অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের (Australian History) কিছু নির্বাচিত অংশ – পর্ব ৫
ইংরেজ কর্তৃপক্ষ প্রথম নৌবহর পাঠানোর আগেই নানা ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন কুক, জোসেফ ব্যাঙ্ক্স এবং অন্যান্যদের রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে এসেছিল এই পরিকল্পনাতে।
নৌবহরের এগারোটি জাহাজের মধ্যে তিনটি ছিল মালবাহী। মালপত্রের বিস্তারিত কোনও তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় সঙ্গে এসেছিল অপচনশীল খাদ্যদ্রব্য, বাসনপত্র, কৃষিকাজ এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের যন্ত্রপাতি, পানীয় জল, মদ, ওষুধপত্র, ব্যান্ডেজ এবং অস্ত্রোপচারের যন্ত্রাদি। উপনিবেশের গভর্নরের আবাসের জন্য আনা হয়েছিল এক পূর্বনির্মিত কাঠের ফ্রেম। বলাই বাহুল্য, অবাধ্য কয়েদিদের জন্য বেশ কিছু হাতকড়া এবং পায়ের বেড়িও ছিল।

১৭৮৮ সালে শীতলীকরণ (refrigeration) প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে কল্পনা করাও কঠিন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় রুটি, মাখন, ময়দা, চাল, চিনি, কড়াইশুঁটি, মাংস ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য তাজা রাখা হয়েছিল কীভাবে!
ঐতিহাসিক নথিপত্র থেকে জানা যায় ক্যাপ্টেন ফিলিপ সরকারের কাছে দু বছর চলার মতো খাবারের অনুরোধ করেছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছনোর পর ওঁর হিসেব অনুযায়ী সঙ্গে আনা খাদ্যদ্রব্য ছিল কেবল এগারো মাস চলার মতো।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ছিল গন্তব্যে পৌঁছনোর কয়েক বছরের মধ্যেই গম, ভুট্টা, শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন করে চাহিদার অনেকটাই মেটানো যাবে। ফসল ফলাবার জন্য বিভিন্ন রকম বীজও সঙ্গে আনা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল কয়েদিদের একাংশকে কৃষিকাজে নিয়োজিত করা হবে।
মাংস এবং দুধের জন্য বেশ কিছু গোরু, ভেড়া, শুয়োর সহ অন্যান্য প্রাণী সংগ্রহ করা হয়েছিল যাত্রাকালে রিও ডি জেনিরো (Rio De Janeiro) থেকে। ধরে নেওয়া হয়েছিল পশুপালন আর সঙ্গে আনা প্রাণীদের বংশবৃদ্ধি করে ভবিষ্যতে এই পণ্যগুলি জোগাড় দেওয়া যাবে।

পৌঁছনোর পরে পরেই ছবিটা কেমন ছিল কল্পনা করা খুব কঠিন নয়। হাজারের উপর মানুষ একটা জনবিরল শুনশান জায়গায় নামল। উদ্দেশ্য, একেবারে নতুন এক উপনিবেশ স্থাপন করা। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসোপযোগী আশ্রয়। আদিবাসীদের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের কথা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল।
কর্তৃপক্ষ এটাও ভেবেছিলেন উপনিবেশ স্থাপনের পর নিয়মিত জাহাজ আসবে ইংলন্ড এবং ভারত থেকে। নতুন কয়েদিদের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য পণ্যও এসে পৌঁছবে নবীন উপনিবেশটিতে।
ক্যাপ্টেন ফিলিপকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যথাশীঘ্র সম্ভব চাষবাস করে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন শুরুর করার। দুর্ভাগ্যবশত বটানি বে’র মাটি কৃষিকাজের উপযোগী ছিল না। পোর্ট জ্যাকসনের জমিও দানাশস্য ফলাবার মতো উর্বর ছিল না। এছাড়া আরও একটা সমস্যা ছিল, প্রথম নৌবহরের যাত্রীদের অধিকাংশের চাষ করা বা পশুপালনে দক্ষতা বা পূর্ব অভিজ্ঞতা তো দূরের কথা— প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকুও ছিল না। প্রথম প্রোথিত গমের বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হয়নি। যাত্রাপথে বীজগুলো গরমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বপন করাও হয়েছিল ভরা গ্রীষ্মে, একেবারেই অনুপযুক্ত ছিল সময়টা।

নামার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, লেফটেনান্ট ফিলিপ গিডলে কিং-এর নেতৃত্বে একটি দলকে নরফোক দ্বীপে পাঠানো হয়েছিল আর একটি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য। অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সিডনির বাসিন্দাদের খাবার জোগান দেওয়া। এই নরফোক দ্বীপ সিডনি থেকে এক হাজার মাইল পূর্বে অবস্থিত। (Australian History)
নানা নিবন্ধে শুরুর দিকের খাদ্যাভাবের কথা বর্ণিত আছে। কিছু ইতিহাসবিদ পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন “near starvation” বা ‘অনাহারের প্রান্তসীমায়’ বলে। বাসিন্দাদের সাপ্তাহিক রেশন সম্পর্কিত তথ্যতে অবশ্য খাদ্যদ্রব্যের অপ্রতুলতার ব্যাপারে কিছুটা খটকা লাগে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বরাদ্দ ছিল সাত পাউন্ড ময়দা, সাত পাউন্ড গোরু বা শুয়োরের মাংস, ছয় আউন্স মাখন, তিন পাইন্ট কড়াইশুঁটি এবং আধ পাউন্ড চাল। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কলকাতায় রেশনে মাথাপ্রতি এর থেকে বেশি কিছু মিলত না। তাই এই প্রায় অনাহারে থাকার কাহিনি বিশ্বাসযোগ্য লাগে না। পরিস্থিতি ছিল কতকটা যা পাওয়া যাচ্ছে তাই খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে— পছন্দসই সুষম খাদ্যের বিলাসিতা ছিল না।
উপরোক্ত খাবারগুলি ছাড়াও বাসিন্দারা নিজেদের জমিতে ফলানো শাকসবজি, ফলমূল দিয়ে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতেন। কয়েদিরা নিজেদের জমির পরিচর্যা করার জন্য শনিবার দুপুরে ছুটি পেতেন। ব্যক্তিগত জমি ছাড়াও পৌঁছনোর দিনকয়েক বাদেই কাছাকাছির মধ্যে তিনটি সরকারি বাগানে বীজ পোঁতার কাজ শুরু হয়েছিল।

উপরোক্ত খাবারগুলি ছাড়াও বাসিন্দারা নিজেদের জমিতে ফলানো শাকসবজি, ফলমূল দিয়ে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতেন। কয়েদিরা নিজেদের জমির পরিচর্যা করার জন্য শনিবার দুপুরে ছুটি পেতেন। ব্যক্তিগত জমি ছাড়াও পৌঁছনোর দিনকয়েক বাদেই কাছাকাছির মধ্যে তিনটি সরকারি বাগানে বীজ পোঁতার কাজ শুরু হয়েছিল।
শাকসবজির ফলন হতে কয়েক মাস লেগেই যায়। অনেক ফলের ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বছর শেষের আগে বেশ কয়েক ধরনের সবজির ফলন হতে শুরু করে।
১৭৮৮ সালের নভেম্বর মাসে লর্ড সিডনিকে (ইনি হোম ডিপার্টমেন্টের সচিব ছিলেন, এঁর নামেই সিডনি শহর) পাঠানো একটি চিঠিতে গভর্নর ফিলিপ জানিয়েছিলেন কমলালেবু, ফিগ, আপেল, কপি, বিনস, স্ট্রবেরি ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে হয়েছে।
একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে জাগে— সমুদ্রে তো নানা ধরণের মাছ, কাঁকড়া, অয়েস্টার ইত্যাদি সহজেই পাওয়ার কথা। মাত্র হাজার মানুষের চাহিদার অনেকটাই তো সমুদ্র মেটাতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

২০২১ সালে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীমতি Jacqueline Anne Newling-এর ৪০০ পাতার ডক্টরাল থিসিস “First Fleet Fare: food & food security in the founding of colonial New South Wales, 1788-1790” থেকে উপনিবেশের প্রথম দু বছরের খাদ্য পরিস্থিতির বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। (Australian History)
শ্রীমতি Newling-এর মতে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষবাস না জানলেও আদিবাসীরা কমবেশি ৬০ হাজার বছর শিকারী সংগ্রাহক হিসাবে অবিচ্ছিন্নভাবে জীবনধারণ করে এসেছেন। ১৭৮৮ তে কমপক্ষে তিন লক্ষ আদিবাসী মানুষের বাস ছিল এই বিশাল ভূখণ্ডটিতে। এই আদিবাসীরা দেশটার কোথায় কী পাওয়া যায় খুব ভালোভাবে জানতেন।
শ্বেতাঙ্গ মানুষের জাত্যাভিমান বরাবরই প্রবল। অনাহারের ভ্রুকুটি সত্ত্বেও এঁরা আদিবাসীদের কাছ থেকে কিছু শিখতে নারাজ ছিলেন। ক্যাঙারু আদিবাসী মানুষদের অন্যতম খাদ্য ছিল। কিন্তু ‘মনুষ্যেতর’ আদিবাসীদের পছন্দের এই মাংস ভক্ষণ করতে শ্বেতাঙ্গদের রুচিতে বেধেছিল।

আজ শহর ছাড়ালেই রাস্তার দুপাশের মাঠে অসংখ্য গোরু, ভেড়া, ঘোড়া দেখতে পাওয়া যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে আড়াই কোটি গোরু এবং সাত কোটি ভেড়া। এগুলি কোনওটাই কিন্তু স্থানীয় প্রাণী (native animals) নয়। সবই এসেছে অন্য দেশ থেকে।
পয়লা মে ১৭৮৮ তে এদেশে প্রাণীদের পরিসংখ্যান ছিল: ঘোড়া ৭, গোরু ৭, ভেড়া ২৯, শুয়োর ৭৪, খরগোস ৫, টার্কি ১৮, হাঁস ৩৫, মুরগি ২০৯।
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।