‘আনকন্ডিশনাল লাভ’ আক্ষরিক বাংলায় ‘নিঃশর্ত ভালোবাসা’। কিন্তু ওই একই শব্দবন্ধ যদি আমাদের পোষ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি তবে হবে ‘নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’।
আর যাঁরা একাকী অথবা পরিবারে জীবজন্তু পালন করেছেন, করছেন, তা সে কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল যাই হোক না কেন- তাঁরা এব্যাপারে অবশ্যই একমত হবেন।
আমাদের পরিবারে জীবজন্তুর পোষার চল পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি। বাবা পাখি ও কুকুর পুষেছেন, বাগান করার পাশাপাশি। ঠাকুরদা বাঘ, ভালুক ও ময়ূর পুষেছেন।
আমাদের পরিবারে জীবজন্তুর পোষার চল পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি। বাবা পাখি ও কুকুর পুষেছেন, বাগান করার পাশাপাশি। ঠাকুরদা বাঘ, ভালুক ও ময়ূর পুষেছেন। তাঁর বাঘের নাম ছিল ডোরা, ভালুকদ্বয়ের ছোটকা ও বড়কা এবং ময়ূরের নাম ছিল মোহন। তবে এখানে নয়, অন্য কোনোদিন হবে সে গল্প।
আসলে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়া যে কথা বলতে তা হল পোষা জীবজন্তুদের কারণেই এ-পরিবার বরাবরই Vet’দের(Veterinary) খুব কাছ থেকে পেয়েছে মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে, অনেক সময়েই ত্রাতা হিসাবেও।

বাবা বলতেন ‘ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ শিশুচিকিৎসক ও পশুচিকিৎসকের। এই দু’জনের মধ্যেও বেশি কঠিন কাজ পশুচিকিৎসকের। কারণ তাঁর পেশেন্ট কথাটুকুও বলতে পারে না। অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আমরা তাদের ভাষা বুঝি না।’
সে যাই হোক ‘ভেটনারি সার্জন’ অর্থাৎ যাঁরা সারাজীবন ধরে নীল ক্রশ (The blue cross) টি বয়ে বেড়ান, তাঁদের জন্য অনেকের মতোই আমাদের পরিবারেও এক দারুণ ভলোবাসা ও সম্মানের জায়গা বরাবর ছিল এবং এখনও আছে।
আমার শিশুকালে ১৯৬১-৬২ সাল, বাবা পুষবেন বলে ‘লেগহণ’ মুরগি আনান সরাসরি ইতালি থেকে। তখনও এদেশে মুরগি পালন সেভাবে শুরুই হয়নি। একজনের অর্ডারে ওরা ১৩টি পাঠিয়েছিল। ডে ওল্ড চিক। ফ্লাইটের ধকল সামলে ১১টি পাখি বেঁচে থাকে এবং বড় হয়।
প্রতি মাসে নিজের ‘মরিস মাইনর’ গাড়ি চড়ে তাদের দেখতে আসতেন কিংবদন্তী বিলেত ফেরৎ Vet, ডা: হরেরাম মুখার্জী। প্রতিবেশী বৃদ্ধা দাস গিন্নী বলতেন ‘মরলে যেন গাঙ্গুলীবাবার মুরগি হয়ে জন্মাই। কেমন বিলেত ফেরত ডাক্তার আসবে দেখতে!’
একটি শোবার ঘর খালি করে তাদের রাখা হয়, অতি যত্নে। প্রতি মাসে নিজের ‘মরিস মাইনর’ গাড়ি চড়ে তাদের দেখতে আসতেন কিংবদন্তী বিলেত ফেরৎ Vet, ডা: হরেরাম মুখার্জী। প্রতিবেশী বৃদ্ধা দাস গিন্নী বলতেন ‘মরলে যেন গাঙ্গুলীবাবার মুরগি হয়ে জন্মাই। কেমন বিলেত ফেরত ডাক্তার আসবে দেখতে!’
আমাদের ছেলেবেলা ১৯৬৮-৭০ সাল উত্তরপাড়া তখনও প্রাসাদনগরী। অনেকটা হয়তো বহরমপুরের মতোই। সে সময়ে সরকারি পশুচিকিৎসালয় সাধারণত গ্রামাঞ্চলেই থাকত। কিন্তু উত্তরপাড়া শহরেও একটি ছিল, অনেকদিন আগে থেকে এবং অনেকদিন পর্যন্ত, লিচুবাগানে। একটি বড় টালির দো’চালা বাড়িতে। বোধহয় রাজাদের পোষ্য হাতি, ঘোড়া, কুকুর এবং অন্যান্য জীবজন্তুদের চিকিৎসার জন্যই হয়েছিল এই ব্যবস্থা। তবে যেহেতু ছিল এবং একজন পশু চিকিৎসক ও একজন কম্পাউন্ডার সব সময় থাকতেন তাই এই শহরের নাগরিকরাও পরিষেবাটুকু পেয়েই যেতেন।

তখন বাড়িতে এত কুকুর পোষার চল ছিল না। ব্যানার্জী পাড়ায় সাকুল্যে চারটি বাড়িতে আর চড়কডাঙ্গায় আমাদের বাড়িতে কুকুর ছিল। সবগুলিই অ্যালসেশিয়ান। এবাড়িতে সঙ্গে কখনও অন্য ব্রিডও। আমাদের পরিবারগুলির জন্য ওই চিকিৎসালয়টি দারুণ ভরসার জায়গা ছিল। আর অসাধারণ সব ডাক্তারবাবু কাজ করে গেছেন সেখানে। এঁদের মধ্যে ডা: নির্মাল্য আচার্য্য ও ডা: জিতেশ চক্রবর্তীর কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। ডা: নির্মাল্য আচার্য্য এক সময় ‘ক্যালকাটা মাউন্টেড পুলিশ’ এর ঘোড়াদের দায়িত্বে ছিলেন। ডা: জিতেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দু’জনেই খুব ভাল ডাক্তার ছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ থাক যে এঁরা অর্থাৎ ভেটেনারি ডাক্তাররা সকলেই ঘোড়ায় চড়তে জানতেন। কারণ M.V.SC, করতে হলে তখন অশ্বারোহণ বাধ্যতামূলক ছিল।
ডা: সুবিত বাসুর সঙ্গে বাবার সূত্রে আলাপ। যথেষ্ট বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল দুজনের। যদিও ওঁর থেকে আমার পিতৃদেব বয়সে বেশ বড় ছিলেন। কী কারণে জানি না আমি ওঁকে প্রথম থেকেই সুবিতদা নামেই সম্বোধন করতাম। সুবিতদা’র অফিস ছিল নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ। উঁচু পদের সরকারি আধিকারিক ছিলেন, প্রাণীসম্পদ দপ্তরে। রাজ্যের পশুশালাগুলিতে অফিসারদের পোস্টিং হত ওঁর হাত দিয়েই। ওঁর সূত্রেই আলাপ ড: তুহিন চক্রবর্তী(গণ্ডার বিশেষজ্ঞ), ও শ্রী এন.সি.বহুগুনা(আই.এফ.এস)–র সঙ্গে। শ্রী বহুগুনা তখন দার্জিলিং জু’র ডিরেক্টর ছিলেন। পরে তিনি চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়াডেন(ওয়েস্ট বেঙ্গল)হন।
জিজ্ঞেস করায় সুবিতদা বলেছিলেন ‘গৈরিক, তোমাদের বাড়ির কুকুরদের টেম্পারামেন্ট ভাল। ওদের মুখ বাঁধার কোনও প্রয়োজন নেই।’ আমাদের পুষ্যিদের উপর এতটা ভরসা ওঁর ছিল ঠিকই কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা, সেই পুষ্যিদেরও তাদের ডাক্তারবাবুর প্রতি কতটা ভরসা ও বিশ্বাস ছিল!
নিজের বড়িতেই চেম্বার করতেন সুবিতদা। তবে প্রয়োজনে বারংবার তাঁকে বাড়িতেও পেয়েছি, ডাকলে।
আমাদের বিশাল আয়তনের ডাবল কোট আ্যলসেশিয়ান ডগ জুনোর কানে “হেমাটোমা” অপারেশন করেছিলেন মুখ না বেঁধে। আমি জিজ্ঞেস করায় সুবিতদা বলেছিলেন ‘গৈরিক, তোমাদের বাড়ির কুকুরদের টেম্পারামেন্ট ভাল। ওদের মুখ বাঁধার কোনও প্রয়োজন নেই।’ আমাদের পুষ্যিদের উপর এতটা ভরসা ওঁর ছিল ঠিকই কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা, সেই পুষ্যিদেরও তাদের ডাক্তারবাবুর প্রতি কতটা ভরসা ও বিশ্বাস ছিল!
একটা ভালোবাসা ওঁর মনুষ্যেতর প্রাণীগুলির প্রতি ছিল, কারণ বোধহয় এই যে উনি নিজেও বরাবর বাড়িতে এক বা একাধিক কুকুর পুষেছেন। কেবল চিকিৎসাই করেননি!
আমাদের স্মুদ কোট আ্যলসেশিয়ান বিচ নেকীকে একবার চোরেরা বিষ খাইয়ে দিল। সম্ভবত খবারে মিশিয়ে। সন্ধের মধ্যে নেকী ২৮ বার রক্ত পায়খানা করল। দৌড়ে গেলাম সুবিতদা’র বাড়ি–ভীষণ ভয়ে। সব শুনে সুবিতদা বললেন ‘চিন্তার কিছু নেই। নেকী ভলো হয়ে যাবে। তবে যা বলব, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে, পারবে তো?’ জবাব দিই ‘পারব। আপনি বলুন কী করতে হবে?’

‘প্রথমেই এক তাল পুরোনো তেঁতুল জোগাড় করে একটা বড় জামবাটিতে জল ঢেলে সেটা গুলে নাও। তারপর ড্রপারে বা চামচে করে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ৫ এম.এল. পরিমাণে ওকে খাওয়াতে থাকো, সারারাত। প্রয়োজনে দু’জনে পালা করে। কাল সকালে ও উঠে বসবে এবং খেতেও চাইবে। কিন্তু কোনও কারণেই আগামী সাতদিন ওকে জল ছাড়া কিছু খেতে দেওয়া যাবে না। তারপর লিকুইড ডায়েট। সলিড খাবার আরও পরে। আর রোজ সকালে তোমরা আমায় রিপোর্ট করে যাবে।’
সুবিতদার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমরাও লড়ে গিয়েছিলাম। আর আমাদের নেকী সেবার ফিরে এসেছিল যমের দুয়ার থেকে।
সুবিতদা আমাদের বাড়ি এলে ততক্ষণাৎ তাঁর পেশেন্টরা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে তাঁকে ঘিরে ধরত। শুঁকে এবং অনুমতি পেলে হাত চেটে দিয়ে ওঁর খবর নিত এবং নিজেদের কথাও বলত। সুবিতদাও ওদের পিঠ চাপড়ে, কান টেনে দিয়ে বা কখনও নাকে নাক ঘষে দিয়ে প্রত্যুত্তর দিতেন, আদর করতেন। না! Vet কে তারা ভয় পেত না। তাদের পরম আত্মীয় ছিলেন তিনি।
লাঞ্চ ব্রেক-এ বেরিয়ে দেখি কারখানা গেটের দু’চারটি বাড়ি পরে জি.টি. রোডের উপরেই যে ভেটেনারি ওষুধের দোকানটা সেখান থেকে “গৈরিক, এই গৈরিক” বলে কেউ ডাকছে আমায়। তাকিয়ে দেখি সুবিতদা। নতুন চেম্বার। বসে একসাথে চা খাওয়া গেল। গল্পও হল অল্প।
বছর দশেক আগের ঘটনা। আমাদের হারলিকুইন গ্রেট ডেন ‘রাধা’ অসুস্থ হল। এতটাই যে তাকেও ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সুবিতদা ততদিনে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। তবুও ওঁরই শরণাপন্ন হওয়া। সুবিতদার অনুরোধে তাঁর অনুজপ্রতিম ডা: স্বপন ঘোষের মতন চিকিৎসক বাড়ি এসে দেখে গেলেন আমাদের ‘রাধা’ কে। আরও পরে তিনিই মারাত্মক ব্লাড ডিসেন্ট্রি থেকে জীবন বাঁচিয়েছেন আমাদের প্রাণের প্রিয় ‘রোদ্দুরের’।
সুবিতদার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। মনে পড়ছে আর একবারের কথা। আমি তখন লিলুয়া রেল কলোনির মুখোমুখি উল্টোদিকে অশোক স্টিল কর্পোরেশনে চাকরি করি। শিফট-ইন-চার্জ। লাঞ্চ ব্রেক-এ বেরিয়ে দেখি কারখানা গেটের দু’চারটি বাড়ি পরে জি.টি. রোডের উপরেই যে ভেটেনারি ওষুধের দোকানটা সেখান থেকে ‘গৈরিক, এই গৈরিক!’ বলে কেউ ডাকছে আমায়। তাকিয়ে দেখি সুবিতদা। নতুন চেম্বার। বসে একসাথে চা খাওয়া গেল। গল্পও হল অল্প।

এর কিছুদিনের মধ্যেই লিলুয়ায় একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে। নিজের পোষা হাতিটিকে নিয়ে এক মাহুত একটি মিষ্টির দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে নমস্কার করিয়ে শুঁড় বাড়িয়ে দিয়েছিল-বোধহয় খাবার অথবা বকশিসের আশায়। ময়রা সেসবের পরিবর্তে হাতিটির বাড়ানো শুঁড়ে ফুটন্ত রস ঢেলে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় উদ্ভ্রান্ত হাতিটি ময়রাকে আক্রমণ করে মারাত্মক আহত করে। স্থানীয় লোকজন পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে সুবিতদা’র চেম্বারে, এরপর সেই হাতিটি তার মাহুতসহ নিয়মিত আসত ঐ চেম্বারে চিকিৎসা করাতে যতদিন না সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। কাজেই পশুচিকিৎসক হিসাবে সুবিতদা কেমন ছিলেন বোঝাতে হলে টানতে হয় এই উদ্ধৃতিটি :
“The best doctor in the world is the veterinarian. They can’t ask their patients what is the matters – they’ve just got to know. Good veterinarians talk to animals. Great veterinarians hear them talk back?” Subitda was great!

গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায়
গৈরিকের জন্ম গঙ্গাতীরের উত্তরপাড়া শহরে। সেতার শিখেছেন 'ইমদাদখানি' ঘরানায়। পৈতৃকসূত্রে গৈরিক পেয়েছেন বাগান করার শখ। বিশেষত কণ্টকপণী। সবুজ কোনোদিনই তাঁর পিছু ছাড়েনি, তিনিও না। কৈশোর ও যৌবনে তিরন্দাজির জাতীয় প্রতিযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বেশ কয়েকবার। ১৯৮০ সালে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলা দলের। গাছ, ফুল, বাগানের সঙ্গে গৈরিক ভালোবাসেন জীবজন্তু, পশুপাখিও। লেখেনও গাছপালা এবং জীবজন্তু নিয়ে। মূলত প্রবন্ধই।
চাকরি জীবন ইস্পাত কারখানায় শুরু। পরে চলে আসেন তাঁর স্বপ্নের জীবিকা শিক্ষকতায়। সেখানেও আজ তিন দশক। শিশু মনস্তত্ত্ব ও আধুনিক সমাজে শিশুর সমস্যা নিয়ে চর্চা করেন গৈরিক।