ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রবাদপ্রতীম শিল্পী,বাবা আলাউদ্দিন খাঁ অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় ৮ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অমৃতলাল দত্ত, হাজারি ওস্তাদ, ওয়াজির খান প্রমুখ সঙ্গীতবিশেষজ্ঞদের কাছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর তালিম পান। পরবর্তীকালে মাইহারের রাজসভায় সভাশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে মাইহার ঘরানা বলতে সঙ্গীতের যে ধারা প্রচলিত তার কাঠামো বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের হাতে গড়া। জন্মবার্ষিকীতে বাবার লেখা ‘আমার কথা’ (শুভময় ঘোষ অনুলিখিত) বই নিয়ে আলোচনা করলেন সরোদিয়া পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
বই: আমার কথা
লেখক: আলাউদ্দিন খাঁ
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম প্রকাশ: বৈশাখ ১৩৮৭ (আনন্দ সংস্করণ)
ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব-এর জীবন ও সঙ্গীতসাধনা নিয়ে বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজিতে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শুভময় ঘোষ অনুলিখিত ও আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত ‘আমার কথা’ বইটি সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। কারণ এই বই-এর ভূমিকা লেখকের ভাষায় ‘এখানে তাঁর জীবনের মূল্য সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে আর প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সঙ্গীতসাধনার ইতিবৃত্ত’। যদিও এই বইটি সে অর্থে ওঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয় বা ওঁর সঙ্গীতশিল্পের আলোচনাও নয়। এই বইটিতে বাবা (এই নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন) বৈঠকী মেজাজে অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় গল্প বলার ঢঙে তাঁর জীবনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা পরিবেশন করেছেন। তার থেকে আমরা যে শুধু তাঁর পারিবারিক পরিচয়, জীবন, সঙ্গীতশিক্ষা, গুরুদের কথা, সঙ্গীতপরিবেশন এবং সঙ্গীতের জন্য বিদেশভ্রমণ-এর তথ্যই শুধু পাই তাইই নয়, ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে, সেই সময়কার একটা সামগ্রিক চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন বাবার শিষ্য বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তাই প্রকাশকের ভাষায়, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূরক যে তথ্যগুলি সংযোজন করেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর তা বইটিকে যে সপূর্ণাঙ্গ করেছে, একথা নির্দ্বধায় বলা যায়।‘
ভূমিকার গোড়ার দিকেই রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘মানুষ এবং শিল্পী হিসেবে বাবার আলোচনা রাগ-অনুরাগ বইতে করেছি তবুও মনে হয় তাঁর সম্পর্কে কথা যেন কিছুতেই শেষ হয়না। তবে এই বইতে বাবা উত্তমপুরুষে একেবারে সাদা-মাটা ভাষায় তাঁর নিজের কথা বলে গেছেন। যা কিনা ছিল বাবার বৈশিষ্ট্য। তিনি গভীর থেকে গভীরতর জ্ঞানের কথা কী অনায়াসে বেমালুম বলতে পারতেন অবাক লাগে। … এই বইয়ের একটা বিশেষ শক্তি হল বাবার খোলাখুলি, অকপট সত্য বলার ক্ষমতা। … জীবনের সব সত্যকে মেনে নেওয়ার এক অসীম ক্ষমতা ছিল বাবার’ (পৃঃ ৮ ও ৯)। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। পৃষ্ঠা ৪৭-এ বাবা বলছেন, ‘ ভবানীপুরের এক সংগীত সম্মেলনে নিমন্ত্রণ গেলাম। আমি আছি পুটিয়ার রানির বাড়ি। ঐ তো হেদুয়ার কাছে। বীণকার লছমীপ্রসাদ, কেরামৎউল্লা, না না মিথ্যা কথা বলব না এমদাদ খাঁ ছিলেন, বিশ্বনাথ রাও ধামার গাইয়ে, দানীবাবু, রাধিকা গোঁসাই।‘ এমন স্মৃতিচারণের ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো সহশিল্পীদের প্রত্য়েকের নাম মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু বাবার কাছে ভুল হয়ে যাওয়াটাই একটা বিরাট পাপ।
আট বছর বয়সে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে কলকাতা এসে টাকাপয়সা হারিয়ে, গঙ্গার ধারে নিমতলা ঘাটে আশ্রয় নেন বাবা আলাউদ্দিন। বাবার ভাষায়, “রোজ একবেলা গঙ্গাজল খাই। সাধু বলে দিয়েছেন আরেকবেলা লঙ্গর খানায়, আর ঐ কেদার ডাক্তারের ডিস্পেনসারির বারান্দায় শুই’।
বাবা দীর্ঘদিন ধরে বহু গুণীর কাছে শিক্ষা করেছিলেন। যার ফলে তিনি ছিলেন রাগ-রাগিনীর সাগর। এইসঙ্গে তাঁর শারীরিক রাগও ছিল অপরিসীম। এই প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর লিখছেন, “এই সূত্রে এসে পড়ল ওঁর লেজেন্ডারি রাগের কথা। এই বিষয়ে আমি আমার ইংরেজি বইতে লিখেছিলাম যে উনি ছিলেন একাধারে বৈষ্ণব ও শাক্ত’। বাবা নিজেই তাঁর রাগ সম্বন্ধে বলছেন ‘একদিন জামিরুদ্দিন আর আরও কয়েকজন – ফাজিল সব। জুটেছে। আমায় নিয়ে ঠাট্টা চলছে। জামিরুদ্দিন বলছে, ‘গোস্ত খাও, বাজাও। মচ্ছিকে পানি মে কুছ্ নেহি হোগা’ শুনেই মেজাজ চড়ে গেল আমার, ‘শুয়োরের বাচ্চা – কী শুনতে চাও, বাজনা নেহি হোগা? পায়ে ধরে সরোদ বাজাব। শুনবি? মা সরস্বতীর জিনিস, তাই পায়ে ধরব না। বাঁ হাতে বাজিয়ে শোনাব’ কাঁহাতক সহ্য করা যায়। হ্যাঁ শুয়োরের বাচ্চাই বলেছিলাম। সেই থেকে বাঁ হাতে তারের যন্ত্র, ডান হাতে চামড়ার যন্ত্র বাজাই। থাপ্পড়ও বাঁ হাতে মারি। বাঙালির মেজাজ। রাজাকেও মেরেছিলাম। আঙুল মচকে গিয়েছিল রাজার থাপ্পড় খেয়ে। বাঙালিকে শান্ত দেখেন রেগে গেলে বোমা মারে”।
এই ঘটনা থেকে আমার বাবার চরিত্রের আরএকটি দিক উপলব্ধি করতে পারি, সেটা হল ধর্মনিরপেক্ষতা। মুসলমান বংশে জন্মগ্রহণ করেও হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু দেব-দেবীর ওপর ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস। কারণ বাবার পূর্বপুরুষরা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। বাবার কথায়, ‘আমার পূর্বপুরুষেও এক ভবানী পাঠক ছিলেন। দীননাথ দেবশর্মা – মুলুকগ্রামে বাড়ি। দেবশর্মা – কী? ব্রাহ্মণ ত? হ্যাঁ তাই ছিলেন। …সেই কুকীদের মধ্যে গিয়ে দীননাথ বাস করলেন, কালীমন্দিরে কালী পুজা করেন। … শিবপুরের শিব – তাঁর নামেই গ্রামের নাম – জাগ্রত দেবতা। সব মানস পূর্ণ হয়। … সেই শিবের বাড়িতে শিশুকালে খেলতুম, সবাই বলত শিবও খেলতেন আমাদের সঙ্গে। তাঁকে চিনতুম না।‘। বাবা এই আধ্যাত্মিকতা পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। ওনার বাবার নাম ছিল সদু খাঁ। তিনি সাধুপ্রকৃতির লোক ছিলেন, তাই থেকে সাধু, তার থেকে সদু খাঁ নাম। তিনি ওই শিবমন্দিরে বসে সেতার বাজাতেন। বাবা যখন রামপুরে শিক্ষা করছেন সেই সময় এই আধ্যাত্মিকতার অনেক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যেমন উনি বলছেন, “মহম্মদ হুসেন খাঁ – এই মাস্তাক হুসেন খাঁর গুরুর ভাই। আর এনায়েৎ খাঁর ভাই – তাঁর কাছে যেতাম। তা তিনি একদিন বল্লেন, ‘মন্ত্র নাও তুমি আমার গুরুর কাছে।‘ বেরিলীতে তাঁর সঙ্গে গেলাম সাধুর কাছে। গুরু হাত ধরে বল্লেন, ‘আরে মহম্মদ হুসেন, এর ত সংগীতের দিকে মন। সেদিকেই এর আধ্যাত্মিক সাধনা।”
বাবার জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছে। তার একটা উদাহরণ বাবা নিজেই দিয়েছেন – “এক মহাত্মা ছিলেন। তিন তোলার টাকা দিলাম তাঁকে। রোজ তিনি চায়ের সরঞ্জাম আনতেন। ৭দিন চা খেতেন, ৮ দিনের দিন একটা রুটি। এক মাস ছিলেন। যাবার আগে তমসা নদীর জলে, ৭ দিন গলা জলে নেমে রইলেন। তারপর একটা মাদুলী তৈরি করে দিলেন আমাকে। … বল্লেন, ‘এটা তোমরা রেখে দেবে। খুব উপকার হবে। আমি চলে গেলে শনিবার ধুনো দিয়ে হাতে বাঁধবে।‘ তাই করলাম। ঘুমের থেকে উঠে দেখ্লাম দুটা দৈত্যের মত আমার দুপাশে শুয়ে। সর্বনাশ এটা কী? স্বপ্ন দেখছি নাকি? মাদুলিটা খুলে ফেল্লাম্। দেখি আর নাই। … ২য় দিনও তাই – চক্ষু মেলে দেখি আর ভয় পাই। ৩য় দিন ফেলে দিলাম তমসার জলে। গুরুদেবকে বললাম। তিনি শুনে বল্লেন, আরে আরে করলে কী? তোমাকে দুজন জামিন দিয়ে গেছল – যা বলতে তাই করত ওরা।“।
উত্তরকালে উনি ওঁর একমাত্র ছেলে আলি আকবর খাঁ সাহেবকেও শিক্ষাকালীন বহুবার হাত-পা বেঁধে মার-ধর করেছেন। অন্যান্য শিষ্যরাও বাদ যায়নি। আবার এটার বৈপরীত্য দেখিয়েছেন পুত্রসম শিষ্য রবিশঙ্করের ক্ষেত্রে।
বাবা সঙ্গীতের টানে বাড়ি ছেড়েছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। বঞ্চিত হয়েছিলেন বাবা-মায়ের আদর, ভালোবাসা ও যত্ন থেকে। বিশেষ করে অতটুকু বয়সে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে মহিলাদের প্রতি একদিকে যেমন ছিল অনাগ্রহ আবার অন্যদিকে ছিল ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক বিশেষ অভিব্যক্তি। বারবার তাঁর কথাবার্তা-আচার-ব্যবহারে তার প্রতিফলন ঘটেছে। এই বইতে মাঝে মধ্যেই ফুটে উঠেছে তার ইঙ্গিত। পরবর্তীকালে উনি যে একটুতেই রেগে যেতেন সেটা খুব সম্ভবত পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। কারণ উনি বলছেন ‘বাবা সংসার দেখতেন না। মা দেখতেন। মা খুব রাগী লোক ছিলেন’। আবার আরএক জায়গায় বলছেন “বাবা ফিরে এসে বল্লেন, ‘শিব বাড়িতে ঠেকা দিচ্ছে, এক মহাত্মা সাধুর সঙ্গে। ওকে তুমি মেরনা’ মা-‘যেমন বাবা, তেমনি ছেলে।‘ মা ধরে এনে তিন দিন হাত পা বেঁধে রাখলেন, খেতে দিলেন না আর খুব মারলেন।“
উত্তরকালে উনি ওঁর একমাত্র ছেলে আলি আকবর খাঁ সাহেবকেও শিক্ষাকালীন বহুবার হাত-পা বেঁধে মার-ধর করেছেন। অন্যান্য শিষ্যরাও বাদ যায়নি। আবার এটার বৈপরীত্য দেখিয়েছেন পুত্রসম শিষ্য রবিশঙ্করের ক্ষেত্রে। এই প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর বইটির ভূমিকার আরএক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমার ওপর ভগবানের আশীর্বাদ ও অসীম কৃপা ছিল বাবার। ওঁর থেকে কোনদিন মারধোর খাইনি, এমনকি কোনো রকম গালিগালাজ নয়। হয়ত তার কারণ এই যে, আমার মা আমাকে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর বাবাও ওঁকে কথা দিয়েছিলেন।’
বাঙালি নারীজাতির ওপর ওনার একটা বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। যেমন উনি এক জায়গায় বলছেন, ‘একটা আমার লজ্জার কথা বলি – মা ভগ্নী নাতিরা সব আছেন, ত্যক্ত হবেন না। আমার বাড়ি গাঁয়ে। গৃহস্থলোক। বাড়িতে তিন বউ। তাঁরা যখন বাইরে যান, দুটো বদমায়েশ লোক পেছনে লাগে। বড় বৌদি খুব সাহসী। তিনি একদিন বল্লেন লোকটাকে, ‘আমরা গৃহস্থ বউ, আমাদের পেছনে লেগেছ লজ্জা করে না?’ দাদাকেও জানালেন সেকথা। পঞ্চায়েত বসল, হিন্দু-মুসলমান মিলে, লোকটাকে দণ্ড দিল। আমার স্ত্রী সেইদিনই ফাঁসি দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর মনে হল ‘আমার উপর কুদৃষ্টি দিয়েছে। কোনদিন ধরে নিয়ে যাবে আমার কলঙ্ক হলে।‘ তিনবার ফাঁসি যাবার চেষ্টা করেছিলেন। এ আমার স্ত্রীর কথা শুধু নয় – বঙ্গললনাদের কথা, সতীত্ব।” এই বাবা আলাউদ্দিন একদিন মাইহারের রাজাকে বলছেন, ‘রানি ছাড়া আর কারও দিকে কুদৃষ্টি দিতে পারবেন না।‘ আরও বলছেন, ‘রানিদেরও শেখাই – মেয়ে হলেও তাঁরা মায়ের জাত, তাই শেখাতে আপত্তি নেই’। আবার বাবাই ইংলণ্ডে এক লর্ডের বাড়িতে একটি মেয়েকে কাঁচা মাংস খেতে দেখে বলছেন, ‘কাঁচা মাংস খাচ্ছ। আমাকে ছুঁতে পারবে না।‘
‘চল রামপুর। গেলাম। খোলার বাড়ি মাটির দেওয়াল। আমাকে রাখলেন দূরে পায়খানার কাছে, এক ঘরে। গন্ধে কষ্ট পাই। তারপর ওস্তাদকে বল্লাম, ‘গুরুদেব আপনার সব পয়সা যা দিতেন, তার হিসেব নিন।‘
বিশেষ করে ধর্মের ব্যাপারে বাবার চিন্তাধারা যে অনেক আধুনিক ছিল তার প্রমাণ মেলে তাঁর এক সুচিন্তিত উক্তি থেকে। বাবা বলছেন, ‘তবে প্যালেস্তাইন, তুর্কী, মিশর অঞ্চলের মুসলমানদের দেখে বুঝেছি আমাদের দেশের মুসলমানদের থেকে তারা কত পৃথক। মোল্লাদের লম্বা দাড়ি নেই। কিন্তু কী সুন্দর তারা কোরাণ পড়ে আজান দেয়। যেমন সুন্দর উচ্চারণ, তেমনি হৃদয়ে ভক্তি। দেশের মোল্লাদের শিক্ষায় মনে হত ইস্লামে বুঝি সঙ্গীতের স্থান নেই। কিন্তু ওদেশে সংগীতের অনাদর নেই, ওদের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কি সুন্দর নাচ রয়েছে। উদয়ের সব নাচেই হিন্দু দেব-দেবীর কথা। কিন্তু তবুও সব শ্রেণীর মুসলমানরই তার নাচ দেখে আনন্দে প্রশংসায় মুখর। … সেদেশের মেয়েরাও বোরখা ফেলে দিয়ে পুরুষের সঙ্গে বাইরে কাজ করছে – আমাদের দেশের মোল্লাদের যদি একবার আরব-তুর্কী ঘুরিয়ে আনতে পারতাম, তাহলে এদেশে মুসলমানদের দুরবস্থা কমে যেত – দাঙ্গা হাঙ্গামাও হত না’।
বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়া মানে নুনের পুতুল হয়ে সমুদ্র মাপতে যাওয়া। নিমেষে তলিয়ে যেতে হয়। তাই রবিশঙ্কর বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘তবুও মনে হয় তাঁর সম্পর্কে কথা যেন কিছুতেই শেষ হয় না’। কিন্তু আমাদের তো কোথাও শেষ করতে হবে, তাই লেখাটা শেষ করব উনি সঙ্গীতশিক্ষার জন্য কী অমানুষিক সংগ্রাম ও কষ্ট করেছিলেন তার কথা বলে। যা আজকের দিনের শিক্ষার্থীদের কাছে অভাবনীয়, স্বপ্নাতীত।
আট বছর বয়সে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে কলকাতা এসে টাকাপয়সা হারিয়ে, গঙ্গার ধারে নিমতলা ঘাটে আশ্রয় নেন বাবা আলাউদ্দিন। বাবার ভাষায়, “রোজ একবেলা গঙ্গাজল খাই। সাধু বলে দিয়েছেন আরেকবেলা লঙ্গর খানায়, আর ঐ কেদার ডাক্তারের ডিস্পেনসারির বারান্দায় শুই’। এরপর শেখার সুযোগ হল যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সভাগায়ক নুলো গোপালের কাছে। গুরু বল্লেন, ’১২ বছর সুর সাধনা করতে হবে’। … সাধু বলে দিয়েছে গঙ্গাজল খেতে – তাই খাই একবেলা, আরেকবেলা লঙ্গরখানায় ভাত। সুর সাধি – একহাতে তানপুরা আরেক হাতে বাঁয়া ধরি, একপায়ে মাত্রা মাত্রা গুনি, আরেক পায়ে তাল এই হল গুরুর মূল মন্ত্র … ৩৬০ রকমের পাল্টা করালেন গুরু তার সঙ্গে তাল।” নুলো গোপালের মৃত্যুর পর হাবু দত্ত, নন্দবাবু, লোবো সাহেব, হাজারী ওস্তাদদের মতন গুণীদের কাছে বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র শিখে সরদ শিখতে গেলেন রামপুরের ওস্তাদ আহমেদ আলীর কাছে। সেখানে তিনি কী কষ্টটাই যে করেছিলেন তা শোনা যাক্ তার নিজের মুখে, “চল রামপুর। গেলাম। খোলার বাড়ি মাটির দেওয়াল। আমাকে রাখলেন দূরে পায়খানার কাছে, এক ঘরে। গন্ধে কষ্ট পাই। তারপর ওস্তাদকে বল্লাম, ‘গুরুদেব আপনার সব পয়সা যা দিতেন, তার হিসেব নিন।‘ দিলাম, বাক্স ভর্তি সব মোহর। (আমারটাও দিলাম গুরুদক্ষিণা) (গুরুর) বাবা মা দুজনেই খুব খুশি হলেন। তখন আরেকটা একটু ভালো ঘরে জায়গা পেলাম। কাপড় সেলাই করে পরি। মোটা রুটি খাই। কী কুক্ষণেই দশ হাজার টাকা ফেরৎ দিয়েছিলাম তাই দিয়েই তো নতুন বাড়ি উঠ্ছে। তারপর চুন সুরকি মিস্ত্রী এল – ‘আলাউদ্দিন, একটু হাত লাগাও।‘ ইঁট বয়ে শূল রোগ হল – এখনও আছে।“
দেশের মোল্লাদের শিক্ষায় মনে হত ইস্লামে বুঝি সঙ্গীতের স্থান নেই। কিন্তু ওদেশে সংগীতের অনাদর নেই, ওদের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কি সুন্দর নাচ রয়েছে। উদয়ের সব নাচেই হিন্দু দেব-দেবীর কথা। কিন্তু তবুও সব শ্রেণীর মুসলমানরই তার নাচ দেখে আনন্দে প্রশংসায় মুখর।
নানা ঘটনাচক্রে অবশেষে বাবা উপস্থিত হন বীণকার ও রামপুরের রাজদরবারের সভাবাদক মহম্মদ উজীর খাঁ সাহেবের কাছে। কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস ধরে শত চেষ্টা করে উনি উজীর খাঁ সাহেবের দেখা না পেয়ে প্রাণ দিতে গেলেন আফিম খেয়ে। এই সময় ভাগ্যক্রমে নবাবের সুদৃষ্টি ও কৃপাবলে উজীর খাঁ সাহেবের কাছে শেখার সুযোগ হল। কিন্তু শেখা কি হল? বাবার কথায়, “মেডেল পরিষ্কার করি। দিনের বেলা রেওয়াজ করার সুযোগ পেতাম না। রাত্রে ৮টার সময় বসতাম্ রেওয়াজ করতে। … বাসি রুটি লবণ দিয়ে খাই।‘ নবাব বলে দিয়েছেন, ‘গুরুদেবের রোজ সেবা করবে। টাকা পয়সায় এ বিদ্যা পাওয়া যায় না। জান তো?’ সকালবেলা গেলাম। ৮টার সময় গুরুদেব ওঠেন। পায়খানায় বদনায় জল দিলাম, ফিনাইল দিয়ে ধুলাম। রোজ এই কাজ করি। আর যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এইভাবে কাটল ২.৫ বৎসর। … ১২টার সময় গুরুদেবের কাছে থেকে তাঁর (মহম্মদ হুসেন) কাছে যেতুম। খাওয়ার নাই ছোলা জল খেতাম, … আর মটরবালী।
এর কিছুদিন বাদে যখন বাবা আলাউদ্দিনের স্ত্রী আত্মহত্যার প্রচেষ্টার খবরের তার পৌঁছল উজীর খাঁ সাহেবের কাছে, তখন তাঁর টনক নড়লো। বাবার কথায়, ‘আরে আরে বাবু আছে–কোথায়–গুরুর ছেলেরা বলে ‘হুজুর, সে তো রোজই ১২টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে।‘ তোমরা তাকে শিখালে না কেন?” আপনার অনুমতি নেই, কেমন করে শেখাই।‘ … একথার পর ডাকলেন তাঁর ছেলেদের, তাঁদের বল্লেন, ‘পিয়ারা মিঞা, মজলা সাহাব, ছোটা সাহাব থেকে আলাউদ্দিন তোমাদের ভাই হল। তোমাদের যা তালিম দিয়েছি সব তোমরা একে দাও। আমিও শিখাব।‘ এই গুরু হল আমার শিক্ষার, আমার স্ত্রীর ফাঁসির খবর পেয়ে।“
এই রকম অসাধারণ সব ঘটনার সমাবেশে অতুলনীয় একটি বই হল আলাউদ্দিন খাঁ-র ‘আমার কথা।‘ যিনি পড়বেন তিনিই ধন্য হবেন।
সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চলে পড়াশোনা ও লেখালেখি। 'আপনাদের সেবায়', 'প্রসঙ্গ ঠুমরি', 'সুরের গুরু' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। সরোদচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় করেন বাংলা ছবিতে।
2 Responses
বাংলার ও ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান বাবা আলাউদ্দিন খাঁর চরণে শত কোটি প্রণাম।
দারুণ লেখা।