(Sholay)
১৯৭৫ সালের, ১৫ই অগাস্ট মুক্তি পেয়েছিল ‘শোলে’ যাকে নিঃসন্দেহে বলিউড চলচ্চিত্রের একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায় বলা যেতে পারে। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের ছবির সাবেকি কাঠামোর গায়ে বদলের হাওয়া লেগেছিল ’৭০ এর শুরু থেকেই। ‘আনান্দ’, ‘কটি পতঙ্গ’, ‘অমর প্রেম’, ‘জঞ্জীর’, ‘ববি’, ‘জনি মেরা নাম’, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’, ‘ইয়াদো কি বারাত’, ‘আন্দাজ’ এই সব ছবি কাহিনি বৈচিত্র, অভিনয় এবং সঙ্গীতের সুললিত মূর্ছনার ঘাড়ে চেপে হৈ হৈ ফেলে দিয়েছিল বক্স অফিসে। গল্পের প্রয়োজনে ছোট-খাট মারদাঙ্গা থাকলেও, পর্দা জুড়ে মোটামুটি একটা শান্তির আবহ বজায় ছিল। (Sholay)
আরও পড়ুন: আসলেই শোলে: ‘শোলে’-র গান: গানকথার সংলাপ
“মেরা গাঁও মেরা দেশ” মুক্তি পেল ১৯৭১-এ। রাজস্থানের ঊষর প্রান্তরে ডাকাতদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় জেল খাটা আরেক অপরাধী– এই ছিল কাহিনির বিষয়বস্তু। এই দেশীয় ডাকাতেরা “অভিশপ্ত চম্বল” এর পাতা থেকে উঠে আসা ডাকু মানসিং অথবা নবাবসিং এর মতোই নিষ্ঠুর, ক্রূর এবং অত্যাচারী। উচ্চগ্রামে বাঁধা অ্যাকশনের সেই শুরু। ‘শোলে’ আসলে সেই ফর্মুলাতে যোগ করেছিল হলিউডের আমেরিকান-ওয়েস্টার্ন ছবির রসায়ন, যা মিলে মিশে তৈরি করেছিল এক নতুন বলিউডি আখ্যান। নির্বাক যুগের ছবি ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ বা পরের দিকের ‘ওয়ান্স আপ অন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’ অথবা ‘দি ম্যাগ্নিফিসিএন্ট সেভেন’ এর পশ্চিমী গোত্রের ধারণাকে রমেশ সিপ্পি কী চমৎকার ভাবেই না ভারতবর্ষে এনে ফেলেছিলেন। (Sholay)

যদি ইতিহাসগতভাবে দেখা যায়, ‘শোলে’ আসলে একটি মস্ত যতিচিহ্ন। শেখর কাপুর বলেছিলেন “Indian film history can be divided into Sholay BC and Sholay AD”। আধুনিক এক রূপকথার নাম ‘শোলে’, যার অবয়ব তৈরি হয়েছিল প্রায় দু’বছরের একটা দীর্ঘ সময়ে- ভারতের সিনেমা রাজধানী বোম্বের স্টুডিওর ঘেরাটোপের বাইরে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকেশনে। (Sholay)
‘শোলে’-র নির্মাণ যজ্ঞ মধ্য সত্তরের সময়ে দাঁড়িয়ে এক ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড যা পঞ্চাশ বছর পরেও একধরণের বিস্ময়। স্মৃতির ঝাঁপিতে রয়ে গেছে বহু ঘটনা, তার হয়তো খানিক জানা, খানিক অজানা। ব্যাঙ্গালোরের অদূরে রামানগরমের শুটিং লোকেশনে কাহিনির “রামগড়” গ্রাম একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল। সেখানে চলেছিল ফিল্মের পর্বত প্রমাণ নির্মাণ কাজ, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় দু’বছর। (Sholay)
স্রেফ চার লাইনের গপ্পো
সেলিম খান আর জাভেদ আখতার জুটির প্রথম কাজ ‘শোলে’। গল্পের খোঁজ করছেন রমেশ এবং জি পি সিপ্পি। এমন গল্প চাই নতুন ছবির জন্য যা হবে একদম অন্যরকম- ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’-এর থেকে আরও এগিয়ে। ততদিনে সিপ্পি ফিল্মসে মাস মাইনের চাকরিতে বহাল হয়েছেন সেলিম এবং জাভেদ। বহুদিন আগে খেরো খাতার পাতায় লেখা হয়েছিল কয়েকটা লাইন- এক অবসারপ্রাপ্ত সেনানায়ক; তাঁর পরিবারকে হত্যা করেছে কেউ বা কারা। পরিবারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি সাহায্য নেবেন তাঁর দুই সাহসী অফিসারের, যাঁদের একসময় কোর্ট মার্শাল করে শাস্তি বিধান হয়েছিল সেনা ছাউনিতে নিয়ম ভঙ্গের অপরাধে। এই গল্পের প্লট বেশ কিছুকাল মনমোহন দেশাই, প্রকাশ মেহেরার মতো পরিচালকের হাত ঘুরে ফিরে এসেছিল তাঁদের কাছেই, পড়ে ছিল পাতার ভাঁজে। প্রায় ভুলতে বসা এই প্লট থেকেই তিন ঘণ্টার এক সিনেমা তৈরি মনস্থ করেছিলেন রমেশ এবং জি পি। একমাস ধরে বারো বাই বারো ফুটের এক ঘরে বসে রমেশ এবং সেলিম-জাভেদ তৈরি করেছিলেন কাহিনি ও চিত্রনাট্য। শুধু “সেনানায়ক” হয়ে যান পুলিশ অফিসার ‘ঠাকুর বলদেব সিং’ এবং দুই সাহসী “অফিসার” এর চরিত্র বদলে হয় “বীরু” এবং “জয়” নামে দুই জেল ফেরত আসামী। বাকি ইতিহাস! (Sholay)
জীবনের চরিত্ররা সেলুলয়েডের ফ্রেমে
১৯৫৬ সালে মধ্যপ্রদেশের জন্ম হল। নতুন রাজধানী হয় ভোপাল। এর আগে চম্বল উপত্যকার ডাকাত মানসিং মারা পড়েছিল পুলিশের হাতে। ভাবা গিয়েছিল চম্বলের শাপমুক্তি ঘটেছে। কিন্তু মানসিং-এর ‘রাজত্ব’ এবার ভাগ বাটোয়ারা হয়ে তৈরি হল প্রায় ১৬ টি ডাকাত দল, যার মধ্যে একটি দলের খলনায়ক গব্বর সিং নামে এক ডাকাত। তার অত্যাচার তখন ত্রাসের সঞ্চার করেছে। লোকের নাক কান কেটে শাস্তি দেওয়া ছিল দস্তুর। সেলিমের বাবা ছিলেন ইন্দোর শহরের পুলিশের বড় কর্তা। তাঁর কাছে শোনা গল্প থেকে তৈরি করেছিলেন গব্বরের চরিত্র। অনেকের মতে অবশ্য এই নামকরণ হয়তো বাস্তবের এক অপরাধীকে অমর করে দেওয়া– যা এড়ানো গেলে ভাল হত। (Sholay)
“সব থেকে বিস্ময়কর সংযোগ হল ঠাকুর বলদেব সিং এর চরিত্র, যিনি বাস্তব জীবনে ছিলেন সেলিমের শ্বশুরমশাই। একবগগা মানুষটি তাঁর মেয়ের সঙ্গে একজন মুসলিমের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি, ফলত, তাঁদের মধ্যে প্রায় সাত বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। “
মনে পড়ে সুরমা ভোপালী আর জেলের নাপিত হরিরামকে? এরাও দু’জন ভোপাল শহরে সেলিমের পরিচিত দুই চরিত্র। কিন্তু সব থেকে বিস্ময়কর সংযোগ হল ঠাকুর বলদেব সিং এর চরিত্র, যিনি বাস্তব জীবনে ছিলেন সেলিমের শ্বশুরমশাই। একবগগা মানুষটি তাঁর মেয়ের সঙ্গে একজন মুসলিমের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি, ফলত, তাঁদের মধ্যে প্রায় সাত বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। (Sholay)

“আংরেজ জামানে কা জেলর“ এর চেহারা চলনে বলনে মনে করিয়ে দেয় “দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর“ ছবিতে হিটলার অনুকৃত চার্লি চ্যাপলিনকে। ডাক পড়েছিল অভিনেতা আসরানির; জাভেদ নাকি তাঁকে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রকাশিত একটি বই, যার মধ্যে ছিল স্বয়ং হিটলারের নানা ভঙ্গিমায় ছবি। পুনে ফিল্ম ইন্সিটিউট-এ পড়াকালীন একবার হিটলারের বাচনভঙ্গির রেকর্ডিং শুনেছিলেন। হাঁটা চলা এবং তার সঙ্গে সংলাপ ভঙ্গিমা মিশিয়ে তৈরি করলেন জেলরের চরিত্র, কথার শেষে জুড়ে দিলেন “দ্যা গ্রেট রেস“ ছবির অভিনেতা জ্যাক লেমনের “হা হা”! (Sholay)
অভিনেতাদের অদল বদল
“মাল্টিস্টারার”, কোনও সিনেমার ক্ষেত্রে এই শব্দ বললে যা বোঝা যায়, “শোলে” আসলে তাই-ই। সে সময়ের প্রথম সারির বেশ কিছু অভিনেতাকে নিয়ে রমেশ সাজিয়েছিলেন তাঁর কাস্টিং। একটা লম্বা সময় ধরে অভিনেতা বাছাইয়ের পর্ব চলেছিল। তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ধর্মেন্দ্র–হেমা মালিনীর এই ছবিতে জায়গা করে নেওয়াটা যেমন ছিল পূর্ব সিদ্ধান্ত, তেমনই আমজাদ খানের প্রবেশ রীতিমত আকস্মিক। সিকিম তখনও ভারতের রাজ্য নয়। সেখানকার একটি ছেলে- ড্যানি ডেনজংপা, “ধুন্দ” নামে একটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করে হৈ হৈ ফেলে দিয়েছে। ড্যানির ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা পুনে ফিল্ম ইন্সিটিউটে। গব্বর সিং-এর চরিত্রের জন্য এরকমই এক মুখ আর দেহ সৌষ্ঠব খোঁজা চলছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে “শোলে”–র অভিনয় শুরু হবে। ঠিক সেই সময়ে ডাক এল ফিরোজ খানের ছবি “ধর্মাত্মা“-র শুটিং-এ। যেতে হবে আফগানিস্থান। ছবিটি ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার “দ্যা গডফাদার“ এর হিন্দি। দুই বড় পরিচালক, দুই বড় ব্যানার এবং দুই সাঙ্ঘাতিক চরিত্রের মাঝে পড়ে শুরু হল ড্যানির টানা পোড়েন। জিৎ হল “ধর্মাত্মা“-র। (Sholay)
তাহলে গব্বরের কী হবে? বাজার চলতি খলনায়ক কেউ তো নেই যিনি গব্বরের চরিত্রে প্রাণ দিতে পারবেন। একমাস পরেই কাজ শুরু।
তাহলে গব্বরের কী হবে? বাজার চলতি খলনায়ক কেউ তো নেই যিনি গব্বরের চরিত্রে প্রাণ দিতে পারবেন। একমাস পরেই কাজ শুরু। ওদিকে রামানগরমের শুটিং লোকেশনে সেট তৈরির কাজও প্রায় শেষ। এরকম অবস্থায় একদিন একটি ছেলের কথা মনে পড়ল জাভেদের। ১৯৬৩ সালে যুব উৎসবে দেখেছিলেন তাঁর অভিনয়। রমেশও তাঁর অভিনয় দেখেছিলেন অনেক পরে বোম্বের কোনও মঞ্চে। মনে পড়ল তাঁরও। খোঁজ শুরু হল সে ছেলের। অবশেষে সেলিম খান, বান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ডে খুঁজে পেলেন তাঁকে। হাজির করলেন রমেশের সামনে। দোঁহারা চেহারা, কালো কোঁকড়ান চুল আর সুকঠিন মুখের আদলে গব্বর এসে দাঁড়িয়েছে তখন রমেশের সামনে। “শোলে”-র সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল আরেকটি নাম- আমজাদ খান! (Sholay)
“শোলে”–র অন্যতম চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। জানা যায় প্রথমদিকে তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিলেন আরেক তারকা- শত্রুঘ্ন সিনহা। রমেশের পাল্লা সেদিকে ঝুলে থাকলেও, সেলিম–জাভেদ রায় দেন অমিতাভের পক্ষেই। (Sholay)
“প্রায় একশজন মানুষ কাজে লেগে পড়লেন রামানগরমের উন্মুক্ত প্রান্তরে। গড়ে তুলতে হবে একটা গ্রাম, যেখানে থাকবে রাস্তা, বাড়িঘরদোর, বাজার, মন্দির, মসজিদ, ঠাকুর বলদেব সিং-এর বাড়ি এবং পাহাড়ের উপরে ডাকু গব্বরের ডেরা। “
রামানগরম থেকে রামগড়
শিল্প নির্দেশক রাম ইয়েদকার। ছোট্ট খাট্ট মানুষটি ছিলেন করিৎকর্মা। মূলত বিদেশি ফিল্মের কাজ করলেও ১৯৭১ সালের দু’টি হিন্দি ছবি- দেব আনন্দের “গাইড” এবং রাজ খোসলার “মেরা গাঁও মেরা দেশ”– তাঁকে এনে দিয়েছিল অসামান্য সাফল্য। রমেশের প্রথম এবং শেষ পছন্দ ছিলেন রাম। “শোলে”–র গপ্পো শুনে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া, এবারে আর রাজস্থানে নয়। রমেশ একমত। আসলে রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চল দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ভারতীয় ছবিতে চম্বলের প্রতিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, কিছু ক্ষেত্রে তা তৈরি হয়েছে বিশাল স্টুডিয়োর অন্দরে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাম। গন্তব্য দক্ষিণ ভারত। রমেশকে কথা দিয়েছেন এক মাসের মধ্যে খুঁজে দেবেন লোকেশন। ভবঘুরের জীবনযাত্রা। পথের ধারে রান্না করে খাওয়া, গাড়িতে ঘুমানো। এমন জায়গা কোথায় যেখানে পাহাড়ের পাশে থাকবে এক গ্রাম– একদিকে থাকবে ঠাকুর সাহেবের বাড়ি– পাহাড়ের ওপরে কোথাও গব্বরের আস্তানা। একদিন এসে পৌঁছলেন ব্যাঙ্গালরের অদূরে এক জায়গায়। মনে পড়ল বেশ কিছু বছর আগে এখানে শুটিং করেছিলেন কোনও এক ইংরেজি ফিল্মের। স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করে বুঝলেন ঠিক জায়গায় এসেছেন। খানিক দূর গিয়ে, এবার পায়ে চলা পথ। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন এক টিলার ওপরে। সামনে দেখতে পাওয়া গেল রামগড়কে। জায়গার নাম রামানগরম! “শোলে” ক্যামেরাবন্দি হবে এইখানেই। (Sholay)

শুটিং এর হরেক কাণ্ড
প্রায় একশজন মানুষ কাজে লেগে পড়লেন রামানগরমের উন্মুক্ত প্রান্তরে। গড়ে তুলতে হবে একটা গ্রাম, যেখানে থাকবে রাস্তা, বাড়িঘরদোর, বাজার, মন্দির, মসজিদ, ঠাকুর বলদেব সিং-এর বাড়ি এবং পাহাড়ের উপরে ডাকু গব্বরের ডেরা। কিন্তু এ তো গেল ছবিতে যেটুকু দেখা যাবে; ফিল্মের শুটিং তো আর এক জন দু’জনের কর্ম নয়। তার জন্য আসবে বহু কলাকুশলী, প্রচুর দামি যন্ত্রপাতি, গাড়ি, ঘোড়া; দরকার হবে মেক আপ রুম, বিশ্রামের জায়গা, গুদাম ঘর, প্রায় এক হাজার মানুষের জন্য খাবার দাবার রান্না এবং তা পরিবেশনের উপযুক্ত স্থান। (Sholay)
দিনটি ৩রা অক্টোবর, ১৯৭৩। পর্দায় রাধার সঙ্গে বীরুর প্রেম পর্বের সেই শুরু। জয়া তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অমিতাভ নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসতেন তাঁকে ব্যাঙ্গালরের হোটেল থেকে। জয়া তাঁর এক স্মৃতিচারণে বলেছেন পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা পিকনিক।
ছবির প্রথম দৃশ্য যেটি তোলা হয় সেটি হল বীরু (অমিতাভ) রাধার (জয়া) হাতে ঠাকুর সাহেবের সিন্দুকের চাবি ফিরিয়ে দিচ্ছে। দিনটি ৩রা অক্টোবর, ১৯৭৩। পর্দায় রাধার সঙ্গে বীরুর প্রেম পর্বের সেই শুরু। জয়া তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অমিতাভ নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসতেন তাঁকে ব্যাঙ্গালরের হোটেল থেকে। জয়া তাঁর এক স্মৃতিচারণে বলেছেন পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা পিকনিক। কে আর হোটেলে বসে থাকতে চায়, যার কোনও শট দেওয়ার থাকত না সেও পৌঁছে যেত শুটিং-এ। রাত্তিরবেলা জয়ার বিরিয়ানি খাওয়ার শখ জাগলেই তিনি বেরোতেন অমিতাভ আর ধর্মেন্দ্রকে সঙ্গী করে। একবার মধ্যরাতে গাড়ি বিপর্যয়, তিনজনে মিলে অটোরিক্সা চেপে ফিরলেন হোটেলে। (Sholay)
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে বহু বছর কাজ করেছিলেন এ কে হাঙ্গাল। সেখান থেকে হিন্দি ছবির দুনিয়ায়। “শোলে”–র শুটিং-এর সময় তিনি কাজ করছিলেন দেব আনন্দের একটি ছবিতে যার শুটিং চলছিল হিমালয়ের কাছাকাছি কোনও অঞ্চলে। দেব আনন্দের নির্দেশে তাঁকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হল কাঠমান্ডুতে, যাতে সেখান থেকে অনায়েসে তিনি পৌঁছে যেতে পারেন রামানগরম, শুটিং-এর নির্দিষ্ট সময়ে। (Sholay)
অনন্য হরি ভাই
সঞ্জীবকুমারের মতো একজন বহুমুখী অভিনয় প্রতিভা, যিনি হয়তো হলিউড ছবিতে কাজ করলে অস্কার পেতে পারতেন অনায়াসেই, অভিনয় করেছিলেন “শোলে”তে। ভারী দিলদরিয়া মেজাজের মানুষটি কলাকুশলীদের কাছের “হরি ভাই”! রমেশের আগের ছবি “সীতা আউর গীতা”তেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। সুতরাং রমেশ বুঝেছিলেন হরিভাই এবং ঠাকুর বলদেব একে অন্যের জন্য তৈরি! ওদিকে ধর্মেন্দ্রের সুপ্ত বাসনা বলদেবের চরিত্রে যদি অভিনয় করা যায়। কারণ, তিনিই তো এ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র। রমেশের কাছে আর্জি পেশ করলেন– রোল বদলা বদলি হোক। কিছুতেই বোঝানো যায় না। উপায়ন্তর না দেখে রমেশ অন্য পথে হাঁটলেন। সেই সময়ে হেমা-ধর্মেন্দ্রর প্রেম পর্ব তুঙ্গে। ওদিকে সঞ্জীবকুমার আবার একবার হেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত। রমেশ বললেন “একটা জিনিস বোঝো, রোল বদল করলে, হরিভাই আসবে বীরুর জায়গায়– সেক্ষেত্রে হেমা যাবে…”। ধর্মেন্দ্র এরপরে আর এগোননি। (Sholay)
“রিলিজের ঠিক এক মাস আগে “শোলে”-র শেষ অংশ আবার নতুন করে ক্যামেরাবন্দি করতে হয়, জুড়তে হয় ধ্বনি। এখনও “শোলে”র এই দু’টি ভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যায়। একটি সেন্সর প্রত্যয়িত, অপরটি নয়।”
হরি ভাইয়ের পানাসক্তি ছিল রীতিমত নজরকারা। তাঁর রাত শেষ হত প্রায় পরের দিন ভোর রাতে। রমেশ বিচক্ষণ। একজনকে লাগিয়ে দিলেন কলটাইম মেনে হরি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে লোকেশনে পৌঁছোনোর দায়িত্বে। (Sholay)
তবে সব থেকে মজার ঘটনা ঘটল শুটিং-এর প্রায় শেষ দিকে। সেদিন ছিল জয়ের মৃত্যু দৃশ্যের চিত্রগ্রহণ, যেখানে দেখা যাবে রাধা তার জীবনে ফেরবার শেষ আশাটুকু হারিয়ে ভেঙে পড়ে। হরি ভাই নিঃশব্দে এগিয়ে যান রমেশের কাছে, কানে ফিস ফিস করে বলেন, এরকম একটা পরিস্থিতিতে মেয়েটাকে কি আমার দুহাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নিয়ে খানিক সান্ত্বনা দেওয়াটা ঠিক নয়? রমেশ কটমট করে একটা দৃষ্টি দেন। গম্ভীর গলায় বলেন, হরি ভাই, কোন হাতের কথা বলছেন? আসলে জাত অভিনেতা সঞ্জীব আবেগের আতিশয্যে ভুলেই বসেছেন ঠাকুরের হাত খোয়া গিয়েছে বহুদিন আগেই! (Sholay)

অবশেষে কি দাঁড়াল?
শুরুর রেলগাড়ির অ্যাকশন সিকুয়েন্স তোলা হয় বোম্বের কাছে পানভিল–উড়ান লাইন ধরে যেখানে সারাদিনে স্টিম ইঞ্জিন লাগিয়ে চলাচল করত দুটি মাত্র ট্রেন– একটি যাওয়ার, অপরটি ফেরবার। এরও খোঁজ পান রাম ইয়েদকার। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে, শুরু হয় রেলগাড়ির শুটিং, চলে প্রায় দু’মাস। ১৯৭৩ এর অক্টোবর থেকে প্রায় দু’বছর চলেছিল “শোলে”–র শুটিং, যা অবশেষে সম্পূর্ণ হল প্রায় সাড়ে চারশো শিফটে। পরে আরও একবার ফিরতে হয়েছিল “শোলে” ইউনিটকে রামানগরমে। তখন দেশে জরুরি অবস্থা। তার মধ্যেই ছবি মুক্তি পাবে ১৫ই অগস্ট, দেশের স্বাধীনতা দিবসে। বেঁকে বসল সেন্সর বোর্ড। রাষ্ট্রের নির্দেশ, কোনও পুলিশ আধিকারিক, হোক বা তিনি অবসরপ্রাপ্ত, আইনকে নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। অতএব চিত্রনাট্য না চাইলেও, ডাকু গব্বরকে ঠাকুর সাহেবের কাঁটাওলা জুতোর তলা থেকে কোনওমতে বাঁচিয়ে তুলে দিতে হয় সেই খাকি পোশাকের আইনি হাতে। রিলিজের ঠিক এক মাস আগে “শোলে”-র শেষ অংশ আবার নতুন করে ক্যামেরাবন্দি করতে হয়, জুড়তে হয় ধ্বনি। (Sholay)
এখনও “শোলে”র এই দু’টি ভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যায়। একটি সেন্সর প্রত্যয়িত, অপরটি নয়।
আরও ছিল বাকি। ৭০ মিলিমিটারের প্রিন্ট তখন তৈরি হত লন্ডনে। ১৪ই অগাস্ট সন্ধ্যেবেলা বর্ষণ মুখর বোম্বে শহরের মিনারভা হলে অতিথিদের জন্য বিশেষ শো। সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন, সরকারি আমলা, কে নেই সেখানে? কাস্টমস-এর অনুমতি না মেলায় সেই প্রিন্ট পড়ে থাকে বিমানবন্দরের এক কোণে। পরে জানা গিয়েছিল এর কারণ জনৈক সরকারি আমলার নির্দেশ। সেদিন সন্ধ্যায় ৩৫ মিলিমিটারের ছোট পর্দার প্রিন্ট দেখানো হয়েছিল দর্শকদের। (Sholay)
কিন্তু এভাবে আটকানো যায়নি সেদিন “শোলে”কে। আর যায়নি বলেই দীর্ঘ পাঁচ বছর ঐ মিনারভা হলেই চলেছিল “শোলে”। ১৯৯৬ এর ২৬শে জানুয়ারি, ২১ বছর পরে সরকার পরিচালিত দূরদর্শনে সারা দেশ দেখল “শোলে”– বোঝা গেল কাহিনির মোচড়ে, দৃশ্যায়নের চমকে, সংলাপের তীক্ষ্ণতায়, আবহের মূর্ছনায়, সঙ্গীতের মাদকতায় এবং কারিগরির দক্ষতায় সে গড়ে নিয়েছিল তার নিজের জায়গা যা আজ পঞ্চাশ পেরিয়েও, থেকে গেছে স্বমহিমায়! (Sholay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য – আন্তর্জাল
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।
5 Responses
Three clarifications. Salim- Javed’s first collaboration was Andaaz. Guide was released in 1965 & Amitabh’s screen name in Sholay was Jai.
শুনেছি BBC কোনো একবার 25 ডিসেম্বর শোলে সম্প্রচার করেছিল এর বিপুল জনপ্রিয়তার কথা জেনে।
কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই এর সঙ্গেও কাহিনী র কাঠামোয় কিছু মিল আছে
শুধু তাই নয় , বিবিসি ছবিটিকে একসময় the film of the milinnieum হিসেবে ঘোষণা করেছিল
কত অজানা তথ্য জানতে পারলাম আমার প্রিয় সিনেমা সম্পর্কে!
ধন্যবাদ