“কহী দূর জব দিন ঢাল যায়ে
সাঁঝ কী দুলহন বদন চুরায়ে
চুপকে সে আয়ে মেরে
খয়ালোঁ কে আঁগন মে…”
এক ব্যতিক্রমী সুরস্রষ্টা: সলিল চৌধুরী: স্বপন সোম
আশা ভোঁসলে’র কণ্ঠে যে গান প্রবল সাড়া ফেলেছিল, সে গানের সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরী (Salil Chowdhury)। যাঁর সুরের মায়ায় জাদুকর ভুলে যেতেন খেলা। চোখের রং ধুয়ে নেমে আসে জল। সুর যেন মায়ার পালক বুলিয়ে দিচ্ছে চোখের উপর। মন থেকে বেরিয়ে আসে অন্তর্নিহিত দুঃখ-স্রোত। আর আমরা উঠে পড়ছি সেই মঞ্চে, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে দর্শক আসনে বসে আছে, আমাদের অবচেতন ছায়া। হাততালি দিচ্ছে, কাঁদছে, বরফের মতন কঠিন মন গলে বেরিয়ে আসছে প্রেমের প্রচ্ছদ।

বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন ডাক্তার। তাঁর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের রেকর্ডগুলি হয়ে উঠল সলিল চৌধুরীর ছেলেবেলার সঙ্গী। শিল্প ও রাজনীতির সংমিশ্রণ প্রথম তাঁর বাবা শেখাতেন তাঁকে। তাঁর বাবা গ্রাম-মজুরদের নিয়ে মঞ্চ নাটক করতেন; এই নাটকগুলো সে সময়ের দুর্দশা ও সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন দেখায়। দাদা নিখিল চৌধুরীর ‘মিলন পরিষদ’-এ শুরু হয় সঙ্গীত শিক্ষার পাঠ। ছাত্রাবস্থায় নেমে পড়লেন রাজনীতির ময়দানে। এরপর যোগ দেন গণনাট্য সঙ্ঘে। সলিল চৌধুরীর জীবনের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে পরতে পরতে লেগে আছে কৃষকের ঘাম, আন্দোলন, শ্রমজীবি প্রান্তর, অপ্রকাশিত কবিতা। সুর তাঁকে নিয়ে গেল আরও মাটির কাছাকাছি।
গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দেওয়ার পর প্রথমদিকে বাঁশি বাজালেও পরে গণসঙ্গীত লিখে, গানগুলির সুর রচনা করতেন তিনি। মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, ফসলের দাম সব ক্ষেত্রেই বেজে উঠত তাঁর সুর করা গণসঙ্গীত।
সক্রিয় রাজনীতি করার সময়ে জড়িয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনে। গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দেওয়ার পর প্রথমদিকে বাঁশি বাজালেও পরে গণসঙ্গীত লিখে, গানগুলির সুর রচনা করতেন তিনি। মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, ফসলের দাম সব ক্ষেত্রেই বেজে উঠত তাঁর সুর করা গণসঙ্গীত। ১৯৪৯ সালে ‘পরিবর্তন’ ছবিতে প্রথম মিউজিক কম্পোজ করেন সলিল চৌধুরী। সত্যেন বোস পরিচালিত এই সিনেমায় সাউন্ড রেকর্ডিং-এর কাজ করেছিলেন তপন সিনহা ও সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঋত্বিক ঘটক, বিমল রায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন সলিল চৌধুরীর। সলিল চৌধুরীর লেখা ছোটগল্প ‘রিক্সাওয়ালা’ শুনে বিমল রায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিছুদিন পর টেলিগ্রাম করে চলে আসতে বললেন তাঁকে। টেলিগ্রাম আসে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জ্যোতি চৌধুরীর বিয়ের দিনেই। পাড়ি দিলেন মুম্বাই, গল্পটি অবলম্বনে তৈরি হল বিমল রায়ের প্রথম পরিচালিত সিনেমা ‘দো বিঘা জমিন’। এই গানের সুরকারও ছিলেন সলিল চৌধুরী। হিন্দি গানের জগত ভেসে গেল সলিল ঢেউ-এ।
পরবর্তী সময়ে সত্যেন বোস এই একই গল্প থেকে তৈরি করেন ‘রিক্সাওয়ালা’ সিনেমাটি। যদিও সে সিনেমায় দুটি গান রাখা হয়নি।
পরবর্তীতে, ‘সলিল চৌধুরীর কবিতা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হলেও, সেখানে বেশিরভাগ কবিতাই ছিল অপ্রকাশিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েও গিয়েছে সেসব।
সলিল চৌধুরীর কম্পোজ করা গান, সুর ঘন ছায়া হয়ে আসে প্রান্তিক থেকে নাগরিক রোদ্দুরে। অন্যদিকে, তাঁর নাটক ও কবিতাগুলি ছিল নিষিদ্ধ। তাই সেগুলি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। পরবর্তীতে, ‘সলিল চৌধুরীর কবিতা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হলেও, সেখানে বেশিরভাগ কবিতাই ছিল অপ্রকাশিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েও গিয়েছে সেসব।
সুরকার হিসেবে সলিল চৌধুরী ছিলেন ব্যতিক্রমী ও প্রথাগত নিয়মের বাইরে। কোনও গান সুর করতে হলে, তিনি আগে সুর করতেন তারপর শব্দগুলিকে সেই সুরে ভাসিয়ে দিতেন। যে হিন্দি সিনেমার জন্য সলিল চৌধুরী রাতের পর রাত জেগে সুর করেছেন। সেখানে আঙুল তোলা হয় তাঁর দিকে। মোৎর্জাটের থেকে তিনি নাকি সুর চুরি করতেন! এমনও অভিযোগ করা হয়েছিল।

সলিল চৌধুরী সংবাদ মাধ্যম ও হিন্দি সিনেমার অন্ধকার অলিগলি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পেরে ওঠেননি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সম্পর্কে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হত ‘হলুদ সাংবাদিকতা’। যদিও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল স্বাভাবিকভাবেই। সলিল চৌধুরী ছিলেন সেই নদীটি, যেখানে ঘাটে এসে বসে মানুষ, সুরের আশ্চর্য জল ছিটিয়ে দেয় চোখে, মুখে। ভিজে যায় মনের কোণ। ফেনিল ঢেউ এসে দুলিয়ে দেয় ফসল ভরা মাঠের হাসি, আবার কেঁদে ওঠে শুকনো খরায়। টানা সুর, লয়ে বেজে ওঠা গানগুলি আজও হারায়নি সময়ের ছন্দ।
“সাউন্ড অন সাউন্ড” নামে একটি রেকর্ডিং স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দি সিনেমার নানা বিষয় ও গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন।
১৯৭০-এর দশকে সলিল চৌধুরী হিন্দি চলচ্চিত্র জগৎ থেকে কিছুটা গুটিয়ে নেন। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সঙ্গীত গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। “সাউন্ড অন সাউন্ড” নামে একটি রেকর্ডিং স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দি সিনেমার নানা বিষয় ও গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন।
হিন্দি সিনেমা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় প্রাণ দিয়ে সুর দিয়েছেন সলিল চৌধুরী। মালয়ালম, তেলেগু, কন্নড় প্রভৃতি ভাষার গানগুলিও জনপ্রিয়তা পায়।
তেভাগা আন্দোলনের জন্য রচিত ‘হেই সামালো’ মানুষের শিরা-উপশিরায় মিশে আছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গান হয়ে উঠেছে লোকসঙ্গীত। সলিল চৌধুরী নিজেই হয়ে উঠেছেন সঙ্গীতের সেই ঘরানা। যাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কিশোর কুমারও এক সোফায় না বসে মাটিতে বসেই গাইতে শুরু করেন গান।
তথ্যসূত্র: http://salilda.com/
https://www.prohor.in/

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।
One Response
বড়ো সুন্দর লিখেছো দাদা 🌼❤️তোমার গদ্যের হাত টা বড়ো সুন্দর, অনেককিছু জানতে পারলাম 🌼