয়েছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ব্রিটিশেরই কয়েকজন যুবক বা তাদের দেশের রাজকুমারীরা এক ভারতীয়-র পা ছুঁয়ে দেখছে বা সেই পায়ের ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করছে! এ এক অভাবনীয় ব্যাপার! যার কেন্দ্রে রয়েছেন একজন ভারতীয় খেলোয়াড়― কিংবদন্তি ফুটবলার শৈলেন মান্না! তাঁর জন্মশতবর্ষে শুধুমাত্র এই কথা ভেবেই শ্রদ্ধায় অবনত হতে হয়।
চিত্রঋণ:
দি হার্ড ট্যাকেল ডট কম
তথ্যঋণ :
১) আরবি রচিত কলকাতা ফুটবল/ সম্পাদনা : শিবরাম কুমার
২) শতাব্দীর সেরা শৈলেন মান্না/ মানস চক্রবর্তী
৩) মোহনবাগান অমনিবাস/ সম্পাদনা : শিবরাম কুমার
৪) শৈলেন মান্না : এক বিরলতার প্রতীক(নিবন্ধ)/ অভীক চট্টোপাধ্যায় (‘খেলা’, শারদ সংখ্যা ১৪১৯)
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।