জানুয়ারি মাস, শীতের সকাল। সালটা ঠিক মনে করতে পারছি না। দ্রুতগতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে হলদিয়ার দিকে। গাড়ির মধ্যে আমরা চারজন আরোহী। তপনদা (Tapan Sinha), অরুন্ধতী দেবীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং তপনদার একাধিক ছবির কস্টিউম ডিজাইনার সংগীতশিল্পী মুকুল মুখার্জি এবং তপনদার ছবির প্রধান স্থির চিত্রগ্রাহক সুকুমার রায়। হলদিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ‘হলদিয়া উৎসব’-এ তপনদা এবং ভারতরত্ন সানাইবাদক ওস্তাদ বিসমিল্লা খানের সংবর্ধনাসভায় উপস্থিত থাকা। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছানো গেল। সরকারি অতিথিশালায় বিশ্রাম, তপনদার সঙ্গে এক টেবিলে মধ্যাহ্নভোজ— সবই সারা হল সময়মতো। অনুষ্ঠান শেষে আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল।
চিরকালই বাসে বা গাড়িতে বেশি দূরত্বের পথ পাড়ি দিতে আমার অসুবিধা হত এবং এখনও হয়। যাত্রাপথে আমার অসুবিধার কথা জানতে পেরে তপনদা গাড়ি থামিয়ে নিজে পিছনে এসে বসলেন আর আমাকে নিজের জায়গায় বসতে বললেন। এ হেন প্রস্তাবে আমার আপত্তি ওঁর কথার ওপর টিঁকল না। গাড়ি চলতে থাকে আর দু’পাশে সরে যায় চলমান প্রাকৃতিক দৃশ্য। সন্ধ্যাকাশের একটি বিশেষ দৃশ্যের দিকে আমাদের চোখ পড়ে। নীল আকাশের গায়ে অনেক সাদা টুকরো মেঘ জমে আছে। মনে হয় যেন কোনও চিত্রকরের তুলিতে আঁকা ছবি। আমার দৃষ্টি গিয়ে আটকায় তপনদার মুখের ওপর। এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে মেঘের দলকে দেখছেন। হঠাৎই আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘অমন আকাশকে ফিল্মের ভাষায় কী বলে জানো?’ আমরা তিনজনই নিরুত্তর। নিজের করা প্রশ্নের উত্তর এবার নিজেই দিলেন। ‘ক্রোসাস স্কাই’। বললেন, এই ভাষাটি শুনেছিলেন আকিরা কুরোসোয়ার কাছে।

কথায় আর গল্পে অনেকটা সময় আর পথ পার হয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি হাওড়া জেলায়। তপনদার মনে পড়ে গেল ‘অতিথি’ ছবির শুটিংয়ের স্মৃতি। কারণ, মহিষাদল রাজবাড়ির পথের খুব কাছ দিয়েই আমরা একটু আগে এসেছি। রবীন্দ্রনাথের তারাপদ তার সব বন্ধন ছিন্ন করে তপন সিংহের হাত ধরে ঢুকে গিয়েছিল বাঙালির অন্দরে। ‘অতিথি’ ছবি থেকেই তপনদার সংগীত পরিচালনার শুরু।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে, সংগীতের প্রতি কতখানি গভীর ভালবাসা ছিল তপন সিংহের (Tapan Sinha)। নিজেও ভালো গান গাইতেন। তাঁর প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি ছবিতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কালীপদ সেন এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপের কাজ করেছিলেন। ‘অতিথি’ থেকে তাঁর শেষ ছবি পর্যন্ত তপন সিংহ স্বয়ং সংগীত পরিচালনার দায়িত্বটি খুব সহজেই নিজের কাঁধে তুলে নেন। ‘সহজে’ শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম, কারণ তিনি সংগীতের বিষয়টা তিনি বরাবরই খুব ভালো বুঝতেন। কেরিয়ারের একদম প্রথমে শব্দগ্রহণ করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন বহু বছর। সেই সময়ে বিখ্যাত সব সংগীত-শিল্পীদের গান রেকর্ডের কাজ করতেন সুনিপুণভাবে। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর একটি বিশেষ ঘরে একটিমাত্র মাইক্রোফোনের মাধ্যমেই কাজটি করতেন। তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে যে হারমোনিয়ামটি ছিল সেটি কুন্দনলাল সায়গলের। কবে এবং কীভাবে সেটি তপনদার কাছে এসেছিল, জানা নেই।

ছবির সিচুয়েশনের প্রয়োজনে গানও লিখেছেন তপন সিংহ। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিও ছিল বিশেষ টান। নিজের ছবিতে অভিনেতা এবং অভিনেত্রীদের দিয়ে গানও গাইয়েছেন। সেই সব গান গেয়েছিলেন বৈজয়ন্তীমালা, মৃণাল মুখোপাধ্যায়, পার্থ মুখোপাধ্যায়, ছায়া দেবী, চিন্ময় রায় প্রমুখ। ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবির একটি দৃশ্যে তপনদা নিজেই কয়েক কলি গান গেয়েছিলেন। ‘এখনই’ ছবিতে তাঁর রচিত ‘বন্ধু তোমার আশার আশাতে’, ‘অতিথি’-র ‘মাঝে নদী বহে রে’, ‘বাঞ্ছরামের বাগান’ ছবিতে ‘এক অচিন পাখি উড়ে উড়ে এল মনের ভাঙা খাঁচাতে’ ছবির মধ্যে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আজও সেই সব গান শুনলে ভালো লাগে। ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে ছায়া দেবীর কণ্ঠে দুটি গান এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গানকেও তাঁর বিভিন্ন ছবির দৃশ্যে তীক্ষ্ম সুন্দরভাবে পিকচারাইজ করেছিলেন।

আবার ‘হারমোনিয়াম’ ছবির কথায় ফিরে যাই। একটি হারমোনিয়ামকে কেন্দ্র করে যে একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি হতে পারে, তা না দেখলে ভাবা যায় না। একটা হারমোনিয়ামের ক্রমাগত হাতবদল হচ্ছে আর তাকে কেন্দ্র করে এক-একটি জায়গায় ঘটছে হরেকরকম ঘটনা। সেই ছবিতে কে না গেয়েছিলেন! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, পিন্টু ভট্টাচার্য প্রমুখ শিল্পীদের সমারোহ দেখা গিয়েছিল। ছায়াদেবীর কথা তো আগেই বলেছি।
তপনদার আত্মজীবনীর এক জায়গায় পড়েছিলাম তাঁর মা গ্রীষ্মকালে ছাদে তারাভরা আকাশের তলায় শুয়ে গাইতেন— ‘যতবার আলো জ্বালতে চাই’। তপনদার মুখেই শোনা বাংলা-বিহার সীমান্তের কাছে বীরভূমের হিলোরা গ্রামের বাড়িতে পুজোর সময়ে ঢাকের সঙ্গে কাঁসি বাজাতেন তিনি। তাঁর অনেক গুণের মধ্যে একটা ছিল বাঁশি বাজানো। এই সূত্রে আবার মনে পড়ে যায় ‘অতিথি’র তারাপদর কথা। একদিন শুনেছিলাম তাঁর এক বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা। লন্ডন ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রার এক অনুষ্ঠানে তারা বাজিয়েছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। গানটি ‘অতিথি’ ছবির থিম মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

তপন সিংহর সংগীত পরিচালনার কথা নিয়ে লিখতে বসলে ‘হারমোনিয়াম’ ছবির কথা ঘুরে-ফিরে আসবে। বীরভূমের হিলোরার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় পোটোরা আসতেন ঠাকুর তৈরি করতে। সেই দলে ছিলেন গোপাল বৈরাগী। তিনি প্রতিমা গড়ার সময় সর্বদাই গুনগুন করে গান গাইতেন। তার মধ্যে ছিল একটি গান ‘মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না’। এই গানটিই পরবর্তীকালে তপনদা পরিমার্জনা করে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে। এই ছবিতেই তিনি খালি গলায় ধুমরীভাঙা গান গেয়েছিলেন। এই ছবির জন্য তপনদা ছাড়াও গান লিখেছিলেন প্রখ্যাত গীতিকাল শ্যামল গুপ্ত। ‘হারমোনিয়াম’ ছবির সংগীতের জন্য সিওলের এশিয়া ফেস্টিভ্যালে ‘বেস্ট মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন সংগীত পরিচালক। সিনেমার টাইটেলে প্রবাদপ্রতিম হারমোনিয়াম-বাদক মন্টু ব্যানার্জির বাজনার প্রয়োগ সত্যিই অভিনব।

বর্ষার এক সন্ধ্যায় তপনদার অতীতের গল্প করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর ছবিগুলিতে ব্যবহৃত আধুনিক বাংলা গানগুলো তৈরি করা হত রবীন্দ্র অনুসৃত সুরে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে সংগীত-স্রষ্টারা ক্রমে সেই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসেন। স্বতন্ত্র সব সুরে নতুন গানগুলি তৈরি হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। বলাই বাহুল্য সেইসব গান মানুষের মন জয় করেছিল। তা বলে রবীন্দ্রনাথের গান কোনওদিনই অন্তর থেকে মুছে যায়নি। জীবনপ্রান্তের শেষ সীমায় এসে অবসর যাপনের সময়ে দিনান্তবেলার আকাশে পাখিদের আনাগোনা দেখতে দেখতে হাতে রাখা গীতবিতানের পাতা ওল্টাতে গিয়ে চেষ্টা করতেন দু-এক কলি গাইতে। কোনওটায় সুর আসত আবার কোনওটায় আসত না। মনে করতেন তাঁর জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের মতো আর কেউ ওই বিশ্বচরাচর এবং সাত ঋতুকে দেখেননি।
ছবি সৌজন্য: লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।